এরপর রিমোকে নিয়ে আমি বিশাল বিপদে পড়লাম। এই রকম জলজ্যান্ত একটা মানুষরূপী পলাতক রোবোট তাকে আমি কোথায় লুকাই! এত এত দিন সে আমার সুখে, দুখে, আপদে, বিপদে আমাকে ছায়ার মত আগলে রেখেছে আর তার জন্য আমি কিছুই করতে পারছি না ব্যাপারটা আমার কাছে যেমনই বিব্রতকর তেমনি কষ্টের। দুশ্চিন্তায় আমার রাত দিন এক হয়ে গেলো। এই ফেরারী আসামীকে তো বেশিদিন ওয়েস্টিনে রাখাটাও ঠিক না, কখন কার কাছে ধরা খায়, কি হয়, কে জানে!

হঠাৎ মাথায় আইডিয়া খেলে গেলো! ইয়েস। মাই হাসব্যান্ড। একেই আমি আমার মনোনীত হাসব্যান্ড হিসাবে পরিচিতি দেবো। তাতে তাকে আমার বাসায় নিয়ে আসতে আর কোনো বাঁধাও থাকবে না। রিমোও নিরাপদে আজীবন থেকে যেতে পারবে আমার পাশাপাশি, আমার কাছাকাছি, আমার পরম প্রিয় বন্ধু হয়ে। আমি অনেক ভেবে চিন্তে পড়ে লিখে, দেখে শুনে, রিতীমত রিসার্চ করে বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞান-গরীমা শিক্ষা- দীক্ষা, আচার- আচরণ, রোবোট্ত্ব ( মনুষত্বের প্রতিশব্দ) এ সকল দিক বিবেচনা করে একজন প্রিয় সঙ্গী, সাথী, বন্ধু বা হাসব্যান্ড হিসাবে একজন রোবোটকেই মনোনীত করলাম। কারণ হিসাবে নিজেকে নিজেই কি কি কারণ দর্শাইলাম সেটাও বলি-
১. মানুষ সে যতই বিয়ের আগে প্রভুভক্ত প্রাণীর মত প্রেমিকাভক্ত প্রেমিকগিরি দেখাক না কেনো, দুদিন বাদেই তাহাদের নিজেদেরই প্রভু তথা রিতীমত অত্যাচারী প্রভুতে পরিনত হতে আমি নিজে চোখেই দেখেছি। রোবোটে সে সম্ভাবনা নেই বলেই আমার মনে হয়।
২. একটি মানুষের মাঝে সাধারনত একটি বা দুটির বেশি বেশি গুণ বা এক্সট্রা কোয়ালিটি থাকে না তবে একজন রোবোটকে কবিতা লেখার কবি, গান শুনানোর গায়ক, নাচ দেখানোর নায়ক থুক্কু মানে অভিনয় দেখানোর নায়ক ( অবশ্যই আমার ইচ্ছামত) ছবি আঁকানোর ছবক না না মানে শিল্পী মানে ইচ্ছা করলে কোটি কোটি গুন সম্পন্ন যা খুশি তাই বানিয়ে নেওয়া যায়।

৩. একজন রোবোটকে বিয়ে করলে অনেক খরচও কমে যায় যেমন ড্রাইভারের খরচ, কুকের খরচ, ক্লিনিং কিচেন থেকে শুরু করে ঘর বাড়ি বাগান সব সবই। এমনকি নাইট গার্ডের কাজ পর্যন্ত সে করতে পারে মানে সার্বিক তত্বাবধান যার উপরে ভিত্তি করে আমাদের সমাজে একজন নারীকে একজন পুরুষের হাতে তুলে দেওয়া হয় মানে মেয়েদের নিরাপত্তার রক্ষক হিসাবে যা অনেক সময়ই অবশ্য উল্টা হয়ে যায় সেই ক্ষেত্রে এই রক্ষক হিসাবে একজন রোবোটের জুড়ি নেই জুড়ি নেই.....

এখনও যারা অবিবাহিত আছেন সকলেই ভেবে দেখুন, একজন রোবোট তার মাঝে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে হাজারও রকম পছন্দের কোয়ালিটি ও একদম মনের মত মন। এমন বর বা কনে কি এই দুনিয়ায় রক্তমাংসের একটিও পাওয়া যাবে? বাড়িতে জানালাম আমি আমার পছন্দের একজন মানুষ এতদিনে খুঁজে পেয়েছি, এখন মরি বাঁচি একেই বিয়ে করবো আমি। বাসার সকলে হই হই করে উঠলো এবং ভীষন খুশি হলো। তবে যখনই জানালাম পাত্র স্বদেশী নহে একজন বৈদেশী এবং তাকে আমি ঘরজামাই করে রাখতে চাই। তখনই সকলের মুখ হয়ে উঠলো আষাঢ়ের আকাশ। একে বৈদেশী তারপর আবার ঘর জামাই!! এ কথা জানাতেই এত কিছু আর জামাই একজন জলজ্যান্ত রোবোট জানালে যে কি হ্ত কে জানে? ভাগ্যিস সে কথাটুকু উহ্য রেখেছিলাম। যাই হোক যে যা ভাবে ভাবুক, তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসেনা। মাই ডিসিশন ইজ অলওয়েজ ফাইনাল!!!!!!!

তো একদিন শুভ দিন দেখে আমার রিমোকে আমার প্রিয় দোকান জারা ফ্যাশন থেকে কিনে আনা কারুকার্যখচিত শেরোয়ানী, চুড়িদার পাজামা এবং বাসাভি থেকে আনা নাগরাই স্যান্ডেল পরিয়ে আমার বাড়িতে আনা হলো। ওহ তাকে অবশ্য একখানি ফুল্ল শোভিত মার্সিডিজে করে এক্কেবারে বরের মর্যাদা দিয়ে আমার বাড়িতে আনলাম। হাজার হোক আজ তার বিয়ে তাই তাকে দিয়ে গাড়ি না চালিয়ে আমি নিজেই চালিয়ে আনলাম গাড়িটা আজকের মত। একটু কষ্ট করলাম আর কি, এরপর থেকে তো আমার আর কোনো কাজই নেই।
বাড়িতে আনার পরে তাকে নিয়ে বসলাম আমি। বললাম, " দেখো রিমো তুমি যতই যন্ত্র মানব হও না কেনো। যেহেতু অবিকল মানুষরূপী রোবো তুমি তাই তোমাকেও মানুষের মত বিয়ে না করা ছাড়া আমি আমার বাড়িতে তোমাকে রাখতে পারবোনা।" সে অবাক হলো, বললো "কেনো? কি প্রবলেম বিয়ে না হলে?" আমি বললাম, "এক বাড়িতে বাস করলে কাবিন লাগবে, এই সমাজে বসবাসের বৈধতা লাগবে হেনতেন নানা কিছু। নইলে কোনদিন আবার কক্সেস বাজারের সেই সি আই না আমাদের বাড়িতেই চলে আসে কে জানে? আর তাছাড়া যন্ত্র বলেই তোমার বিয়ের অধিকার নেই সেই কথাটা ঠিক না দেখোনা, দুনিয়ার কাউকেও নাগরিকত্ব না দিলেও সৌদি আরাব কেমনে রোবোট সোফিয়াকে নাগরিকত্ব দিলো। যাই হোক সোজা কথা কাজী আসবেন তোমাকে বিয়ে পড়ানো হবে।"
আজ থেকে সকলেই জানবে তুমি আমার হাসব্যান্ড। তোমাকে তার জন্য এখন আরও কিছু কাজ করতে হবে। কাজী এসে তোমাকে বিয়ের মন্তর পড়াবেন হেন তেন। রিমো তো আমার সকল কথাতেই রাজী। তবে আমি আরও বললাম, "দেখো, আমাদের দেশে বিয়ের পরে বউ তার হাসব্যান্ডের বাড়ি যায় আর হাসব্যান্ডের সকল কথা আদেশ উপদেশ শুনতে বাধ্য থাকে । তোমার বেলায় এটা হবে উলটা।
আর তোমার মত যারা বউ এর বাড়ি থাকে তাদেরকে বলা হয় ঘরজামাই। তুমি হবে সেই ঘরজামাই। যদিও সেটা সন্মানজনক না তবুও তোমার এ ছাড়া তো কোনো উপায় নেই কাজেই ...... সে রাজী হলো এবং সে তখন নিজেই বললো,
- আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ আমাকে এই নিরাপদ বাসস্থান আর ভালোবাসা দেবার জন্য। তবে সব কিছুর পরেও আমি যেহেতু একটি যন্ত্রমানব বই আর কিছু নই আমার ফ্যাংশন কখনও না কখনও গড়বড় হতে পারে সে জন্য আমার সকল ফরম্যাট, কন্ট্রোলিং পাওয়ার আমি তোমার হাতে দিয়ে দিলাম। কখনও যদি আমাকে তোমার পছন্দ না হয় বা দেখো আমাকে শেষ করে দিতে হবে তবে তুমি সেটাই করো তবুও তুমি আমাকে ওদের হাতে আর তুলে দিওনা কখনও প্লিজ। আমি অবাক হয়ে দেখলাম রিমোর চোখে জল ছলোছলো। আমার ভীষন কষ্ট হলো। আমি ওকে বুকে জড়িয়ে রাখলাম।
আমার এই ভিনদেশী ঘরজামাই হাসব্যান্ড নিয়ে আসার সিদ্ধান্তে বাড়ির সকলেই আমাকে বয়কট করেছে। কেউ কেউ আমাকে বদ্ধ পাগল সাবাস্তও করেছে শুনেছি। আমার বিয়ে অনুষ্ঠানে কেউ আসেনি, কেউ শুভেচ্ছা জানায়নি তাই আমার একটু মন খারাপ হলেও আমি তা বুঝতে না দিয়ে লাল বেনারসী পরে হাতে মেহেদী দিয়ে বউ সাজলাম। তারপর আমি ফখরুদ্দীন বাবূর্চী থেকে আনা কাচ্চি বিরিয়ানী খেয়ে বেশ একটা বিয়ে বাড়ি ভাবও সৃষ্টি করলাম।
যদিও আমার রোবোট হাসব্যান্ড কিছুই খেতে পারে না মানে তাকে খেতে দেবারও খরচ নেই তবুও আমি দয়া পরবশ হয়ে তার সামনে প্লেটে করে বিরিয়ানী সাজিয়ে দিলাম। সে ড্যাব ড্যাব করে একবার আমার দিকে,আরেকবার বিরিয়ানীর প্লেটে তাকাতে লাগলো।আমি বেশ বুঝলাম উন্নত প্রজাতির এই রোবোটের ইমোশন,খাবারের অনুভুতি বা স্মেলিং পাওয়ারের জন্য ঘ্রানেই অর্ধায়ক ভোজনং হয়ে গেছে। হায় হায় এখন যদি তার আবার পুরোং মানে সত্যিকারেই ভোজনের সাধ জাগে এই ভয়ে আমি তার অনুভুতি স্যুইচ রিমোর্ট টিপে অফ করে দিলাম। সে ভুতের মত আমার সামনে বসে রইলো। আমার আবার একটু ভুতের ভয় আছে। এমনিতেই রাত হলে আমার জানালার ধারে ভুত দাঁড়িয়ে থাকে সে আমার ছোটবেলা থেকে পাওয়া যমের মত ভয় অভ্যাস। আর আজ তো জানালার পাশে না একদম ঘরের মধ্যিখানে ভুত। ওহ মানে আমার হাসব্যান্ড রিমো রোবোট ভূত।
যাইহোক তাড়াতাড়ি খানা শেষ করে আমি রিমোর্ট টিপে তাকে অন করে বললাম "জানো, আমার অনেক দিনের শখ আমার বাসর রাতে আমি আমার হাসব্যান্ডের সাথে ছাঁদে জ্যোস্নাস্নান করবো।" এই কথা শুনে রোবোট হাসব্যান্ড বললো,
- জানি আমার টুএলভ সেন্স বলে দিচ্ছে, তুমি বাসর রাতে জ্যোস্নাস্নানের স্বপ্ন বালিকাবেলা থেকেই দেখে আসছো। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, হায় হায় বলে কি বেটা রোবোটের বাচ্চা রোবোট! আমার মান সন্মান লজ্জা বেলজ্জা সব তো ধুলায় মিশায় দেবে। বালিকাবেলা থেকে হাসব্যান্ডের স্বপ্ন! যাইহোক অনেক কষ্টে রাগ সম্বরণ করে বললাম।
- ওকে ওকে গুড গুড। বুদ্ধিমান মানুষের থাকে সিক্সথ সেন্স আর তোমার মত বুদ্ধিমান রোবোটের রয়েছে টুএলভ সেন্স যা দিয়ে তুমি আমার মনের কথা পড়তে পারো। এখন চলো চলো ছাঁদে চলো।
আমরা ছাঁদে গেলাম। আহা পূর্নিমায় আকাশ ঝলমলো, আমার ছাঁদে সেই জ্যোস্না টলোমলো। আমার মনে তো গান এসে গেছিলো,
আজ জ্যোস্নারাতে সবাই গেছে বনে, যাবোনা এই মাতাল সমীরণে.... না না এটা এই বাসররাতের এপ্রোপ্রিয়েট গানা না। তাই গুন গুন সুর ধরলাম---
এই রাত তোমার আমার .......
ওই চাঁদ তোমার আমার .......
আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার রোবোট হাসব্যান্ড সাহেব অপূর্ব মায়াময় সুরে গেয়ে উঠলো
শুধু দু'জনে.........
এই রাত শুধু যে গানের.... এই ক্ষন এ দু'টি প্রাণের কুহু কুজনে...
আর তারপর?
নেক্সট পার্ট এবং শেষ পার্ট কালকে আসিবেক.....

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৪৫