কালো গিলাফের মায়ায় কা'বার ছায়ায় বিমুগ্ধ কয়েকটি মুহূর্ত কেটে গেল স্বপ্নের মত। ধীর পদবিক্ষেপে ক্রমে ডানে অগ্রসর হয়ে সবুজ চিহ্নিত কর্নারে গিয়ে হাজরে আসওয়াদ বরাবর পৌঁছে দু'হাত তুলে 'বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার' বলে তাওয়াফ শুরু করলাম। থেমে থেমে অযুত কন্ঠের সাথে আমার মুখেও উচ্চারিত হচ্ছে- 'লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা- শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা অন্নি'মাতা লাকা অল মুলক, লা- শারীকা লাক'।
তাওয়াফে যখনই নেমেছি লক্ষ্য করেছি মন্ত্রমুগ্ধের মত আমি কা'বার সন্নিকটে ঘেঁষে যাচ্ছি। ক্রমশঃ। নিজের অজান্তেই। তা মাতাফজুড়ে ভীড় যতই থাক না কেন। সঙ্গীগন কখনও কখনও হারিয়ে যেতেন। আমি নিশ্চিন্ত। আমার যেন হারাবার কিছু নেই। মালিকের বাড়িতে এসে কীইবা হারানোর থাকে? আর আমার মত নিঃস্বের জন্য তো সে সম্ভাবনা আরও ক্ষীন। আর এরপরেও মহান মালিকের ইচ্ছা যদি এমনই হয়ে থাকে, কিছু যদি হারিয়ে যায়ই, তিনি কি তার থেকে বেশি, অনেক বেশি ফিরিয়ে দিবেন না? আল্লাহু আকবার! তিনি তো মহান মহিয়ান বেনিয়াজ। তাঁর তো দেয়ার কোন সীমা-পরিসীমা নেই। কতবার কতভাবে কতস্থানে যে তিনি এই অধমকে দয়া দিয়ে মায়া দিয়ে ছায়া দিয়ে বেশুমার কৃপা করেছেন, তার কি কোন ইয়ত্তা আছে?
আহ! ভাবতেও চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে! তাঁর দয়া ব্যতীত একটি নিশ্বাসও কি নেয়ার শক্তি আমার ছিল? হায় হায়! কোথায় ছিলাম? কী ছিলাম? অস্তিত্বহীন থেকে তিনি দয়া করে বাবার প্রিয় স্পর্শে চির স্নেহময়ী মমতাময়ী মাতৃজঠরে আমার ছোট্ট কচি দেহের বীজ বুনে দিলেন! আল্লাহু আকবার! ধীরে ধীরে সে বীজ অঙ্কুরিত হল। প্রথম চল্লিশ দিন বীর্য আকারে মাতৃজঠরে ঘূর্নায়মান ছিলাম। দ্বিতীয় চল্লিশ দিন ছিলাম জমাট রক্ত আকারে। এরপরে পরের চল্লিশে মাংস পিন্ডে পরিনত হলাম। আহ! কী আজব আমার মহান সৃজয়িতার সৃষ্টি-কৌশল! কুদরতের কারিশমা! তারপর পরের চল্লিশে সেই জমাট মাংস পিন্ড থেকে অকল্পনীয়ভাবে আমার মহান মালিকের নিপূন কারুকার্যতায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো আকৃতি লাভ করলো। অতঃপর পরের চল্লিশে সেই মাংস পিন্ডকে সৌন্দর্যমন্ডিত করার জন্য আমার ছোট্ট কচি অবয়বের উপরে চামড়ার পোষাক পরিয়ে দেয়া হল। আল্লাহু আকবার! ফাতাবারাকাল্লাহু আহসানুল খালিকীন! কতই না মহান স্রষ্টা মহিয়ান! আল্লাহু আকবার!
প্রিয় পাঠক, বিনীত ক্ষমা প্রার্থনা করছি। কথায় কথায় দূরে সরে গিয়েছিলাম একটু। আসলে আবেগ বড় অদ্ভূত জিনিষ। টেনে নিয়ে যায়। ছুটতে চাইলেও ছোটা যায় না। আবেগ তো ভালবাসা থেকেই আসে। এই যে জগত-মহাজগত এবং এগুলোতে যা কিছু বিদ্যমান এসবও তো মহান প্রভূ পালয়িতার ভালবাসার অনুপম বহিপ্রকাশ বৈ কিছু নয়। তিনিই তো প্রেম-ভালবাসার স্রষ্টা। আল্লাহু আকবার!
তাওয়াফের একেকটি চক্কর অতিক্রম করছি আর চোখ তুলে প্রিয় কা'বার প্রতি মাঝে মাঝে তাকাচ্ছি। আশায়-ভালবাসায়। ভয়ে-প্রত্যাশায়। যদি এই ঘরের মালিক একটিবার দয়ার নজরে মায়ার নজরে এই অধমের দিকেও তাকান! মাকামে ইবরাহীমের কাছে এসে একটু দাঁড়িয়ে যাই। ইচ্ছে হল একটু ছুঁয়ে যাই। ছুঁয়ে দিলাম। অন্তর ছুঁয়ে গেল। এখানে রয়েছে সেই পবিত্র পাথরখন্ড যার উপর দাঁড়িয়ে পিতা হযরত ইবরাহীম অালাইহিসসালাম স্বীয় পুত্র ইসমাঈল অালাইহিসসালামকে সাথে নিয়ে আল্লাহ পাকের নির্দেশে বাইতুল্লাহ নির্মান করেছিলেন। মহান নবী হযরত ইবরাহীম অালাইহিসসালামের পায়ের ছাপ সে পাথরে আজও স্পষ্ট বিদ্যমান। দেখতে দেখতে সাতটি চক্কর শেষ হয়ে এল। আলহামদুলিল্লাহ।
মাকামে ইবরাহীমের পেছনে গিয়ে দু'রাকাঅাত সালাত আদায় করলাম। হদয়ের অর্গল যেন খুলে গেল। না বলা কথাগুলো চোখের অশ্রু হয়ে ঝড়ে ঝড়ে পরে যেতে থাকল। আয় আল্লাহ, আপনি কতইনা মহান, আপনার ঘরে ডেকে এনে আপনার বান্দাকে ফোটা ফোটা তপ্ত অশ্রু বিসর্জনের অমূল্য নেয়ামত থেকেও বঞ্চিত করেন নি! আপনি সত্যি মহান! আপনি সত্যি মহান!!
এই পর্বেও যুক্ত করা হল প্রিয় বাইতুল্লাহর কিছু অসাধারন ছবি। আশা করি ভাল লাগবে প্রত্যেকের।
বাইতুল্লাহর ছাদে তাওয়াফের অনুপম দৃশ্য।
কা'বা শরীফের দরজার পাশের একটি বিশেষ দৃশ্য।
দুঃখিত! কোন কারনে ছবি আপলোড করতে ঝামেলা হচ্ছে। পরবর্তীতে আবার চেষ্টা থাকবে ইনশাআল্লাহ।
চলবে-
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১৮ সকাল ১০:২২