সমাজে নানান শ্রেনি পেশার ভাল মন্দ মানুষের বসবাস। কিছু মানুষ সত্যিকারার্থে পুরোপুরি ধার্মিক। কিছু রয়েছেন যারা ধার্মিক তবে অতটা নন। আধাআধি টাইপের। আবার কিছু মানুষ। যাদের সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। দু'চারজন। নাস্তিক ফাস্তিক। এছাড়া আরেক শ্রেনির মানুষ রয়েছে এই সমাজে। তারা ধর্মকে বিকিকিনি করে জীবন ধারন করেন। সোজা বাংলায় বললে বলতে হয়- তারা ধর্মব্যবসায়ী। এই ধর্মব্যবসায়ী শ্রেনির মানুষগুলো নিয়েই আজকের আলোচনা। ধর্মব্যবসায়ীগনের পরিচয় দেয়া কঠিন। কারন, নানান বেশে, বহুরূপী ছলাকলা আর চাকচিক্যতায়, নানাবিধ রূপে স্টাইলে, বহুধা বিভক্ত পথ ও পদ্ধতির প্রয়োগে, নিজেদের আবিলতা মিটিয়ে ধর্মব্যবসায় কর্মে নিয়োজিত এরা। এদের কেউ কেউ পীর সেজেছেন। নামকাওয়াস্তে পীর। তালের পীর। নারিকেলের পীর। এগুলো হঠাত গজায়। সিজনের ফল ফসল। এসবের মতই তথাকথিত এই পীরদের আবির্ভাব। এরাও হঠাত পীরের তখতে সমাসীন হন। জাতে গোত্রে নেই। কথায় বলে-
বাবায় না দাদায় না,
পাগড়ি বান্ধে কষে না।
কিন্তু এই পীরদেরটা কেন যেন কষে যায়। চৌদ্দ গোষ্ঠীতে এদের পীর না থাকলেও কেন যেন খুব দ্রুত এরা শাইন করে যায়। তরতরিয়ে লাউ গাছের লতা যেমন দেখতে না দেখতে বেড়ে ওঠে। এরা ফুলে ফেঁপে ওঠে তারচে'ও অধিক দ্রুত। অর্থ নেই। পুজি নেই। খাটনি নেই। খাটুনি নেই। এযেন আলাদীনের আশ্চর্য্য চেরাগ। এযেন মোগল সম্রাটদের মসনদে আরোহনের আজব ইতিহাস। হঠাত পীরের তখতে আরোহন করলেন। আর অমনি লক্ষ কোটি মানুষ বশ করে ফেললেন। দেখ কি না দেখ। কোটি কোটি টাকার পাহাড় গড়ে উঠলো বাবার দরবারে। টাকার স্তুপ। অঢেল অর্থের খেলা।
কেতাদুরস্ত তথাকথিত এই পীরদের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে-
১। চামচা, চামচিকা কয়েকজন নিয়োগ দিয়ে দশাসই চেহারা নিয়ে তখতে সমাসীন হতে পারলেই হলো। এছাড়া এদের থাকে লালসালু জড়ানো সাজুগুজু করানো দু'একটা কবর। কিছু উর্বশী তন্বী তরুনী আনত নয়না ষোড়শী এদের চারপাশে ঘুরঘুর করে। নর্তন কুর্দন গীত সঙ্গীত স্ফুর্তি করে এরা। আসর জমানোর জন্য এদের ছাড়া কি হয়? একটু বিনোদন আর কি!
২। বাবার দরবারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য গাজাসেবন। গাজা নিত্যসত্য প্রসঙ্গ। গাজা না হলে খাজাবাবার ভাব ওঠে না। দরবার জমে না। কল্কিতে টান না দিলে মনে জোশ আসে না। দিলে খোশ ভাসে না। অন্তরে হুশ আসে না। মৃত প্রান জেগে ওঠে না। মনময়ূর বেচাইন হয় না। আর এসব না হলে সিদ্ধিলাভ কেমনে হবে?
৩। এরা একেকজন টাকার পাহাড়। বিশাল বিত্ত বৈভবের অধিকারী।
৪। প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের রথি মহারথিগনের একাংশ যারা তুখোর ঘুষখোর- এদের হাতে বাইয়াতপ্রাপ্ত থাকেন। পীর বাবার বিপদে আপদে এরা ত্রানকর্তা হিসেবে ভূমিকা রাখেন।
৫। এই শ্রেনির পীরগন পারতপক্ষে নিজে নামাজ পড়েন না। অন্ধভক্ত মূর্খ মুরিদদের আদায় করতেও বলেন না।
৬। এদের দরবারে গরু মহিষ প্রচুর হাদিয়া আসে। যদিও সাইয়্যিদুল মুরসালীন মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর রওজায়ে আতহারে আজ অবদি কোনো দিন একটি গরু মহিষ কিংবা উট বকরি ভেড়া আসার ঘটনা ঘটেছে বলে কেউ শোনেনি।
এরকম আরও কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে এদের।
এরা কথা বলেন যু্ক্তি দিয়ে। এদেরকে কোনো কোনো সময়ে দলিল দিতে দেখা যায় কুরআনের আয়াত দিয়ে। তখনই মনে হয়, হায়! এদের কথাও তো সত্য! তো, কথা সত্য হলে কী হবে? মতলব যে খারাপ! আসুন, এই কথা সত্য মতলব খারাপ জিনিষটা ভালভাবে বুঝার জন্য একটি মজার গল্প রয়েছে। গল্পটায় একটু চোখ বুলিয়ে নিই-
তিন ভাদাইম্যা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। কোনো কাজ কর্ম করে না। এর ওর কাছে চেয়ে চিন্তে পেটের ক্ষুধা নিবারন করে। একদিন সন্ধ্যেবেলা মোড়ল বাড়ির দরজায় গিয়ে তিন ভাদাইম্যা হাক ডাক শুরু করেছে। মোড়ল সাব বাড়ি আছেন? মোড়ল সাব বাড়ি আছেননি? ডাক শুনে মোড়ল সাহেব বেড়িয়ে এলেন। তিন ভাদাইম্যা কয়, মোড়ল সাব, সারা দিন কিছু খাই নাই। খাবার দ্যান। মোড়লের অন্তর নরম। বউরে কন, খাবার যা আছে এদের দিয়ে দাও। বউ রান্না ঘরে গিয়ে দেখেন চারটি রুটি আছে। তিন ভাদাইম্যাকে চার রুটি দিয়ে মোড়ল সাহেব বিদায় করলেন। ভাদাইম্যারা তাতেই খুশি। খুশি মনে তারা মোড়ল বাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনের রাস্তার পাশে নিরিবিলি স্থানে রুটি খেতে বসলো। একেকজন একটি করে রুটি খেল। বেঁচে গেল একটি রুটি। এই রুটিটি নিয়ে বাধলো যন্ত্রনা। তিনজনেরই লোভ কিভাবে রুটি খাওয়া যায়।
তিন ভাদাইম্যার মধ্যে যিনি সবার বড়, বললেন, ''দ্যাখ, হাদিসে আছে, যে বড়কে শ্রদ্ধা করে না, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভূক্ত নয়। আমি যেহেতু তোদের দুইজনের চেয়ে বয়সে বড়। হাদিস মাইন্যা রুটিটা আমারে দিয়ে দে।''
ছোটটা বললো, ''হাদিস খালি তুমি একাই পড়েছ মনে হয়! হাদিস আমিও পড়েছি। ছোটবেলা ওস্তাদ পড়াইছে। সহীহ হাদিস। যে ছোটকে স্নেহ করে না, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভূক্ত নয়। আমি যেহেতু তোমাদের দুইজনের ছোট এই হাদিসের উপর আমল কইরা রুটিটা আমারে দিয়ে দাও।''
মেঝটা লাফ দিয়ে উঠলো এবার, ''ও, আচ্ছা, হাদিস বুঝি সব তোমরাই পইড়া আইছো! 'খইরুল উমূরে আওসাতুহা' -এই হাদিস শোনো নাই? সকল কাজে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা উত্তম। রাসূলে পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শও ছিল তাই। নবীজীর আদর্শ মেনে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে রুটিটা আমারে দিয়ে দাও।''
তিনজনই সহীহ হাদিসের দলিল দিয়েও যখন রুটি বাগাতে পারলো না, নিরুপায় হয়ে একটি নতুন বুদ্ধি আটলো। বড়টা বললো, ''আচ্ছা, আয় একটা কাজ করি, এইভাবে হাদিস দিয়ে কোনো ফয়সালা হবে না। বেহুদা সময় নষ্ট না করে আয়, আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়ি। দেখি, আল্লাহ তাআ'লার পক্ষ থেকে কুদরতিভাবে কোনো ফায়সালা আসে কি না।''
পরামর্শ যথার্থ। রুটিখানা মাঝখানে রেখে তিন ভাদাইম্যা ঘুমিয়ে পড়লো।
দীর্ঘক্ষন ঘুমিয়ে বড়টা জেগে উঠলো। চিতকার করে বললো, ''এই শোন্, সবাই বল্ সুবহানাল্লাহ! আজব এক স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নে দেখি, আল্লাহ পাকের ফেরেশতা জিবরাইল আলাইহিস সালাম এসেছেন আমার কাছে। এসে বলছেন, তাড়াতাড়ি ওঠ্। বয়স থাকতে হজ করতে হবে। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন মক্কা মদিনায়। সকল স্থান ঘুরিয়ে, হজ্ব পালন করিয়ে আবার এই মাত্র ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন। আল্লাহর ঘরের মেহমান হিসেবে রুটিটা এখন আমার প্রাপ্য। ওটা আমাকে দিয়ে দে।''
মেঝটা বললো, ''আগে সুবহানাল্লাহ বল্! অামিও তো আজিমুশ্বান এক স্বপ্ন দেখেছি। হযরত মিকাইল আলাইহিস সালাম এসেছিলেন আমার কাছে। আমাকে বলেন, তোকে আল্লাহ পাক মিরাজে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন। তাড়াতাড়ি চল্। আমি তার সাথে গেলাম। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন মিরাজে। আরশে আজীমে ঘুরিয়ে, আল্লাহ পাকের দীদার করিয়ে, সাত আসমান, সাত জমিন তামাম কিছু ভ্রমন করিয়ে আমাকে এই মাত্র এখানে নামিয়ে দিয়ে গেলেন। যেহেতু আমার মিরাজ নসীব হয়েছে। আরশ কুরছি ভ্রমনের সৌভাগ্য হয়েছে। আমার সম্মানের দিকে তাকিয়ে রুটিটা আমারই প্রাপ্য। আমাকে দিয়ে দে ওটা।''
ছোটটা এবার আড়মোড়া ভেঙ্গে বললো, ''কি আর বলবো, দু:খের বিষয়! স্বপ্ন আমিও একটা দেখেছি। আজরাইল আলাইহিস সালাম এসেছিলেন আমার কাছে। এসেই কঠিন এক ধমক! আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, ওঠ্! আমি উঠলাম। বললেন, তোর সময় শেষ। এখনি জান কবজ করবো। যা খাওয়ার তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। আর খেতে পারবি না। সামনে তাকিয়ে দেখি, রুটি আছে একটি।''
বড়টা বললো, ''আজরাইল আইছে ভাল কথা। কিন্তু, তুই রুটি কি করছস?''
ছোট ভাদাইম্যার ত্বড়িত জবাব, ''আজরাইলের হুকুম না মাইন্যা তো উপায় ছিল না। ভয়ে ভয়ে তাড়াতাড়ি রুটি খাইয়া ফালাইছি।''
বড়টা বললো, ''ক্যা, তুই এই কাম করলি ক্যা?''
আলোচ্য ঘটনাটি যদিও হাসির খোরাক যোগায়। কিন্তু, এটি মোটেই হাসির গল্প নয়। তিন ভাদাইম্যা হাদিস বলেছে ঠিকই, কিন্তু তাদের প্রত্যেকের উদ্দেশ্য একটাই, হাদিসের দলিল দিয়ে রুটি খাওয়া। ঠিক একইভাবে, আজকের সমাজের ধর্মব্যবসায়ী শ্রেনিটিও, এমন করেই ধর্মের দোহাই দিয়ে, কুরআন হাদিসের দলিল দিয়ে, ঠিক এদের মতই দুনিয়া কামাইর উদ্দেশ্যে খড়গহস্ত। এই লুটেরাদের রুখবে কে?
গল্পটি যদিও হাস্য কৌতুক করে রচিত। কিন্তু এর বাস্তবতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। দ্বীন-ঈমান ক্রয়কারী ধর্মব্যবসায়ীদের কবলে পড়ে কতজন যে কতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তার কি কোনো ইয়ত্তা আছে?
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এদেশের হক্কানী পীর বুজর্গগন, যারা নিজেদের অর্থের লোভে বিক্রি করেন না, যারা দুনিয়ার লোভ লালসাকে জলাঞ্জলি দিয়ে পারকালীন জীবনকে প্রাধান্য দেয়ার প্রচেষ্টায় অগ্রগামী, উম্মতের হেদায়েতের নিমিত্তে যাদের হৃদয়ে নিরন্তর রক্তক্ষরন হয়, এই শ্রেনির আলেম, মুহাক্কিক সত্যপথের দিশারী পীর মাশায়েখগনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ পূর্বেও যেমন ছিল, ভবিষ্যতেও অবিকল থাকবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৯ সকাল ৯:০৯