somewhere in... blog

ডাইনোসরের ডানায়

২৪ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ৮:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমি একজন লোককে চিনি, যিনি ডাইনোসর ফোবিয়ায় ভুগছেন। আমার বেশ পরিচিত এবং শ্রদ্ধাভাজন মুরুব্বী তিনি। তার কথাবার্তা এবং জীবনদর্শন সবসময়ই পরিশীলিত বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। সুতরাং, যখন শুনলাম যে প্রাগৈতিহাসিক এবং বিলুপ্ত সেই বৃহদাকার জন্তুর ভয়ে তিনি জর্জরিত, এবং তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হচ্ছে এতে, এর পেছনে যৌক্তিক কারণ অনুসন্ধানে শশব্যস্ত হইনি। জানতাম, তিনি ভয় পেলে জেনে বুঝেই পাবেন। ভয়ের পেছনে যৌক্তিক কারণ উদঘাটনে উৎসাহী গোয়েন্দাপ্রধান হবার ইচ্ছে জাগেনি আমার। মানুষ মাত্রই ভয়কাতর। ভয়ের উপাদান কমে যাচ্ছে দিনকে দিন। আরো বিস্তৃতভাবে বললে, প্রকৃত ভয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভয় পাচ্ছে নিরীহ সব ব্যাপার বা বস্তুকে। কারো হয়তো বা উঁচু জায়গায় উঠতে ভয়, কারো বেড়াল দেখে পলায়নেচ্ছা জাগে, কেউ বা আবার পেনসিল দেখে ছোটবেলার বানানভুলজনিত শাস্তির কথা ভেবে থরথর কাঁপে। অথচ তারা ভূত-ভবিষ্যত-স্রষ্টা কিচ্ছুকেই ভয় পাচ্ছে না। সেই হিসেবে ডাইনোসরের মত একটা জবরদস্ত প্রাণীকে ভয় পেলে নৈরাশ্যবাদী এবং সংশয়বাদী সমিতির আড়তদারেরা তাদের হতাশার গোডাউনে আরো কিছু মালমশলা যোগ করে ভ্রান্তিপণ্য বিপননে সচেষ্ট হতে পারে, আমার বয়েই গেছে তাতে। আর তাছাড়া সম্প্রতি পাওয়া খবরে জানলাম ব্যাপারটা এমন না যে, তিনি ডাইনোসর ভীতির কারণে যাবতীয় বৈষয়িক কার্যকালাপ বন্ধ রেখেছেন। প্রারম্ভিক জটিলটা কাটিয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠছেন ক্রমশ। দিব্যি অফিস করছেন, বাজার করছেন, আড্ডায় রসিকতা করে বন্ধুবান্ধবকে হাসাচ্ছেন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছেন ধীরে ধীরে ভয়টাকে চোখ রাঙানোর পর্যাপ্ত অবকাশ দিয়েই। ডাইনোসরের চোখের দৃষ্টিসীমার ভেতরে থেকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করার জন্যে আমি তাকে বরং বাহবাই দেব। তিনি ভয় পেতে পারতেন পেটোয়া বাহিনীর নতুন বাহানাকে, তিনি ভয় পেতে পারতেন তার সঙ্গিনীর অবিশ্বস্ত হবার সম্ভাবনাকে, তিনি ভয় পেতে পারতেন ফুডগ্রেডবিহীন রঙীন পানীয়কে। যে তিনটি কারণ বললাম, যতদূর জানি, ডাইনোসর ভীতিতে আক্রান্ত হবার পূর্বে এগুলো তাকে ভুগিয়েছিলো বেশ। গ্রিনরোডে নতুন ব্যবসা খুলে বসার পর থেকেই চাঁদাবাজদের আগ্রাসন শুরু হয়েছে তার ওপর। এদিকে তার স্ত্রী সম্পর্কে নানারকম কানাঘুষা চলছে, ভদ্রলোকের ব্যস্ততার সুযোগে তিনি নাকি কার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে এখন ডিভোর্স দেবার প্ল্যান করছেন। তিন নম্বর কারণটি অবশ্য কিছুটা লঘু, ভদ্রলোক সম্প্রতি একজন নিকটাত্মীয় হারিয়েছেন ক্যান্সারে। ক্যান্সারের কারণ ভেজাল পানীয়ের প্রতিক্রিয়া বলে ডাক্তাররা অনুমান করেছেন। এদিকে ভদ্রলোক আবার কৃত্রিম রঙ দেয়া কোমল পানীয়তে বেজায় আসক্ত। ভয় পাবার এত উপাদান থাকতে ডাইনোসর বেছে নেয়াটাকে আমি প্রজ্ঞা বলব, সৃষ্টিশীলতাও বলা যেতে পারে। তার সাথে এসব নিয়ে আলাপ করার ইচ্ছে আমার বেশ কিছুদিন ধরেই জেঁকে বসছিল। কীভাবে আমি একটি ডাইনোসরকে ভয় পেয়ে তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে অন্যান্য ভয় থেকে দূরে থাকতে পারি তা জানার তাগিদ অনুভব করছি।

ডাইনোসর সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা যৎকিঞ্চিত। স্পিলবার্গের জুরাসিক পার্ক সিনেমাটা দেখেছিলাম। ভয় পাইনি। ক্যাডিলাকস এ্যান্ড ডাইনোসোরাস নামক একটি আর্কেড ভিডিও গেম খেলতাম আগে, কিন্তু সেখানে আমার জয়প্যাডের ক্ষীপ্রগতি এবং দক্ষতার কাছে বিশালাকার প্রাণীগুলো বরাবরই পর্যুদস্ত হত। অগত্যা অদ্ভুত ভয়ে আক্রান্ত হয়ে মুখরোচক খবরে পরিণত হওয়া আমার সেই গুরুজনের শরণাপন্ন হতেই হল। তার সাথে আমার বেশ হার্দিক সম্পর্ক থাকলেও আজকের আগমনকে তিনি দেখলেন বিরক্তি এবং অনীহার দৃষ্টিতে। হয়তো ভেবেছেন অন্যান্যদের মত আমিও তার এই অহেতুক ভয়ের শুলুকসন্ধান করতে এবং ভয়টি কাটিয়ে ওঠার জন্যে হামবড়া অপ্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে এসেছি। তবে কিছুক্ষণের ভেতরেই সে প্রসঙ্গে কিছু না বলা স্বত্তেও আমাদের দীর্ঘদিনকার পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে নীরবেই জানিয়ে দিলেন, ও ভয় তার একান্ত, বিক্রয় বা অংশীদারীত্বে তিনি আগ্রহী নন। এতে আমার আরো রোখ চেপে যায় এবং আমি কোন কারণ ছাড়াই সোফার ফোম আঁচড়াতে থাকি নখ দিয়ে।
-নতুন কেনা সোফাটা এভাবে আঁচড়াচ্ছো কেন?
-আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এর মধ্যে তেলাপোকা বাসা বেঁধেছে।
-এরকম অদ্ভুত সন্দেহ হবার কারণ কী?
-অদ্ভুত বলছেন?
-অদ্ভুত এবং হাস্যকর।
-বেশ!
এবারে আমি যা বলব বা যা বলার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তার প্রাথমিক প্রস্তুতি নেয়াটা সম্পন্ন হয়। আড়ষ্টতা কাটাবার জন্যে কিছুক্ষণ সময় বরাদ্দ দিলাম নিজেকে। হ্যাঁ, এবার বলা যায়!
-অদ্ভুত এবং হাস্যকর না ভেবে ব্যাপারটাকে আপনি এভাবেও ভাবতে পারেন, সাহসী এবং কার্যকর। মানে তেলাপোকার কথা বলছিলাম আর কী। সাহসী এবং কার্যকর একটি প্রাণী। ছয় কোটি বছর ধরে টিকে আছে পৃথিবীর বুকে। যেখানে ডাইনোসরের মত অতিকায় প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে...
তার বিচক্ষণতার কাছে আমার দূরভিসন্ধি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। তিনি এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে বিশ্রীভাবে মুখ হা করে হাই তুললেন, যদিও বেশ বুঝতে পারছিলাম যে তার মোটেও ঘুম পাচ্ছে না। তবে তিনি এতটা নির্দয় থাকলেন না শেষ পর্যন্ত। বিদায় দেবার সময় দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন,
"সব ডাইনোসর এখনও বিলুপ্ত হয়নি"
কথাটি বলার সময় তার কন্ঠের সম্ভ্রমপূর্ণ কম্পন আমাকে ভয়টির খাঁটিত্ব সম্পর্কে নিশ্চয়তা দেয় এবং ভবিষ্যতে সমভয়ানুগামী হবার আশাবাদ যোগায়।

এরপর কিছুদিন আমার কাটলো ডাইনোসর সম্পর্কে গবেষণা করে। ভালোই চলছিলো গবেষণা বা ভয় অন্বেষণ। কিন্তু একের পর এক ভয়ানক এবং বিপদজনক ঘটনা ঘটতে থাকায় তাতে ভালোরকমের ব্যাঘাত ঘটে। প্রথমে আমি বিচ্ছেদের সম্ভাবনা দেখি আমার প্রেমিকার সাথে। সারারাত তার ফোন এনগেজড থাকতো, এবং জিজ্ঞেস করলে যা বলে আর কী মেয়েরা এক্ষেত্রে, ফোন তার কাছে ছিলোনা অথবা বিদেশ থেকে কাজিন ফোন করেছিলো এসব বলে আমার সন্দেহপ্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। আমায় জড়িয়ে ধরে বিচ্ছেদের ভয়। এমন এক জটিল অবস্থায় সম্পর্ক উন্নয়নে সচেষ্ট হব নাকি ডাইনোসরদের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে বন্ধ ঘরে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে আশ্রয় এবং আস্বস্ততা খুঁজবো তা নিয়ে ভাবতে হয়েছিলো বেশ। প্রেমিকা এবং ডাইনোসরদের মাঝে এ দ্বৈরথ বেশ কৌতূহলউদ্দীপক বটে! ভেবে দেখলাম, বিলুপ্ত প্রজাতির অতিকায় প্রাণীটিকে যদি কোনক্রমে ভয়সম্ভবা করা যায় তাহলে প্রেমিকা অন্যের দ্বারা সন্তানসম্ভবা হচ্ছে কী না এ চিন্তা থেকে রেহাই পেতে পারি। সিদ্ধান্ত নেবার ফলে প্রশান্তমনে আমি ডাইনোসর চর্চা বজায় রাখি বেমক্কা হাজার কিলোমিটার দূরের টেকটোনিক প্লেটগুলো আড়মোরা ভেঙে আমার এলাকায় এসে অভদ্রভাবে কড়া নাড়ার আগ পর্যন্ত। রিখটার স্কেলে ৫.৫ মাত্রার ভূ-কম্পনটি আমাকে রীতিমত আতঙ্কিত করে তোলে। আতঙ্কের পাশাপাশি নতুন একটা সম্ভাবনার কথাও মনে হয়, ডাইনোসরেরা কি জেগে উঠছে? নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হলে আমি বেশ একটা মানসিক প্রশান্তি পাই। হয়তোবা ভূ-কম্পন হয়নি, হয়তোবা আমার নিবিড় ডাইনো-চর্চার ফলে মনের টেকটোনিক প্লেটগুলো বেসামাল হয়ে উঠেছে! হয়তোবা আমাকে অধিগ্রহণ করতে আসছে, আমার একান্ত ভয় এবং নির্ভরতা, আমার নিজস্ব ডাইনোসর! ভীতি এবং ভক্তিতে আমার চোখ বুঁজে আসে, অশ্রু ঝরে পড়ে গাল বেয়ে। কিন্তু এই ভক্তিভাব বেশিক্ষণ থাকে না আশেপাশের মানুষের কোলাহল এবং চিৎকারে। তাদের উত্তেজিত সংলাপে আমি নিশ্চিত হই যে সত্যিই ভূমিকম্প হয়েছিলো। ডাইনোসর আসেনি তাহলে? ওহে প্রাগৈতিহাসিক অতিকায় জীব, একবার দেখা দাও, এই বস্তুতান্ত্রিক নশ্বর জীবনের ভয়ার্ত সময়ে তুমি সহায় হও! নাহ, আমি আমার বিচক্ষণ প্রবীণ আত্মীয়ের মত প্রজ্ঞাবান এবং কৌশলী হতে পারিনি এখনও। হয়তোবা পারবোও না। আমার দরকার হ্যালুসিনেশন। কোন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গেলে কেমন হয়?

-আপনার সমস্যাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আরেকবার বলবেন?
-জ্বী, মানে বলছিলাম কী, আমি একটি বিশেষ ধরণের হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত হতে চাই। ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন। সেখানে একটি অতিকায় ডাইনোসর এবং তার দোসর তর্জন-গর্জন করে আমাকে ভয় দেখাবে।
সাইক্রিয়াটিস্ট আমার আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে কীরকম ক্রীয়া প্রদর্শন করবেন ভেবে কিছুটা উদ্বিগ্ন বোধ করি মনে মনে। তবে পরবর্তীতে তার কথাবার্তায় আমি জানতে পারি যে শহরের দৃশ্যপট এবং গণমনস্তত্ত্ব অনেক বদলে গেছে। যারা আগে আমার বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়ের উদ্ভট ভীতিকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিত তারাই আজকাল ব্যাপারটির ইতিবাচক দিক সম্পর্কে অবহিত হয়ে সাংসারিক, বৈষয়িক এবং মানসিক নানাবিধ বিষয় থেকে পরিত্রাণ পেতে ডাইনোসরের দ্বারস্থ হবে বলে মনস্থির করেছে।
-দেখুন, ডাইনোসরের ব্যাপারটা এখন আর মনোসামাজিক বিকলন বা বিচ্যুতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আপনি ইচ্ছে করলে স্যুভনির শপ থেকে ছোট আকারের ডাইনোসর কিনে নিতে পারেন। একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে হ্যালুসিনেশন ত্বরান্বিত করার মত কাজকে নিশ্চয়ই ইথিকালি সাপোর্ট করতে পারি না আমি।
-সোজা কথা বলেন যে আপনি পারবেন না! সোজা কথা বলে দিন না, এই কর্ম করতে গিয়ে আপনি নিজে ব্যর্থ হয়ে এখন আমাকে নিরুৎসাহিত করছেন! যত্তসব! আপনাকে আমি দেখে নেব। আমার আপন চাচার মামাশ্বশুর আর্মির ব্রিগেডিয়ার!
সাইকিয়াট্রিস্টের পাঁশুটে মুখ আর ঝুলে পড়া চোয়াল আমার ধারণার সত্যতা প্রমাণ করে। সেও ভীতিনাসুন্ধানে শামিল হয়েছে অন্য সবার মত। একটা ডাইনোসের থাকলে সে নিশ্চয়ই উচ্চতর সামরিক পদবী সম্পন্ন কারো বরাত তুলে হুমকি দেয়াতে এমন ভড়কে যেত না!

সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বার থেকে বের হবার পরে গলাটা একটু ভিজিয়ে নিতে একটা টং দোকানে বসলাম চায়ের জন্যে। না বসলেই ভালো হত। আমার এক ছুঁচোমুখো আঁতেল বন্ধু যেন ওৎ পেতে ছিলো সেখানে আমি আসবো জেনেই। কিছুক্ষণ পর নানা বিটকেলে প্রশ্নে আমাকে অপদস্থ করার চেষ্টা করবে নিশ্চয়ই! ঠিক আছে, সে সুযোগ তাকে দেয়া যাবে। এ ধরণের পরিস্থিতির জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম, তাই কথোপকথনের ধাঁচটা আঁচ করে নিয়ে নগ্ন শব্দদল সাজিয়েছিলাম যুক্তির পোষাকগুলিকে ভাগাড়ে ফেলে।

কুশল বিনিময় এবং টুকটাক কথাবার্তার পরে অবধারিতভাবে সেই প্রসঙ্গটা চলে আসলো। আয়েশ করে বসে মওকামত আমাকে চেপে ধরল,
-তুই নাকি ইদানিং ডাইনোসর খুঁজে বেড়াচ্ছিস? কেন পুষবি নাকি? নধর দেখে একটা পেলে পরে আমাকে দিস তো। এবারের ঈদে ভাবছি একটা ডাইনোসর কোরবানি দেব।
তার বিদ্রুপাত্মক কথার বাণ আমার ডাইনোনুভূতিতে বেশ ভালোভাবেই আঘাত করে। আমি সাজানো গোছানো কথাগুলো ভুলে গিয়ে হিসহিসিয়ে তাকে ভয় দেখাই,
-দেখ, ডাইনোসর সম্পর্কে কথা বলার আগে ভালোমত জানার চেষ্টা কর, পড়াশুনা কর। না জেনে এরকম কথা বলার আগে দুইবার ভাববি।
আমার বলার ভঙ্গিটা নিঃসন্দেহে ভীতি উদ্রেককারী ছিলো। তার মুখ একদম আমশি মেরে যায়। এই সাফল্যে গর্বিত এবং তুষ্ট হয়ে একটা কাঁঠালগাছে হেলান দিয়ে তৃপ্ত মনে আকাশের দিকে চাইলে আমি দেখতে পাই উড়ে যাচ্ছে একটি ডাইনোসর তার বৃহৎ পাখা মেলে। চেয়ে আছে আমার দিকে, হ্যাঁ, শুধু আমার দিকেই। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে। অবশেষে আমি উহাকে দেখিলাম! ভয় এবং আনন্দের যুগপৎ অনুভূতি আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি আলতোভাবে সরিয়ে দিই আনন্দের পেলব বাহু। এসো ভয় আমাতে লীন হও!

এখন সময় ভয় পাবার। ভয়ে ডুবে থাকার। বৃহত্তম ভয়ের আড়ালে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভয়গুলোকে ঢেকে রাখার। ডাইনোসরের পাখা। তার ছায়ার বিশালত্ব নিশ্চয়ই পরিমাপযোগ্য হবে না! সুখ, আনন্দ, হতাশা, দুঃখ, এসবের সম্মিলনে যে জটিল জীবন আমরা যাপন করি, ভয় নামক মহান অনুভূতি তাদের সবাইকে একীভূত করে জীবনকে করবে সরল এবং স্পষ্ট। চাকুরী পাচ্ছি না বলে টেনশন করব না আর, প্রেমিকার চোখে গোপন সার্চলাইট জ্বলে উঠতে দেখে চমকে যাবো না, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধিতে বাতে ধরা কেশোরোগী বৃদ্ধদের মত কোঁকাবো না বা কাশবো না। রাত হয়েছে অনেক। বাসায় যাবার আগে একবার আমার সহধর্মী আত্মীয়টিকে সুসংবাদটা জানিয়ে আসা দরকার।

আমাকে দেখে এবার তিনি প্রফুল্ল হলেন। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন আমি উদ্দীষ্ট বস্তুর দেখা পেয়ে গেছি!
-এসো এসো! জানতাম তুমি আসবে। জানতাম তুমি খুঁজে পাবে তাকে। এখন তোমার অনুভূতি ব্যক্ত কর।
-আমি আপ্লুত! আমার সাধনা সফল হয়েছে! যদি কিছু পরামর্শ দিতেন, ভয়াচরণ কীরকম হলে ভালো হবে, আপনি তো অভিজ্ঞ এবং বিচক্ষণ মানুষ...
-যার যার ভয়াচরণ তার তার কাছে।
-অল্প কথায় সুন্দর বলেছেন। ধন্যবাদ।
-আরো কিছু বলার আছে আমার। ইহজাগতিক ভয়ের, বিশেষ করে নাগরিক ভয়ের চেয়ে প্রাগৈতিহাসিক ভয় উত্তম।
-আপনি একটা খাঁটি কথা বলেছেন মনির ভাই!
-আমাকে এখন থেকে আর ভাই বলে ডাকবে না। মহান ডাইনোসরের আশীর্বাদে আমি অতি উচ্চ এক স্থানে পৌঁছে গেছি। আমাকে সমীহ করে কথা বলবে। মনে রাখবে, আমাকে দেখেই তুমি ডাইনোসরভীতির ধারণাটা পেয়েছো। এটা শুধুমাত্র ভয়বিধান না, একটি পরিপূর্ণ গোপনদর্শনও বটে। আমাকে গুরু বলে ডাকবা এখন থেকে।
-কী যা তা বলছেন! আপনাকে গুরু ডাকবো কোন দুঃখে! আমি কি আপনাকে ভয় পাই? কেন ভয় পেতে যাব? আমি শুধুমাত্র ভয় পাই আমার একান্ত ডাইনোসরকে।
-ব্যাপারটা ভয়ের না, সমীহের। তুমি আমাকে সমীহ করে চলবা এখন থেকে বুঝলে?
-সে তো আমি করতামই সবসময়, কিন্তু ডাইনোসরকেন্দ্রিক কোন ব্যাপারে আপনাকে সমীহ করতে পারবো না। মনে রাখবেন, আপনার মত আমারও ডাইনোসর আছে। আমি অর্জন করে নিয়েছি। এবং আমারটা নিঃসন্দেহে আপনার চেয়ে বড় এবং প্রকান্ড।
-কোন সাহসে তুমি এ কথা বল!
গর্জে উঠলেন তিনি।
-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছি। আজ বিকেলেই তো দেখলাম। আকাশে উড়ছে। কী বিশাল তার ডানা! কী ভয়ংকর দৃষ্টি তার চোখে!
বলতে বলতে গা শিউরে উঠলো আমার।
-তোমারটার চেয়ে আমারটা হাজারগুণ শক্তিশালী এবং বৃহৎ। এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে তুমি আসলে দেখেছো কী না! হয় বানিয়ে বলছ, নয় তো তোমার দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছে।
-আপনার কথা পরিস্কারভাবে পরস্পরবিরোধী এবং অফেন্সিভ। একটু আগেই বললেন "যার যার ভয়াচরণ তার তার কাছে", আর এখন সেই আপনিই আমার ভয়াচরণকে আক্রমণ করে কথা বলছেন। আপনি কি দেখেছেন আমার ভয়াচরণ? দেখলেও ভয়ারিজমের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবেন।
-তাই? বেরিয়ে যাও এখান থেকে। আই সে গেট আউট!
-আপনি না বললেও যেতাম। আপনার মত জাঁহাবাজ লোকেরা এখন ব্যক্তিগত ভয়কে সমষ্টিতে ছড়িয়ে দিয়ে আবারও যোগজীকরণের মাধ্যমে জড় করে একাধিপত্য কায়েম করার যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রতে লিপ্ত তা বেশ জানা আছে আমার!

কালবিলম্ব না করে ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে গটগট করে চলে আসি আমি ভন্ডলোকটাকে তার অর্বাচীন উচ্চাকাঙ্খা সমেত। ফিরে আসার পথে আবারও আকাশে ডাইনোসরের বিশাল উড়ন্ত অবয়বটা দেখতে পাই। ভয়টা বেশ জোরদার হয়।

নাফিসার ফোনে কল দিচ্ছি বারবার। কল রিসিভ করছে না। কেটে দিচ্ছে। ডাইনোসরকে আমার মহান ত্রাতা অথবা আশ্রয় ভেবে, তার ভয়ে-ভক্তিতে ন্যুব্জ এবং সম্মোহিত হয়ে অবলীলায় অবজ্ঞা করতে পেরেছিলাম নাফিসাকে। কোন একটা নরকের নাম উল্লেখ করে সেখানে গিয়ে বাসস্থান গড়তে উপদেশ দিয়েছিলাম। আজ প্রাচীন প্রেমিকা এবং প্রাগৈতিহাসিক ভয়প্রভু, কোনটাই নেই। বিমর্ষ লাগছে খুব। দেখা দাও দেখা দাও ডাইনোসর! না প্রেমিকা। ডাইনোসর...নাকি প্রেমিকা? যেকোন একজন, প্লিজ আসো। ভালোবাসো অথবা ভীত কর। ডাইনোসর ভীতিটাকে সত্যিই খুব অমূলক মনে হচ্ছে এখন। নিজেকে আস্ত বেকুব ঠাউরে গাল দিতে ইচ্ছে করছে।
-তা তুমি বেকুব নও তো কী?
রিনরিনে গলায় আমার ঘরের ঘুলঘুলির চড়ুই পাখিটা বলে উঠলো।
-শাট আপ লিটল বার্ডি! ঝামেলায় আছি খুব।
-তুমি তো ডাইনোসর নিয়ে অনেক পড়ালেখা করেছ, জানো না, ওরা বিবর্তিত হয়ে পাখি হয়েছে?
-হ্যাঁ, সেরকম কিছু পড়েছি। তো?
-তো যা বলছিলাম, বায়োলজি বইতে তো সব লেখা থাকে না, ডাইনোসরেরা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও পাখিদের সাথে ওদের একটা আত্মিক টান আছে। যেটা শুধু আমরাই বুঝি। আচ্ছা, তোমরা ওদেরকে ভয়ানক কিছু ভেবে কোন মর্যাদার আসনে বসাতে চাচ্ছো বলত? এসবই তোমাদের নীচুতা এবং স্বার্থপরতা, বুঝলে? প্রাচীন পরাক্রমকে ভয়ের আসনে বসিয়ে নিজেদেরকে সমর্পিত করে অন্যান্য ভয়ানক উপাদান এবং ঘটনাকে অগ্রাহ্য করা। খুব লুকোতে চাও তোমরা সবকিছু তাই না? একে অপরকে লুকোচ্ছ ঠিকই, তবে পাখির চোখে ঠিকই ধরা পড়ে যাচ্ছ। শোন, ডাইনোসরকে খুঁজছোতো? ভয়ের দান উল্টে দিয়ে ছকটাতে একটাতে ভালোবাসার দান দাও দেখি! দেখো না সে আসে কী না।
-ব্যাপারটা এভাবে ভাবি নি, তবে...
বলতে গিয়ে দেখি চড়ুই পাখিটা উড়ে গেছে। পাখিটা মন্দ বলে নি। ভালোবেসে ডাকবো ডাইনোসরকে? কিন্তু ডাইনোসরের মত এমন একটা বিদঘুটে প্রাণীকে ভালোবেসে ডাকতে যাবে কে! ঘর থেকে বেরিয়ে উদাস মনে পায়চারি করতে করতে ভাবি। হঠাৎ খেয়াল করি, আমি শূন্যে উঠে যাচ্ছি। আমাকে পিঠে করে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটা বিশাল ডাইনোসর! তার চোখে মোটেই কোন হুমকি নেই, তার চোখ মোটেও আক্রোশে জ্বলজ্বল করছে না। মায়াময় বড় বড় চোখ। ডাইনোসরের বিশাল ডানায় শুয়ে থেকে আমি নাফিসাকে ফোন করে প্রত্যাখ্যাত হতে থাকি, কাঁদি। বিডিজবসে করা এ্যাপ্লিকেশনগুলোর পজিটিভ রিপ্লাই আসেনি একটাও। দুর্ভাবনায় পড়ি। মনির ভাইয়ের সাথে করা আচরনের জন্যে দুঃখিত হই। তার ডাইনোসরটা কি শুধু ভয়ই দেখায় তাকে? এরকম পিঠে করে নিয়ে ওড়ায় না?

শহুরে ক্লেদ, পাপ, ঘাম, প্রতিযোগিতা, ভয়;সবকিছুই দেখি আর রূপকথা বানাই চড়ে ডাইনোসরের ডানায়।




সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ৮:১৬
৪৫৬ বার পঠিত
৯০টি মন্তব্য ৯০টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এক্স লইয়া কি করিব

লিখেছেন আনু মোল্লাহ, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৫১

যাচ্ছিলাম সেগুনবাগিচা। রিকশাওয়ালার সিট কভারটা খুব চমৎকার। হাতে সেলাইকরা কাঁথা মোড়ানো। সুন্দর নকশা-টকশা করা। নর্মালি এররকম দেখা যায় না। শৈল্পিক একটা ব্যাপার। শুধু সিটকভার দেইখাই তার-সাথে কোন দামাদামি না কইরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইলিশনামা~ ১

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


১৯৮৫ সালে ডক্টর মোকাম্মেল হোসাইন ‘ ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে যেই রিসার্চ পেপারটা( থিসিস – এম এস এর জন্য) জমা দিয়েছিলেন সেটা এখানে মিলবে;
[link|https://open.library.ubc.ca/cIRcle/collections/ubctheses/831/items/1.0096089|Spawning times and early life history of... ...বাকিটুকু পড়ুন

৯০% মুসলমানের এই দেশ? ভারতে কতগুলো মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির করা হয়েছে? গতকালও ভারতে মসজিদের পক্ষে থাকায় ৩ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৪২

সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার | SAD

লিখেছেন আজব লিংকন, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৩



শীতকালীন সর্দি-কাশি, জ্বর, হাঁপানি, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, কনজাংকটিভাটিস, নিউমোনিয়া কিংবা খুশকি মতো কমন রোগের কথা আমরা জানি। উইন্টার ডিসঅর্ডার বা শীতকালীন হতাশা নামক রোগের কথা কখনো শুনেছেন? যে ডিসঅর্ডারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

চট্টগ্রাম আদালত চত্বরের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লিখছি

লিখেছেন শান্তনু চৌধুরী শান্তু, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:৪৮



আজ চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা নানান গুজব ও ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা এড়াতে প্রকৃত ঘটনাটি নিরপেক্ষভাবে একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লিখছি।

চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×