গতকাল রাতে সম্ভবত আমার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যু ব্যাপারটা বরাবরই কেমন অস্পষ্ট আর ধোঁয়াটে। সেটা যে কেমন, মানবজাতি তা আজো বুঝে উঠতে পারলো না! কোন মৃত ব্যক্তি তো কখনও এসে বলে যায়নি কাউকে, জীবনের সূতো ছিড়ে গেলে তা দিয়ে কতটুক কি বোনা যায়। তাই আমিও নিশ্চিত নই আমার মৃত্যুর ব্যাপারে। বিজ্ঞানমতে মৃত্যুর পরে আর কোন অনুভূতি থাকবে না। কিন্তু আমি তো দিব্যি সব দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি, নাস্তার টেবিলে পুষ্টিকর খাবার গিলছি গোগ্রাসে। তবে কি আমি মরিনি? ধর্মমতে অবশ্য মৃত্যুর পরেও আরেক জীবন থাকে। সে জীবনের বর্ণনা আবার একেক গ্রন্থে একেকরকম। সবগুলো ধর্মগ্রন্থ পড়া হয়নি বলে মিলিয়ে দেখাও দুস্কর। এমনিতে জীবন আর মৃত্যু নিয়ে তেমন একটা চিন্তা ভাবনা করি না। তবে মৃত্যুর মত অপ্রত্যাগামী কিছু একটা ঘটে গেলে তার আশু সুরাহা করা দরকার। জীবন বা মৃত্যু কোনটাই গুরুত্বপূর্ণ কিছু না, কিন্তু জীবন্মৃত হয়ে কে থাকতে চায়। আমার স্ত্রীও সম্ভবত আঁচ করতে পেরেছে ব্যাপারটা। এতদিন ধরে আমাদের পাশাপাশি বসবাস, এতদিন ধরে একে অপরকে স্প্রে করেছি উন্নত ব্র্যান্ডের সম্পর্কসুবাস, সে না বুঝলে কে বুঝবে? গতরাতে বাসায় ফেরার পর নতুন রেসিপির খাবার, টিভি দেখা, মশারি গুঁজে লাইট নিভিয়ে ঘুমুতে যাওয়া সবই ঠিকঠাক মত চলছিলো। সমস্যাটা আতঙ্ক অথবা আশঙ্কায় রূপ নেয় আমার বাথরুমের বেগ পেলে কোনভাবেই মশারি থেকে বের হতে না পারার মাধ্যমে। সামান্য এক মশারি, আলতোভাবে গোঁজা আছে তোষকের সাথে; তুলে ফেললেই হয়! অথচ আমি তুলবো কী, খুঁজেই পাচ্ছিলাম না নির্গমন পথ কোনভাবেই। ঘুমের ব্যাঘাৎ ঘটায় স্ত্রী খুব বিরক্তচোখে তাকাল আমার দিকে। কিন্তু আমার বেগতিক অবস্থা দেখেও কোনরকম সহায়তা করল না। হাই তুলে বলল,
-তোমার অবস্থা তো সুবিধের মনে হচ্ছে না। মশারীর ভেতর থেকে বের হবার প্রানশক্তি যার নেই, সে কীভাবে বাহ্যিত্যাগ করবে? আর বাহ্যিত্যাগ করতে না পারলে বাঁচবেই বা কীভাবে? থাক, আর চেষ্টা করে লাভ নেই। ঘুমিয়ে পড় অথবা মারা যাবার চেষ্টাও করতে পারো। আমার মনে হয় তোমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। শুভমৃত্যু।
আমি তার আন্তরিক শুভকামনার জবাবে জানাই যে ঘুম এবং মৃত্যুর জন্যে আমার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে, এবং তার নাসিকাগর্জনের ফলে কোনরকম সমস্যা হবে না।
সকালবেলায় ঘুম এবং মৃত্যুবিষয়ক জটিলতা প্রকট হয়ে ওঠে। আমি দ্বিধাণ্বিত অবস্থায় শুয়ে থাকি, শুয়েই থাকি। কাজে যেতে ইচ্ছে করে না। মৃত মানুষদের কি অফিসে যাওয়া জরুরী? এখন আমার উচিত সৎকারকার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া। মরে গেছি বলে তো আর দায়িত্ব শেষ হয়নি। আর নিজের কাজ নিজে করলে তবেই না সর্বোৎকৃষ্ট ফল পাওয়া সম্ভব! স্ত্রীকে ডাকি ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার জন্যে। সে নিশ্চিত করে বলতে পারে না, তবে মৃত্যুর সম্ভাব্যতাও উড়িয়ে দেয়না একেবারে। তার মতে, বিষয়টি যেহেতু জরুরী, আগেভাগে সব সেরে রাখাই ভালো। সে আমাকে ডেথ সার্টিফিকেট আগে থেকেই ইস্যু করার পরামর্শ দেয়।
-যা দিনকাল পড়েছে, সবারই একটা করে ডেথ সার্টিফিকেট করে রাখা উচিত। নইলে দেখা যাবে দিব্যি মরা মানুষ খাটিয়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ, অথচ জীবিত ভেবে প্রাণরস শুষে নিতে ছেঁকে ধরবে পিঁপড়ের দল।
তার কথা কে নাকচ করে দিতে পারিনা। কিন্তু মৃত্যুসনদের প্রাপ্তিস্থান এবং এ সংক্রান্ত বিবিধ দাপ্তরিক কার্যক্রম সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলাম বলে বাধ্য হয়ে তার সাহায্য প্রার্থনা করতেই হয়। আমার স্ত্রী একজন করিৎকর্মা এবং বুদ্ধিমতী মহিলা। সে বেশ দ্রুতই সিন্দুক, ওয়ার্ডরোব, আলমিরা ঘেঁটে একটি জীর্ণ কাগজ বের করে ফেলে।
-এটা নাও!
-কী এটা?
-আমাদের বিয়ের কাবিননামা।
-এটা দিয়ে কি হবে!
আমার বৈষয়িক জ্ঞানের অভাব দেখে সে কিঞ্চিত বিরক্ত হয়।
-আরে, এটা নিয়ে আশেপাশের কোন ডেথগ্রাফিক দোকানে যাও না! পাড়ায় নতুন দোকান উঠেছে দেখনি? সুন্দর করে লেখা, " এখানে যাবতীয় কাবিননামা, জন্মদিনের কার্ড, চাকুরির অভিজ্ঞতাপত্র ইত্যাদিকে সম্পূর্ণ কমপিউটারাইজড গ্রাফিক পদ্ধতিতে ডেথ সার্টিফিকেটে রুপান্তরিত করা হয়"। রাস্তায় চোখ বন্ধ করে হাঁটো নাকি?
তার ঝাঁঝালো বাক্যবাণ আমার অজ্ঞতাকে বিশ্রীভাবে ফুটিয়ে তুললে বেশ অপ্রতিভ হয়ে পড়ি আমি। একটা ব্যাগের মধ্যে কাবিননামাটি নিয়ে দ্রুত বেড়িয়ে যাই। আজ অনেক কাজ।
কম্পিউটারের দোকানের কর্মীরা বেশ অমায়িক এবং দক্ষ। তারা খুঁটিনাটি কথা বলতে বলতে নিমিষেই ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি করে ফেলে। বিল পরিশোধের সময় আবারো আমার অজ্ঞানতা শোচনীয়রূপে প্রকাশ পায়।
-তাহলে ডেথ সার্টিফিকেট হয়ে গেল! আমি ভেবেছিলাম কত জটিল হবে কাজটি!
-আরে ভাই, কাজ শেষ হইসে ভাবসেন? কাজ তো কেবল শুরু! আমরা কেবল একটা ফরম্যাটে কনভার্ট করসি। এখন আপনার স্বাক্ষর লাগবে, মৃত্যায়িত ছবি লাগবে, কত কিছু বাকি, যান যান! শেষ কইরা ফেলেন তাত্তাড়ি!
সত্যায়িত শব্দটার সাথে পরিচিত ছিলাম। কিন্তু মৃত্যায়িত? নাকি মিথ্যায়িত? আবারও প্রশ্ন করে সবার সামনে বোকা বনে যাবার কোন ইচ্ছা ছিলো না। তাই কনভার্টেড প্রি-ডেথ সার্টিফিকেটটি পুনরায় ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে রওনা দিই শহরের পথে। দাপ্তরিক কাজগুলো আজকে আজকেই শেষ করে ফেললে ভালো।
মহল্লা পেরিয়ে বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বাসের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। পেয়েও গেলাম একটা সহজেই। আজ হরতাল নাকি? সবকিছু বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বাসের ভেতর ঢুকে গ্যাঞ্জাম লেগে গেলো কিছু যাত্রীর সাথে। তারা মৃতদের জন্যে সংরক্ষিত আসনে বসে যাচ্ছিলো। আমি প্রতিবাদে সোচ্চার হলাম।
-এই যে ভাই, উঠেন। দেহেন না এইডা মৃতদের জন্যে সংরক্ষিত সিট?
লোকগুলো শুনেও না শোনার ভান করলে আমার মেজাজ চড়ে যায়।
-ঐ মিয়া! কী কই শুনেন না? মৃতদের সিটে বইছেন ক্যান? ওঠেন!
এবার তারাও পাল্টা বচসা শুরু করে দেয়। শহরে মৃতদের বৃদ্ধি এবং অবাধ চলাচল কীভাবে জীবিতদের স্বাভাবিক কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করছে এ নিয়ে তারা উষ্মা প্রকাশ করে। আমি ক্ষিপ্ত হয়ে কন্ডাক্টরকে ডাকলে সে আমার ডেথ সার্টিফিকেট দেখতে চায়। অন্যান্য যাত্রীরাও এতে সায় দেয় এবং গভীর আগ্রহে মৃত্যুসনদ দেখার জন্যে তাকিয়ে থাকে। যেহেতু আমার মৃত্যুসনদের কাজ এখনও শেষ হয়নি, তাই আমি ব্যাপারটা এড়িয়ে চলে সুকৌশলে পরের স্টপেজে নেমে যাবার চেষ্টা করি।
-ঐ বাস, থামাও। আমি নামুম এইহানে।
-এইখানে স্টপেজ নাই। ঐ মিয়া ফাঁপড় নিসেন এতক্ষণ? ধরেন তো ব্যাডারে, এর ডেথ সার্টিফিকেট দেইখাই ছাড়ুম।
তাদের ভাবগতিক খুব একটু সুবিধের মনে হচ্ছে না। মেরে টেরে বসতে পারে। তাই আমি প্রাণভয়ে চলন্ত বাস থেকেই লাফিয়ে নেমে পড়ে কিছুদূর দৌড়ে গিয়ে বেদম হাঁপাতে থাকি। মৃত্যুপরবর্তী কার্যক্রমে একের পর এক বিপত্তি তৈরি হচ্ছে। অবশ্য আমি এখনও নিশ্চিত না মারা গেছি কী না। হঠাৎ এমন অনুভব হচ্ছে আর কী! সে তো জীবিত থাকা অবস্থায়ও হত! হঠাৎ হঠাৎ মনে হত যে বেঁচে আছি। হঠাৎ, খুব হঠাৎ দিগ্বিজয়ী মেঘেদের জয়রথে নিজেকে অভিযাত্রী হিসেবে আবিস্কার করতাম, পূবালী বাতাসের তোড়ে ভেসে আসতো ঘাসফুলের গন্ধ, রাঙিয়ে দিত প্রজাপতির ডানার রঙ। বেঁচে থাকলে এরকম হতেই পারে মাঝেমধ্যে, জানি আমি। এও জানি, বেঁচে থাকা আর মরে যাবার মধ্যে খুব ক্ষীণ একটা রেখা আছে। রেখার দুইদিকের মানুষ নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে না জেনেই ভুল জীবন অথবা মরন যাপন করছে। গত বেশ কয়েকদিন ধরেই আমার ভেতর মরণ অনুভব প্রবল হচ্ছিলো। রাতে ঘুমুবার সময় চুম্বনের বদলে কদমবুছি করে বসতাম বউকে, পোষা টিয়াপাখিটাকে দেখলে ক্ষিধে লেগে যেত, বাসে উঠতে পুরান পল্টন থেকে ফার্মগেট হেঁটে যেতাম অক্লেশে, ভীড়, ঘাম, গরম তোয়াক্কা না করে। অবশেষে গতকাল রাতের সেই মশারী কান্ড। জীবনের মশারীরূপ ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে যখন শারীরিক বর্জ্য অপসারণের মত জৈবিক কাজগুলো বাধাপ্রাপ্ত হয়, এবং এতে আমার নির্বিকারত্বে স্ত্রীও যোগদান করে, তখন আমি নিজেকে একজন মৃত বা সম্ভাব্য মৃত ভাবতেই পারি!
হয়তোবা এসবই মৃতের অনুভব।
মৃত্যানুভব আমার চারিপাশে নৃত্যরত হয়। কুশীলবেরা আসতে থাকে একে একে। শাহবাগের মোড়ে দেখা হয়ে যায় কুহকের সাথে। পুরোনো বন্ধু। অন্তরঙ্গতা বজায় আছে এখনও। সেও একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বিরসমুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার অবশ্য বিরসমুখে থাকার কারণ রয়েছে। বেচারা অনেকদিন আগেই মৃত্যুকে অনুভব করেছে, কিন্তু কাগজিক জটিলতার কারণে ছাড়পত্র পাচ্ছে না। আমাকেও এভাবে এখানে কতদিন থাকতে হবে কে জানে!
-কী রে দোস্ত, খবর কী? এখনও ছাড়পত্র পাস নাই?
-আরে কেমনে পামু ক! ভেতরে যাওয়ার পাস নাই! যে বিশাল লাইন! কাগজপত্র সব রেডি করছি, ছবি তুলছি, মাগার সাইনটা নিতে পারতাছি না ডেথ মিনিস্ট্রির মন্ত্রীর কাছ থিকা।
-ছবিও তোলা লাগে নাকি? কি টাইপ? পাসপোর্ট না এনভেলপ সাইজ?
-সেইটা একটা হইলেই হইলো। মূল ব্যাপারটা হইলো, তুমি যে মারা গেছো তার প্রমাণ থাকতে হবে ছবিতে।
-এ তো আরেক ঝামেলায় ফালায় দিলি। মারা গেছি বা যাইতাছি এইডা তো বুঝতাসিই! আবার প্রমাণ দিমু কেমুন কইরা!
-আরে বুঝোস না! সরকারী কাজকম্ম। ফর্মালিটির কুনো শেষ নাই। দেখা গেলো সব কাগজ ঠিকঠাক, কিন্তু ছবি এ্যাপ্রুভ হইলো না। এহন থাকো বাইচ্চা! বিতিকিচ্ছিরি কিচ্ছা বুঝছো!
-তুই ছবি তুলসোস?
-তুলসি কিছু। তবে আরো তুলতে হইব। বেশি ভালো তুলিনাই। ডেথ মিনিস্ট্রিতে ছবি তুলার লোক আছে। মাগার ঢুকতে তো হইব আগে, যে ভীড়!
-আজকে যাবি? বেশি বেলা তো হয় নাই। এখুনি রওনা দিলে হয়তো সিরিয়াল মিলতে পারে।
-যাওয়া যায়, চল!
-সার্টিফিকেটটা নিসোস ঠিকমত?
-আরে ঐডা নিয়াই তো ঘুরি সারাদিন!
কথা বলতে গিয়ে কুহকের মুখ থেকে শীতকালের হিমেল ধোঁয়া বের হয়। ঠান্ডাটা বেশ ভালোই পড়েছে। প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে। দিনাজপুরে, পঞ্চগড়ে, শ্রীমঙ্গলে...কোথাও মঙ্গলের দেখা নেই। তবে এসব প্রান্তিক মানুষের মৃত্যুর জন্যে কোন সনদ লাগে না। গোয়ালঘরে বা ধানক্ষেতে পশ্চাদ্দেশ ভেটকিয়ে শক্ত কাঠি হয়ে পড়ে থাকুক, কার কী! তারা অনেকদিন যাবৎ সুস্পষ্টভাবে মৃত্যুরেখার এপাড়ে অবস্থান করছে দুর্লঙ্ঘ্য নিয়তিকে মেনে নিয়ে। আমাদের মত এপার-ওপার ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করছে না। তাই সনদপ্রণেতারাও তাদের নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না।
এসব বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলতে থাকি আর আমাদের মুখ থেকে কুয়াশা নির্গত হতে থাকে। কুয়াশায় ঢেকে যায় চারপাশ। রাস্তা, বাতি, বস্তি, মন্ত্রনালয় সবকিছু। আমরা পথ হারিয়ে ফেলি।
-কুহক, কুহক! কোথায় তুই?
কথা বলতে গেলেই বিপদ। কুয়াশার প্রলেপ গাঢ়তর হতে থাকে।
-আজকে মনে হয় আর যাওয়া হবে না। বাদ দে।
কুহকের মুখনিঃসৃত কুয়াশা আমাদের মোটামুটি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আমরা কেউ কাউকে দেখতে পাই না।
-তবে কাজটা আগায় রাখা যায়। আমি ক্যামেরা নিয়া আসছি। আয় তোর ছবি তুলে দেই। ছবিটা ঠিকমত না তুলতে পারলে সাইন জীবনেও পাইবা না।
-এই কুয়াশার মধ্যে ছবি তুলবি কীভাবে?
-আরে ভালো ক্যামেরা। ফ্ল্যাশ আছে। নাইট মোড, ফগ মোড সবই আছে। তুই যেখানে আছিস সেখানেই দাঁড়ায়া থাক। আমি ছবি তুলতেসি।
স্ন্যাপস
-রেডি?
-হ।
-চপ প্লিজ!
-চপ মানে?
-তোরে বলি নাই। যাদের বলার তারা ঠিকই বুঝছে।
এবং আমিও বুঝে যাই। Chop. কর্তন। চাপাতি এবং ক্ষুর হাতে নিয়ে জাঁহাবাজ মাস্তানেরা এগিয়ে আসে আমার দিকে। আমার বুকে এবং পাঁজরে আঘাত করার মোক্ষম মুহূর্তে চমৎকার একটি স্ন্যাপ নিয়ে নেয় কুহক। রক্তে ভিজে গা আঁঠালো হয়ে আছে। বিরক্তিকর ব্যাপার। এখন এগুলো কখন শুকোবে কে জানে! তবে আশাপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে, চাপাতিঅলাদের আগমনের পরপরই কুয়াশা কেটে গেছে। রোদ উঠছে। পত্রিকার ভাষায় বলা যায় "প্রকাশ্য দিবালোক"। তারা হাসছে। তাদের হাসি থেকে আলো বের হয়ে বিভ্রম দূর করছে কিছুটা। তারা জানান দিচ্ছে যে জীবনরেখার প্রান্তেই তাদের সদম্ভ বসবাস। তাদের কিছু বখশিস দিয়ে দিই সুন্দরভাবে কর্ম সম্পাদনে সহায়তা করার জন্যে। তারা কালবিলম্ব না করে চলে যায়। আরো কতজনের সেবায় নিয়োজিত হতে হবে কে জানে!
-বি রেডি ফর এ্যানাদার স্ন্যাপ।
-আবার কেন?
-তুই কি ভেবেছিস এতেই হয়ে যাবে? আরো কয়েকটা তুলতে হবে। সমস্যা নাই, মৃত্যুকুশীলবেরা আশেপাশেই আছে সব। এরপর কুহক আমার ছবি তোলে পাঁচ টনি ট্রাকের টায়ারের নিচে পিষ্ট অবস্থায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রসফায়ারে গুলিবিদ্ধরূপে, হতাশ প্রেমিকের বেদনাময় শেষমুহূর্তের আশ্রয়-ফ্যানের হুকের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায়। শাটার টিপতে থাকে সে অবিরত। পুরো একটা দিন আমরা এর পেছনেই ব্যয় করি। আজকে আর ডেথ মিনিস্ট্রিতে যাওয়া না হলেও প্রয়োজনীয় কাগজ, এবং ছবির সংগ্রহ গড়ে ওঠায় আগামীকাল সাক্ষরপ্রদানকারী ব্যক্তিটি আমাদের সাথে সদয় আচরণ করবেন ভেবে উৎফুল্ল হই।
*
বাসায় ফেরার পর আমার স্ত্রী মৃত্যুসনদের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আমি তাকে সমস্ত ঘটনা বিবৃত করে আগামীকালের উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা জানাই। বিশেষ উৎসাহের সাথে তাকে ফটোসেশনের বর্ণনা দিই। আমি ভেবেছিলাম আমাদের ফটোসেশন উল্লিখিত কাজের প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে ভেবে সে বাহবা দেবে আমাকে। কিন্তু অভিজ্ঞা নারী আমাকে দেশের হালচাল সম্পর্কে কিছু জ্ঞান প্রদান করে জানায় যে এসব ছবি মৃত্যায়িত করে সনদের সাথে সংযুক্ত করলে তাতে তো কোন লাভ হবেই না, উল্টো এমন আচরণকে রাষ্ট্রদ্রোহীতা এবং মিথ্যাচারণের অভিযোগে দোষী করে শাস্তি দেয়া হতে পারে। আমি তার এমন আচরনে অবিশ্বাস প্রকাশ করলে সে তার কোন এক দরিদ্র শিক্ষক আত্মীয়ের জীবন থেকে বাস্তব উদাহরণ দেয়, যে নাকি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক পিপার স্প্রের কবলে পড়ে মারা যাবার ছবি সংযুক্ত করে তা মৃত্যায়িত করতে গেলে ঊর্ধতন মহলের প্রবল রোষকবলিত হয়ে এখন সুপেয় মৃত্যুতরলের বদলে বক্সিং কোর্টে জীবন নামক ষন্ডার সাথে আজীবন লড়ে যাবার দন্ডপ্রাপ্ত হয়েছে।
অগত্যা...
আবারও প্রলম্বিত মৃত্যু অনুভবকে সাথে করে আরেকটা দীর্ঘ রাত কাটাই। চুম্বন করতে গিয়ে ঢেকুর তুলি, মশাদের ডানা ঝাপটানিতে বিছানার এক কোণে সভয়ে লুকিয়ে থাকি, ব্যাগ থেকে ডেথ সার্টিফিকেটটা বের করে তাতে নানা কারিকুরি করে ম্যারেজ সার্টিফিকেট বানানোর ব্যর্থ চেষ্টা শেষে গভীর মনোযোগের সাথে স্ত্রীর নাসিকাগর্জন শুনি। আর মেঝেতে নেমে এক্কাদোক্কা খেলি, জীবন আর মরণের ক্ষীন রেখার কোনখানে আমার অবস্থান, জানার অক্ষম চেষ্টা!
সকালবেলায় কুহক আসে। তার মাথায় নাকি দারুণ কিছু আইডিয়া এসেছে। এবারের স্ন্যাপগুলোয় কাজ না হয়েই যায় না! কুহক ছবি তুলতে থাকে একের পর এক। মৃত্যুকুশীলবেরা আসে আর যায়, কুশলী নটবর তারা। আমার স্ত্রী বেলা করে ঘুমোতেই থাকে নাক ডেকে। ফটো-নাক-ঘুম এর মন্টাজ অসহ্য লাগে আমার। আমি তার নাকে বালিশ চেপে ধরি। সে গোঙাতে থাকে। তার দেহ নিস্তেজ হয়ে আসছে। মৃত্যু কুশীলবেরা জীবনরেখায় অবস্থান নিয়ে উপভোগ করতে থাকে এই দৃশ্য। মরণরেখা প্রকট এবং বিভাজিত হয়ে ফুটে ওঠে আমাদের ক্ষুদ্র আঙ্গিনায়। আমার নিথর হয়ে আসা স্ত্রীর থেকে মৃতবৎ আমি ক্রমশ দূরবর্তী স্থানে যেতে থাকি। দুজনই মৃত্যুরেখায়, অথচ কি বিপুল বৈপরীত্য এ দুটোর মাঝে! পিছুতে পিছুতে আমি কুহকের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। এখানে আমাদের দুজনের মরণরেখাটা একইরকম। ওর কাছ থেকে ক্যামেরাটা ধার নিয়ে নিয়ে আমি অন্যরেখায় অবস্থিত মানুষদের ছবি তুলতে থাকি। ডিএসএলআর ক্যামেরাটি তার কর্মকৌশল ভঙ্গ করে প্রাচীন আমলের পোলারয়েড ক্যামেরার মত ছবির হার্ডকপি উগড়ে দেয়।
সেখান থেকে বের হয় সকলের স্বাক্ষর এবং ছবিবিহীন ডেথ সার্টিফিকেট।
#প্রাসঙ্গিক কবিতা- দ্বিধাণ্বিত মৃত্যুর সম্মুখে
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৪:১৭