somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প : শিশির

১৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১০:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

।। নাসীমুল বারী ।।
নতুন এপয়েন্টমেন্ট পেয়ে অফিসে ঢোকে সুফলা।
কুশলাদী আর পরিচয়ের শেষ পর্যায়ে যায় একাউন্ট্যান্ট নিয়াজ সাহেবের টেবিলে। নিয়াজ সাহেব একটু থমকে তাকিয়ে থাকেন সুফলার দিকে। ক্ষণিকপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন—ও, সরি! বসুন। তা হোম ডিস্ট্রিক কোথায়?
এ প্রশ্নে সুফলা একটু হেসে বলে—জন্ম রাজধানীতেই। তবে পৈত্রিক নিবাসটা নাই বা বললাম।
অনাবিল হাসির এ বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরে চেয়েই থাকেন সুফলার দিকে। এ চাহনীতেই তিনি মনে মনে ভাবেন দারুণ তো! তারপরই সুফলাকে বলেন—থ্যাংকস্। চা চলবে এক কাপ?
—নো। নো। থ্যাংকস্।
সুন্দর ছিমছাম অফিসে প্রথম দিনটা এনজয়েবল হয়েছে সুফলার। অফিসের সহকর্মীরা বেশ আন্তরিক আর চমৎকার।

একদিন ছুটির পর অফিস থেকে বেরিয়েছে মাত্র অমনি পেছন থেকে পাশে এসে দাঁড়ায় নিয়াজ সাহেব। একটু হেসে বলেন— সেদিন তো চা খান নি, আজ এক কাপ কফি হয়ে যাক। শুধু এক কাপ কফি।
কথার চমৎকারিত্বে এমন অফারটা ফিরিয়ে দিতে পারে নি সুফলা। তাই মুচকি হেসে বলে—ওকে।
পাশেই এক ফাস্টফুডের দোকানে ঢোকে দুইজনে। মাঝামাঝি এক টেবিলে বসে কফির অর্ডার দেয়। সুফলা বলে—অন্য কিছু? সেটা না হয় আমিই - - -।
—নো। আজ আমার গেস্ট, অতএব আমিই- - -।
—ওকে।
কফি এসে পড়ে। কাপে চুমুক দিতে দিতে নিয়াজ সাহেব বলেন—আমার একটা কথা শুনবেন?
একটু চমকে চোখটা বড়ো করে সুফলা ভাবে চিরাচরিত দৃশ্য। রিলেশনের একটা অফার। যা ভেবেছে তা-ই; সুফলার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই বলে ফেলেন নিয়াজ সাহেব—অফিস ডেকোরাম অফিসে। বাইরে আমি আপনাকে তুমি করে বলবো। আমার খুব ইচ্ছে।
সুফলা কফির কাপটা টেবিলে রেখে মাথাটা নিচু করে থাকে ক্ষণিক। তারপর সাহস নিয়ে বলে—ওকে।
কফিটা একটু দ্রুতই শেষ করে দাঁড়ায় সুফলা। স্মীত হাস্যে শান্ত কণ্ঠে বলে—আজ উঠা যাক।
কোন কথা না বলে সুফলার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো নিয়াজ।

বাসায় ফিরে ভাবনায় পড়ে সুফলা। ভদ্রলোক সরাসরি বলেই ফেললো ‘তুমি' করে বলবে! কফির অফারও দিলো। অথচ নিয়াজ সাহেবকে তুমি বলার প্রস্তাব দেন নি। আলতো পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। তারপর নিজে নিজেই বলে—বাহ! ইনজয়এবল ঘটনা। দেখা যাক ভদ্রলোক কতদূর এগোয়!

সুফলা অফিস করে নিয়মিতই।
নিয়াজ সাহেব খুব একটা নয়— মাঝে মাঝেই এসে তার কাছে বসেন। হেয়ালীভাবে দু'চার কথা বলেন। আবার চলে যান। মুখ ফুটে কোন কথাই বলছে না বলে সুফলা বেশ কৌতূহলে আছে। এনজয় করছে ব্যপারটা! মনে মনে হাসে তাই।

আজ অফিসে যাবে না সুফলা। ছুটি নিয়েছে। কোন কারণ নেই—এমনিতেই বাসায় থাকবে।
নাস্তা সেরে মাত্র টিভির সামনে বসেছে। কলিং বেল বেজে ওঠে। দরজা খুলতেই সুফলা ভূত দেখার মতো চমকে যায়। দরজার সামনে নিয়াজ সাহেব। নিজেকে সামলে সুফলা একটু শান্ত হয়ে বলে— আসুন।
রুমে ঢুকে দাঁড়িয়ে থেকেই অনেকটা অযত্নে আনা পাটের ব্যাগের একটা প্যাক কাঁপা কাঁপা হাতে এগিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে—তোমার জন্যে।
চমকে সুফলাও নিচু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে—কী ওটা?
—শাড়ি।
—শাড়ি?
আরও ভীষণ চমকে যায় সুফলা। তবু নিজেকে সামলে বলে—শাড়ি কেন?
—তুমি পরবে। সাজবে। তারপর - - -।
—তারপর কী?
—আমি দেখব। মন ভরে দেখব আর ভাববো।
—কী ভাববেন?
লাজুক একটা হাসি দিয়ে বের হয়ে যায় রুম থেকে। সুফলাও উঠে যায় ওর রুমে। শাড়িটা পরে ম্যাচিং চুড়ি, অলঙ্কার আর কসমেটিকে সেজে আসে ড্রইংরুমে।
না, নিয়াজ ফিরে আসে নি। ধীর পায়ে এগিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেটের দিকে আগায়। নিয়াজের দেখা মেলে না। কী ব্যাপার! নিয়াজ সাহেব শাড়ির সাজ দেখতে চেয়েছিল, কিন্তু গেল কোথায় এখন? আসছে না যে? আচ্ছা আজ হঠাৎ উনি শাড়িটা দিল কেন? কিংবা সুফলাইবা তাঁর এক কথায় শাড়িটা পরে এলো কেন?
তবে কি সুফলা সত্যি সত্যি প্রেমে পড়েছে? ধ্যাৎ ছাই, কেন তাঁর জন্যে অপেক্ষা?
উঠে গিয়ে সুফলা শাড়ি বদলে ফেলে। নিয়াজ সাহেব কিন্তু আর আসেন নি।
তার পরদিনও না।
দুই দিন।
সপ্তাহ।
পেরিয়ে গেল পক্ষকালও। নিয়াজ সাহেব কিন্তু আর আসেনই নি সুফলার বাসায়। এমনকি অফিসেও দেখা মেলে নি। হয়ত ইচ্ছে করে ওর এদিকে আসেন নি। কী লজ্জারে বাব্বা!

সকালে অফিসে যেতে বেরোয় সুফলা। গেটে আসতেই ওর এক কলিগ মুহিত সাহেব আসেন। সুফলাকে দেখে বলে—অফিসে যাচ্ছেন তো?
—হ্যাঁ।
তারপর কেমন যেন অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু ভীতু ভীতু ভাবও। সুফলা উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করে— কী হয়েছে? কোন সমস্যা?
—নিয়াজ সাহেবের খবর জানেন না?
ধক্ করে উঠে বুকটা। লোকটা অবচেতন মনে কিছু একটা ঘটিয়েছে নাকি? ভাবনার ইতি টেনে সুফলা বলে—কী হয়েছে? কোথায় ও? সরি, কোথায় উনি?
—উনি যে হাসপাতালে আপনি জানেন না?
একটু থেমে আবার শান্তকণ্ঠে বলে—আজ কতোদিন যে অফিসে আসেন না, একটুও তো খোঁজ নিলেন না।
সুফলা ব্যাপারটা অন্যভাবে ভেবেছে। দুইজনের প্রতি দুইজনের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যায়—সে ভয়ে কোন খোঁজই নেয় নি। এখন শান্তকণ্ঠে মুহিত সাহেবকে বলে— সরি। আ-স-লে- - - আমি তো নতুন, বুঝতে পারি নি। ভাবছি উনি হয়ত অফিসের কাজে কোথাও গেছেন। যাক, কী হয়েছে উনার?
—ক্যান্সার। মৃত্যুর পথে এখন।
একদম থমকে যায় সুফলা। মৃত্যুর পথে এখন নিয়াজ সাহেব! ইন্টারনেটের মতোই দ্রুত সব ঘটে গেল! আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না সুফলা। বসে পড়ে গেটের সামনের সিঁড়িতেই।
চোখ মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে মুহিত সাহেব শান্তকণ্ঠে বলেন—আমরা সবাই যাচ্ছি দেখতে, আপনিও চলুন।
মাথাটা তুলে আলতো মেজাজী কণ্ঠে সুফলা বলে—আপনাদের সাথে যাব না। আপনারা কেমন মানুষ? এতদিনেও কেন আপনারা আমাকে খবরটা দিলেন না?
—আমরা কি জানি যে আপনি জানেন না?
—তা হলে আজ?
—এখন উনিই আপনাকে দেখতে চেয়েছেন।
—আমাকে! দেখতে চায়?
কেমন যেন চুপসে যায় সুফলা। আর কোন কথা না বলে সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ায়। তারপর একসাথে রওয়ানা দেয় হাসপাতালের দিকে।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে নিয়াজ সাহেব। আরো অনেক লোক—সহকর্মী, আত্মীয়। সুফলা তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আলতো ডাক দেয়—নিয়াজ সাহেব।
পাশ ফিরে তাকায়।
কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তারপর হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে একদম মৌন কণ্ঠে বলেন—এখানে বসো।
কান্না কান্না ভাব নিয়ে সুফলা বসে বিছানায়।
নিয়াজ সাহেব তেমনি কন্ঠে বলেন—আমার মায়ের শাড়িটা চুরি করে তোমাকে দিয়েছিলাম। ওঠা পরিয়ে তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম আমার ছোট্ট বোন বকুলের মতো।
—আপনার বোন বকুল এখন কোথায়?
—ও তো মরে গেছে। এখন ও মহাকালের ক্যানভাসে। ও নেই আমার আঙ্গিনায়, আছ তুমি। তোমাকে ঠিক ওর মতোই মনে হয়। প্রথম দেখাতেই আমার তা-ই মনে হয়েছিল। ও মায়ের এ শাড়িটা পরে প্রায়ই সাজতো। তাই তো---।
আর কোন কথা না বলে পাশ ফেরেন।
সুফলা দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ফুপিয়ে ওঠে।
#
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সংস্কার না করেই ডক্টর ইউনুসকে বিদায় নিতে হবে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে মে, ২০২৫ রাত ৯:৫৯



সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের জন্য ডক্টর ইউনুসের সরকার জুন’২৬ পর্যন্ত সময় চেয়েছেন। সেনাপ্রধান ও বিএনপি তাঁদেরকে ডিসেম্বর’২৫ এর বেশী সময় দিতে সম্মত নয়। আওয়ামী বিরোধী আন্দোলনে বিএনপি আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশের দরীদ্র সমাজ এখনো ফুটপাতে ঘুমাচ্ছেন

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২৪ শে মে, ২০২৫ রাত ১:৪৪

বেরিয়েছিলাম উত্তরা যাওয়ার উদ্দেশ্যে। মানিক মানিক মিয়া এভিনিউ পার হওয়ার সময়ে, খামারবাড়ির সামনে গোল চত্বরে হঠাৎ চোখ গেলো। চত্বর ঘিরে সারি সারি মানুষ শুয়ে আছেন। গত সরকারের আমলে আমার এলাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড. ইউনূসের ক্ষমতার ভারসাম্য এবং পিনাকী গং-এর সংঘবদ্ধ মিথ্যাচার ও সামাজিক প্রতারণা

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২৪ শে মে, ২০২৫ ভোর ৫:৪৬


এই পোস্টটি মূলত ঢাবিয়ানের পোস্ট "বিএনপি - জুলাই বিপ্লবের বিশ্বাসঘাতক" এবং জুল ভার্নের পোস্ট "আব তেরা ক্যায়া হোগা কালিয়া!"-এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে লেখা।

বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংস্কারের দাবির বিষয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বর্তমান রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থার প্রেক্ষাপট এবং প্রত্যাশা......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২৪ শে মে, ২০২৫ সকাল ৭:১১

বর্তমান রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থার প্রেক্ষাপট এবং প্রত্যাশা......

বিএনপি নেতারা ডক্টর ইউনূসের দেখা করতে সময় চেয়ে এক সপ্তাহ ধরে ঘুরতেছেন। কিন্তু ইনটেরিম প্রধানের শিডিউল- ই পাচ্ছেনা। আর ওদিকে নাহিদ শুনলেন, ডক্টর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ওগো ভিনগেরামের নারী, তোরে সোনাল ফুলের বাজু দেবো চুড়ি বেলোয়ারি......

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ২৪ শে মে, ২০২৫ সকাল ১১:২৯


সেই ছোটবেলায় আমার বাড়ির কাছেই একটা বুনো ঝোপঝাড়ে ঠাসা জায়গা ছিলো। একটি দুটি পুরনো কবর থাকায় জঙ্গলে ছাওয়া এলাকাটায় দিনে দুপুরে যেতেই গা ছমছম করতো। সেখানে বাস করতো এলাকার শেষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×