মসজিদে নববীর খুঁটিগুলোর সৌন্দর্য্যের বর্ননা দেয়াও সম্ভব নয়। আহা! কী অসাধারন সুন্দর! কী অসম্ভব সৌন্দর্য্য! কী অপরূপ সৌকর্য্য! কী অদ্ভূত বিমোহিত রূপের বাহার! কী অভাবনীয় নান্দনিকতা! কী অনুপম সৌম্য দর্শন অবয়ব! কী অকল্পনীয় শিল্প নৈপূন্য! হ্যাঁ, আজকের আলো ঝলমলে মসজিদে নববীর কথা বলছি! আজকের এই সুরম্য ভবন তখন ছিল না! খেজুরের পত্র নির্মিত চাল অার খেজুর কান্ডের খুঁটির উপরে দন্ডায়মান সেই মসজিদের স্মৃতি মনে পড়ে যায় বারবার! তখনকার মসজিদের শান-শওকত কেমন ছিল! কেমন ছিল সেকালে প্রিয় নবীজীর উপস্থিতিতে এই মসজিদের অবয়ব! আহ! সেই সান্নিধ্য যদি আমাদের নসীব হত! আমরাও যদি হতে পারতাম তাঁর কালের! তাঁর সময়ের! তাঁর সাক্ষাতলাভে ধন্য-অনন্য!
মসজিদে নববীর ঐতিহাসিক কিছু খুঁটি:
ক্রন্দসী খুঁটি Ustuwaanah Hannanah (the weeping pillar):
প্রথম দিকে হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর গাছের একটি খাম্বার সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে জুমুআর দিনে খুতবা দিতেন। যখন মিম্বর বানানো হলো, তখন হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা বয়ান করতেন। তখন খেজুরের এই খাম্বা হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর বিচ্ছেদের কারণে এমনভাবে কান্না শুরু করে যে, পুরো মসজিদে সে আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে। এ দৃশ্য দর্শনে মসজিদে উপস্থিত সকল আসহাবে রাসূল স্তম্ভিত হয়ে যান। হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বর থেকে নেমে এসে খাম্বার গায়ে হাত বুলিয়ে তাকে শান্তনা দিলে সে শান্ত হয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ "গাছটি ক্রন্দন করে, কারণ, ইতিপূর্বে সে আল্লাহর জিকরের নিকটবর্তী ছিল, আর এখন যে মিম্বারটি তৈরি করা হয়েছে তাতে এই জিকর এর নিকটবর্তী হওয়া থেকে গাছটি বঞ্চিত হয়েছে। যদি আমি আমার হাতটি এর উপরে না রাখতাম, তবে এটি কিয়ামত দিবস পর্যন্ত কান্নাকাটি করত।" পরে সেই খাম্বাটিকে দাফন করা হয়। এটিকে বলা হয় ‘উস্তোয়ানা হান্নানা' বা 'ক্রন্দসী খুঁটি'। এটির আরেক নাম ‘উস্তোয়ানা মুখাল্লাক'।
নবীর বিচ্ছেদে কাঁদে খর্জ্জুরের মৃত খুঁটি কান্ড-শাাখা,
দুনিয়ার মহব্বতে আমাদের নবীপ্রেম পড়ে গেছে ঢাকা!
উস্তোয়ানা তাওবাহ Ustuwaanah Tawbah:
'উস্তোয়ানা তাওবাহ'র অপর নাম 'উস্তোয়ানা আবু লুবাবা'। প্রখ্যাত সাহাবী আবু লুবাবা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর তওবা কবুল হয় যেখানে, সেটি ‘উস্তোয়ানা আবুলুবাবা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু' হিসেবে পরিচিত।
ইসলাম গ্রহনের পূর্বে আবু লুবাবা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর বনু কুরাইযার ইহুদীদের সাথে সুসম্পর্ক ছিল এবং অনেক চুক্তি ছিল। যখন তারা খন্দকের যুদ্ধের সময় মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল এবং খন্দকের যুদ্ধ শেষে মুসলমানদের হাতে বন্দী হন তখন তার কাছে বনু কুরাইযার ইহুদিগন জানতে চেয়েছিলেন, তাদের সাথে কী ধরনের আচরন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে? তখন তিনি তাদের গলার দিকে ইশারা করে দেখিয়েছেন যে, তাদের হত্যা করা হবে।
তিনি শত্রুর কাছে মুসলমানদের গোপন সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন এবং মসজিদে যাওয়ার জন্য এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি মসজিদে নববীর একটি খেজুর গাছের খুঁটির নিকট এসে নিজেকে বেঁধে ফেলেন এবং বলেন:
"যতদিন আমার অনুতাপ আল্লাহ পাক কর্তৃক গ্রহণ করা না হয় ততদিন পর্যন্ত আমি এখান থেকে নিজেকে মুক্ত করব না। এবং নবী পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্যই আমার বন্ধন খুলে আমাকে মুক্ত করে দিবেন।''
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই কথা শুনে বললেন,
"যদি সে আমার কাছে আসে তবে আমি তার পক্ষে ক্ষমা প্রার্থনা করব। এখন তিনি নিজের উদ্যোগে এই কাজ করেছেন, তাই আমি তাঁর অনুতাপকে গ্রহণ না করা পর্যন্ত এই মুহূর্তে কীভাবে তাকে মুক্ত করতে পারি? "
উস্তোয়ানা আবু লুবাবা তাওবার অনন্য নিদর্শন,
এভাবেই করা চাই প্রভূতে নিজেকে পূর্ন সমর্পন।
কবুল হল আবু লুবাবাহ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর তাওবা
অনেক দিন ধরে তিনি খাদ্য ও পানীয় ছাড়া বাঁধা ছিলেন। প্রার্থনা এবং প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়া ব্যতিত তাকে ছাড়া হত না। তারপর এক সকালে, কয়েকদিন পরে, তিনি সুসংবাদ পেয়েছেন যে তাঁর তাওবাহ কবুল করা হয়েছে। সাহাবীগণ তাঁর কাছে খবর দিয়েছিলেন এবং তাঁকে বন্ধন খুলে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন:
"যতক্ষণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর অনুকম্পার হাতে আমার বন্ধন খুলে না দিবেন, আমি অন্য কাউকে তা করার অনুমতি দেব না।"
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ফজরের নামাজের জন্য প্রবেশ করলেন, তখন তিনি আবু লুবাবাহ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর বন্ধন খুলে দিলেন। এটি এমন এক স্থান যেখানে আবু লুবাবা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু নিজেই স্বেচ্ছায় তাওবাহ কবুল হওয়ার প্রত্যাশায় নিজেকে খুঁটির সাথে আবদ্ধ করেছিলেন।
এইখানে দাঁড়ায়েছি, হৃদয়ের কুঠুরিতে ক্ষমার আশায়,
বাঁধ ভাঙ্গা অশ্রুরা অগোচরে ছুটে আসে, নয়ন ভাসায়।
উস্তোয়ানা আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা
ইতিকাফের সময় হজরত মা আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা যে জায়গায় থেকে জানালার মধ্য দিয়ে নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর খেদমত করতেন, তা হচ্ছে ‘উস্তোয়ানা আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা।
জানালার ফাঁক গলে প্রিয় নবী - প্রিয় স্বামী - সেবায় ব্যাকুল,
উম্মত জননী মা আয়িশার ত্যাগে আজও মন হয় গো আকুল।
‘উস্তোয়ানা সারির’ Ustuwaanah Sareer:
আরবি 'সারির' শব্দের অর্থ খাট বা চৌকি। ইতিকাফের সময় রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর জন্য খাট-বিছানা যেখানে পাতা হতো, তা হচ্ছে ‘উস্তোয়ানা সারির’। এখানে আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাম করতেন।
ই'তিকাফে রত থেকে ইবাদাতে মশগুল শাফিয়ে উমাম,
কাষ্ঠ খাটে কদাচিত নিতে হত এইখানে সামান্য আরাম।
উস্তোয়ানা আলী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু Ustuwaanah Hars / ‘Ali (may Allah be pleased with him).
এটিকে উস্তোয়ানা হারস বলা হয়। অপর নাম উস্তোয়ানা আলী। হজরত আলী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু কিছু সংখ্যক সাহাবীকে সাথে নিয়ে যেখানে দাঁড়িয়ে নবীজিকে পাহারা দিতেন সে স্থানটিতে অবস্থিত খেজুর গাছের খুটিটি ‘উস্তোয়ানা আলী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু' নামে পরিচিত হয়।
যখন নিম্নের আয়াত নাজিল হয়, তখন নবী ﷺ তাঁর সাহাবীদেরকে বললেন যে, আল্লাহ পাক কর্তৃক রক্ষা করার প্রতিশ্রুতির কারনে তিনি আর পাহারাদারি রাখতে চান না।
".. এবং আল্লাহ আপনাকে মানুষের থেকে রক্ষা করবে .." সূরা আল Ma'idah, আয়াত 67
নবীপ্রেম তাজা হয় উস্তোয়ানা আলী দেখে আশিকের মনে,
প্রকৃত আশিকে রাসূল তো সে-ই, যার মুহাব্বত সুন্নতের সনে।
উস্তোয়ানা ওফুদ
‘উস্তোয়ানা ওফুদ’ হচ্ছে সেই স্থান, যেখানে বসে রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেশ-বিদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন।
রাসূলের স্মৃতির পরশে ভেজা উস্তোয়ানা অফূদের ছায়া,
হৃদয়ের বাগিচায় আজো আনে নবীপ্রেম নবীজীর মায়া।
উস্তোয়ানা তাহাজ্জুদ Ustuwaanah Tahajjud
এই স্থানে হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন। বর্তমানে এই স্থানটিতে বইয়ের আলমারি রাখা হয়েছে।
এইখানে কান্নাগুলো অশ্রু হতো তাহাজ্জুদের সুদীর্ঘ সালাতে,
উম্মতের নাজাতের তরে রোনাজারি নিশিতে রফিকে আলা'তে।
উস্তোয়ানা জিবরাইল Ustuwaanah Jibra’eel
যে খুঁটিটির পাশ দিয়ে জিবরাইল আলাইহিস সালাম হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাত করার জন্য আগমন করতেন সেটি 'উস্তোয়ানা জিবরাইল' নামে পরিচিত। এই খুঁটিটি রওজা শরিফের বাউন্ডারির ভেতরে পড়ে যাওয়ায় এখন আর এটিকে দেখার উপায় নেই।
এছাড়া কিছু খুঁটি রয়েছে যেগুলো হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময়কার মূল মসজিদে নববীর সীমানা নির্দেশক। এগুলোর গায়ে ইংরেজিতে ‘this is the Masjid of the Prophet ﷺ’ কথাটি লেখা থাকে। যার বাংলা 'এটি নবীজীর মসজিদ' ।
রাসূলের সময়ের মূল মসজিদে নববীর সীমানা চিহ্নিত খুঁটি,
আসুন, যিয়ারতে হারামাইন শরিফাইন পানে, যাই যাই ছুটি।
এই সিরিজের আগেকার পোস্টগুলো। ইচ্ছে করলে ঘুরে আসতে পারেন পেছনের পর্বগুলোয়-
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-২)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৩)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৪)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৫)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৬)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব৭)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৮)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৯)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১০)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১১)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১২)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১৩)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১৪)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১৫)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১৬)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১৭)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১৮)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১৯) ব্লগে দেড়শোতম পোস্ট
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-২০)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-২১)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-২২)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-২৩)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-২৪)
এই পর্বগুলো যারা নিয়মিত পড়ছেন। মন্তব্যে আসছেন। গুরুত্বপূর্ন পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। প্রেরনা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ায় উতসাহ দিচ্ছেন সকলকে হৃদয় নিংড়ানো শুভেচ্ছা। ভাল থাকুন নিরন্তর।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৯ সকাল ৯:২৪