জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাতটা চোখের পাতায় পার করে সকালবেলা ভাবছি,কি লিখবো ? আমি অতি ক্ষুদ্র লেখকমাত্র। চিকুরপুরের মজা পুকুরটার পাশেই আমার ঘর। ইস্পাতের সুতোয় বোনা,বাবুইয়ের বাসার মতো। একটা বারান্দাও আছে। আর কিছু বইপত্র। শুধু লেখার মতো একটু কাগজ আর কলম নেই ! এমন সময় কানে বজ্রাঘাত-"চাল্লু আহেন মাম্মু,পরিবর্তন আইইছে। পানির দরে মাছ-তরকারি লইয়া যান ঘরে।'তিন লাফে বারান্দায় গিয়ে দেখি এক তরিতরকারীওয়ালা্ ভ্যান সাজিয়ে দাম হাঁকছে,'পদ্মার ইলিশ ১০০ টাকা,রু্ই ৫০ টাকা,তেলাপিয়া ৪০ টাকা কেজি। আলু,পটল,পেঁয়াজ.বেগুন,বেবাক এক কেজি কইরা নিলি মাত্র ২০ টাকা।' বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো,ভুল শুনলাম না তো ! কানটা বাগিয়ে ধরলাম,হ্যাঁ ঠিকই তো,সুমধুর শব্দগুলো ঠিক ঠিক কানে খৈয়ের মতো ফুটছে ! আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। চেয়ারটা ছেড়ে গায়ে জামাটা পেঁচিয়ে সোজা রাস্তা-'এত সস্তা ?'
দু হাত কচলে শুশ্শ্রুমন্ডিত বিক্রেতার বিনীত উত্তর-'মাম্মু, গন্ডগোলের বছরকার পরেরত থেইক্যা গত কা্ইলক্যা পর্যন্ত যে দ্যাশ ছিল,তার তামাম সাফ।জনগনই ভোট দিয়্যা পরিবর্তনের ডাক দিছে। তাই আইজ থেইক্যা আমিও সসতায মাল বিক্রি করতিছি।'
কি বলবো ভাবছিলাম। এমন সময় দেখি পাড়ার বিশ্বনিন্দুক,কুটিল ও একধারে নাস্তিক জগদুল চাচা চোখে মাথায় টুপি ও সুরমার আস্তরন মেরে হেটে যা্চ্ছেন।এড়নোর প্রচেষ্টায় মাটিতে কিছু একটা খোঁজার ভান করলাম। কিন্তু ওপরওয়ালা তা মানবেন কেন ? জগদুল চাচা আমার সামনে দাঁড়িয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে বললেন-' এত আনন্দ কোথায় রাখি, কও তো বাপু ? দ্যাশের মানুষ যে কি ভাল,তা আমার মতো অধমের পক্ষে বলা অসম্ভব। সবার দিলে একটা আধ্যাত্নিক বোমা ফাটছে। তাই সবাই কেমন পাল্টাইয়া গেছে !' ঘা মারার সুযোগ ছাড়লাম না। মনে করিয়ে দিলাম-'কিন্তু,চাচা আপনি তো এতদিন মোড়ের চায়ের দোকানটাতে কূটনামির দানছত্র খুলে বসেছেন, তাছাড়া মুনকার ব্রাদার্সদের নিযেও আপনার খুব একটা মাথাব্যাথা নেই্। ওই যে পুবাকাশে তাকিয়ে দেখুন,সুর্যটাও টাঙানো আছে ঠিকঠাক। হঠাৎ আজ কি হলো ?'
-'পরিবর্তন,সবই পরিবর্তনের মারপ্যাঁচ রে,বাছা'-বলে জগদুল চাচা পা বাড়ালেন। আমি পেছন থেকে শুনতে পেলাম-'বিশ্বনবী মোস্তফায় রাস্তা দিয়া হাঁইট্যা যায়,একটা পাখি বইস্যা ছিল গাছেরও শাখায়।'
শরীরটা খারাপ লাগতে শুরু করলো। বাড়ি ফিরবো ভাবছি,হঠাৎ পৌরসভার একটা অর্ধউলঙ্ঙ্গ গাড়ী খ্যাঁক্ করে ব্রেক কষে সামনে হাজির। চারপাঁচটা টোকাই ও কয়েকজন ধোপধুরস্থ লোক আমাকে দেখে প্রথমে সালাম দিল,তারপর করজোড়ে বললো-'মাননীয় মহোদয়,আমরা পৌরসভা থেকে দেখতে এসেছি সমস্ত অঞ্চল,বাসবাড়ি ও লোকালয় পরিষ্কার আছে কিনা,মশার উৎপাত নেই তো ? আমাদের সঙ্গে ঝাড়ুদার,সুইপার তো আছেই,এমনকি জলবিয়োগের রেখাচিত্র নির্মূলকারী ও সিগারেটের মুথা সংগ্রহকারী পর্যন্ত আছে। আর,প্লাষ্টিকের ওপর বিশেষভাবে প্রশিক্ষন টোকাইদের তো দেখতেই পাচ্ছেন। এবার, আপনার অন্দরে প্রবেশের রাস্তাটা যদি একটু দেখিয়ে দিতেন ?
ঘরের চাবীটা কোনমতে হাতে তুলে দিয়ে দু হাতে মাথাটা ধরে রাস্তার এক কোনে বসে পড়লাম। শরীরে চিমটি কাটলাম। স্বপ্ন দেখছি নাতো ! ফর্সা চামড়ায় একটা নাতিদীর্ঘ রক্তিম রেখা উঁকি দিয়ে ভুলটা ধরিয়ে দিল। নাহ ! এও সম্ভব ! এমন সময় শুনতে পেলাম-'ব্যাগ থাকবে কতক্ষন,ব্যাগ যাবে বিসর্জন।' দেখি ,পাড়ার বিখ্যাত তোলাবাজ মস্তান 'হা্ড্ডি সজীব'।হাতে বড় একটা ব্যাগ। এদিকেই আসছে। আমাকে দেখে নিষ্পাপ হাসি উপহার দিল। তারপর বললো-'মিয়া ভাই,এই যে ব্যাগটা দেখতিছেন না,বলেন তো এর ভিতরি কি আছে ?
বুকে হাতুড়ী পেটার শব্দ লুকিয়ে বললাম-'আমি কিভাবে জানবো?'
-'সত্য কইছেন মিয়াভাই,ইস ! বয়সকালে যদি এই পরিবর্তনটা হইতো,তাইলে আমার আর লালবাড়ী দেখন লাইগতো না। সে কতা যাউকগ্যা,এই ব্যাগটার ভেতর আমার পঁচিশ বছরের কাজ-কামের যন্ত্রপাতি আছে।'
-মানে ?
-দুইখান নাইনএম্এম,পাঁচটা রিভলবার,নয়টা পাইপগান,সঙ্গে আরও দুইখান কাটা রাইফেল আর কয়েকখান মিষ্টি।
--মিষ্টি!?
-'ও মোর খোদা,বোঝেন নাই ?' হাড্ডি তার কাঁকলাস ভাষ্কর্য ঝাঁকিয়ে বললো-' ককটেল।'
আমি তো থরহরি কম্পমান। মিনমিন করে শুধু জিজ্ঞেস করলাম-'তা,এই ব্যাগ নিয়ে সাতসকালে কোথায় যাও ? বড় কোন ফাইল আছে বুঝি ?'
-'ছি কানে ধরি। এখন ইছামতির জলে সব বির্সজন দিতে যাচ্ছি !'--এই বলেই ব্যাগটা মাথার ওপর বাউলদের মতো ঘুরাতে ঘুরাতে সে হাঁটা ধরলো,আর যপ করতে লাগলো-'ব্যাগ থাকবে কতক্ষন। ব্যাগ যাবে বিসর্জন।' বুঝলাম,পরিবর্তনের ধাক্কায় হাড্ডি সজীব রত্নাকর থেকে বাল্মিকিতে পরিণত হয়েছে।
বেলা গড়াচ্ছে। রাস্তা ছেড়ে উঠতে পারিনি। বউটা হয়তো ভাবছে,আপদ গেছে, ভালই হয়েছে। বাড়ির বাইরে থাকলেই তো ভাল। ভেতরে রামরাজত্ব !
হঠাৎ,রাস্তার উল্টো পাশের বাড়ির গেট খোলার শব্দ। দেখি মিষ্টার এবং মিসেস চৌধুরী হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে আসছেন। একি ! ভুল দেখলাম না তো ! পাড়ার সবাই জানে,চৌধুরী দম্পত্তির মাত্রাতিরিক্ত কলহ-বিবাদে উৎপন্ন শব্দদুষনের ফলে তাদের পাশের বাড়ীর রতন সাহেবের হার্ট-অ্যাটাক হয়েছিল। চায়ের দোকানে সবাই বলাবলি করে,রতন সাহেব নাকি ভেবেছিলেন চৌধুরীর বাসায় কোন ধর্ষণকারী প্রবেশ করেছে। কেউ একজন নাকি গলা ফাটিয়ে বলছিল-' আজ তোর ইজ্জত লুটে হত্যা করবো।' বিপরীতে নারীকন্ঠ চিৎকার-'উউহ,পারে না কিছু করতে,উঠে পড়ে রাত থাকতে।'
সে যাই হোক,যুগলকে জিজ্ঞেস করলাম-'দুজন হংসমিথুন হয়ে কোথায় চললেন ?
একসঙ্গে জবাব এলো-'বিবাহিত জীবনের উনিশ বছরে প্রথম সিনেমা দেখতে যা্ছি।'
বাস্তব সিনেমার সমীকরন মেলানোর তাগিদে বাড়ি ফিরলাম। হঠাৎ ভূমিকম্প ! ঘুম ভেঙ্গে চোখ মেলে দেখি,আমার অর্ধাঙ্গীনি চেয়ার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ত্রাহি চিৎকারে বলছে-'লোকটা কী যে সব আবোল-তাবোল ভাবে আর পাগলা কানাইয়ের মতো লেখে ! পত্রিকা-ব্লগগুলোরও খেয়ে কাজ নেই,এসব ছাইভষ্ম ছাপে।ওঠো,বাজারে যাও।'
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১০:৫০