সবুজ বরফির মতো নিমের মিহিদানা পাতাগুলো বেয়ে সোনা রোদ এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। সেখান থেকে ঠোক্কর খেয়ে বিছানাতে। আমার পাশেই বৃত্ত একে শূয়ে আছে কুন্ডলীপাকিয়ে। হঠাৎ কানে এলো কি একটা অজানা পাখি যেন ডাকছে। সাড়া দিতে কাজ ফেলে মা এসে দাঁড়ালো জানালায়। ক্ষয়া শিকের ফাঁক গলে মায়ের চোখ আটকে গেল আমাদের প্রতিবেশীর শরীরে। সুলতানের চিত্রার মতো চিত্রবিচিত্র প্রতিবেশী পাতার আড়ালে লুকিয়ে অবিশ্রান্ত ডেকে যাচ্ছে পাখিটা। যেন, তার ঠোঁট ফেটে চুঁইয়ে পড়ছে অনেক পুরোনো দিনের কাতরতা।
'দেখ কি সুন্দর পাখিটা !'-মায়ের গলায় বালিকাসুলভ উল্লাস। 'ওর নাম জানিস নাকি ?'
-'কোথায় দেখি ?'
জ্বরে শরীরটা পুড়ে খাক। তবুও অলসতা কাটিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। নিমের ঘরে চোখ রাখতেই দেখি সবুজ পাতার ভাঁজে জীবন্ত হলুদ। -'কুটুম পাখি।'
সেই চৈত্রের কাঠফাটা দুপুরে বহুপুরোনো জানালার ক্ষয়া ফ্রেমে আজও স্থির হয়ে আছে মা আর তার সন্তানের কুটুম পাখি দেখার দৃশ্যটি।
জল্লাদের যেমন কিছু করার থাকেনা,হাতল টানা ছাড়া। তার হাত আর হাতলের দুরত্ব যতটুকু,মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তের আয়ুও ঠিক ততটুকু।
নিমগাছটাকে কে বা কারা যেন মৃত্যুদন্ড দিল !
নিশুতি রাতেও দেখেছি তাকে। ফিনিক জোসনায় জানালা খুলে। ওর মর্মর আর্তনাদ বাতাসে শিষ কেটে আমার বুকে এসে বিধেঁছিল। হয়তো বুঝতে পেরেছিল,আজই ওর শেষরাত। বাতাসে নাক ডুবিয়ে কিছু শেষ নিঃশ্বাস নেয়ার। বুঝতে পেরেছিল কি,সারারাত মাথার ওপর জেগে থাকা তারাগুলো আর কোন দিন কোটি কোটি বছর পেরিয়ে আসা আলো দিয়ে স্পর্শ করবে না ওর ডোরাকাটা বাকল। সবুজ বরফির মতো পাতাগুলোও আর কোনদিন সুর্যের রিলিফ নিয়ে তাদের রসুই ঘরের উনুন চাপানোর সুযোগ পাবে না। মাটির যত গভীরেই ওর শেকড় প্রোথিত থাক না কেন,কাঠুরের কুঠার সেই বন্ধন বিদীর্ণ করতে বিন্দুমাত্র বেগ পাবে না।
কিন্তু বেপারীর বেগ থামাতে উষার আগেই হাজির ফাঁসুড়ে। হাতে কুঠার। চোখে খুনের নেশা। প্রথমে জরিপ চললো অনেকক্ষন ধরে,তারপর দড়ি বেঁধে দিলেন গাছটার দু হাতে। মাইকেল অ্যাঞ্জেলো যে মমতায় তার ফ্রেসকোগুলো আঁকতো ঠিক ততখানি মমতা দিয়েই ফাঁসুরে তার কুঠারকে নামিয়ে আনলো নিমগাছটার গর্দানে। বারবার !
রক্ত ছিটকে এসে পড়লো জানালায়। যেখানে মা আর সন্তানের পাখি দেখার দৃশ্যটি আজও স্থির হয়ে আছে। তবে কোনও আর্তনাদ শুনতে পাইনি।
খুনটির একমাত্র সাক্ষী হয়ে রইলাম আমি। কাজের মেয়ে বললো-'অ্যানে ফিলাট(ফ্লাট) উটপি চাচীমা।' মায়ের অসম্ভব সুন্দর চোখদুটো শুধু একবার পিলসুজে বাতির মতো জ্বলে উঠলো ! ধরা গলায় মা বললো-'ওই কুটুম পাখিটা আর আসবে না......তাই নারে খোকা ?'