ঢ্যাঙা-পাতলা শরীর। পানের পিচকির ভারে মুখটা জবজবে। ঢোলা পাঞ্জাবী-পায়জামা ছাড়া অন্যকোন লেবাসে, তাকে কখনোই দেখিনি। হাঁটার গতি ছিল অদ্ভুত রকমের দ্রুত। দেখে মনে হতো পাঞ্জাবী-পায়জামা পড়া একটা টু-পিস হ্যাঙ্গার রাস্তা দিয়ে দিব্যি হেঁটে যাচ্ছে ! তাই দেখে স্কুলের এক ছাত্রের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল-'হ্যাঙ্গার মোখলেস।' ব্যস,সেই শুরু। এমুখ-ওমুখ হয়ে নামটি একপর্যায়ে স্কুলের সবার মুখে মুখে। আমি অবশ্য তার সামনে ও্ইনাম কখনোই মুখে আনতাম না। তবে,মনে মনে জপ করতাম। সপ্তাহে তিনবার। আমার আকুল প্রার্থনায় কোনদিন উনি সাড়া দিতেন,কোনদিন দিতেন না। তবে, যেদিন দিতেন,সেদিন ওনার ঘন্টা বাজানোর ঢংঢং শব্দটা আমার কাছে মনে হতো,পৃথীবির সবচেয়ে মধুরতম শব্দ । মুক্তির বার্তা !
ক্লাসের দ্বিগ্বজদের এড়িয়ে চলতাম। তাই বসতাম পেছনের বেঞ্চিতে। সপ্তাহের তিন দিন শেষ ক্লাস থাকতো ভূগোল স্যারের। উনি আমাদের নিয়ে আর্কটিক থেকে বৈকাল পারি দেয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু,আমরা হারিয়ে যেতাম। স্যারের গাট্টায় পথ চিনে ফিরে আসতাম। মাথায় প্রায় একমাস ব্যথা থাকতো। স্যার সামনে সারি থেকে পড়া ধরতে ধরতে মাঝখানের সারি পর্যন্ত আসতেই আমি কায়কামোন্য বাক্যে জপ করতাম-'হ্যাঙ্গার মোখলেস,বাঁচাও।' যেদিন সাড়া দিতেন, সেদিন ঘড়িতে চারটে বাজার কয়েক মিনিট আগেই শুনতে পেতাম.....ঢ্ংঢংঢংঢং।
মুক্তি শব্দটির অর্থ তখন বুঝতাম না। কিন্তু আজ বুঝি, জীবনে প্রথম প্রকৃত মুক্তি স্বাদ এনে দিত মোখলেস চাচার সেই ঘন্টা। ব্যাগটা কোনরকমে কাঁধে চাপিয়েই দে..ছুট।
বাসায় গিয়ে কোনমতে গালে-মুখে গিলে চলে যেতাম নাইংল্যাখালির বিলে। পাশের পতিত ক্ষেতগুলোয় ফুটবল খেলতাম সন্ধ্যা পর্যন্ত। তখন দেখতাম বিলটা কি সিগ্ধ-শান্ত,কুলকুল-মর্মরও। কিন্তু বর্ষায় সেই আবার ভীম যমের মতো ! চারপাশের আমনের ক্ষেতগুলো রাক্ষুসী হয়ে অবলীলায় খেয়ে নিত। একেবারে,মোখলেস চাচার ঘন্টার মতো !
পরীক্ষা হলে মোখলেস চাচার আর্শীবাদ পেতনা কেউ। হয়তো হ্যাঙ্গার শব্দটা হজমের প্রতিশোধ তুলতেন,তাই ঘন্টা বাজাতে এক মিনিটও তার দেরি হতো না। প্রথম ঘন্টাটি শেষ হলেই ঢং.....(লেখরে তোরা,তারাতারি লেখ)......দ্বিতীয় ঘন্টায় ঢংঢং.....(গতি বাড়াতে গিয়ে লেখা আমার কায়ার ঠ্যাং-বগের ঠ্যাং)...শেষ ঘন্টা বাজার পনেরো মিনিট আগে বেজে উঠতো...ঢ্ংঢংঢংঢংঢং...শুনতে সেই ছুটির ঘন্টার মতোই,কিন্তু কি নিষ্ঠুর! পাঁচটা প্রশ্নের সাড়ে তিনটা লেখা হয়েছে,বাকি পনেরো মিনিটে আরও দেড়খানা ?! ততক্ষনে আমার পেটের মধ্যে ব্যাঙ লাফাচ্ছে,আর হাতের কলম ভুলভাল নাচছে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও সেই নাচ থামেনি। ঘন্টা থেকেও নিস্তার মেলেনি। পরীক্ষা হলে ঘন্টার ধ্বনিতে বুক কাঁপতো। স্কুলের সেই দিনগুলোতে আইনষ্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি বোঝার কথা ছিল না। বড় হয়ে বুঝেছি । আসলে ঘড়ির কাঁটাগুলো সবসময় একই গতিতে চলেনা। নইলে ভূগোল স্যারের ক্লাসে যে ঘড়ির কাঁটাকে প্রার্থনায় গুঁতোয় ঠেলেও সরানো যেতনা,পরীক্ষার সময় সেই একই কাঁটা কিভাবে সাঁই সাঁই করে ঘোরে ?
ঘোরার কথা বলতেই লালীর ঘন্টা বেজে বসলো ! খেলা শেষে নাইংল্যাখালির বিল থেকে লালীর সঙ্গে বাসায় ফিরতাম। হ্যাঁ,মিনার মতো আমারও একটা লালী নামের ধেনু ছিল। তার গলায় বাঁধা থাকতো পেতলের একটা ঘন্টা। গোধূলীর স্বর্ণজলা আকাশের নিচে সবুজের আল ধরে,লালীকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে আমায় টুংটাং শব্দের গান শোনাতো,ওই ঘন্টা।
উচ্চ মাধ্যমিকেই যাত্রা ধরেছিলাম। বাড়ি থেকে পালিয়ে যাত্রাপালায় হাজিরা দেয়ার অনেক রেকর্ডই জমা আছে কেরামান-ব্রাদার্সের নথিতে। যাত্রায় আমি কখনো ঘড়ির ব্যবহার দেখিনি। একটা ঘন্টা বাজিয়ে যাত্রা শুরু হতো। প্রথম ঘন্টা..দ্বিতীয় ঘন্টা....তৃতীয় ঘন্টা...ব্যস তারপরই যাত্রার শুরু। তবে শুরুর সময় রাত নয়টা উল্রেখ করা থাকলে,ওটা নিমেষেই লাফ দেয় এগারোটায়। দশটা নাগাদ দর্শকেরা বিরক্ত হয়ে হৈঁ-চৈ শুরু করে। ঠিক তখনই প্রথম ঘন্টা ! অর্থাৎ,চটুল মেকআপ নেয়া একজন লোক মঞ্চের পাশে হারমোনিয়াম রেখে যাবেন। তাই দেখে থামে দর্শকেরা। একে একে আরও বাদ্যি-বাজনা ভিড় জমায়। সাড়ে দশটা নাগাদ দর্শকদের ফের হৈঁ-চৈ এবং দ্বিতীয় ঘন্টার শব্দ। অভুক্ত কিংবা অতিভুক্ত মেনকা-মনসারা এসে আধঘন্টা নাচগান করে মঞ্চে,তারপরই তৃতীয়ঘন্টা এবং পালার শুরু.........।
তবে,মঞ্চে যাই হোক জীবনের যাত্রাপালায়, নিত্য-নতুন ঘন্টাধ্বনির সঙ্গে আমাদের পরিচিতি । তারা ভাষা বিচিত্র,প্রকাশও ভিন্ন। এখন দমকলের আওয়াজ শুনি।বুকের মধ্যে দাউদাউ করে ঘন্টা বেজে ওঠে,দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাই,এক অভাগির ঘর পুড়ছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে পাওয়ার অনিশ্চয়তায়, তার বুকেও তো হাতুড়ীর ঘা পড়ছে।
গীর্জার ঘন্টাগুলোয় আবার ঘা পড়ার শব্দ নেই। কেমন যেন একটা মিহি আওয়াজ। যে কোন চার্চের বাতাসই একটু ভারী । আবছা আলো,অসংখ্য মোমবাতি,ক্রুশবিদ্ধ যীশুর ছবির সঙ্গে প্রার্থনাসঙ্গীতের রেণু মিশে মনের ভেতর একটা অপার্থিব অনুরনন তোলে। মন্দিরে তেমনটা দেখিনি। ঘন্টা সেখানেও বাজে। তবে একটু উচ্চস্বরে। আচ্ছা, ঈশ্বর কি অনেক দুরে থাকেন ? জোরে শব্দ না করলে তার কাছে খবর পৌঁছানো যায় না ? কই,আমি তো পেরেছিলাম। বউটাকে নিয়ে বাড়ির উঠোনে মাদুর পেতে জোসনা ভাগাভাগি করছিলাম। হঠাৎ কোত্থেকে একটা শঙ্খীনি এসে বউটাকে কেটে দিল। ডাক্তার ডেকেছিলাম। কাজ হয়নি। মনে মনে ঈশ্বরকে ডেকেছি। তিনি শুনেছিলেন। সেদিন রাতেই স্যাঙাত পাঠিয়ে ঈশ্বর আমার হৃদয় চুরি করেন। মনের ঘন্টা বাজায় আঁচ করতে পেরেছিলাম। তেমন তো অক্ষমেরাও পারে !
আজকাল ঘুমের ঘোরে মাঝে-মধ্যে সেই ঘন্টার আওয়াজ পাই। হয়তো স্বপ্ন। নাকি ঘন্টারই আবছা শব্দ ? ঘন্টা হলে, সেটা কি মোখলেস চাচার ছুটির ঘন্টা, না পরীক্ষা শেষ হওয়ার পনোরো মিনিট আগের ঘন্টা, নাকি ঈশ্বরের ঘন্টা, কে জানে ?