পেছনের পর্বগুলো-
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-২)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৩)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৪)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৫)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৬)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব৭)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৮)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৯)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১০)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১১)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১২)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১৩)
কান্নার স্মৃতি বিজড়িত উহুদ প্রান্তর
উহুদের ময়দান পরিদর্শনকালে স্মৃতিতে ভেসে ওঠে হাজারও পূন্যস্মৃতি। তার কিয়দাংশ পূর্বের পর্বে দেয়া হয়েছিল। বাকি কিছুটা এখানে উপস্থাপন করা হল-
উহুদের আরও কিছু ঘটনা: হৃদয়স্পর্শী আলোচনা
হিজরী তৃতীয় সন। শাওয়াল মাস। কুরাইশ মুশরিকরা বদরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে মদীনার দিকে অগ্রসর হয়। মক্কা থেকে প্রায় সাড়ে চারশো' কিলোমিটারের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কুরাইশ বাহিনী মুসলমানদের নির্মূল করার অভিপ্রায়ে মদীনা নগরীর উপকন্ঠে মাত্র চার মাইল দূরে উহুদ প্রাঙ্গনে এসে উপনীত হয়। কুরাইশ বাহিনী উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে তাদের ছাউনী ফেলে। এতেই উপলব্ধি করা যায়, তাদের ভেতরে কী পরিমান ক্ষোভ ছিল। কতটা আক্রমনাত্মক অবস্থায় ছিল কুরাইশগন।
অপপ্রচারকারীদের কথা ভিত্তিহীন
যারা বলেন, মুসলিমরা যুদ্ধবাজ। যুদ্ধ, তরবারি, রক্তই তাদের নেশা। এরা ইতিহাসে অজ্ঞ অথবা জেনেও না জানার ভান ধরে থাকা জ্ঞানপাপী। সত্য ইতিহাস সচেতন প্রত্যেকের কাছেই উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে,
১। মক্কা থেকে নির্মমভাবে মুসলমানদের মদিনায় বিতাড়নের পরেও কুরাইশগন হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরছিল। তাদের কোনোভাবেই সহ্য হচ্ছিল না যে, মুসলমানগন সেখানে (মদিনায়) শান্তিতে বসবাস করুন। আর এই হিংসার অনলে জ্বলে পুড়ে মরতে মরতেই আবু জাহেলের নেতৃত্বে কুরাইশগন মদিনা আক্রমনের দু:সাহস নিয়ে প্রথম সম্মুখ সমরে অবতীর্ন হওয়ার বাসনায় মক্কা থেকে সুদূর বদর প্রান্তরে গিয়ে উপনীত হয়, মদিনা থেকে যার দূরত্ব ১৫১ কিলোমিটার। পক্ষান্তরে মক্কা থেকে এটি ৩৪৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে মুসলমানগন যখন দেখলেন, কুরাইশগন মদিনা আক্রমনের জন্য ধাবিত হচ্ছে, তারা আত্মরক্ষার তাগিদে, মদিনাকে শত্রুর আক্রমন থেকে রক্ষার প্রয়োজনে বদর প্রান্তরে গিয়ে উপনীত হতে বাধ্য হন। তারা যুদ্ধ করার জন্য নয়, শত্রুদের প্রতিহত করার মানসেই নিতান্ত প্রয়োজনবশত:ই এই যুদ্ধে মোকাবেলায় অংশ নেন। এই যুদ্ধটিকে কোনো মিথ্যাবাদী ব্যতিত মুসলমানদের উস্কানিতে এটি সংঘটিত হয়েছে, এমন কথা বলার কোনো সুযোগ নেই।
২। উহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৪৬৩ কিলোমিটারের অধিক পথ পাড়ি দিয়ে আসা মক্কার কুরাইশ বাহিনীর সাথে মদিনার মুসলমানদের। মদিনার উপকন্ঠে এসে মদিনা আক্রমনের ভয়াবহ মুহূর্তে মুসলমানগন হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হন। শত্রুদের হাত থেকে নিজেদের শহর, নারী শিশুদের রক্ষার তাগিদে, শত্রুদের প্রতিহত করার অনস্বীকার্য্য দায়িত্ববোধ তাদের উহুদের ময়দানে টেনে আনে।
৪৬৩ কি.মি পাড়ি দিয়ে আসা মক্কার কুরাইশ হানাদারদের দোষ না দিয়ে যারা বলেন, মদিনা থেকে মাত্র ৪ কি.মি দূরের উহুদে যাওয়াই মুসলমানদের যুদ্ধংদেহীর পরিচয় প্রকাশ করে, পৃথিবী তাদের অন্ধ কিংবা একচোখা আখ্যায়িত কেন করে না?
এখানেই সংগঠিত হয়েছিল উহুদের যুদ্ধ। ৬২৫ ঈসায়ী,২৩ মার্চ /৩ হিজরী,৭ শাওয়াল বদর যুদ্ধে পরাজয় ও অবমাননা ওবং নেতৃস্হানীয় ব্যাক্তিদের নিহত হওয়ার প্রতিশোধ নিতে কুরাইশরা যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হয়। তখন রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাত্র ১০০০ মুজাহিদ নিয়ে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হন। প্রথমে মুসলমানরা বিজয়ী হলেও পরবর্তীতে কৌশলগত স্হান ত্যাগ করার কারনে সাময়িক বিপর্যয় ঘটে মুসলিম শিবিরে। ফলে যুদ্ধটির জয় পরাজয় একরকম অমিমাংশিতই থেকে যায়। এতে ৭০ জন মুসলমান শহীদ হন এবং প্রতিপক্ষ কুরাইশদের ৩৭ জন অবিশ্বাসী নিহত হয়।
পাহাড়ের এ অংশ থেকে তীরন্দাজগন স্হান ত্যাগ করায় উহুদ যুদ্ধে দৃশ্যত মুসলমানদের বিপর্যয় নেমে আসে। সাথে শহীদদের কবর ও মসজিদ দেখা যাচ্ছে।
মুনাফিকদের দলত্যাগ
পথিমধ্যে মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনু উবাই তার অনুগত তিনশত লোক নিয়ে মুসলিম বাহিনী থেকে সরে পড়ে। মাত্র সাত শত যোদ্ধা নিয়ে আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন হাজার যোদ্ধার সম্মুখীন হন। এই অসম যুদ্ধে মুসলিমরা বীর বিক্রমে লড়াই করেন। সত্তর জন মুসলিম শহীদ হন। আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুরুতর আহত হন।
এই গুহায় রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহত হয়ে অবস্হান নেন।
জয় পরাজয় অনিশ্চিত রেখেই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি
এই যুদ্ধে কারোই চূড়ান্ত বিজয় হয়নি। তবে কুরাইশরা মদীনায় প্রবেশ না করেই ফিরে যায়। উহুদের যুদ্ধের পর মুমিনদের প্রশিক্ষণের জন্যে আল্লাহ পাক যেই বাণী পাঠান তার একাংশে বলা হয়-
وَلاَ تَهِنُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَنتُمُ الأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ
''আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মুমিন হও তবে, তোমরাই জয়ী হবে।'' [আলে ইমরান : ১৩৯]
إِن يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِّثْلُهُ وَتِلْكَ الأيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللّهُ الَّذِينَ آمَنُواْ وَيَتَّخِذَ مِنكُمْ شُهَدَاء وَاللّهُ لاَ يُحِبُّ الظَّالِمِينَ
''তোমরা যদি আহত হয়ে থাক, তবে তারাও তো তেমনি আহত হয়েছে। আর এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি। এভাবে আল্লাহ জানতে চান কারা ঈমানদার আর তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহীদ হিসাবে গ্রহণ করতে চান। আর আল্লাহ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না।'' [আলে ইমরান : ১৪০]
وَلِيُمَحِّصَ اللّهُ الَّذِينَ آمَنُواْ وَيَمْحَقَ الْكَافِرِينَ
''আর এ কারণে আল্লাহ ঈমানদারদেরকে পাক-সাফ করতে চান এবং কাফেরদেরকে ধবংস করে দিতে চান।'' [আলে ইমরান : ১৪১]
أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُواْ الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللّهُ الَّذِينَ جَاهَدُواْ مِنكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ
''তোমাদের কি ধারণা, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনও দেখেননি তোমাদের মধ্যে কারা জেহাদ করেছে এবং কারা ধৈর্য্যশীল।'' [আলে ইমরান : ১৪২]
উত্তরাধিকার আইন প্রবর্তন
উহুদ যুদ্ধে ৭০ জন মুসলিম শহীদ হন। ফলে তাদের পরিত্যক্ত জমিজমা ও অন্যান্য সম্পদ বন্টন সম্পর্কে ইসলামের পথ নির্দেশ জানার প্রয়োজন দেখা দেয়। সেই সময়টিতে আল্লাহ পাক উত্তরাধিকার আইন সংবলিত আয়াত নাযিল করেন-
يُوصِيكُمُ اللّهُ فِي أَوْلاَدِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الأُنثَيَيْنِ فَإِن كُنَّ نِسَاء فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِن كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ وَلأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِن كَانَ لَهُ وَلَدٌ فَإِن لَّمْ يَكُن لَّهُ وَلَدٌ وَوَرِثَهُ أَبَوَاهُ فَلأُمِّهِ الثُّلُثُ فَإِن كَانَ لَهُ إِخْوَةٌ فَلأُمِّهِ السُّدُسُ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِي بِهَا أَوْ دَيْنٍ آبَآؤُكُمْ وَأَبناؤُكُمْ لاَ تَدْرُونَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ لَكُمْ نَفْعاً فَرِيضَةً مِّنَ اللّهِ إِنَّ اللّهَ كَانَ عَلِيما حَكِيمًا
''আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেনঃ একজন পুরুষের অংশ দু?জন নারীর অংশের সমান। অতঃপর যদি শুধু নারীই হয় দু' এর অধিক, তবে তাদের জন্যে ঐ মালের তিন ভাগের দুই ভাগ যা ত্যাগ করে মরে এবং যদি একজনই হয়, তবে তার জন্যে অর্ধেক। মৃতের পিতা-মাতার মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্যে ত্যাজ্য সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ, যদি মৃতের পুত্র থাকে। যদি পুত্র না থাকে এবং পিতা-মাতাই ওয়ারিস হয়, তবে মাতা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ। অতঃপর যদি মৃতের কয়েকজন ভাই থাকে, তবে তার মাতা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ ওছিয়্যতের পর, যা করে মরেছে কিংবা ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের পিতা ও পুত্রের মধ্যে কে তোমাদের জন্যে অধিক উপকারী তোমরা জান না। এটা আল্লাহ কতৃক নির্ধারিত অংশ নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, রহস্যবিদ।'' [সূরা আন নিসা: ১১]
আল্লাহ পাক আরো বলেন,
وَلَكُمْ نِصْفُ مَا تَرَكَ أَزْوَاجُكُمْ إِن لَّمْ يَكُن لَّهُنَّ وَلَدٌ فَإِن كَانَ لَهُنَّ وَلَدٌ فَلَكُمُ الرُّبُعُ مِمَّا تَرَكْنَ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِينَ بِهَا أَوْ دَيْنٍ وَلَهُنَّ الرُّبُعُ مِمَّا تَرَكْتُمْ إِن لَّمْ يَكُن لَّكُمْ وَلَدٌ فَإِن كَانَ لَكُمْ وَلَدٌ فَلَهُنَّ الثُّمُنُ مِمَّا تَرَكْتُم مِّن بَعْدِ وَصِيَّةٍ تُوصُونَ بِهَا أَوْ دَيْنٍ وَإِن كَانَ رَجُلٌ يُورَثُ كَلاَلَةً أَو امْرَأَةٌ وَلَهُ أَخٌ أَوْ أُخْتٌ فَلِكُلِّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا السُّدُسُ فَإِن كَانُوَاْ أَكْثَرَ مِن ذَلِكَ فَهُمْ شُرَكَاء فِي الثُّلُثِ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصَى بِهَآ أَوْ دَيْنٍ غَيْرَ مُضَآرٍّ وَصِيَّةً مِّنَ اللّهِ وَاللّهُ عَلِيمٌ حَلِيمٌ
''আর, তোমাদের হবে অর্ধেক সম্পত্তি, যা ছেড়ে যায় তোমাদের স্ত্রীরা যদি তাদের কোন সন্তান না থাকে। যদি তাদের সন্তান থাকে, তবে তোমাদের হবে এক-চতুর্থাংশ ঐ সম্পত্তির, যা তারা ছেড়ে যায়; ওছিয়্যতের পর, যা তারা করে এবং ঋণ পরিশোধের পর। স্ত্রীদের জন্যে এক-চতুর্থাংশ হবে ঐ সম্পত্তির, যা তোমরা ছেড়ে যাও যদি তোমাদের কোন সন্তান না থাকে। আর যদি তোমাদের সন্তান থাকে, তবে তাদের জন্যে হবে ঐ সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ, যা তোমরা ছেড়ে যাও ওছিয়্যতের পর, যা তোমরা কর এবং ঋণ পরিশোধের পর। যে পুরুষের, ত্যাজ্য সম্পত্তি, তার যদি পিতা-পুত্র কিংবা স্ত্রী না থাকে এবং এই মৃতের এক ভাই কিংবা এক বোন থাকে, তবে উভয়ের প্রত্যেকে ছয়-ভাগের এক পাবে। আর যদি ততোধিক থাকে, তবে তারা এক তৃতীয়াংশ অংশীদার হবে ওছিয়্যতের পর, যা করা হয় অথবা ঋণের পর এমতাবস্থায় যে, অপরের ক্ষতি না করে। এ বিধান আল্লাহর। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সহনশীল।'' [সূরা আন নিসা: ১২]
আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদীনা রাষ্ট্রে এই উত্তরাধিকার আইন প্রবর্তন করেন।
উহুদের হৃদয় বিদারক আরও কিছু ঘটনা
উহুদের মাঠে কুরাইশ বাহিনীর হিংস্রতা ছিল অকল্পনীয়, অভাবনীয় এবং অমানবিক। তারা শাহাদাতপ্রাপ্ত মুসলিম বীরদের নাক, কান ইত্যাদি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কর্তনের মত নিকৃষ্ট কর্মে লিপ্ত হয়। হিন্দা বিনতি উতবাহ হামযাহ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর কলিজা ফেড়ে দেয় এবং তা মুখে নিয়ে চিবাতে থাকে। সে কাটা কান ও নাকের তোড়া ও হার বানিয়ে তা নিয়ে উল্লাস করে।
শহীদ ও আহতদের অনুসন্ধান
কুরাইশ বাহিনীর প্রত্যাবর্তনের পর মুসলিমগন তাদের শহীদ ও আহতদের খোঁজ খবর নেয়ার সুযোগ লাভ করেন। যাইদ ইবনু সাবিত রাদিআল্লাহু তাআ'লা বর্ননা করেন, 'উহুদের দিন রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে প্রেরন করেন যে, আমি যেন সা'দ বিন রাবী'র মৃত দেহ অনুসন্ধান করি'। তিনি আমাকে আরও বলেন, 'যদি তাঁকে জীবিত দেখতে পাও তবে তাঁকে আমার সালাম জানাবে এবং আমার কথা বলবে যে, সে নিজেকে কেমন দেখতে পাচ্ছে তা রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে চান।'
আমি তখন নিহতদের মধ্যে চক্কর দিতে দিতে তাঁর কাছে পৌঁছলাম। দেখি যে, তাঁর শেষ নি:শ্বাস আসা যাওয়া করছে। তিনি বর্শা, তরবারি ও তীরের সত্তুরেরও বেশি আঘাত পেয়েছিলেন। আমি তাঁকে বললাম, 'হে সা'দ! রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং আপনি নিজেকে কেমন পাচ্ছেন তা জানতে চেয়েছেন।'
তিনি উত্তরে বললেন, 'রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমার সালাম জানাবেন এবং তাঁকে বলবেন যে, আমি জান্নাতের সুগন্ধি পাচ্ছি। আর আপনি আমার কওম আনসারদের বলবেন যে, যদি তাদের একটি চক্ষুও নড়তে থাকে এবং এমতাবস্থায় শত্রু রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তবে আল্লাহ তাআ'লার নিকট তাদের কোনো ওযর চলবে না।' আর এ মুহূর্তেই তাঁর প্রানবায়ু বেরিয়ে যায়।
শহীদগনকে একত্রিতকরন ও দাফন
উহুদের যুদ্ধে শহীদগনকে দাফনের জন্য যখন একত্রিত করা হয় তখন রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও শহীদদেরকে পরিদর্শন করেন এবং বলেন,
''আনা আশহাদু আলা হা-উলায়ে ইন্নাহু মা- মিন যারি-হিন ইউযরাহু ফী- ছাবী-লিল্লাহি ইল্লা- অল্লা-হি বাআ'সাহু ইয়াওমাল ক্কিয়ামাতি ইয়াদমাল্লাউনু লাউনুদ্দামি অররী-হুল মিছক।''
''আমি এ লোকদের ব্যাপারে সাক্ষী থাকব। পৃকৃত ব্যাপার হচ্ছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে আহত হয়, আল্লাহ তাঁকে কিয়ামতের দিন এ অবস্থায় উঠাবেন যে, তাঁর ক্ষতস্থান দিয়ে রক্ত বইতে থাকবে। রঙ তো রক্তেরই হবে, কিন্তু সুগন্ধি হবে মিশকের মতো।''
শহীদদের বিনা গোসলে দাফনের নির্দেশ
কতিপয় সাহাবায়ে কিরাম তাদের শহীদদেরকে মদিনায় স্থানান্তরিত করেছিলেন। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে নির্দেশ দিলেন যে, তারা যেন শহীদদেরকে ফিরিয়ে এনে তাঁদের শাহাদাতের স্থানেই দাফন করেন। তিনি আরও নির্দেশ দেন যে, তাঁদের অস্ত্র শস্ত্র এবং চর্ম নির্মিত যুদ্ধের পোষাক যেন খুলে নেয়া না হয়। আর গোসল ছাড়াই যে অবস্থায় তাঁরা রয়েছেন সেই অবস্থাতেই যেন তাঁদেরকে দাফন করা হয়। তিনি দু'দুজনকে একই কাপড়ে জড়াতেন এবং দুই কিংবা তিন শহীদকে একই কবরে দাফন করতেন এবং প্রশ্ন করতেন,
''আইয়্যুহুম আকসারু আখজাল্লিল কুরআন?''
''এদের মধ্যে কুরআন কার বেশি মুখস্ত ছিল?''
সাহাবীগন যার দিকে ইশারা করতেন তাকেই তিনি কবরে আগে রাখতেন এবং বলতেন,
''আনা শাহী-দুন আ'লা হা-উলা-য়ি ইয়াওমাল কিয়ামাতি।''
''কিয়ামতের দিন আমি এ লোকদের ব্যাপারে সাক্ষ্যদান করবো।''
গাছী-লুল মালাইকাহ হানযালার মৃতদেহ অদৃশ্য ছিল
হানযালার মৃতদেহ অদৃশ্য ছিল। অনুসন্ধানের পর এক জায়গায় এমন অবস্থায় দেখা গেল যে, যমীন হতে তা উপরে রয়েছে এবং তাঁর লাশ হতে টপ্ টপ্ করে পানি পড়ছিল। এ দৃশ্য দেখে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কিরামকে জানালেন যে,
''ফিরিশতারা একে গোসল করিয়ে দিচ্ছেন।''
তখন রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
''ছালূ আহলাহু মা- শা'নুহূ?"
''তাঁর বিবিকে জিজ্ঞেস কর, প্রকৃত ব্যাপারটি কী ছিল?''
তাঁর বিবিকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তার প্রকৃত ঘটনাটি বলেন। এখান থেকেই হানযালা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু এর নাম 'গাছী-লুল মালাইকাহ' (ফিরিশতাগন কর্তৃক গোসলপ্রাপ্ত) হয়ে যায়।
রাসূলে পাক রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কান্না
ইবনে মাসউদ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বর্ননা করেছেন, ''রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হামযাহ ইবনে আবদিল মুত্তালিবের জন্য যেভাবে কেঁদেছেন তার চেয়ে বেশি কাঁদতে আমরা তাঁকে কখনো দেখিনি। তিনি তাঁকে কিবলাহ মুখী করে রাখেন। অত:পর তাঁর জানাযায় দাঁড়িয়ে তিনি এমনভাবে ক্রন্দন করেন যে, শব্দ উঁচু হয়ে যায়।''
প্রকৃতপক্ষে শহীদদের দৃশ্য ছিল অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। খাব্বাব ইবনু আরত বলেন, ''হামযাহ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু এর জন্য কালো প্রান্তবিশিষ্ট একটি চাদর ছাড়া কোনো কাফন পাওয়া যায়নি। ঐ চাদর দ্বারা মাথা আবৃত করলে পা খোলা থেকে যেত এবং পা আবৃত করলে মাথা খোলা থেকে যেত। অবশেষে মাথা ঢেকে দেয়া হয় এবং পায়ের উপর ইযখির ঘাস চাপিয়ে দেয়া হয়।''
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৯ সকাল ৯:০৯