দেশের বাইরে আসলে, বিমানবন্দরে নামার পরপরই প্রথমেই যেই দুইটা ব্যাপারে সবাই ব্যাকুল হয়ে উঠে। তার একটা হচ্ছে ডলার ভাঙানো আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে দেশে রেখে আসা পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা। যোগাযোগের জন্য সিম কেনা। ভাইবারের ভরসায় আমি সিম কেনার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি না করলেও ডলার ভাঙানো অতিআবশ্যকীয়। ডলার ভাঙানোর জন্য্ যাওদ বা যাইদ এর উপরই ভরসা করতে হলে। তার কথা মতো বিমানবন্দের এক্সচেঞ্জ বুথ থেকেই একশ ডলার ভাঙালাম এবং পরেরদিন বুঝতে পারলাম শপ্রতি ডলারে পনের রিংগিট কম পেয়েছি। মন খারাপ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হলে না। লাঙ্কাউইতে আসার পর কারও মন খারাপ থাকতে পারে না। প্রকৃতি উজার করে তার সৌন্দর্য্য এখানে মেলে ধরেছে।
২০০৭ সালে ইউনেস্কো লাঙ্কাউইকে 'ওয়ার্ল্ড জিওপার্ক' হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। আন্দামান সাগরে বুকে ভাসমান ছোটবড় ১০৪টি দ্বীপের সমন্বয়েই এই লাঙ্কাউই। মূল দ্বীপটার আয়তন আয়তন প্রায় ২৫ বর্গকিলোমিটার। দ্বীপের দুই-তৃতীয়াংশই বন-আচ্ছাদিত পাহাড়, পর্বত ও প্রাকৃতিক গাছপালাবেষ্টিত। আমাদের ট্যুর গাইড প্রথমেই আমাদের নিয়ে গেল লাঙ্কাউই আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ডে।
এখানে প্রবেশ মূল্য মালয়দের জন্য ৩০ রিংগিট আর বিদেশীদের জন্য ৪০ রিংগিট। ট্যুর গাইড আমাদের ৩০ রিংগিটে আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ডে প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিল।
আমার ধারণা ছিল আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ডটা হবে সমুদ্রের নিচে। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। আশা করেছিল দেখবো যে হঠাৎ হাঙর এসে মাছ শিকার করছে। অক্টোপাস তার বর্ণ পরিবর্তন করে ফেলেছে। এখানকার আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ডটা তেমন নয়। সংগ্রহশালা প্রচুর। কিন্তু প্রত্যেকটা জলজ প্রাণীই আলাদা কাচের ঘরে সংরক্ষণ করা। অনেকটা চিড়িয়াখানা টাইপের। পার্থক্য এই যে এখানে সামুদ্রিক অনেক দুর্লভ প্রাণী আপনি সহজেই দেখতে পাবেন। সমুদ্রের নিচের অনেকপ্রাণীর সাথেই আপনি সেলফি তুলতে পারবেন। কিন্তু হাঙর, তিমি, জেলিফিস একই সাথে বসবাসের যে চিত্র আপনি এখানে পাবেন না। আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ডে ঘুরঘুর করতে করতে কখন যে চকলেট আর পারফিউমের দোকানে চলে এসেছি বুঝতেই পারলাম না। প্রথমে বুঝি নাই। পরে বুঝলাম এইটা এদের ব্যবসায়িক কৌশল। আপনি যেকোন দর্শণীয় স্থানে যান বা ফুটওভারে উঠেন, নামার সময় আপনাকে নামতে হবে চকলেটের দোকানের ভিতর দিয়ে। আর চকলেট বা সুভ্যনুরের দোকানের ভিতরে হাটতে হাটতে কখন যে আপনার হাতে শপিং ব্যাগ জমা হতে শুরু করেছে আর পকেট থেকে রিংগিট খরচ হতে শুরু করেছে আপনি বুঝবেনই না। তবে লাঙ্কাউই ডিউটি ফ্রি দ্বীপ। এইখানে বিশেষত অল্পখরচে খুবই ভালোমানের চকলেট কিনতে পারবেন।
শুরু করেছিলাম আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ড দিয়ে, কথা প্রসঙ্গে চকলেটে চলে এসেছি। দেখলেন তো, কিভাবে ওরা শপিঙে প্রভাবিত করে। মালয়েশিয়া শপিঙয়ের জন্য আমাদের আশেপাশের দেশের ভিতরে ভালো। বিয়ের বাজার, বিশেষ উৎসবে বিত্তশালীরা কেন মালয়েশিয়ায় যায় এখানে আসলেই বোঝা যায়। যাইহোক কেনাকাটার গল্প পরে হবে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলল। দুপুরের খাবারটা খেয়ে নি। আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ডের অপরপাশেই এক ভারতীয় রেস্তোরায় আমরা ঢুকলাম। ভাত, পাপড় ভাজা, মুরগী, ফিস ফ্রাই আর ডেজার্ট। এর ভিতরে ফিস ফ্রাইটা অসাধারণ ছিল। টাটকা সমুদ্রের মাছ ভাজা (নাম জানি না) । ওফ, অসাধারণ। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা এবার হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সেই গতকাল রাতে মালিন্দ এয়ারে কুয়ালালামপুরের উদ্দেশ্যে উড্ডয়ন করেছিলাম। মাঝরাতে কুয়ালালামপুরে নেমে তিনঘন্টা এয়ারপোর্টে ঝিমিয়ে সকালের মালিন্দ এয়ারের ফ্লাইটে লাঙ্কাউই। লাঙ্কাউইতে এসেই আমাদের ট্যুরের জন্য ভাড়া করা নির্দিষ্ট টুরিস্ট বাসে লাগেজ রেখেই এতক্ষনে ঘুরেফিরে এইমাত্র হোটেলে উঠলাম।
হোটেলের নাম বেলাভিস্টা। একটু পুরানো আমলের ঘরানায়। ১৪ একর জমির উপর বিশাল বড় হোটেল।
আজকের দিনটা আর আগামীকাল লাঙ্কাউইতে আছি। এত অল্পসময়ে সম্পূর্ণ দ্বীপটা ঘুরে দেখা সম্ভব না। তাই হাতে যতটুকু সময় আছে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলাম। রুমে এসে হাতমুখ ধুয়েই আমি আর আমার ভ্রমণ সঙ্গী মাসুম ভাই, জোহা ভাইকে নিয়ে লাঙ্কাউই ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের ট্যুর গাইড সন্ধ্যায় আসবেন। তাই এই সময়টা নিজেদের মতো করেই ঘুরতে হবে। হোটেলের লবি থেকে লাঙ্কাউই এর একটা ম্যাপ সংগ্রহ করলাম। মাসুম ভাই কোথাও ভ্রমণের আগেই সেই এলাক সম্পর্ক অল্প বিস্তর গবেষণা করে আসেন। তাই উনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা ঠিক করলাম প্রথমেই যাবো 'কিলিম কার্স্ট জিওফরেস্ট পার্ক' এ।
যতই সামনের দিকে এগোতে থাকি ততই রাস্তার দুইপাশের পাহাড় আমাদেরকে ঘিরে ধরে। লোকালয় ছেড়ে আমরা গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করতে থাকি। মাঝে মাঝে দুই একটা রিসোর্ট ছাড়া জনবসতির আর কোন চিহ্ন চোখে পড়ে না।
ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাদের যেখানে নামিয়ে দিলো তারপরে আর কোন রাস্তা নাই। রাস্তার বাম পাশে বেশ বড়সড় একটা হোটেল। সৈকতের পাশেই দুই একটা সুভ্যেনুর দোকান আর রেস্টুরেন্ট। ডানপাশে বোটের জেটি। পর্যটক আর স্থানীয়দের ধরে সবমিলিয়ে গোটা বিশেক মানুষের দেখা মিলল। আমাদের ভাড়া করা ক্যাবের বিল মেটানোর সময় খেয়াল করলাম তিনটা ট্যাক্সিক্যাব দাড়িয়ে আছে। তাই আমাদের ক্যাবটাকে পয়সা দিয়ে বসিয়ে না রেখে ছেড়ে দিলাম। সামনে নীল সমুদ্র ডাকছে। আমরা সমুদ্রের দিকে ছুটলাম। সমুদ্রের অসাধারণ সম্মোহনী শক্তি আছে। যাকে অগ্রাহ্য করা প্রায় অসম্ভব। জোহা একটু পিছিয়ে পড়লেও আমি আর মাসুম পাগলের মতো সমুদ্রে দিকে এগোতে থাকি। সমুদ্রের এক পাশে পাহাড়। সেই পাহাড়ের ওপর ওয়াচটাওয়ার। খুবই ইচ্ছা করছে সেই ওয়াচটাওয়ারে উঠতে। কিন্তু পাহাড়টা অনেক উচু। তারচেয়েও বড় ব্যাপার পাহাড়ে উঠতে হলে আমাকে সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে। আন্দামান সমুদ্রের বুক ফুড়ে পাহাড়টা সগর্বে দাড়িয়ে আছে।
আমরা মূল সড়কে এসে দেখি কোন গাড়ি নাই। অদূরে জেটির কাছে দুইটা প্রাইভেট কার দাড়িয়ে থাকতে দেখে ছুটলাম জেটির কাছে। কিন্তু সবগুলোয় রিজার্ভ।
একটা ঘটনা আমাদেরকে আরও বেশি প্রভাবিত করলো। হঠাৎ দুইটা মটরসাইকেল পিছন থেকে আমাদের পেরিয়ে একশ গজ সামনে দাড়িয়ে কাউকে যেন ডেকে কিছু একটা বলে চলে গেল। আমরা ওইজায়গায় যেতেই রাস্তার পাশ থেকে এক ট্যাক্সিড্রাইভার (পরনে ট্যাক্সিড্রাইভারের পোশাক) আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করলো, "ট্যাক্সি লাগবে কিনা?"। ঢাকা শহরের চোর-ছিনতাইকারীর সাথে থাকতে থাকতে আমাদের মন হয়ে গেছে সন্দেহপ্রবণ। দুইটা মটর সাইকেল, ক্যাবওয়ালার আগ্রহ দুই মিলিয়ে আমরা অন্যকিছু আচ করে নিলাম। তাই ক্যাব ড্রাইভারের আমন্ত্রণ প্রত্যক্ষাণ করে হাটতে থাকলাম এবং অবশেষে সেই কাঙ্খিত 'সিকিউরিটি পোস্ট' এ আমরা নিরাপদেই পৌছে গেলাম।
নিরাপত্তাকর্মী নেপালী। আমাদেরকে পেয়ে সে খুশিই হলো। আমাদের একটা ট্যাক্সি লাগবে শুনে সে চেচিয়ে কাউকে কী যেন বলল। আমাদের জানালো পাচমিনিটের ভিতর জানাচ্ছে। নিরাপত্তাকর্মীর কার সাথে কথা হচ্ছে আমরা তাকে দেখতে পাচ্ছি না। কারণ সে রাস্তার ডানপাশের ঢালুতে রাস্তা নেমে যেয়ে কিছুদূর যে বাক নিয়েছে, সেই বাকের ওপাশে দাড়িয়ে। বাকের আড়ালে দাড়ানো লোকটার হাতে নিশ্চয় ওয়ারলেস আছে। কারণ আমরা ওয়ারলেসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মূলত আমরা যেখানে দাড়িয়ে আছি এইটা একটা সংরক্ষিত এলাকা। আমাদের উপস্থিত থাকাকালীন সময়েই এক বিদেশী কুটনীতিকের গাড়ি বহর নিচের ঢালু থেকে উঠে এসে আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেল। টানজিঙ রুহ হচ্ছে কুটনীতিক, বড় ব্যবসায়ী, বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য নির্মিত রিসোর্ট। পয়সাওয়ালা ব্যক্তিরা নির্জনে সময় কাটানোর জন্য এখানে আসেন। আমরা সেই সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে বসে আছি। এদিকটাই সাধারণ পর্যটকরা খুব একটা আসে না। তাই ট্যাক্সিক্যাবের পরিমাণও কম। কিছুক্ষণ বাদে ওয়ারলেসওয়ালা খবর দিলো, হোটেলে একটা ট্যাক্সিক্যাব আছে। ওইটা আসতেছে। আমাদের কাছ থেকে ভাড়াটা নিশ্চিত করলো। ট্যাক্সি আসার পর আমি ব্যাপারটা ধরতে না পারলেও জোহা আর মাসুম ধরে ফেলল। এই সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার। কিছুক্ষণ আগে যার আমন্ত্রণ আমরা প্রত্যক্ষাণ করে এসেছি। ব্যাপারটা আমাদের কাছে এখন পরিষ্কার হলো। মটরসাইকেলের আরোহীরা আমাদের অসহায় অবস্থা বুঝতে পেরে সে ওই ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ডেকে আমাদেরকে গন্তব্যে পৌছে দিতে বলেছিল। কিন্তু আমরা ভেবেছিলাম অন্য কিছু। লাঙ্কাউইতে নিরাপত্তা নিয়ে খুব একটা সমস্যা নেই। পর্যটকরাই এদের রুটিরোজগারের মূল উৎস। তাই পর্যকদের নিরাপত্তা এরা নিজেরেই নিশ্চিত করে। বলছি কারণ, দুই দিনে আমি লাঙ্কাউইতে কোথায় কোন নিরাপত্তা কর্মী দেখতে পাইনি।
বিনা পয়সায় থ্রিলার নিয়ে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। আসার সময় ট্যাক্সিতে বসেই রক্তিম সূর্যকে আন্দমানের বুকে ডুবে যেতে দেখেছি। ট্যাক্সি থেকে যখন নামি ঘড়িতে স্থানীয় সময় সাড়ে সাত। নেমেই সুইমিংপুলের দিকটায় ছুটলাম। কারণ এখানে সূর্যাস্ত সাতটা পচিশে। (এত বড় দিন আমাদের জানা ছিল না) সূর্যের লাল আভা এখনও আকাশে ছড়িয়ে আছে। এই হোটেলের সুইমিংপুলে বসে সমুদ্র দেখা যায়। (কিন্তু সৈকত না থাকায় সমুদ্রে নামা যায় না।) মাসুম ভাই তার ট্রাইপডে ক্যামেরা সেট করলো। আমি মাটিতে শুয়ে ল্যান্ডস্কেপটা ক্যামেরার ফ্রেমে আনার চেষ্টা করলাম। চারপাশটা লাল। সমুদ্রের বুকে ইয়ট, দূরের সন্ধ্যা বাতি; অভাবনীয় দৃশ্য।
সূর্য ডুবে রাতের অন্ধকার নামার পরপরই আমাদের ট্যুর গাইড উপস্থিত। আমাদেরকে ট্যুরিস্ট বাসে উঠানো হলো। যেখানে রেস্টুরেন্টে খেতে যাবো সেইখানকার দূরত্ব বাসের হিসাবে ৪০-৫০মিনিট। জায়গাটার নাম পানটাই চেনাঙ (Pantai Chenang)। পানটাই চেনাঙই মূলত পর্যটক অধ্যুষিত এলাকা। এখানে প্রচুর হোটেল, বিভিন্নরকমের রেস্টুরেন্ট, শপিঙ মল রকমারী আলোয় ঝকমক করছে। লাইভ গান হচ্ছে, গিটারের টুঙটাঙ শব্দ ভাসছে, বিদেশী পর্যটকরা ঘুরছে, কেনাকাটা করছে, আড্ড দিচ্ছে, ফুর্তি করছে। রমরমা পরিবেশ। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, প্রচুর মানুষ আছে এখানে। আহ মানুষের কোলাহল কেন আমার এত ভালো লাগে?
রাত দশটার পরেই দ্বীপটা নিশ্চুপ হয়ে যায়। খাবারের দোকানগুলো বাদে বাকিসব বন্ধ হয়ে যায়। দ্বীপ জুড়েই শুনশান নিরবতা। আমাদের হোটেলে এই নিরবতা আরও একটু বেশিই। রাতে হোটেলটাকে অনেকটা হ্যারী পটারেরর যাদুর যাদুঘরের ভবনের মতো মনে হয়।
নির্জন রাস্তায় এলোমেলো ঘোরাঘোরি করে সেই ভবনের একটা কক্ষে ঘুমাতে গেলাম। আজ এই পর্যন্তই। আগামীকাল দিনব্যাপী কর্মসূচীতে ঠাসা। আজ একটু বিশ্রাম করি। শুভ রাত্রি
(চলবে..)
আমার লাঙ্কাউই ভ্রমণের গল্প (পর্ব-২)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১২:৫৯