পেছনের পর্বগুলোতে যেতে-
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-২)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৩)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৪)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৫)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৬)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব৭)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৮)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-৯)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১০)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১১)
বাইতুল্লাহর মুসাফির (পর্ব-১২)
রাতের আলো ঝলমলে উহুদ পাহাড়
পূন্যভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনার পথে
মক্কাতুল মুকাররমাহর মায়া কাটিয়ে, প্রিয় বাইতুল্লাহর ছায়া ছেড়ে বেদনাহত হৃদয়ে, অশ্রুসিক্ত নয়নে অবশেষে বিদায়, আল বিদা জানাই প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রিয় জন্মভূমি মক্কাহ মুআজ্জমাহকে। দুরু দুরু অন্তরে পা বাড়াই প্রিয় নবীজীর শহর মদিনার পানে। আমাদের সফর কত আয়েশের! মদিনা মুনাওওয়ারাহর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে বাসে উঠে বসেছি। আলহামদুলিল্লাহ! কী আরামদায়ক সফর! কত শান্তি- প্রশান্তি আর আয়েশের সফর! এসি বাসের ইজি চেয়ারে বসে আছি! মনের মুকুরে কত আনন্দ বেদনার স্মৃতিদের অবাক যাতায়াত! কত প্রেম-ব্যথার কাব্যগাঁথা রচনা করে চলে চির অচেনা এই মন! শরীর বেধে রাখা যায়, অবয়ব আটকে রাখা সম্ভব; মন তো কোনো বন্ধন মানে না, তাকে তো আর আটকে রাখার উপায় নেই। তাই ভাবনারা হারিয়ে যায়! ভাবগুলো জেগে ওঠে! স্মৃতির আলো-আঁধারীর অর্গল খুলে গেছে! আমি ভাসছি! আমি ডুবছি! আমি সন্তরন-কোলাহল-নৃত্য করছি! আমি অবাক-আশ্চর্য্য-হতবাক হচ্ছি! আমি হাসছি! আমি কাঁদছি! আহ্! এ তো চির চেনা সেই প্রিয় পথ, যে পথে মক্কা ছেড়েছিলেন প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এই পথেই তো প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে মদিনার পথে হিজরত করেছিলেন প্রিয় নবীজী! তপ্ত মরুভূমির অধিকতর তপ্ত কঙ্করাকীর্ন পাহাড়ি পথে তিনি চলেছিলেন সঙ্গী আবু বকরকে নিয়ে! কখনো পদব্রজে! আবার কখনো উটের পিঠে! আহ্! কতটা কষ্টের ছিল প্রিয় নবীজীর মহিমান্বিত সেই সফর! খাদ্য নেই খাবার নেই! পানি নেই পানীয় নেই! আহ্! ক্ষুধা পিপাসায় কাতর বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মানব আর তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গী সিদ্দীকে আকবার! পথ চলছেন আনমনে! দীর্ঘ দীঘল সফর! মক্কা থেকে সুদূর মদিনা! সাড়ে চারশো' কিলোমিটারের সুদীর্ঘ পর্বতময় কন্টকাকীর্ন পথ! কতটা রৌদ্রে দগ্ধ হয়েছিলেন তারা! কতটা ক্লেশে বিধ্বস্ত হয়েছিল প্রিয় নবীজীর কোমল শরীর মোবারক! রোদে পোড়া সেই সফরের সাথে আজকের আমাদের এসি বাসের সফরের পার্থক্য খুঁজে হয়রান হই! আবেশে আকুল ব্যাকুল অন্তপ্রান হই! মনের গহীন থেকে উথলে ওঠে না বলা কথামালাগুলো! ব্যথা-বেদনারা হাহাকার করে ওঠে প্রিয়তমের প্রিয় স্মৃতি স্মরন করে!
উহুদ প্রান্তর
ঐতিহাসিক হিজরত
২৭ শে সফর নবুয়তের চতুর্দশ সনের ১২ কিংবা ১৩ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যরাতের সামান্য কিছু সময় পর নিজ গৃহ থেকে বের হয়ে সর্বাধিক বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য সঙ্গী আবূ বকর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর গৃহে গমন করেন প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সেখান থেকে একত্রে দু'জন পথচলা শুরু করেন মদিনার পানে। গারে সাওরে গিয়ে আশ্রয় নেন তারা। তিন রাত (যথাক্রমে শুক্র, শনি ও রবিবার) সেখানে অবস্থানের পর পুনরায় ১৬ ই সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনার পথে যাত্রা করেন তারা।
কুবায় আগমন
দীর্ঘ পথচলার পরে ২৩ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ, মোতাবেক ৮ ই রবিউল আউয়াল নবুয়তের ১৪ তম বর্ষে প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আবূ বকর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু কুবা নগরীতে উপনীত হন।
কুবা নগরীতে চার দিন অবস্থান এবং ইসলামের ইতিহাসে প্রথম জুমুআর সালাত
আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুবাতে চার দিন (সোম, মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার) অবস্থান করেন। এখানে তিনি ইসলামের সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মান করেন। যার নাম মসজিদে কুবা। এখানেই আদায় করেন সর্বপ্রথম জুমুআর সালাত। চার দিন কুবা নগরীতে অবস্থানের পর অবশেষে প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবেশ করেন মদিনাতুল মুনাওওয়ারায়। মক্কা থেকে রওনা হওয়ার পর থেকে মদিনায় পৌঁছতে তার সব মিলিয়ে সময় লাগে প্রায় ১৪ দিনের মত।
জান্নাতুল বাকীতে অবস্থিত তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান ইবনে আফফান রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর কবর
উহুদের প্রাঙ্গনে: বাঁধভাঙ্গা কান্নাদের থামাতে পারিনি সেদিন
কত স্মৃতির প্রত্যক্ষদর্শী প্রিয় উহুদের প্রান্তর। এখানেই দান্দান মোবারক শহীদ হয় রাসূলে আরাবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর। শত্রুর বর্শার আঘাতে তাঁর শিরস্ত্রান কেটে মস্তকে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে রক্তাক্ত জখম হন তিনি। প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ''এই উহুদ আমাকে ভালবাসে। আর উহুদকেও আমি ভালবাসি। কার এমন সাধ্য, এখানে গিয়ে দু'ফোটা অশ্রু না ঝড়িয়ে ফিরে আসে!''
বাসর রাতের মায়া কাটিয়ে প্রত্যুষে এখানেই ছুটে এসেছিলেন হযরত হানযালা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু। বীরের মত লড়ে অবশেষে প্রান বিসর্জন দেন ইসলামের মহিমাকে সমুন্নত করার জন্য।
এখানেই শুয়ে আছেন প্রিয় নবীজীর পিতৃব্য বীরকেশরী আসাদুল্লাহি ওয়া আসাদু রসূলিহী হযরত হামযা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু। অসাধারন বীরত্ব আর অভাবনীয় রননৈপূন্যের একপর্যায়ে তিনিও পান করেন শাহাদাতের পেয়ালা। আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয় চাচার ইন্তেকালে এখানে অশ্রুসজল নেত্রে আল্লাহর দরবারে দুআ করেছিলেন।
উহুদের এই প্রান্তরে অশ্রু ঝড়াতে হয় না। হামযা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর কবরের পাশে যখন দাড়াবেন, হাজারো স্মৃতির ধারক বাহক উহুদের পাহাড়গুলো যখন দেখবেন, আপনার চোখ এমনিতেই অশ্রুসজল হয়ে উঠবে।
আল্লাহ পাক তাঁর অভিমুখী প্রত্যেক ইচ্ছুক বান্দা বান্দীকে এই প্রিয় স্মৃতিগুলো প্রত্যক্ষ করার তাওফিক দান করুন।
নয়নাভিরাম মসজিদে কুবা
উহুদ যুদ্ধ চলাকালীন ঈমানদিপ্ত কিছু কাহিনী
উহুদ যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন এক ঘটনা। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনে সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তের মাঝে এই উহুদ যুদ্ধ একটি। সীরাতে ইবনে হিশাম থেকে শুরু করে সকল প্রাচীন সীরাত ও হাদীসের গ্রন্থগুলিতে উহুদ যুদ্ধের কাহিনী খুব গুরুত্ব সহকারে বর্ণিত হয়েছে। বক্ষমান বর্ননায় সীরাতের বিখ্যাত গ্রন্থ সীরাতে ইবনে হিসাম এবং আল্লামা ইদ্রীস কান্ধলভী রহ. লিখিত সীরাতুল মোস্তফা সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আর রাহিকুল মাখতূম, এবং মিশকাত শরীফ থেকে উহুদ যুদ্ধের কিছু ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশা-আল্লাহ।
রাসূলের নির্দেশ অমান্য করায় দৃশ্যত বিজয় পর্যবসিত হল বিপদসংকূল ঘনঘটায়
উহুদ যুদ্ধের প্রথম দিকে মুসলমানদের বিজয় সূচিত হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম তীরন্দাজগন যখন ভাবেন যে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে তাই তাদের নির্ধারিত জায়গা ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধের ময়দান পরিত্যাগ করা শুরু করলেন তখন ওঁত পেতে থাকা শত্রুগন পাল্টা আক্রমন করে। এমনকি কাফেররা রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনেক নিকটবর্তী হয়ে পড়ে।
৭ জনই শহীদ হয়ে যান
যাই হোক, তখন একপর্যায়ে বিপদাপন্ন আল্লাহর রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কে আছ যে কাফেরদেরকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে দিবে এবং জান্নাতে আমার বন্ধু হবে? তখন ৭ জন আনসার সাহাবী রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এলেন। একে একে তাঁদের ৭ জনই শহীদ হয়ে যান।
আপন ভাইকে হত্যা করার জন্য আগ্রহী
সাহাবী সা'দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর কাফের ভাই উতবা ইবনে আবু ওয়াক্কাস সুযোগ বুঝে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি পাথর নিক্ষেপ করে। এতে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ঠোট মোবারক কেটে যায় এবং নিচের পাটির একটি দাঁত পড়ে যায়। তাঁর আহত কাটা ঠোট থেকে রক্ত ঝড়ে পড়তে শুরু করে। এ দৃশ্যের নির্মমতা প্রসঙ্গে পরবর্তীতে সা'দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রাঃ বলেন, তখন আমি আমার আপন ভাইকে হত্যা করার জন্য যতটা আগ্রহী ও উৎসাহী হয়ে পড়ি, জীবনে আর কখনো কাঊকে হত্যা করার জন্য এতটা আগ্রহী বা উৎসাহিত হয়নি।
হাজারো স্মৃতির ধারক উহুদ পাহাড়
হে আল্লাহ আমার কওমকে ক্ষমা করুন, কেননা তারা জানে না
কুরাইশদের পাথরের আঘাতে যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুখমন্ডল থেকে রক্ত পড়তে থাকে, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছিলেন, হে আল্লাহ আমার কওমকে ক্ষমা করুন, কেননা তারা জানে না।
তোমাকে জাহান্নামের আগুন কখনই স্পর্শ করবে না
সাহাবী মালিক ইবনে সিনান রাঃ নিজের মুখ দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুখমন্ডলের ক্ষতস্থান থেকে সমস্ত রক্ত চুষে উনার মুখমন্ডল পরিস্কার করে দেন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেন, তোমাকে জাহান্নামের আগুন কখনই স্পর্শ করবে না।
হাস্যোজ্জ্বল দাঁত দিয়ে পুনরুত্থিত করবেন
কুরাইশদের বিখ্যাত পালোয়ান ইবনে কুমাইয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এত জোরে আঘাত করে যে, বর্মের ২ টি লৌহ খন্ড আল্লাহর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাথার ভিতরে ঢুকে যায়। হযরত আবু উবাইদা ইবনে জাররাহ রাঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুখ থেকে লৌহ দন্ডগুলো বের করতে যেয়ে তাঁর নিজের দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে এমন জোরে টান দেন যে এতে তাঁর ২ টি দাঁত ভেঙ্গে যায়। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ পাক তোমাকে হাস্যোজ্জ্বল দাঁত দিয়ে পুনরুত্থিত করবেন।
তালহা নিজের জন্য জান্নাত ওয়াজিব করে নিয়েছে
যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাহাড়ের উপর উঠতে মনস্থ করলেন কিন্তু নিজের শারীরিক দূর্বলতার জন্য পাহাড়ের উপরে উঠতে পারছিলেন না, তখন তালহা রাঃ বসে পড়েন এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পিঠে পা রেখে পাহাড়ে আরোহন করেন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তালহা নিজের জন্য জান্নাত ওয়াজিব করে নিয়েছে।
তালহা রাঃ এর হাতের সবগুলো আঙুল কেটে যায়
কাফেরদের আক্রমন প্রতিহত করার সময় তালহা রাঃ এর হাতের সবগুলো আঙুল কেটে যায়। তখন তিনি অবলীলায় বলে উঠেন, হাসান! হাসান! উত্তম হয়েছে! উত্তম হয়েছে! তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তালহাকে বলেন, তুমি যদি তখন হাসান না বলে বিসমিল্লাহ বলতে, তাহলে ফেরেশতারা তোমাকে উঠিয়ে নিয়ে যেত এবং কাফেররা তোমার দিকে তাকিয়ে থাকত। এমনকি ফেরেশতারা তোমাকে নিয়ে আসমানে প্রবেশ করত।
যে ব্যক্তি শহীদকে জীবিত অবস্থায় পৃথিবীতে চলাফেরা করতে দেখতে চায়, সে যেন তালহাকে দেখে
কায়স ইবনে হাযম রাঃ বলেন আমি তালহার ঐ হাত দেখেছি, যা দিয়ে তিনি উহুদ যুদ্ধে কাফেরদের আক্রমন প্রতিহত করেছেন, তা ছিল সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্থের মত। হযরত আবু বকর রাঃ বলেন, উহুদ যুদ্ধের দিন তালহার শরীরে ৭০ টির বেশি জখম আমরা পেয়েছি। ঐ দিনের পুরোটাই ছিল তালহার জন্য। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উহুদ যুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠলেই বলতেন, যে ব্যক্তি শহীদকে জীবিত অবস্থায় পৃথিবীতে চলাফেরা করতে দেখতে চায়, সে যেন তালহাকে দেখে।
রাতের অনন্য সুন্দর মসজিদে নববী প্রাঙ্গন-১
মানব বর্ম আবূ দুজানা
কাফেররা যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি বৃষ্টির মত তীর ছোড়া শুরু করে, তখন সাহাবী আবু দুজানা রাঃ মানব বর্ম হিসাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সামনে দাঁড়িয়ে যান। কিন্তু এই চরম মূহুর্তেও ঐ সাহাবী রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি বেয়াদবী হবে ভেবে উনার পিঠ রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুখের সামনে না এনে উনার মুখ রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সামনে রাখেন আর উনার পিঠ কাফেরদের সামনে দিয়ে কাফেরদের তীর ও বর্শার আঘাত সহ্য করে যাচ্ছিলেন। সুবহানাল্লাহ! দেখুন, সাহাবীরা রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সম্মানের প্রতি কি রকম লক্ষ্য রাখতেন।
আবু দুজানার পিঠ চালুনির মত হয়ে যায়
কাফেরদের তীর ও বর্শার আঘাতে সাহাবী আবু দুজানার পিঠ চালুনির মত হয়ে যায়। উনি ঐ ময়দানেই শহীদ হয়ে যান। ঠিক এরকমভাবে সাহাবী কাতাদা ইবনে নুমান রাঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রক্ষা করতে যেয়ে তার চোখে কাফেরদের তীর বিদ্ধ হয়ে চোখের মনি বের হয়ে আসে। ঐ চোখের মনি সাহাবী কাতাদা রাঃ নিজ হাতে ধরে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে নিয়ে আসেন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার চোখের মনিটিকে চোখের যথাস্থানে রেখে দিলেন। তৎক্ষনাৎ কাতাদা রাঃ এর চোখ আগের চেয়েও সম্পুর্ণ সুস্থ ও জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে।
রাসূলের প্রিয় দক্ষ তীরন্দাজ সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস
হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রাঃ ছিলেন দক্ষ তীরন্দাজ। উহুদের দিন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক একটি তীর সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রাঃ এর হাতে তুলে দিতে থাকেন আর বলেন, তোমার প্রতি আমার পিতা মাতা উৎসর্গ হোক। হযরত আলী রাঃ বলেন, সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস ছাড়া আর কারো জন্য আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার পিতামাতাকে উৎসর্গ করতে শুনিনি।
শুহাদায়ে উহুদের কবরগাহ। আল্লাহু আকবার! এখানেই শুয়ে আছেন সাইয়্যিদুশশুহাদা' বীরকেশরী, আসাদুল্লাহি ওয়া আসাদু রাসূলিহী নবীজীর পরম শ্রদ্ধেয় পিতৃব্য আমির হামযা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুসহ উহুদের দিন শাহাদাতের অনন্য মর্যাদা অর্জনকারী সত্তুর জন সাহাবী। আল্লাহ পাক তাদের কবরগুলোকে জান্নাতুল ফিরদাউসের মর্যাদায় ভূষিত করুন।
উহুদ পাহাড় আজো অশ্রু ঝরায়
মদিনা নগরীর উত্তর দিকজুড়ে বিস্তৃত বিখ্যাত উহুদ পাহাড়। মাথা উঁচু করে থাকা উহুদকে মদিনা শহর থেকেই দেখা যায়। এই সেই বিখ্যাত পাহাড়, যার পাদদেশে মক্কার কাফেরদের সাথে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। উহুদ পাহাড় নিয়ে হাদিসে রয়েছে অনেক বর্ণনা। উহুদের যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সরাসরি নিজে অংশ নেন। মুসলিম বাহিনীর দৃশ্যত: বিজয়ের প্রায় শেষ লগ্নে এখানেই সূচিত হয়েছিল মর্মন্তুদ ঘটনা। ৭০ জন মুসলিম বীর এই যুদ্ধে শহীদ হন। শহীদ হন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পিতৃব্য সাইয়্যেদুশ শুহাদা হজরত হামজা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই যুদ্ধে গুরুতরভাবে আহত হন। উহুদ যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত কবরস্থান জিয়ারত করেন মদিনায় আগত প্রায় প্রত্যেক মুসলমানই। কাঁকর বিছানো শুহাদায়ে উহুদের কবরস্থান রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও যিয়ারাত করেছেন।
উহুদের যুদ্ধের কঠিনতম দিন
মদিনায় পৌঁছার পরে এক সুন্দর দিনে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় উহুদের পাদদেশে। এলাকাটি এখন প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। মূল পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট আকারের আরেকটি পাহাড়ের চূড়া। এর নাম রুমান পাহাড়। এই পাহাড়ের উপরই রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ৪০ জন সাহাবিকে একটি সঙ্কীর্ণ গিরিপথ প্রহরায় নিয়োজিত রেখেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন তীরন্দাজ বাহিনীও। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিয়েছিলেন, কোনো অবস্থাতেই তারা যেন এই প্রহরা থেকে সরে না যান। এমনকি সম্মুখের বাহিনীর গোশত ছিঁড়ে খাওয়া দেখলেও তারা যেন এখানকার প্রতিরক্ষাকার্যক্রম থেকে নিবৃত্ত না হন। যুদ্ধের প্রথম দিকে কাফের বাহিনী পিছু হটতে থাকে। প্রবল বিক্রমে এগিয়ে যেতে থাকেন রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আত্মত্যাগী সাহাবিগন। সঙ্কীর্ণ গিরিপথ প্রহরার দায়িত্ব ছিল আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের নেতৃত্বে একদল সেনার উপর। যুদ্ধে মুশরিকদের পরাজয় প্রত্যক্ষ করে তারা আর স্থির থাকতে পারেননি। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কঠোর নির্দেশ উপেক্ষা করেন তারা। ঐতিহাসিকদের মতে, আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের তাঁর সাথে থাকা প্রহরারত বাহিনীকে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা নিষেধ উপেক্ষা করে পলায়নপর মুশরিকদের পিছু ধাওয়া করেন এবং নিজেদের অবস্থান ছেড়ে দেন। দূর থেকে খালিদ বিন ওয়ালিদ তা দেখে অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে সঙ্কীর্ণ গিরিপথ অতিক্রম করে পেছন থেকে মুসলিম বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে যুদ্ধের গতিপথ হঠাত পাল্টে যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বর্ম ভেদ করে তাঁর পবিত্র শরীরে তীর বিদ্ধ হয়। সাহাবিরা রা: রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঘিরে মানববর্ম তৈরি করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দান্দান মোবারক শহীদ হয় এ যুদ্ধে। হজরত আবু বকর রা: হজরত ওমর ফারুক রা: প্রমুখ এ যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথী ছিলেন। তৃতীয় হিজরিতে সংঘটিত এ যুদ্ধে মক্কার কুরাইশদের সংখ্যা ছিল তিন হাজার। সাথে ছিল অশ্বারোহী বাহিনী। আর মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র সাত শ’। এর মধ্যে অশ্বারোহী বাহিনী ছিল অনুল্লেখযোগ্য। তা সত্ত্বেও মুসলিমরা যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় বিজয় লাভ করেন। পরবর্তীতে নিজেদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার কারণে তারা পরাজিত হন। তবে কুরাইশরা বিজয়লাভের পরও দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেছিল কেন তা আজো ঐতিহাসিকদের কাছে বিস্ময়কর। আমরা শুহাদায়ে উহুদের কবরস্থান যিয়ারত করি। প্রানভরে দুআ করি সাইয়্যিদুশ শুহাদা' হযরত আমীর হামযা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে।
রাতের অনন্য সুন্দর মসজিদে নববী প্রাঙ্গন-২
মসজিদে নববী সংলগ্ন দর্শনীয় স্থান মদিনা মিউজিয়াম
মদিনায় রয়েছে ঐতিহাসিক নিদর্শনাবলী সংবলিত মসজিদে নববীসংলগ্ন মদিনা মিউজিয়াম। এই মিউজিয়ামে অনেক পুরনো দুর্লভ কুরআন ও হাদিস গ্রন্থ এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সময়ের কিছু ঐতিহাসিক দলিলের অনুলিপি সংরক্ষিত আছে। মিউজিয়ামের অভ্যন্তরে এর কলাকুশলীরা সাধারনত: মিউজিয়ামে সংরক্ষিত বিবিধ বিষয়াবলী সম্পর্কে সফরকারীদের ব্রিফ করে থাকেন। তারা সফরকারীদের অন্যান্য কথার সাথে একথাও বুঝিয়ে দেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনায় আসেন তখন কিছু দিন তিনি বিখ্যাত আনসার সাহাবি আবূ আইউব আল আনসারির রা: বাড়িতে ছিলেন। এরপর নিজ গৃহ ও মসজিদে নববীর নির্মাণকাজ শেষ হলে তিনি সেখানেই ওঠেন।
মাটির ঘরে থাকতেন আল্লাহর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর জন্য প্রথম যে ঘর তৈরি করা হয়েছিল তা ছিল খেজুরের ডালপালা ও মাটির প্রলেপ দিয়ে তৈরি। তিন থেকে পাঁচ মিটার আয়তনের একটি কক্ষে রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বসবাস করতেন। একটি সাধারণ খাটিয়ার ওপর রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘুমাতেন। খেজুর পাতার তৈরি মাদুরে ঘুমাতেন দোজাহানের বাদশাহ।
সিরাত গ্রন্থে উল্লেখ আছে, হজরত ওমর ফারুক রা: একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পিঠে খেজুর পাতার বড় বড় দাগ দেখে কেঁদে উঠে বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আপনার পিঠে এত দাগ! আপনি এমন বিছানায় ঘুমান? মিউজিয়ামে ঘুরে আপনি দেখতে এবং জানতে পারবেন পুরনো সেই সোনালি দিনগুলোর অনেক স্মৃতি। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জামানার ঐতিহাসিক দলিলপত্রাদি দেখে মুগ্ধতায় রুদ্ধবাক হবেন আরেকবার।
মদিনা মুনাওওয়ারাহর গুরুত্বপূর্ন একটি ম্যাপ
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৯ সকাল ৯:০৯