বেলাশেষে (২০১৫)
অভিনয়েঃ সৌমিত্র চ্যাটার্জি, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত
আমার নিজস্ব কিছু ভাবনা
বিবাহিত জীবনের ৪৯ বছর পরে, জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে বিশ্বনাথ মজুমদারের হঠাৎ মনে হলো তাঁদের বৈবাহিক সম্পর্কে আসলে প্রেম বা ভালবাসা বলে কোনকিছুর অস্তিত্ব ছিল না। সবটাই অভ্যাস, আর দায়িত্ব। তিনি এ দায়িত্বের শেকল থেকে মুক্তি চান, ৪৯ বছরের বিবাহিত জীবন থেকে মুক্তি চান, চান বিবাহবিচ্ছেদ! সিনেমার শুরুটা এভাবেই।
তারপরে আসে বিভিন্ন সাংসারিক টানাপোড়েন, প্রেম এবং অভ্যাসকে গুলিয়ে ফেলা, পরস্পরকে নতুন করে আবিস্কার করা, মমতা, নির্ভরশীলতা, বিশ্বাস...চমৎকার একটা মুভি! অনেকদিন পরে কিছু দেখতে বসে বারবার চোখ ভিজে উঠছিল। আবেগাপ্লুত হয়ে যাচ্ছিলাম। কলকাতায় আজকাল এত চমৎকার সব মুভি বানায়! আর অভিনয়...বিশেষ করে আরতি দেবীর ভূমিকায় স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হতেই হয়। এই বয়সে এত চমৎকার অভিনয় করেছেন, মনে হয়েছে তাঁর প্রেমে পড়ে যাই।
এইবার... এইবার কিছু তিতা কথা কই। আগেই স্পয়লার এলার্ট দিয়ে রাখি। যারা ভূয়সী প্রশংসা শুনে মুভিটি দেখে আবেগে আপ্লুত হতে চেয়েছিলেন তারা আমার এই লেখা এড়িয়ে যান।
স্বামী ভদ্রলোকটি আজীবন বাইরে কাজ করলেন, বই-পুস্তক, লেখক, পাঠক নিয়ে সময় কাটালেন, ঘরের ভেতর কিভাবে কি হয়ে যাচ্ছে তার কোন খোঁজই কোনদিন রাখেন নি। চারটা সন্তানকে গর্ভে ধারণ, তাদের জন্ম, লালন পালন, এত বড় একটা বাড়ির দেখাশোনা, বাচ্চাদের পড়াশোনা, অসুস্থতা, কাজের লোকদের সামাল দেয়া, রান্না করা, এবং স্বামী ভদ্রলোকটির পায়ের জুতা থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুর দেখভাল করা, তাঁর জীবনকে নির্বিঘ্ন করা যাতে তিনি বাইরের লোকের কাছে বিদ্বান দ্বিজ্ঞজ হিসেবে পরিচিত হতে পারেন...সবকিছু একা হাতে করেছেন স্ত্রীটি। বিয়ের পর পরই অসুস্থ শ্বশুরের দেখাশোনার দায়িত্বও পড়েছিল সেই স্ত্রীটির কাঁধে। প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে স্বামীর দেয়া আলতা আর পায়েল পরে কেন বধূটি মন ভোলাতে আসেন নি তাই নিয়ে তাঁর অভিমান। অথচ বধূটি সেবা করছে তাঁরই বাবার, নিজের বাবার সেবা কিন্তু তিনি নিজে করেন নি। এত এত সব সাংসারিক দায়িত্ব যদি স্ত্রীটি পালন না করতেন তাহলে কিন্তু অপবাদের বোঝাও তাকেই বইতে হতো।
আর কিনা শেষবেলায় এসে স্বামীর মনে হলো স্ত্রীটি কেন কিছুই পারেন না। কেন লাইব্রেরিতে কাজ করলেন না, কেন এত এত বই পড়ে পন্ডিত হলেন না, কেন ব্যাংকের লেনদেন করতে জানেন না, কেন তাঁর স্ত্রীটি স্বাবলম্বী নন! হু মানতেই হয়, ৪৯ বছর আগের এক বালিকা বধূ খুব পড়ালেখা জানতেন না, চাকরি করবারও সুযোগ তার ছিল না। কিন্তু সেই সুযোগ থাকলেই কি আর না থাকলেই কি! মজুমদার সাহেবের বড় ছেলে আর বউয়েরতো এই সমস্যা ছিল না। তারা প্রেম করে বিয়ে করেছিল, বউটি পড়ালেখা জানা শিক্ষিত মেয়ে, নিজ হাতে বুটিকের ব্যবসা করছে...স্বাবলম্বী। তাওতো ছেলেটির বউয়ের উপর থেকে মন উঠে গেছে। কারণ কি? আর কিছু নয়, সাংসারিক অভ্যস্ততায় তাদের প্রেমটা চাপা পড়ে গেছে। যে টিপটপ প্রেমিকাকে দেখে সে মুগ্ধ হয়েছিল ঘরের আটপৌড়ে জীবনে তার দেখা আর পাওয়া যায় না। যার মেধা, বুদ্ধির ধার তাকে পেশাগত জীবনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিয়েছিল, এখন আর তার সাথে এসব বিষয় নিয়ে আলাপ করবার সুযোগই হয় না। বাড়ি ফিরলেই রোজ পুরনো কাসুন্দি বাচ্চার স্কুল, পড়া, সংসার খরচ, কাজের লোক...এসব করতে করতেই রাত পার হয়ে যায়। তাই ছেলেটিকে বাইরের চটক খুঁজে নিতে হয়। এখন আর সে তার ইন্টেলেকচুয়াল আলোচনার জন্য স্ত্রীর কাছে আসে না, চলে যায় অন্য একজনের কাছে।
এই হয়...এই হয়ে আসছে। আর এইখানেই আমার আপত্তি। আরতি দেবীর "বাহিরটা তুমি সামলাবে, আর ভিতরটা আমি...এমনই কথা ছিল।" এই কথাটিতেই আমার আপত্তি। সংসারতো একজনের নয়, স্ত্রীর যেমন দায়িত্ব আছে স্বামীরও আছে। দুইজনের সমঝোতায় সংসার চলে। দুজন দুজনের শারীরিক মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দেখভাল করলে তবেই সংসার সুখের হবে। মজুমদার সাহেব যদি বাহিরের কাজের সাথে সাথে তাঁর স্ত্রীটিকেও ঘরের কাজে একটু সাহায্য করতেন, তবে তাঁর অনেকটা বাড়তি সময় থাকতো, তিনি তখন কিছু পড়তে পারতেন, কিংবা একটু বাইরেও যেতে পারতেন, স্বামী ভদ্রলোকটির সাথে বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় অংশ নিতে পারতেন, তাঁদের কথাবার্তা তেল-নুন, বাচ্চা, কাজের লোকে আটকে থাকতো না, তাঁর সমস্ত টেনশন বধূবরণ সিরিয়ালের কনকের জন্য হতো না। মজুমদার সাহেব যদি নিজের জুতোজোড়া নিজেই খুঁজে নিতেন, নিজের কাপড় নিজের ধুয়ে রাখতেন কিংবা খাবার পর বাসন কোসন তুলে রাখতেন তাহলেও তাঁর স্ত্রীটির কাজে একটু সাহায্য হতো। তিনিতো তা করেন নি। বাহির আর ভিতর বলে আসলে কি কিছু আছে! সবইতো সবার, দুইজনের সমান অংশীদার। স্বামীটি যা চাইবে সেটাই স্ত্রীর চাওয়া কেন হবে? কেন হতে হবে? তার নিজস্বতা কেন থাকবে না? এখানেই আমার আপত্তি।
তবে হ্যাঁ তারপরেও সিনেমাটা অনেক অনেক সুন্দর। অনেক কিছু শেখার আছে এই মুভি থেকে। প্রত্যেক স্বামী-স্ত্রীর অবশ্যই পাশাপাশি বসে এই মুভি দেখা উচিৎ। সংসার, দাম্পত্য শুধু যে অভ্যাসের ব্যাপার নয়, এই অভ্যাস, মমতা, নির্ভরতার পাশাপাশি প্রেমও আছে...আর সেই প্রেম যে এমনি এমনি হয় না, চর্চা করতে হয় সেটা শেখার ব্যাপার আছে। সবকিছু একপাশে সরিয়ে রেখে দুজনের আলাদা করে, একান্ত কিছু সময় কাটানোর প্রয়োজন আছে, সেটা শুধু শারীরিক নয়, একটু ভালবাসার স্পর্শ বা দুজনের আগ্রহের বিষয় নিয়ে টুকটাক গল্প...এরও দরকার আছে। ভালবাসি ভেবে নিজের ভেতর চেপে রাখলেই হয় না, সেটা প্রকাশেরও প্রয়োজন আছে। আর যারা এটা নিজেরা বোঝে না, তাদের জন্য এই মুভিটা দেখা খুব জরুরি। আমি বলবো দেখুন, ভালবাসার মানুষটির পাশে বসে, হাতে হাত রেখে এই সিনেমাটা দেখুন। আপনার মন বদলাবে, নতুন করে ভাবতে আর ভালবাসতে ইচ্ছা হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:০৩