somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোন এক মাকে

১৮ ই জুলাই, ২০১৩ ভোর ৫:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সবাই বলে, মা উষার সঙ্গে পাল্লা দেয় !
আমাদের পরিবারটা ছিল গোলগাল একটা জাম্বুরার মতো। তার এক একটি কোরকে দাদা-দাদী,চাচা-চাচি,ফুপুদের বসবাস। সব মিলিয়ে দশ-বারো জন। মাঝের শুন্যতাটুকু ভরাট করে সবগুলো কোরককে একসুত্রে গাঁথার কাজটি করেছিলেন,আমার মা।
আমি ঘুমে থাকতেই মা উঠে এঁটো বাসন-কোসন মেজে উনুন চাপায়। সকালের চা,আমাদের স্কুলের টিফিন,বাবা-চাচ্চুদের প্রাতঃরাশ সঙ্গে অফিসের লাঞ্চ। অন্তত, চার পদের কম নয়। ঘন্টার কাঁটা আটটা ছোঁয়ার আগেই মা এসব তৈরি করে ফেলতো।হয়তো তখনই আমি চেঁচিয়ে উঠতাম-মা, জুতোর ফিতে খুঁজে পাচ্ছি না। বাবা বলে শার্টের বোতামটা। বাথরুম থেকে মেজ চাচ্চু আওয়াজ দেয়-দিন ভিখারীর শ্যাম্পুটা চাই। দাদা কেশো গলায় -বৌমা,চা কই ? ওষধটাও দিতে ভুলে গেছ। সত্যি বৌমা, তোমার আজ-কাল কিছুই মনে থাকে না। এদিকে চাচাত ভাইয়ের হরলিকস গুলোতে মা'র ভুল হয়না। মেজ চাচি বলে রেখেছে-দুপুরের রান্নাটাও করে রাখতে। তার শরীরটা বিশেষ ভাল যাচ্ছে না।
পরিবারের হর্তা-কর্তারা সবাই পেটে তা দিয়ে বেরিয়ে যায়। কেউ জিজ্ঞেস করেনা-রাঁধুনিটির পেটে দানা-পানি, কিছু পড়েছে কিনা ? স্কুলে না গেলে আমি জানি,বেশিরভাগ দিনই মা সকালে কিছু খায় না। আগের রাতের ভাত বেঁচে গেলে খায়। মা হেসে বলে, শাস্ত্রে আছে দানা ফেলতে হয়না।
চা তৈরি শেষে দাদার জন্য তেল-রসুন গরম করে মা।বুড়োর বাত ছিল। এরপর নির্দিষ্ট সময় অন্তর কিছু ট্যাবলেট। এরই মাঝে গোয়ালিনিটা চলে আসে। তাকে বসিয়ে রেখে মা খড়িগুলো নিয়ে ছাদে শুকোতে দেয়। কালু (হাইল্যা) একেকদিন কাঠের গুঁড়ো নিয়ে আসতো। আশে-পাশের দু্ই-তিন ঘর কৃষিজীবি পরিবারের কাছ থেকে মা প্রতিদিন গোবর নিয়ে রাখতো। কালু গুঁড়ো নিয়ে এলে মা সেই গোবর মুঠো বানিয়ে তাতে কাঠের গুঁড়ো ছড়িয়ে শুকোতে দিত। দেখতে অবিকল,বিষ্কিটের গুঁড়ো মাখা কালোজাম ! মাঝে-মধ্যে জ্বালানির টান পড়লে মা ওই ঘুঁটো পুড়িয়েই দুপুর চালিয়ে নিত।
গোয়ালিনিকে বিদায় করে মাকে ছুটতে হতো কুসুম গরম তেল-রসুন নিয়ে। উঠোনে জাকিয়ে বসা দাদার পায়ের বাড়ন্ত ব্যাথার ক্ষনিক উপশম ঘটাতে। এরই ফাঁকে বালতিতে মা কিছু কাপড়-চোপড় ভিজিয়ে রাখতো।বালতিটা দাদার কেদারা থেকে বেশি দুরে নয়। রোজ কাচাকাচি।রোজ মাজামাজি।সংসারটা ঝকঝকে-তকতকে। কিন্তু দুপুরের খাবার খেতে মায়ের রোজ তিনটা-চারটা বেজে যায়। দাদা-দাদীকে খাইয়ে তবে মা আর চাচি খায়।
খাওয়ার পর ছাদে গিয়ে কুমড়োর বড়ি দেয়া,আচারের বোয়মটা কাক আর চঁড়ুইয়ের ঠোঁট থেকে চোখে চোখে রাখা কিংবা কাঁথা সেলাই করতো মা। শীতের দিন উল বুনতো। আমার সোয়েটারের খরচটা বেঁচে যেত। ফুরসত পেলে মা সাহিত্যের গলি-ঘুপচিতে হেঁটে বেড়াতে পছন্দ করতো। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার খুব প্রিয় লেখক। পাড়ার লাইব্রেরি থেকে মেজ চাচ্চু বই এনে দেয়।
পাঁচটা নাগাদ স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে প্রতিদিনের মতো সেই ভাত-ডাল-ভাজির জঙ্গল। অন্য কিছু করতে পার না ! যাও খাবো না। জিদ করেনা, খেয়ে যা সোনা। আমি খেলতে যাচ্ছি। মা দৌড়ে এসে আমাকে ধরে কয়েক গাল খাইয়ে তবেই ছাড়তো আর বলতো-'‌সন্ধ্যার আগেই ফিরবি। বাবা এসে দেখতে না পেলে কিন্তু মারবে।'
জামাটা ছিঁড়ে এনেছিস। তোর আজ রক্ষে নেই খোকা। দাঁড়া তোর বাবা আসুক। বাবা এসে জুতো খোলার আগেই আমার সারাদিনের কর্মকান্ডের মাশুল বুঝিয়ে দিতেন। কখনো হাতে কখনো কাঠের স্কেলটি দিয়ে। মাকে দেখতাম শুধু ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে। তুমি সবচেয়ে খারাপ মা। বাবাকে সব বলে দাও। দাঁড়াও আজ বাবা এলে আমিও বলবো-সেদিন দাদা-দাদী ঘুমিয়ে পড়ার পর তুমি আর চাচি মিলে মুখে পান গুঁজে, বুড়ো-বুড়ির কাপর-চোপড় পড়ে ভেংচি কেটেছ। আমায় পান খেতে দাওনি।
টিফিনে রোজ রুটি খেতে আমার ভাল লাগেনা।ওরা সবাই কত কি আনে ! দুইটা টাকা দেবে ? ফনেল চাচার ভেলপুরি খাবো। আজ না, কাল দেব। রোজই এক কথা বলো। দাও, নাতো। মাসে বড়জোর তিনবার। তাও আমি জমিয়ে রাখি। ছয় টাকা হলে বিকেলে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে কুলফি খাই। তারপর ভাল করে জিভ ধুই। নইলে বাসায় ফিরে জিভের রং দেখে তুমি টের পেলেই সর্বনাশ ! একটা ঘুড়ি কিনবো, সেই পয়সাটাও তুমি দাওনা। ওদিকে, কেটে যাওয়া ঘুড়ি ধরলে বাবা মারে।
বাবা-চাচারা সন্ধ্যায় ফিরে চা-নাস্তা করে। তুমি হেঁশেলেই থাক। আমরা ভাই-বোনেরা খাই দশটা নাগাদ। সবকিছু কিছু গুছিয়ে তোমার খেতে খেতে একটা বাজে।আমি আর বোন আগেই ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে যখন উঠি, তখন তুমি রসুইঘরে। তুমি কখন ঘুমোও মা !
দাদার বড্ড শুচিবাই। সেদিন কালু তার গ্লাসে পানি খেয়েছিল বলে কি চড়টাই না মারলো ! আমি কাউকে বলিনি তুমি লুকিয়ে ওর বউয়ের জন্য নিজের নতুন শাড়ীটা দিয়ে দিয়েছ। আমি কাউকে বলিনি গোয়ালিনির চালের সংকট হলে তার ভরসা তুমি।
এখন আমি হাইস্কুলে। বেশ সাহস হয়েছে। তাই জীব বিজ্ঞানের ভেতর তিন গোয়েন্দা থাকে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে মাসুদ রানা। পড়ার সময় কান খাড়া করে থাকি তোমার চুড়ির আওয়াজের দিকে,কখন তুমি চলে আস।তোমার হাতের চুড়ির আওয়াজ আমি ঠিক বুঝতে পারি। বাকি সবার থেকে ওটা আলাদা। ঠিক যেমন তোমার কাপড়ের আঁচলের গন্ধ! আমাকে কোনদিনই পড়ানোর সময় তোমার ছিল না। তুমি অবশ্য ইংরেজিও ভাল পারতে না।পড়াবে কি ! তুমি কিছুই জান না মা। তুমি একটা অপদার্থ।
ইদানিং তুমি বোনটাকে নিয়ে পরেছ। ও নাকি বড় হচ্ছে। এখন ওর সঙ্গেই সময় কাটে তোমার। দাদা-দাদী মরে গেছে। জাম্বুরার কোরকগুলোও পট পট করে ছিঁড়েছে। সবার হাড়ি আলাদা। তবুও এখনো উষা তোমায় টেক্কা দিতে পারেনা। ঠিক চারটায় উঠে পড়ো। বলো-নামাজের জন্য ওটা নাকি অভ্যাস হয়ে গেছে। ঠিক ঘুম ভেঙ্গে যায়। এখন অবশ্য একটু তাড়াতাড়ি শুতে যাও। কিন্তু আগেও সারাদিন যা করতে এখনও প্রায় তাই। বাবার কাছে আসার পর থেকে তুমি নতুন কিছুই করলে না মা।
বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ওরা চলে যাওয়ার দিন,তুমি খুব কেঁদেছিলে। আর একবার অত কাঁদতে দেখেছি তোমাকে। যেদিন বাবা মারা গেল। তারপর চাকুরীর জন্য যেদিন আমি বাড়ি ছাড়লাম। বছরে দুইবার আসতাম। তুমি কতো রান্না করো। তোমার বিশ্বাস,বাড়ির বাইরে আমার বোধহয় ঠিক করে খাওয়া জোটে না। তোমাকে বুঝিয়ে আর পারি না। আসলে তুমি তো কিছুই জানো না মা। পড়ে আছো সেই মান্ধাতার আমলে। এখনকার মায়েরা তাদের সন্তানকে তাদের পায়ের ওপরই বেড়ে ওঠায়। তোমার মতো আচলতলে সন্তানের চোখ ঢেকে কেউ রাখে না। তোমার জন্যই আধুনিকতার সঙ্গে আমার আলাপটা অনেক দেরিতে হয়েছে মা।কত পিছিয়ে পড়েছি আমি। সব দায় তোমার।
বউ-ছেলেপুলে নিয়ে এখন নিজের বাসায় থাকি। তুমিও থাক আমার সঙ্গে ।তিতির-তিনাবদের নিয়ে সারাদিন মেতে থাক।কতবার বলেছি,একটু বাইরে যাও। দুনিয়াটা চোখ মেলে দেখ। বোনটার ওখান থেকে কিছুদিন ঘুরে এসো। কিন্তু আমি তো আর তোমার আগে জন্ম নিতে পারিনি। তাই,ওসব বায়না উড়িয়ে দাও হেলায়। তুমি তো ইন্টারনেট চালাতে জানো না মা। গ্যাসের রেগুলেটরটা পর্যন্ত এখনও লাগাতে পারোনা। এখনো হাতেই কাচাকাচি কর তুমি। ঘুম থেকে ওঠার সময়টা শুধু পিছিয়ে গেছে এক ঘন্টা। তবুও আজও যতো রাতেই বাড়ি ফিরি না কেন, না খেয়ে খাবার আগলে বসে থাক তুমি। নয়টা বাজলেই বউকে দিয়ে ফোন করাও-কোথায় আছি। কখন ফিরছি ? শার্টটা একদিনের বেশি পড়লে নিজেই কেচে রাখ। জুতোর ফিতেটা অবধি হারায় না আমার।
একদিন আমার কপালে একটা চুমু খাবে মা ? খুব সাধ আমার। কখনো পাইনি ওটা। আমরা যে পরিবেশে বড় হয়েছি, তখন এসবের চল ছিলনা।
নেশা করলে তার আমেজ থাকা পর্যন্ত, কেরামান-কাতেবিনরা নাকি দুই কাঁধ ত্যাগ করে। প্লাবিত চোখে এখনও বাড়ি ফিরি প্রায় রাতে। মদিরার গন্ধে ডুবে থাকে শরীর। তখনও, খাবার আগলে আমার পথ চেয়ে বসে থাকে সেই একজনই-
আমায় পিছিয়ে দেয়া মা।


সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১০:৪৭
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইরান ইসরাইলের আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ আর আমাদের সুন্নী-শিয়া মুমিন, অ-মুমিন কড়চা।

লিখেছেন আফলাতুন হায়দার চৌধুরী, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩০

(ছবি: © আল জাযীরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক)

শ্রদ্ধেয় ব্লগার সামিউল ইসলাম বাবু'র স্বাগতম ইরান পোষ্টটিতে কয়েকটি কমেন্ট দেখে এই পোষ্ট টি লিখতে বাধ্য হলাম।
আমি গরীব মানুষ, লেখতে পারিনা। তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৯




আমরা পৃথিবীর একমাত্র জাতী যারা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য, নিজস্ব ভাষায় কথা বলার জন্য প্রাণ দিয়েছি। এখানে মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান চাকমা মারমা তথা উপজাতীরা সুখে শান্তিতে বসবাস করে। উপমহাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্যা লাস্ট ডিফেন্ডারস অফ পলিগ্যামি

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০


পুরুষদের ক্ষেত্রে পলিগ্যামি স্বাভাবিক এবং পুরুষরা একাধিক যৌনসঙ্গী ডিজার্ভ করে, এই মতবাদের পক্ষে ইদানিং বেশ শোর উঠেছে। খুবই ভালো একটা প্রস্তাব। পুরুষের না কি ৫০ এও ভরা যৌবন থাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রিয় কাকুর দেশে (ছবি ব্লগ) :#gt

লিখেছেন জুন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৩



অনেক অনেক দিন পর ব্লগ লিখতে বসলাম। গতকাল আমার প্রিয় কাকুর দেশে এসে পৌছালাম। এখন আছি নিউইয়র্কে। এরপরের গন্তব্য ন্যাশভিল তারপর টরেন্টো তারপর সাস্কাচুয়ান, তারপর ইনশাআল্লাহ ঢাকা। এত লম্বা... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেরত

লিখেছেন রাসেল রুশো, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:০৬

এবারও তো হবে ইদ তোমাদের ছাড়া
অথচ আমার কানে বাজছে না নসিহত
কীভাবে কোন পথে গেলে নমাজ হবে পরিপাটি
কোন পায়ে বের হলে ফেরেশতা করবে সালাম
আমার নামতার খাতায় লিখে রেখেছি পুরোনো তালিম
দেখে দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×