অনেক দিন আগের কথা। ইমাম আজম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি তখন জীবিত। বাগদাদে একজন নাস্তিক বক্তা বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করে নানানসব কূযুক্তি ছড়িয়ে বেড়াতেন লোকসমাজে। মানুষজন তার কথা শুনে কেউ তাকে পাগল বলতো। কেউবা আবার তার শিষ্যত্ব গ্রহন করে নতুন দলে যোগ দিয়ে নতুন কিছুর স্বাদ নেয়ার চেষ্টা করতো। সুচতুর এই লোকটির সাথে যুক্তি তর্কে সচরাচর কেউই পেরে উঠতো না।
তখন বাগদাদের আকাশে বাতাসে আলোকোজ্জ্বল ধুমকেতুর ন্যায় ছড়িয়ে ইমাম আজমের নাম যশ। ধর্মীয় বিষয়ে তাঁর অসাধারন মেধা, অখন্ডনীয় যুক্তি, অতুলনীয় প্রজ্ঞার কথা বাগদাদ আর ইরাকের সীমানা ছাড়িয়ে আরব আজম, তথা মাশরিক মাগরিবে পরিবিস্তৃত।
নিজের জ্ঞান গরিমায় উল্লসিত উক্ত নাস্তিক ব্যক্তি একদিন লোকদের জড়ো করে বললেন, 'ডাকো তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বক্তাকে, আমি আজ তাকে পরাজিত করে প্রমান করে দেখাবো, সৃষ্টিকর্তা কিংবা আল্লাহ বলে কেউ নেই। এই পৃথিবীসহ সমস্ত বস্তুনিচয় নিজে থেকেই প্রাকৃতিকভাবেই সৃষ্টি হয়েছে। এর পেছনে স্রষ্টার ধারনা ভুল।'
ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির নিকট উক্ত নাস্তিকের সংবাদ জানানো হল। ইমাম আজমের সাথে তার বাহাস করার মনোবাসনাও অবহিত করা হল। ইমাম আজম সম্মতি দিলেন। দিন তারিখ নির্ধারন করা হল।
একপর্যায়ে অবশেষে এল বাহাসের নির্দিষ্ট সেই দিনটি। উম্মুক্ত প্রান্তর কানায় কানায় পূর্ন। লোকে লোকারন্য। দূর দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন মানুষেরা। বাহাস দেখতে। সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে বাহাস বলে কথা! সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে বাহাস! মানুষের যেন আগ্রহ আর উতসাহের শেষ নেই! সবাই খোশ মেজাজে টান টান উত্তেজনা নিয়ে নির্দিষ্ট মাঠে এসে সমবেত। নাস্তিকও এসে হাজির।
বাহাসের জন্য নির্ধারিত সময় শেষ। প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন তখনও উপস্থিত সবাই। সন্ধ্যা প্রায় ছুঁই ছুঁই। ইমাম আজমের খবর নেই।
মাঠভর্তি অপেক্ষমান লোকদের ধৈর্য্যে যেন আর কুলোয় না!
নাস্তিকের মুখে ব্যাঙাত্মক হাসি! লোকদের বলে ওঠেন তিনি, 'দেখ, সে যুক্তিতে পেরে উঠবে না ভেবে পালিয়ে গেছে।'
কিন্তু নাস্তিকের ঠোটের কোনের বিদ্রুপের হাসি ফুরোতে না ফুরোতেই ইমাম আজম এসে হাজির। দেরি হবার কারন হিসেবে নিজেই কৈফিয়ত দিয়ে জানালেন, 'দু:খিত, কিছুটা দেরি হওয়াতে! কিন্তু দেরিটা আমার অনিচ্ছায় হয়েছে! ঘটনা হচ্ছে, আমি রওনা সময়মতই হয়েছিলাম, কিন্তু নদী পার হওয়ার জন্য যখন নদীর তীরে আসলাম, সেখানে এক আজব ঘটনা দর্শনে একটু দেরি হয়ে গেল!'
নাস্তিক বললো, 'কী এমন ঘটনা দেখলেন, যা আপনার কাছে আজব মনে হল?'
ইমাম আজম বলেন, 'নদী পার হবার জন্য কিনারে এসে দাড়ালাম। মনে মনে নৌকা খুঁজছিলাম। কিন্তু কোনো নৌকার দেখা মিলছিল না। নদীর পাড়ে যেখানে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম তার পাশেই ছিল বিশাল এক বটবৃক্ষ। কোথাও কোনো লোকজনের চিহ্ন নেই। হঠাত দেখি, কোত্থেকে এক কড়াত, চলে এলো। বিশাল বট গাছটি মুহূর্তের মধ্যে কাটা হয়ে গেল। একের পর এক তক্তা বেড়িয়ে এলো সেই কাটা গাছ থেকে।'
এই পর্যন্ত বলে ইমাম আজম একটু থামলেন।
নাস্তিক ভ্রু কুঁচকে তাকালেন তাঁর দিকে। কী বলবেন, যেন তাল পাচ্ছেন না।
ইমাম আজম যোগ করলেন, 'একটু পরে দেখি, কোথা হতে পেরেকে এসে এসে তক্তাগুলো জোড়া লাগিয়ে একটি নৌকা বানিয়ে ফেলা হল। এরপর কোথা থেকে একটা বৈঠাও এলো। কোন মাঝি ছাড়াই নৌকাটি আমার দিকে ভেসে আসলো। আমি তাতে উঠে বসলাম। অতঃপর নৌকাটি নিজে থেকেই আমাকে এখানে নিয়ে আসলো। এতেই একটু যা দেরি।'
ঘটনা শুনে নাস্তিক হাসিতে লুটিয়ে পড়ে। লোকদের উদ্দেশ্যে বলল, 'এই বুঝি, তোমাদের শ্রেষ্ঠতম বক্তা? ভেবেছিলাম তার বোধ হয় স্ক্রু দু'য়েকটি ঢিলা! আসলে তো দেখছি, তিনি পুরোই লুজ!'
ইমাম আজম জিজ্ঞেশ করলেন, 'কেন? কি সমস্যা?'
নাস্তিক বলল, 'আপনি দাবি করেন, কোন কারিগর ছাড়াই আস্ত বটগাছ কেটে ফেলা হলো! গাছ ফেড়ে অটোমেটিক তক্তা বেরিয়ে এলো! কাঠের টুকরো একের সাথে আরেকটি লেগে নিজে নিজে নৌকা হয়ে গেল! আবার মাঝি ছাড়াই নিজে থেকেই আপনাকে নদী পার করে এখানে নিয়ে আসলো? এসব কি পাগলের প্রলাপ নয়?'
ইমাম হেসে উত্তর দিলেন, 'নদীর পাড়ের বট গাছ বিশাল এই সৃষ্টি জগতের অতি ক্ষুদ্র একটি সৃষ্টি! সামান্য এই গাছটি যদি কোনো কারিগর ছাড়া কাটা না যায়, একটি নৌকা নিজে থেকে তৈরি হয়ে যেতে না পারে, নিজেকে পরিচালিত করতে না পারে- এগুলো যদি আপনার কাছে পাগলের প্রলাপ মনে হয়, তাহলে বলুন, এই সমগ্র সৃষ্টিজগত, প্রাণীকুল, আকাশ-বাতাস, গ্রহ-নক্ষত্র, চাঁদ-সূর্যসহ তামাম কিছু নিজে থেকেই তৈরি হয়ে গেল? আর কারো সুনিপূন হাতের সুদক্ষ ইশারা ব্যতিতই এত সুন্দরভাবে সুপরিচালিত হয়ে আসছে?'
উত্তর শুনে নাস্তিকের জীবনের ভুল ভেঙ্গে গেল। ইমাম আজমের হাতে হাত রেখে জনাকীর্ন বাহাসের ময়দানে নাস্তিক বিমুগ্ধ অন্তরে পাঠ করে নিলেন বিশ্বাসের কালিমা, 'লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।'
সৌভাগ্যবান নাস্তিক বটে! হাজারো মানুষের সম্মিলনে জীবন পাল্টে নেয়া কি কম সৌভাগ্যের! ছিলেন নাস্তিক! এসেছিলেন বিশ্বাসের প্রদীপ নিভিয়ে দিতে! কিন্তু জগতের শ্রেষ্ঠতম ফকিহ আলেমে দ্বীন ইমাম আজমের পরশে বদলে গেলেন মুহূর্তেই! হয়ে গেলেন বিশ্বাসে পরিপূর্ন আলোর পথের অন্য মানুষ! ময়দানে সমবেত লোকদের দুআয় ধন্য হলো নাস্তিকের নতুন জীবন!
পড়ে দেখতে পারেন ইমাম আজম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে নিয়ে আমার অারও কিছু পোস্ট-
জ্ঞানের প্রজ্জ্বলিত মশালকে নিভিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা রুখে দিন
ইমাম আবূ হানীফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি: জাতির শ্রেষ্ঠতম মুহাদ্দিস, ফকীহ এবং আল্লাহওয়ালা
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৯ সকাল ৯:৩৪