সীমাসঞ্চালি
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
সীমা দ্রুত পা চালিয়ে চলছে। আজ বাড়ি ফিরতে দেরী হয়ে গেছে তার। পৌরসভার স্থাপিত স্ট্রিটল্যাম্পগুলো সব বিকল হয়ে বসে আছে যেন ভয়ার্ত পরিস্থিতির সাথে আঁতাত করবে বলে। নির্জন, অন্ধকার রাস্তায় জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই। কোত্থেকে এক মাতাল হেঁড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে তার পিছু নিয়েছে। লক্ষণ মোটেই সুবিধের মনে হচ্ছেনা। কেন যে শর্টকাটে পথ পেরুতে গিয়ে এ রাস্তাটা বেছে নিয়েছিলো! তবে ভয় নেই, নিজেকে আশ্বাস দেয় সীমা। আর কিছুদূর, দ্রুত পায়ে হেঁটে চললে বিশ কদম লাগবে হয়তো, তারপরেই এই ভীতি জাগানিয়া অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে সে। বাঁক পেরুলেই সামনে যে রাস্তাটা পড়বে, তা এত নির্জন না। দোকানপাটও আছে বেশ কিছু সেখানে, আলো আছে, মানুষজন আছে। সীমা তার চলার গতি বাড়িয়ে দেয় আরো। এত দ্রুত হেঁটে তার অভ্যেস নেই, ব্যথায় পা টনটন করছে। মাতালটা আরো এগিয়ে আসছে নাকি! সীমা সভয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই প্রচন্ড একটা চড়ের ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল একটা ম্যানহোলের ঢাকনার ওপর।
"বেসামাল মাল তুমি ডার্লিং! তোমাকে আজকে আরো বেসামাল করব"
বলে লোকটা তার মুখ চেপে ধরে আর অদ্ভুত একরকম শব্দ করে হাসতে থাকে। এমন হাসতে কাউকে কখনও শোনেনি সীমা। চিৎকার করে সাহায্য চাওয়ারও আর কোন উপায় থাকেনা তার। এই অসহায়ত্বের পূর্ণ সুযোগ নিতে তৎপর হয়ে হামলে পড়ে লোকটা তার ওপর। ক্ষীণ শরীরের একজন অষ্টাদশী তরুণী যৌন জিঘাংসায় উন্মুখ মাতাল দশাসই পুরুষের সাথে পারবে কী করে? তারপরেও সীমা চেষ্টা করে নিজেকে চরম অপমান আর লাঞ্চনা থেকে রক্ষা করতে। পাষন্ড লোকটার অন্ডকোষে কষে একটা লাথি লাগাতে চায় সে, কিন্তু তা যথাস্থানে না লেগে উরুর মাংসল পেশীতে আদরের পরশ বুলিয়ে যায় যেন! ফলে ব্যথায় কাতর হবার বদলে লোকটা আরো উন্মত্ত এবং উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তার পাশবিকতা নতুন মাত্রা পায়।
"বেসামাল আচরণ কইরনা আমার লগে সোনা! আমি তোমার চেয়ে অনেক বেশি বেসামাল!"
মদের বোতলে শেষ চুমুকটি দিয়ে ছুড়ে ফেলে লোকটা তার কথার যথার্থতা প্রমাণে ব্যতিব্যস্ত হয়। সজোরে সীমার মাথা ঠুকে দেয় ধান্দাবাজ প্রকৌশলীর কর্মসাক্ষী হয়ে থাকা এবড়ো থেবড়ো ভাঙাচুরা রাস্তায়। প্রচন্ড আঘাতে ককিয়ে ওঠে সীমা। কিন্তু মুখ চেপে রাখার ফলে চিৎকার করতে পারে না। আরো একটা অনুরূপ আঘাতের পর সে নিস্তেজ হয়ে যায়। জ্ঞান হারানোর আগে প্রচন্ড অপমান আর ব্যথাকে সাক্ষী করে সে প্রতিজ্ঞা করে "প্রতিশোধ নেব আমি, যদি বেঁচে থাকি।"
অবশ্য সেই প্রবল যন্ত্রণাময় মুহূর্তে তালগোল পাকিয়ে আসা চিন্তা এবং দৃষ্টিশক্তি নিভে থাকা স্ট্রিটল্যাম্পগুলোর মতই অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল বলে সে তার প্রতিজ্ঞার খামতির দিকটা ঠাহর করতে পারে নি। এই অন্ধকার, এই গহীন অন্ধকারে আক্রমণকারী এবং ধর্ষকের চেহারা বা আকৃতি কোনটাই সে আঁচ করতে পারেনি। পরেরদিন খবরের কাগজে হয়তোবা তার ধর্ষিত হবার খবর বেশ বিতং করে ছাপা হবে, ধর্ষকের নাম এবং ছবি যথারীতি উহ্য থাকবে। সীমার পরিবারও আর দশটা বাঙালি পরিবারের থেকে আলাদা না যে, অপরাধীর তত্ত্বতালাশ করে তাকে বিচারের সম্মুখীন করতে ব্যবস্থা নেবে। উল্টো তারা বরং রাত করে বাড়ি ফেরার কারণে প্রতিবেশী এবং স্বজনদের টিটকিরি ও ভর্ৎসনায় জেরবার হয়ে সীমাকেই দোষারোপ করবে। এতে অবশ্য একদিক দিয়ে ভালোই হবে তার। সুরতহাল প্রতিবেদনে সরস বর্ণনার ফাঁদে তাকে পড়তে হবেনা, ধর্ষণের সময় তার পরনে কী ছিলো, ধর্ষক তার স্পর্শকাতর কোন কোন অঙ্গে কীভাবে অঙ্গচালনা করেছিলো, এসব প্রশ্ন থেকে নিস্কৃতি পাওয়া যাবে। তারপরেও, উপর্যুপরি আঘাতে পর্যুদস্ত এবং কামনার অগ্নিতে ভস্মীভূত হবার আগে সীমা শুধুমাত্র একটা কথাই ভেবেছিলো "যদি বেঁচে থাকি, প্রতিশোধ আমি নিয়েই ছাড়বো!"।
*
সীমা বেঁচে আছে। তার ক্ষীন শরীর অতগুলো আঘাত সয়ে নিয়ে, মুখে কপালে কিছু দাগস্মৃতি বহন করে দিব্যি বেঁচে আছে অপরিসীম প্রানশক্তিকে সম্বল করে। ভাগ্যক্রমে তার ধর্ষিত হবার খবর সংবাদপত্র বা কোটকাচাড়িতক যায়নি। প্রায় দুপক্ষকাল হাসপাতালে আঘাতগুলো পরিচর্যার জন্যে থাকতে হয়েছিলো তাকে। চিকিৎসকদের চোখে সীমার ধর্ষিত হবার আলামতগুলো ধরা পড়লেও তার পরিবারের অনুরোধে সে খবর বাইরে প্রকাশিত হয়নি। অবশেষে যথাযথ চিকিৎসাপর্ব এবং গোপনীয়তার সুচারূ সমণ্বয়ে সীমার ঘটনাটিকে বেখেয়ালে ঘটে যাওয়া একটি সড়ক দূর্ঘটনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়, এবং তার গৃহাগমননের সময় পাড়াপ্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজনদের ডেকে একটি উৎসব এবং প্রার্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজনের মাধ্যমে ব্যাপারটিকে পুরোপুরি ধামাচাপা দিতে পেরে তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। কে জানে তৃপ্তির হাসিও হাসেন কী না!
এসব হাসির হিমছুরি, গোপনীয়তার সদম্ভ চাবুক, নির্লজ্জ স্বস্তির বিকৃত ফ্ল্যাশিং সীমাকে অনেকটাই নীরব এবং সংকুচিত করে ফেলে। মাঝেমধ্যে গুমড়ে থাকা ক্রোধ প্রতিশোধের স্ফুলিঙ্গ হয়ে ফুঁসে উঠতে চাইলেও পরিস্থিতি বিবেচনা করে সে বুঝতে পারে তার এই স্পৃহা কতখানি প্রতিবন্ধকতা দিয়ে আবৃত। সে লোকটির চেহারা মনে করতে পারে না, শারীরিক অবয়বও খেয়াল করে উঠতে পারেনি ভালোমত সেই অন্ধকারে। শুধু মনে আছে বিক্ষিপ্ত কয়েকটি শব্দ। মদ্যজড়িত কামুক গলায় উচ্চারিত কয়েকটি শব্দ "বেসামাল মাল, ডার্লিং"। কন্ঠস্বরটা সেই মুহূর্তে তার মনে ছিল, কিন্তু কালিক বিবর্তনে এখন তা গতানুগতিক বাংলা সিনেমার ধর্ষণোদ্যত খলনায়কের সংলাপের মতই কানে বাজে। আলাদা করে ভাবার উপায় নেই। কোথাও থেকে কোন সহায়তা না পেয়ে সীমার প্রতিশোধের ইচ্ছেটা ক্রমশ সীমাবন্দী হতে থাকে। দিনদিন কমতে থাকে সেই সীমার পরিধি।
*
বছর পাঁচেক পরে, যখন সেই ভয়াবহ স্মৃতিটি অন্যান্য স্বাভাবিক রুটিন দুঃস্বপ্নের মত একটি প্রাকৃতিক নিয়মে পরিণত হয়েছে, এবং সীমাও এতে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে , তখন প্রতিশোধের চিন্তা প্রতিস্থাপিত হতে থাকে মুখমন্ডলে আঘাতজনিত দাগগুলো কীভাবে নির্মূল করা যায় তা দিয়ে। তার ঘনিষ্ট কিছু বন্ধু অবশ্য জানে দাগগুলোর উৎসকথা। সময়ের সাথে সাথে তীব্র প্রতিশোধস্পৃহা রূপান্তরিত হয় গ্রহণযোগ্য মাত্রার মর্মবেদনায়। নিঃসঙ্গ এবং অবান্ধব সেই প্রতিকূল কাল ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে বন্ধুদের সংস্পর্শে। এমন ঘটনার সম্মুখীন অনেক মেয়েকেই চিরজীবনের জন্যে পুরুষবিদ্বেষী এবং প্রেমপরিপন্থী আচরণ করতে দেখা যায়। সীমার ক্ষেত্রে তা হতে গিয়েও হয়নি। এজন্যে সে ধন্যবাদ জানায় ভাগ্য এবং বিশেষ করে ঘনিষ্ট বন্ধুদের। যাদের কারনে সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব হয়েছে। আজ সে চিবুক এবং ললাটে লেগে থাকা দাগ মুছে ফেলতে কোন ডাক্তারের কাছে যাওয়া ভালো, এ আলোচনা করতে করতে অতীতের দুঃস্মৃতিকাল স্মরণ করে প্রিয় বন্ধুর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে পারে। কাঁদতে কাঁদতে অনেকসময় চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা ফিরে আসে আবার, চোখমুখ শক্ত করে ফিসফিসিয়ে, হিসহিসিয়ে নিজেকে মনে করিয়ে দেয়, "যদি বেঁচে থাকো, প্রতিশোধ তুমি নেবেই"। তার প্রিয় বন্ধু শম্পা এসব দেখেশুনে নিজেকে প্রবোধ দেয়, ভাগ্যিস এমন কিছু তার জীবনে ঘটেনি। ভীত হয়, ঘটতেও পারে ভেবে, সেইসাথে সীমার জন্যে তার ভেতরে গভীর সমবেদনা এবং মমত্ববোধ সৃষ্টি হয়। এসমস্ত সময়ে পরিস্থিতি হালকা করার জন্যে সে লঘু কোন আশাপ্রদ বিষয়ের অবতারণা করে। যেমন, কীভাবে একজন সুপুরুষ, হৃদয়বান প্রেমিকের আগমন সবকিছু বদলে দেবে, কীভাবে তাদের প্রেমগুঞ্জনে সবাই অতিষ্ট হয়ে উঠবে ইত্যাদি! সীমাও বেশ আগ্রহ ভরে শুনতে থাকে। কল্পনার অশ্বগতি অতিক্রম করে ফেলে অতীতের দুঃস্মৃতিদলকে। ভয়ও হয়, কল্পনার উড়ালপথ বাস্তবে এসে মিললে সে যদি লাগাম ছিড়ে পড়ে যায়? সেইজন তাকে ওঠাবেতো? নাকি সেই কালোরাতের পাশবিকতা স্টিমরোলারের মত তাকে পিষেই যাবে? নেতিবাচক চিন্তাটা মাথায় আসতেই উবে যায় সব সুখকল্পনা। শম্পাকে বলা বৃথা। সে মনে মনে আবারও উচ্চারণ করে দৃপ্তস্বরে,
"প্রতিশোধ! প্রতিশোধ নিতেই হবে তোমাকে!"।
*
-সীমা, প্রতিশোধ নেবার সুযোগ কখনও আসবে কী না জানি না, কিন্তু যদি কখনও আসে, আমাকে পাশে পাবে তুমি। তোমার কাছে আমার অনুরোধ, একা একা প্রতিশোধ নিওনা। ওই পশুটাকে একবার যদি পাই...মাদারচোৎ!
বেশি রেগে গেলে মুখ খারাপ করে বসা শাহেদের স্বভাব। এতে সীমা প্রথমদিকে আপত্তি করলেও এখন সে জানে গনগনে রাগের চুল্লিটাকে হাওয়া দেবার জন্যে মাঝেমধ্যে খিস্তি করাটা বেশ ভালো কাজে দেয়। তাই এখন আর সে শাহেদকে বাধা দেয়না এ ব্যাপারে। তবে নিজ থেকে কখনও সে অমন কথা বলতে পারে না। যদিও এই মুহূর্তে শাহেদের সাথে তারও খিস্তি করতে ইচ্ছে করছে, তবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সে।
আজ তার মনটা বড্ড খারাপ ছিলো সারাদিন।
শাহেদ তার জীবনে আসার পর ভালোবাসার কোমল কঠিনে মেশা উন্মাদ গতি আর প্রবাহে উড়েই গিয়েছিলো পুরোনো কষ্ট, যন্ত্রণা, বিষণ্ণতা। শাহেদ তাকে ভুলিয়ে দিতে পেরেছিলো অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই অপমান আর লাঞ্চনার স্মৃতি। সীমার মধ্যে একটা নতুন বোধের উন্মোচন হয়েছিলো। ঘৃণা আর প্রতিশোধের বলয়ে ঘুরপাক খেয়ে জীবনকে বৃত্তাবদ্ধ না করে ভালোবাসার সপ্তাকাশ পাড়ি দেবার আনন্দময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সে। প্রথমদিকে স্থিত হবার আগে সে অনেক ভেবেছিলো, তার অতীতের কথা যদি শাহেদ কোনভাবে জানে সে কী মেনে নিতে পারবে? ধর্ষিতা তকমা গায়ে লাগলে সহানুভূতিশীল এবং সুযোগসন্ধানী বন্ধুর অভাব হয়না বটে, কিন্তু সারাজীবন হাত ধরে থাকা যায় এমন আকাঙ্খা পোষণ করলে তাদের সেই হাত দ্বিধার তেল সংকোচের জল মিলে বড় বিচ্ছিরিরকম পিচ্ছিল হয়ে যায়। শাহেদের ক্ষেত্রেও সীমার প্রথমদিকে এমন মনোভাব ছিলো, কিন্তু কিছুদিন পরে তার মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মায়, শাহেদ অমন সংকীর্ণ মানসিকতার কেউ না। কিন্তু তাই বলে সীমা তাকে সবকিছু খুলেও বলেনি। এসব শুনলে শাহেদ কষ্ট পাবেনা মনে? প্রতিশোধের অঙ্গারে জ্বলে খাক হওয়াটা কত কষ্টকর সীমা তো জানে! শাহেদকে তাই এর ভাগীদার করতে চায়নি। কিন্তু আজ পরিস্থিতিটা এমন হয়ে গেলো, এমন কিছু ঘটনা ঘটল, এবং এর ফলে সীমার মনের ভেতর বিষণ্ণতার ঝড়োহাওয়া এমনভাবে ধেয়ে এলো, খড়কূটো হয়ে উড়ে যাবার ভয়ে শাহেদের কাছে আশ্রয় নিতেই হল তাকে। সীমা যেন এক ছোট্ট চড়ুই পাখি, আর শাহেদ বিশাল বটবৃক্ষ। আশ্রয়ের নিশ্চয়তা জেনে পরম নির্ভরতায় ক্লান্ত ডানাদুটো বিষণ্ণতার জল ঝাপটে গুটিসুটি বসে পড়ল সেই বৃক্ষের এক শাখায়। সবুজ পাতার নিবিড় মমতায়।
সীমার মুখ দেখেই শাহেদ বুঝতে পেরেছিলো তার ভেতর খুব বড় একটা ঝড় গেছে, বড়রকম গড়বড় হয়ে গেছে।
-কী হয়েছে সীমা?
এই জিজ্ঞাসার অপেক্ষাতেই যেন ছিল সে। শান্ত এবং ক্লান্ত কন্ঠে বিবৃত করল গতকাল রাতের অসহনীয় অভিজ্ঞতা। যে অভিজ্ঞতার সাথে জড়িত ছিলো তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিনটি। সীমা বলে গেল সাতাশ বছর বয়সী আইবুড়ো মেয়ের বিয়ে নিয়ে রোগাক্রান্ত মায়ের একঘেয়ে দুশ্চিন্তার জবাবে কিছু কাটখোট্টা কথা বলে ফেলায় কীভাবে তাকে টেনেহিঁচড়ে অতীতের বিভীষিকাময় বদ্ধ কূপে নামিয়ে দেয়া হল।
-তোর বিয়ে হবে কীভাবে? কলঙ্কের কথা কি আর চাপা থাকে? আর তোর যা চালচলন, আর কথাবার্তা, এতদিনে নিশ্চয়ই কারো জানতে বাকি নেই ধিঙ্গি মেয়ে রাতের বেলা ধেই ধেই করে ঘরে ফেরার সময় ডাকাতের কবলে পড়ে কীভাবে ইজ্জত হারিয়েছিলো। ধামাচাপা দেবার চেষ্টা কম করিনি। কিন্তু যা ঘটে তার কিছু তো রটেই! এখন এই কলঙ্কিনী মেয়েকে নিয়ে আমি কোথায় যাই? বিয়ে করার কথা বললে মুখ ঝামটা দিস কেন হারামজাদী? বদনামটা ভালো করে ছড়াক, সবাই জেনে ফেলুক, তারপর আবার রাতেরবেলা একা বাড়ি ফেরার সময় রেপড হ। অবশ্য হলেই বা তোর কী, তোর তো কিছু যায় আসেনা তাতে। সব দোষ পড়বে আমাদের ঘাড়ে। ইয়া মাবুদ...
সীমার বাবা অন্যত্র বিয়ে করে পাকাপাকিভাবে এখানকার পাট চুকিয়ে দেবার পর থেকে তার মা ধীরেধীরে অসুস্থ এবং অসংলগ্ন আচরণ করতে থাকেন। শারীরিক অসুস্থতাটা দিনেদিনে প্রকটভাবে দৃশ্যমান হতে থাকলেও মানসিক পীড়ন এবং অবনমনটা বোঝা গেছে খুব শম্বুক গতিতে। সে রাতেই যেন পীড়িত মানসিকতার অসুস্থ মহিলাটি তার সমস্ত ক্ষোভজনিত অসংলগ্নতা সীমার ওপরে ঢালবেন বলে ঠিক করলেন। তা তিনি ঢাললেন বটে। বেশ ভালোই ঢাললেন। ক্লান্ত হয়ে ঘুমোনোর আগে টানা দুটো ঘন্টা সীমাকে বুঝিয়ে ছাড়লেন নয় বছর আগের সেই ঘটনার কালো ছোপ কীভাবে তার সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে, কলঙ্ক কীভাবে বিস্তৃত হয়েছে, এবং এর থেকে কোন নিস্কৃতি নেই। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন সীমার ঘুম কেড়ে নিয়ে, তন্দ্রার আগমনকে দুঃস্বপ্নমন্ডিত করে। সেই রাত, সেই ভয়ংকর রাত অনেকদিন পর ফিরে ফিরে এল বারেবারে তার কাছে। দমবন্ধ লাগলে একটু বাতাসের জন্যে জানালা খুলে দিলে সীমা দেখতে পেল অন্ধকারে টলতে টলতে হেঁটে আসছে একটা কামুক পিশাচ। বালিসে মুখ গুঁজে কাঁদতে গেলে সেই পিশাচটা তাকে ঠেসে ধরে বলে,
"বেসামাল মাল তুমি বেইবি, বেসামাল!"।
শাহেদের কাছে সবকিছু খুলে বলার পরে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে অনেকটা অনুমেয়ই ছিলো সীমার। তার কাছ থেকে প্রতিশোধবাণীর প্রতিধ্বণি শুনে সীমার মন খারাপ ভাব কেটে যায়। সে তাকে সিনেপ্লেক্সে নতুন আসা থ্রিডি মুভিটা দেখানর জন্যে বায়না ধরে। শেষ পর্যন্ত দিনটা তাদের ভালোই কাটে!
*
বিয়ের আগ পর্যন্ত একটা সময়ে মাঝেমধ্যেই শাহেদ খুব মনমরা হয়ে থাকতো। হঠাৎ করে মেজাজ খারাপ করত। খিস্তিখেউরের তুবড়ি ছোটাতো। তখন তাকে কিছুতেই নিবৃত্ত করা যেতনা। সীমার আফসোস হত তখন, কেন যে সেসব শাহেদকে বলতে গিয়েছিলো!
-বাইনচোতটারে আমি খুন করমু! এই, ও দেখতে কিরকম ছিলো কউতো?
সীমা সেদিনের ঘটনার ডিটেইলস কিছুই বলেনি শাহেদকে। বলেনি তাকে পেছন থেকে আঘাত করে রাস্তায় ফেলে দেয়া হয়েছিলো। বলেনি তার মাথাটা দুবার সজোরে ঠুকে দেয়া হয়েছিলো। বলেনি তাকে কোন সম্বোধনে ডেকেছিলো ধর্ষক পিশাচটা। বলেনি তাকে দুপক্ষকাল হাসপাতালে থাকতে হয়েছিলো। বলেনি, কারণ সীমা জানে, এসব ব্যাপার জিইয়ে রাখলে তারা প্রাণ পায়। বিস্মৃত স্মৃতির শরীরে নখ, দাঁত গজায়। তারা আঘাত করতে থাকে বারবার। সীমা এইসব আঘাতে জর্জরিত হয়ে ভালোবাসাকে ঢাল হিসেবে অবলম্বন করে অবশেষে মুক্তি পেয়েছে। তাহলে শাহেদ কেন বন্দী হতে যাবে আবার সেই কদর্য অন্ধকারে?
-বল, বল আমারে কুত্তার বাচ্চাটা কি পইরা ছিল, সে দেখতে কেমন ছিল!
-এ্যাই, একদম মুখ খারাপ করবা না। আমার ভালো লাগেনা এসব। একদম না।
-সীমা, তুমি বুঝতে পারছো না! আমার মাথার ভেতর প্রলয় ঘটে যায় যখন ঐ কথাটা মনে আসে। খানকির পোলাকে আমি খুন করব!
শাহেদের মাথার প্রলয়নাচন থামানোর জন্যে সীমা সময় নেয়। অনেকখানি সময় নেয়। প্রাজ্ঞ মনোস্তত্ত্ববিদের মত শাহেদের মাথা থেকে ওই বিষয়টা ঝেটিয়ে বিদেয় করে, যতটুকু করা সম্ভব।
তারপরে,
ক্ষোভ, অক্ষমতা, প্রতিশোধস্পৃহার আগুনঝড় ভালোবাসার জলের কবলে পড়ে মিইয়ে গেছে নিশ্চিত হলে সীমা শাহেদকে হ্যাঁ বলে। নতুন জীবনের স্বপ্নে বিভোর দুজনের চোখ থেকে রাতের পর্দা সরে গিয়ে ভোর আসে। স্নিগ্ধ কোমল ভোর। জীবনভর ভোরজীবনের প্রত্যাশায় তারা বিয়ে করে পবিত্র গ্রন্থ আর বন্ধুবান্ধবকে সাক্ষী রেখে। অবশ্য তাদের জীবনে তারা দুজনা ছাড়া আর সবাই, সবকিছুই বাহুল্য। অপ্রয়োজনীয়।
*
-জানোয়ার একটা!
সীমার প্রলুদ্ধকর কামনামদির জড়ানো কন্ঠের আসকারামিশ্রিত আহবানে উত্তেজিত হয়ে শাহেদ প্রবলতর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। ফুলশয্যার রাতে ফুল নিয়ে রোমান্টিকতা করা অথবা শয্যায় শরীর এলিয়ে দিয়ে নাক ডেকে ঘুমোনো অর্থহীন। তারা একে অপরের শরীরের সাথে শরীর মেশাতে থাকে। যতই মেশায়, ঠিকমত যেন তৈরি হয় না দেহব্যঞ্জন! তারা বারবার মিলিত হয়। সারারাত। বারবার। পরস্পরকে এত কাছে করে পাওয়ার এ অভাবনীয় অভিজ্ঞতা তাদের কাছে নতুন এবং বিস্ময়কর। কী আছে তোমার কাছে, কী দেবে আমায় তুমি! দেয়া নেয়ার পালা চলতেই থাকে। ভোরের দিকে চুড়ান্ত রকম ক্লান্ত হয়ে পড়লে সীমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবার সময় শাহেদ বলে,
-আহা সীমা! বেসামাল একটা রাত, পুরাই বেসামাল!
সীমার অবচেতন মনের অতল থেকে ঘাঁই মেরে স্মৃতির হাঙ্গরেরা ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে এসে চেতন মনের সরোবরে মহানন্দে সাঁতরাতে থাকে। শিকার খুঁজতে থাকে। দলবেঁধে। এবং পেয়েও যায়!
সীমার মনে পড়ে সে রাতের কথা। মাতাল দৈত্যটা তাকে আঘাত করে হামলে পড়ার আগে বলেছিলো, "বেসামাল মাল তুমি ডার্লিং, বেসামাল!"। আর বিচ্ছিরিরকম হেসেছিলো। সীমার মনে পড়ে কী পড়ে না কেমন। হঠাৎ তার খতিয়ে দেখতে ইচ্ছে হয় শাহেদ এভাবে হাসতে পারে কী না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, 'এভাবে'টা আসলে কীভাবে, তাও তার মনে নেই ঠিকমত। তবে মেলানোর জন্যে বেশ কিছু নমুনা পেলে সে ঠিকই মিলিয়ে নিতে পারবে। "আশ্চর্য! আমি এসব ভাবছি কেন! একটা শব্দ মিলে গেছে বলেই শাহেদকে সন্দেহ করা শুরু করেছি! ছি! ও যদি জানে তো কী হবে। কতটা মন খারাপ করবে! সামান্য একটা কাকতালীয় ব্যাপারের জন্যে খাল খুঁড়তে গিয়ে হাঙ্গর টেনে আনা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না"। নিজের সাথে এভাবে মীমাংসা করে সীমাও ঘুমিয়ে পড়ে। তবে ঘুম ভালো হয়না তার। অদ্ভুত সব বাজে স্বপ্ন দেখে। কখনও সেই রাতের অন্ধকার পথ আলোকিত হয়ে যায়, টলতে থাকা মাতালটাকে মনে হয় শাহেদ। কখনও গতরাতের উন্মত্ত সময়টায় শাহেদের পরিবর্তে একটা অন্ধকার ছায়াশরীর বিচ্ছিরি হেসে ভীষণ মারতে থাকে তাকে। আর বলে "বেসামাল মাল তুমি ডার্লিং!"
বিবাহপরবর্তী ছুটির সময়টায় মধুচন্দ্রিমা করতে তারা সাগরে এবং পাহাড়ে যায়। শরীরসর্বস্ব ভালোবাসায় নিজেদের উজার করে দেয়। সীমা প্রাণভরে উপভোগ করে এসময়টা। এই সময় আর কখনও ফিরে আসবে না সে জানে। কিন্তু তারপরেও সঙ্গমকালীন সময়ে মাঝেমধ্যেই সে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে, কখন শাহেদ সেই শব্দটা উচ্চারণ করে ভেবে এবং তার ভয়কে, যেটা সে অমূলক এবং বোকামিতে ভরা ভেবে দূরে সরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো সেটা সত্যি হয়। শাহেদ আবারও সঙ্গমের চরম মুহূর্তে বলে সেই বাক্যটা, এবার তা আরো কাছাকাছি গঠনের।
*
"কেন এসব ভেবে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছি! শাহেদ শব্দটা একাধিকবার বলেছে, সেই মাতালটার মত করেই অনেকটা। তাতে কী প্রমাণিত হয়! কিছুই না। শাহেদের মত একটা ছেলে রেপ করতেই পারে না। কোনভাবেই না। আমার ধর্ষিত হবার কথা শুনে ওর চোখে আমি আগুন জ্বলতে দেখেছি। সর্বগ্রাসী ভয়ানক প্রতিশোধের আগুন। সে কেন ঐ লোকটা হতে যাবে! হাস্যকর চিন্তাভাবনা।"
নিজেকে প্রবোধ দেয়ার পর একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে সীমা। কিন্তু শ্বাসের সাথে ঢুকে যায় সোঁদাজল। আর বাড়তে থাকে হাঙ্গরের বিস্তার। তার মনে পড়ে, শাহেদ মাঝখানে কিছুসময় এ্যালকোহলে আসক্ত ছিল। অল্প কিছুদিনের জন্যে অবশ্য। শাহেদের এই স্বীকারোক্তির পরে সে আর বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করেনি।
-আর করো না তো? আর কখনও করবা না তো?
এমন হালকা তিরস্কারেই ছেড়ে দিয়েছিলো তাকে। এখন তার মনে হয় ব্যাপারটা সম্পর্কে আরো কিছু জানা দরকার। শাহেদ কোন সময়টায় ড্রিঙ্ক করত? কত বছর আগে? ওর কি কখনও বিশাল কোন ব্ল্যাকআউট হয়েছিলো? কবে সেটা? শাহেদ কি খুব বিচ্ছিরিভাবে হাসতে পারে?
নিজের মনের সাথে যুঝে পরাজিত হয়ে অগত্যা এক ছুটির বিকেলে সীমা সিদ্ধান্ত নেয় শাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করবার। বারান্দায় বসে পাতাবাহারের শরীর ভেদ করে আসা কৌতুহলী রোদে নিজের ভয়ার্দ্র হৃদয় গচ্ছিত রেখে তাকে জিজ্ঞাসা করে,
-শাহেদ!
-হু, বল।
-তুমি ড্রিঙ্ক করতে একসময় খুব, তাই না?
-খুব অল্পসময়ের জন্যে করেছি কিছুদিন। তবে এটা ঠিক, খুব করেছি। খুব বেশি পরিমাণেই করছি। ঠিকঠাক মনেও নেই সেসব কথা।
-ব্ল্যাকআউট হত তোমার? কতবার হয়েছে?
-বললাম না মনে নাই আমার ওসব কিছু! তুমি কেন এসব জিজ্ঞাসা করছ এতদিন পর?
-আরেহ এমনি! সেদিন একটা আর্টিকেল পড়লাম এ্যালকোহল নিয়ে তাই কৌতুহলবশে।
শুনে বেশ তৃপ্তির একটা হাসি হাসলো শাহেদ। তাকে নিয়ে সীমার এমন যত্নশীল চিন্তাভাবনায় খুশি হয়ে ওঠে সে। কতদিন আগে ড্রিংক করত, তার ফলে কোন ক্ষতি হতে পারে কী না ভবিষ্যতে, নিশ্চয়ই এসব ভেবেই জিজ্ঞাসা করছে!
শাহেদের হাসি সীমার কর্দমাক্ত হয়ে ওঠা মনসরোবরে সাঁতার কাটা হাঙ্গর আর তাদের সাথে সদ্য যোগ দেয়া পিরানহার দলকে উন্মত্ত করে তোলে।
-শাহেদ তুমি কতভাবে হাসতে পারো? খুব বিচ্ছিরিভাবে একটু হেসে দেখাওনা আমাকে! তুমি না অভিনয় করে পুরস্কার পেয়েছিলে ভার্সিটিতে! দেখাও না একটু প্রতিভা!
-হাহাহা! এটা আবার কেমন অনুরোধ! অবশ্য মাঝেমধ্যে তোমার এসব উদ্ভট অনুরোধ রক্ষা করতে আমার বেশ ভালোই লাগে।
শাহেদ নানারকম বিচ্ছিরি হাসি হাসতে থাকে সীমার মনোরঞ্জনের জন্যে। সীমাও খুব মজা পেয়েছে এমন ভাব করে হাসতে থাকে। আর তার মাথার মধ্যে গোত্তা মারতে থাকে হাঙ্গর এবং পিরানহার দল। সেদিনের সেই বিদঘুটে ভয়াল রাতের খলনায়কের সাথে আজকের এই সুন্দর সন্ধ্যার নায়কের মিল পাওয়া যায়?
যায়?
যায়?
কিন্তু সীমার তো মনে নেই ঠিকমত। একদম নিশ্চিত না হয়ে সে দোষারোপ করবেই বা কীভাবে? শাহেদের ভালোবাসার কাছে নিজের জীবন সমর্পণ করে সে ছিটকে বেরুতে পেরেছে কুন্ঠা, শঙ্কা, বিবমিষা আর প্রতিশোধস্পৃহায় ভরা ভয়াল গোলকধাঁধা থেকে। গোলকধাঁধা থেকে কি আসলেই মুক্তি পাওয়া যায়? ফিরে ফিরে আসে। ফিরে ফিরে আসছে সেই হাসি, আবার মিলিয়েও যাচ্ছে। সেই শব্দটা, ফিরে এসেছিলো দুবার, মিলিয়ে যায়নি। এ্যালকোহল। ব্ল্যাকআউট। সেই সময় দুজনের একই শহরে থাকা, অবশ্য ঢাকা একটা বিশাল শহর। কিন্তু শাহেদ কেন কুমিল্লা, সৈয়দপুর বা বরিশালে থাকতে পারলো না সেসময়? সেই সময়। সীমার ধর্ষিতা হবার সময়। শাহেদের এ্যালকোহল নেবার সময়। একই? সীমা জানে এই প্রশ্নটা তাকে জিজ্ঞসে করতেই হবে একদিন না একদিন। তাহলে আজই নয় কেন?
-শাহেদ!
-বল।
প্রশ্নের উত্তরটা শোনার পর সীমা খুব শান্ত থাকে। সে প্রস্তুত ছিলো এমন কিছু শোনার জন্যে। তারপরেও নিশ্চিত হওয়া যায়না। এতকিছু মিলে যাবার পরেও সীমা নিশ্চিত হতে পারে না। কারণ সে লোকটিকে দেখেনি। তার চেহারা বা আকার আকৃতি কোনকিছু সম্বন্ধেই তার ধারণা নেই। শাহেদকে সে বেনিফিট অব ডাউট দিয়ে দেয়। কিন্তু সে জানে, নিজের মধ্যে এত কনফিউশন পুষে রাখার ফলে একদিন ঠিকঠিক তার নার্ভাস ব্রেকডাউন ঘটবে। এবং একদিন তাই হয়। অনবরত একই প্রশ্নোত্তরের মুখোমুখি হবার ফলে শাহেদ নিজেও হয়তোবা কিছু একটা আঁচ করতে পেরে মনমরা হয়ে যায়। সে বুদ্ধিমান ছেলে।
-তুমি বলতে পারছো না তোমার কতবার এবং কত সময়ের জন্যে ব্ল্যাকআউট হয়েছে তাইনা?
-সীমা...বারবার...
-একই প্রশ্ন কেন করি তাইনা? কেন করি তুই জানিসনা? জানিসনা শুয়োরের বাচ্চা? আমি বেসামাল মাল তাইনা চুতমারানি?
শাহেদের নির্বাক চোখের দিকে তাকিয়ে সীমা অবশেষে তার অকথিত অধ্যায়ের সবচেয়ে টুইস্টিং সংলাপটি বলে।
-ঐ লোকটা আমাকে বেসামাল মাল বলছিলো। তুমিও একই রকম শব্দ বলছ কয়েকবার। সে কেমন বিচ্ছিরিভাবে হাসতো আমার মনে নাই। তবে যেসময় তুমি এ্যালকোহল নিতা, যেসময় তোমার ব্ল্যাকআউট হইত তার সবকিছুই আমার রেপড হবার সময়ের সাথে মিলে যায়।
-সীমা আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম ঐ লোকটাকে ধরতে পারলে আমি খুন করব। আমি আমার কথা রাখবো। আমি প্রতিশোধ নিব।
-কী করবা, নিজেকে হত্যা করবা? সেই মুরোদ তোমার আছে? যদি না থাকে, তো আমি তোমাকে খুন করব। ইট ইজ লুজ লুজ সিচুয়েশন ডার্লিং! খুন হওয়া ছাড়া তোমার উপায় নাই!
কিন্তু ভালোবাসার ছোট্ট ডিঙিতে করে উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে আসা শাহেদ আর সীমারও যে একে অপরকে ছাড়া থাকার উপায় নেই! তাই তারা এই জটিল দোদুল্যমান মানসিক পরিস্থিতিতে একে অপরকে সান্ত্বনা দেয়, কখনও সীমা শাহেদকে,
-আমার তো সেই লোকটার চেহারা মনে নেই। আর তোমার ব্ল্যাকআউটজনিত কারণে কিছুই স্মরণে নেই। তাই ঐ লোকটাই যে তুমি তা ভাবতে হবে না।
অথবা শাহেদ সীমাকে,
-তোমার তো সেই লোকটার চেহারা মনে নেই। আর আমার ব্ল্যাকআউটজনিত কারণে কিছুই স্মরণে নেই। তাই ঐ লোকটাই যে আমি তা ভাবতে পারছি না।
তবুও দংশন করে সন্দেহের সর্প। ভালোবাসা ডেকে আনে ঘৃণাকে, "নাও, তোমার প্রিয়তমার ধর্ষণকারীকে ধরে এনেছি। হত্যা কর তাকে।"
"তোর ধর্ষণকারী তোর পাশেই ঘুমোয়। লজ্জা করেনা? ঘেন্না করে না বেহায়া মেয়ে? তোর কি কোন আত্মসম্মানবোধ নেই? হয় ওকে মার নয় তো তুই মর!"
*
ভালোবাসার ধূর্ত ফাঁদে বেকুবের মত ধরা খেয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে সন্দেহ, ঘৃণা এবং প্রতিশোধ। তাদেরকে এমন বিহবল অবস্থা থেকে মুক্তি না দিয়ে উপায় ছিলো না শাহেদ বা সীমার। ক্রমশ নেতিবাচক চিন্তাটা জাঁকিয়ে বসে দুজনের মাঝে। তারা আলাদা শোয়। শাহেদ অপেক্ষা করে সীমা কর্তৃক নিহত হবার। সীমা অপেক্ষা করে নিশ্চিত হবার পরে ছুরি দিয়ে শাহেদের গলাটা কেটে দেবার জন্যে।
একদিন কাজ থেকে ফিরে সীমা রাতে খাবার পর খুব শান্তভঙ্গিতে রান্নাঘর থেকে বটিটা নিয়ে শাহেদের রুমে নক করে। শাহেদ ইদানিং বাইরে থেকে খেয়ে আসে। শাহেদের হাতেও একটা ছুরি। আর টেবিলে রাখা এক লিটারের বোতলে হান্ড্রেড পাইপারস।
-সীমা আমিই মনে হয় সেই!
অর্ধেকটা বোতল শেষ করার পর তার কন্ঠ জড়ানো। সীমার কি পরিচিত লাগে কন্ঠটা?
-আমারও তাই মনে হয়।
-আমি নিজেকে খুন করব। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম।
-যদি নিশ্চিত হই, এই মুহূর্তে সেটা করতে আমারও দ্বিধা থাকবে না কোন।
-নিশ্চিত হবার আর বাকি আছে কী!
কাঁদোকাঁদো গলায় বলে সে এক টানে বা হাতের কবজিতে বড় একটা ক্ষত সৃষ্টি করে ছুরি দিয়ে। মেজর কোন আর্টারি কাটা পড়েছে সম্ভবত। কুলকুল করে রক্ত বইছে।
-আমিই সেই!
শাহেদের এমন কন্ঠ সীমা কখনও শোনেনি। তার অপরিচিত লাগে সবকিছু। বর্তমান রক্তসঙ্কুল পরিবেশ, অতীতের বিভৎস নির্যাতনের রাত। তার কানের সামনে কে যেন খুব বিচ্ছিরিভাবে হেসে ওঠে।
-দাঁড়াও শাহেদ! থামো! প্লিজ থামো! মরে যাবে তো!
দৌড়ে শাহেদের কাছে গিয়ে শাড়ির আঁচল ছিড়ে ব্যান্ডেজ করে ছুরিটা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বটিটা গলার কাছে ধরে তাকে বলে,
-ড্রিংক কর শাহেদ, ড্রিংক কর। এবার আর ব্ল্যাকআউট হবে না। ড্রিংক কর। আর বিচ্ছিরিভাবে হাসতে থাকো কেমন?
শাহেদ অপ্রকৃতস্থের মত হাসতে থাকে। বটিটা কখনও গলার কাছে ধরে কখনও সরিয়ে নিয়ে সীমা তাকে নির্দেশনা দিতে থাকে হাসির রকম পরিবর্তন করার।
এ্যালার্মঘড়িটাতে একটা বিচ্ছিরি হাসির শব্দ টিউনড করা ছিলো। ভোরের দিকে সেটা যথাসময়ে বেজে উঠলে সীমা, শাহেদ আর ভোর, ঘোর অবস্থায় এই তিনের মধ্যেই এক প্রবঞ্চনার বোধ তৈরি হয়।
১১৩টি মন্তব্য ১০৯টি উত্তর
পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন
আলোচিত ব্লগ
এক্স লইয়া কি করিব
যাচ্ছিলাম সেগুনবাগিচা। রিকশাওয়ালার সিট কভারটা খুব চমৎকার। হাতে সেলাইকরা কাঁথা মোড়ানো। সুন্দর নকশা-টকশা করা। নর্মালি এররকম দেখা যায় না। শৈল্পিক একটা ব্যাপার। শুধু সিটকভার দেইখাই তার-সাথে কোন দামাদামি না কইরা... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইলিশনামা~ ১
১৯৮৫ সালে ডক্টর মোকাম্মেল হোসাইন ‘ ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে যেই রিসার্চ পেপারটা( থিসিস – এম এস এর জন্য) জমা দিয়েছিলেন সেটা এখানে মিলবে;
[link|https://open.library.ubc.ca/cIRcle/collections/ubctheses/831/items/1.0096089|Spawning times and early life history of... ...বাকিটুকু পড়ুন
সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার | SAD
শীতকালীন সর্দি-কাশি, জ্বর, হাঁপানি, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, কনজাংকটিভাটিস, নিউমোনিয়া কিংবা খুশকি মতো কমন রোগের কথা আমরা জানি। উইন্টার ডিসঅর্ডার বা শীতকালীন হতাশা নামক রোগের কথা কখনো শুনেছেন? যে ডিসঅর্ডারের... ...বাকিটুকু পড়ুন
চট্টগ্রাম আদালত চত্বরের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লিখছি
আজ চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা নানান গুজব ও ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা এড়াতে প্রকৃত ঘটনাটি নিরপেক্ষভাবে একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লিখছি।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে... ...বাকিটুকু পড়ুন