১-১
একটু তোমায় নিলাম আমি
এক চিমটি মেঘে থামি
জলের ছিটেয় নিলেম পাগলামি
একটু তুমি বুকের ভিতর
বেপরোয়া শ্রাবণ ভাদর
ভাসাও ডোবাও তোমার-ই আমি।
রিকশায় যখন আনন্দ চৈতীকে কাঁধের ওপর জড়িয়ে ধরে সে নরম লতার মত নুয়ে পড়ে, আনন্দর চওড়া বুকে সমর্পণ করে নিজেকে। আজ চৈতীর খুব খুশির দিন। পথের দূরত্ব আর নাগরিক ব্যস্ততা ওদের সচরাচর কাছে আসবার সুযোগ দেয় না তেমন। তাই যেদিন আনন্দর সাথে দেখা হয় সেদিন ও যেন হাওয়ায় ভাসতে থাকে, খুলে দেয় মনের অর্গল, প্রচন্ড উচ্ছাসে হাসে, গান গায় গলা ছেড়ে, দাপিয়ে বেড়ায় শহর জুড়ে, শিহরিত হয় গভীর আবেগে, সমর্পণ করে পরম বিশ্বস্ততায়। ওদের সামনে পিচ ঢালা কালো রাস্তাও রঙ্গিন ফুলের বাগান হয়ে ওঠে, গাড়ির ধোয়ায় ঝাপসা বাতাসে দেখে ঝলমলে ডানার প্রজাপতি, ভুলে যায় আশেপাশের পুরো পৃথিবীকে, সমস্ত চরাচরে তখন ওরাই একমাত্র মানব মানবী। এই একটা দিনের কয়েকটা ঘন্টা চৈতী সযত্নে মনের কৌটোয় তুলে নিয়ে আসে, রেখে দেয় গোপনে। এ হলো ওর আগামী দিনগুলোর সঞ্জিবনী শক্তি! চৈতী মুখ তুলে তাকায় আনন্দর চোখে, চাঁদের আলোয় চকচক করতে থাকা ওর কপালের ওপরকার চুলে আনন্দ চুমো খায়, তারপর নেমে আসে চোখের পাতায়, নাকে, তারপর ঠোঁটে। গভীর চুম্বনে নিজেদের প্রাণশক্তি পান করে ওরা।
আনন্দ আর চৈতী অনেকক্ষণ বসে থাকে লেকের পাড়ে, শেষ বিকেলের রোদের তেজ কমে নরম আলো ছড়িয়ে পড়ে, তারপর সে আলো নিভু নিভু হয়ে যায়, তারপর অন্ধকার নেমে আসে। অন্য এক পৃথিবীর মতো লেকের ওপাড়ের রাস্তায় ছুটে চলা গাড়ির হেডলাইট হঠাৎ হঠাৎ দেখা দেয়, আনন্দর গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকে চৈতী, গভীর আবেগে গান গায় আনন্দ। চৈতীর মনে হয় এ সন্ধ্যার স্থায়িত্ব হোক অনন্তকাল!
-আমাকে ভালবাসো? গান শেষে প্রশ্ন করে আনন্দ।
-হু । আদুরে বিড়ালের মতো গুনগুন করে ওঠে চৈতী। আরো একটু গুটিয়ে আসে আনন্দর বুকের কাছে। ওর দম বন্ধ হয়ে আসে, এতো ভালবাসা সহ্য করার ক্ষমতা ওর নেই। মনে হয় ভালবাসতে ভালবাসতে বুঝি মরে যাবে!
২-১
মরে যাবো রে মরে যাবো,
কি অসহায় আমি, একবার ভাবো।
-আচ্ছা শোনো আজকে একটা নতুন মুভি আনছি দেখবা?
ওপাশ থেকে কোন সাড়া আসে না। একটু চুপ থেকে আনন্দ আবার জানতে চায় একই কথা। এবারও চৈতী চুপ। -কি কথা বল না কেন? আনন্দ এবার অধৈর্য। অধৈর্য চৈতীও, ঠান্ডা কড়া গলায় বলে, 'খুব ফূর্তি না মনে? বাচ্চাদের এখন রাতের খাওয়া দিতে হবে। দুইজনকে খাওয়াতেইতো এক ঘন্টার বেশি চলে যাবে। তারপর কালকের জন্য রান্না, ওদের কাপড়চোপর গোছানো, নিজের খাওয়া, বিছানা গোছানো, ওদের ঘুম পাড়া্নো, তোমার কি মনে হয় এসব এমনি এমনি হয়ে যাবে? নিজেতো কোনদিন একটা কাজেও হেল্প করো না।'
আনন্দ প্রতিবাদ করে কিছু একটা বলতে চায়, তারপর আবার চুপ হয়ে যায়। এটাও ঠিক চৈতীর অনেক এক্সপেক্টেশন ও পূরণ করতে পারে না, তবু কিছুটা চেষ্টাতো করেই। কিন্তু সেটা খুব একটা যথেষ্ট হয় না। সারাদিন অফিস, লম্বা জার্নি করে চৈতী এমনিতেই বিরক্ত থাকে, তারপরে বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ততা। ও যেন আজকাল কেমন হয়ে গেছে! খুব রুক্ষ, বদমেজাজী, রাগী। ওর পরস্পর এঁটে থাকা ঠোঁট আর দৃঢ় চোয়াল দেখে আনন্দর মনে হয় এই চৈতীকে সে চেনে না। লুকিয়ে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনন্দ।
সারাদিন চৈতীর ওপর দিয়ে অনেক বেশি ধকল যায়। একটা সময় পর থেকে কেমন শরীর ভেঙ্গে আসতে থাকে। মনে হয় একটু শুয়ে থাকতে, একটু চোখ বুজে নিজের মতো করে সময় কাটাতে, কিংবা আনন্দর হাত ধরে চুপ করে বসে থাকতে। কিন্তু সময়-সুযোগ কোনটাই ওকে ফেভার করে না। ওর মনে বিষণ্নতার পলি জমে, ও প্রতিদিন আরেকটু বেশি মলিন হয়। বাচ্চাদের গল্প শুনিয়ে, গান গেয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে অনেক রাত হয়ে যায়। ওর খুব ইচ্ছে হয় আনন্দকে কাছে পেতে, একান্তে একটু সময় কাটাতে, ও একটা মুভি দেখতে চাইছিল, দুজনে মিলে দেখতে পারতো এখন। কিন্তু টের পায় আনন্দ ঘুমিয়ে গেছে অনেক আগেই। হয়তো সেও অপেক্ষা করে ছিল চৈতীর এগিয়ে আসার জন্য। লম্বা একটা দিনের ক্লান্তি দুচোখের পাতায়, আরো লম্বা একটা দিন সামনে, কিন্তু চৈতীর ঘুম আসে না। চিত হয়ে শুয়ে চৈতী অন্ধকারে সিলিং এর দিকে চেয়ে থাকে। চোখ জ্বালা করে, বুক ভেঙ্গে আসে, কিন্তু মাঝখানের দূরত্বটুকু পার হতে পারে না। অন্ধকার এক গহবরে চৈতী যেন ডুবে যায়, হতাশায় মরে যেতে ইচ্ছা করে।
১-২
তোমাকে ছেড়ে যাবো কোথায়?
তোমাকে ছেড়ে কি বাঁচা যায় ?
মেঘের-ই ওই নীলে তুমি জীবন দিলে,
এ বড় সুন্দর জ্বালায় আমায়
মেঘের-ই ওই নীলে তুমি জীবন দিলে,
এ বড় নির্মম পোড়ায় আমায়!
চৈতী যতটা চঞ্চল আনন্দ ঠিক ততটাই শান্ত, চৈতী আবেগের প্রকাশে যতটা উচ্ছসিত আনন্দ ততটাই চাপা, চৈতীর মধ্যে ছেলেমানুষী পাগলামিটা যত বেশি আনন্দ যেন ততটাই নির্লিপ্ত। তাই দিনে পাঁচবার চৈতী ফোন করে বিরক্ত করলেও আনন্দ পাঁচদিনেও হয়তো নিজে থেকে ফোন করে না। চৈতীর পাঁচ ছয়টা আবেগে ভরপুর এসএমএসের ফিরতি আনন্দর ছোট্ট একটা রিপ্লাই আসে। প্রতি সপ্তাহে চৈতী একবার দেখা করতে চাইলেও আনন্দ ঘুম বা অন্য কোন অজুহাতে পেছায় শুধু। চৈতী অভিমান করে, রাগ হয়, অস্থির হয়, পাগলাটে হয়ে ওঠে। তারপর কখনো কখনো হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়, আবার কখনো পাগলামির চূড়ান্ত করে ফেলে। শীতের সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা, রাতই বলা যায়। শহরের অন্য মাথা থেকে চৈতী এসে দাঁড়িয়ে আছে আনন্দর অফিসের সামনে। গত দুই সপ্তাহ অনেক চেষ্টা করেও আনন্দর নাগাল না পেয়ে আজ ছুটে চলে এসেছে। ইচ্ছে আনন্দ বের হলেই হালুম করে উঠবে মুখের সামনে।
আনন্দ খুব খুশি হয় চৈতীকে দেখে। কিন্তু কিছুতেই প্রকাশ করে না। শুধু ছোট্ট করে বলে, 'বিড়াল তুমি এখানে কেন!' চৈতী খলবল করে ওঠে, 'হ্যাঁ তুমিতো আমাকে ভুলেই গেছো। আর ভালবাসো না। কতদিন দেখি না তোমাকে বলতো? কতদিন ছুঁই না তোমাকে! আমি কি পারি থাকতে তোমাকে না দেখে? তুমি জানো না?' অভিমানে চোখ টলমল করে চৈতীর।
আনন্দ এক হাতে জড়িয়ে ধরে চৈতীকে, বাতাসের মত নরম করে বলে, 'পাগলি! আমিতো আছিই তোমার সবসময়। কোথায় যাবো বল! এতো কিসের ভয় তোমার?'
ওরা একসাথে বসে ফুচকা খায়, গভীর রাত জেগে ফেসবুকে চ্যাটিং করে। ওরা হুডখোলা রিকশায় বৃষ্টিতে ভেজে, খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আনন্দ ফোন করে গান শোনায় চৈতীকে। ওরা পাশাপাশি দেখে সূর্যাস্ত, রাতের খসে পড়া তারা দেখে দুজনে শহরের দু'প্রান্তে বসে ইচ্ছেপূরণের প্রার্থনা করে। এভাবেই গভীর বাঁধনে বাধা পড়ে দুজনে, আত্মার খুব কাছাকাছি।
২-২
একটু রাত ডুবে আসে
একটু আলো নীভে আসে
তুমি দূরে একা লাগে
মধুর ওই চাঁদটাকে
অ্যালুমিনিয়াম লাগে
হাঁটি আমি চাঁদ ও হাঁটে।
অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয়ে যায় আনন্দর। বাস থেকে নেমে দ্রুত হাঁটতে থাকে বাসার উদ্দেশ্যে। এমন সময় মোবাইলে টুং টাং করে এসএমএস টোন বেজে ওঠে। 'বাবুর ডায়াপার শেষ, নিয়ে এসো। আর একটা গায়ের সাবান।' ফেরার পথে দোকানে থেমে জিনিসগুলো নেয় আনন্দ, বড় মেয়ের জন্য একটা চকলেট। আরেকটু এগুতেই দেখে একটা ছোট মেয়ে হাতে এক তোড়া গোলাপ নিয়ে যাচ্ছে, দোকানের বাতিল, মলিন গোলাপ নিয়ে তোড়া বানিয়েছে বোঝা যাচ্ছে। তবে একেবারে খারাপও না অবস্থা। আনন্দর একবার মনে হয় চৈতীর জন্য নিবে! আবার অস্বস্তি হয় কখনো ওকে সেভাবে ফুল দেয়া হয় নি বলে। নিবে কি নিবে না ভাবতেই ফুলওয়ালা মেয়েটা অনেকটা পথ পার হয়ে যায়। মনের মধ্যে একটা খচখচে অনুভব নিয়ে আনন্দ বাসায় ফেরে।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর চৈতী বাচ্চাদের সাথে খেলায় ব্যস্ত। এমন সময় আনন্দ বলে, জানো আজকে তোমার জন্য ফুল কিনতে চেয়েছিলাম। চৈতী একটু থেমে যায়, মুখে সুন্দর একটা আলো জ্বলে উঠতে শুরু করে, গালের পাশে লালচে আভা, ব্যগ্র হয়ে জানতে চায়, 'কোথায় ফুল? আনো নি কেন?'
-আনি নি। এইসব ফুল দেয়া টেয়া আদিখ্যেতা মনে হয় আমার কাছে। তুমিতো জানোই।
চৈতীর মুখের আলো দপ করে নিভে যায়। একটা ছোট্ট হু দিয়ে উঠে চলে যায় বাচ্চাদের নিয়ে। আনন্দর মনে হয় তার সেই পুরনো দীপ্তিময়ীকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখতে পেয়েছিল বুঝি, কিন্তু সেই দীপ্তি জ্বলে ওঠার আগেই সে নিজেই নিভিয়ে দিল।
বাচ্চারা সেই রাতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল, সেই রাতে আকাশে ভরা পূর্ণিমা ছিল, সুন্দর মিষ্টি বাতাসও ছিল। চৈতী অনেকক্ষণ চুপচাপ বারান্দায় বসে ছিল, ওর ইনসমনিয়া বিয়ের বছরখানেক পর থেকেই। আনন্দও জেগে ছিল, অন্তর্জালের জগতে বুঁদ হয়ে। মাঝখানে শুধু দরজার পর্দাটা ঝুলছিল, কেউ সরায় নি। পার হয়ে আসে নি কাছাকাছি।
১-৩
মরে যাবো রে মরে যাবো,
কি অসহায় আমি, একবার ভাবো।
সন্ধ্যা ৭।১৫ঃ "তুমি কোথায়? ফোন ধরো না কেন?"
সন্ধ্যা ৭।২৮ঃ "প্লিজ ফোনটা ধরো। জরুরি কথা আছে।"
সন্ধ্যা ৭।৪৫ঃ "আমারতো টেনসন হচ্ছে এখন। ফোন ধরো প্লিজ।"
রাত ৮।২০ঃ "আমি কিন্তু এখন তোমার বাসার ল্যান্ডফোনে ফোন করবো।"
রাত ৮।৩৫ঃ "আমার যা ইচ্ছা হয় তাই কিন্তু করে ফেলবো। পরে আফসোস করোনা।"
রাত ৯।০০ঃ "ফোন ধরো প্লিজ। কেন ফোন ধরছো না তুমি!"
অবশেষে রাত সাড়ে বারটায় আনন্দ ফোন ধরে ঘুম ঘুম গলায়, 'হ্যাঁ বলো।'
চৈতী ফেটে পড়ে, 'তুমি কোথায় ছিলা?' আনন্দ শান্ত বরাবরের মতোই, 'ঘুমাচ্ছিলাম।'
-তুমি আমার এসএমএস পাও নি? আমি বলেছি জরুরি কথা আছে।
-বলো কি কথা।
চৈতী আর কিছু বলে না। ও বোঝে আনন্দ জানে ও কি বলতে এমন পাগল হয়েছে। সে নিজেও জানে আনন্দর উত্তর কি হবে। এতো আনন্দ শুরুতেই বলে দিয়েছিল ওকে, "আমার কাছে কোন কমিটমেন্ট আশা করো না। আমি বাঁধনে জড়াবো না। যেকোন সময় আমি চলে যেতে পারি, তোমারও সেই স্বাধীনতা আছে।"
এখন যদি চৈতীর বাবা-মা ওর বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে উঠেন, অসুস্থ হয়ে পড়েন, ওকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বিয়েতে মত দিতে বাধ্য করেন তাহলেতো ওর জন্য সমস্ত পথ খোলাই আছে। আনন্দ ওকে বাধা দেবে না। কিন্তু চৈতী মনপ্রাণে চেয়েছিল আনন্দ ওকে ধরে রাখুক, নিজের করে রাখুক। সারারাত ওর এক চিলতে বারান্দায় বসে থাকে চৈতী। বুকের ওপর পাথর চাপা, গলায় দলা পাকিয়ে উঠে কষ্ট। কিন্তু চোখে পানি আসে না। চৈতী খুব ভাল করে বুঝতে পারে আনন্দকে ছাড়া ওর পৃথিবী কতটা অর্থহীন, বুঝতে পারে আনন্দকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা কতটা অসম্ভব। আনন্দ কেন বোঝে না? আনন্দ কি ওকে ভালবাসে না? চৈতীর বুকের ভেতর কৃষ্ণগহবরের হাহাকার।
২-৩
ভালো লাগে না, লাগে না রে
বাঁচাবে আজ বলো কে আমারে?
বুঝিনা, জানিনা মেনেও মানিনা,
সে ছাড়া নেই আমি ঘোর আঁধারে,
এপারে ওপারে খুঁজি যে তাহারে
সে ছাড়া নেই আমি, চাই তাহারে।
চৈতী খুব ব্যস্ত আজকে। ছুটির দিনগুলোয় সংসারের জমে থাকা সব কাজ একসাথে সারতে হয়, তাই অন্যদিনের চেয়ে ছুটির দিনের ব্যস্ততাও বেশি। সকাল থেকেই পুরো বাড়িতে চরকির মতো ঘুরছে। ঘুম থেকে উঠেই বাচ্চাদের খাইয়ে ঘর ঝাড়ামোছা করল, আবার দৌঁড়ে রান্নাঘরে। রোজ বুয়ার রান্না খেতে হয়, তাই আজ সে নিজেই স্পেশাল কিছু রাঁধছে। আবার বাচ্চাদের গোসল, খাওয়া। নিজের খাওয়া। এরমধ্যে পুরো সপ্তাহে ব্যবহৃত জামাগুলো ইস্ত্রী করা। আবার ঘুরে এসে আনন্দকে তাড়া দেয়া ঘুম থেকে ওঠার, সময়মতো গোসল-খাওয়া সারবার। একটুখানি স্থির হয়ে বসবার ফুরসত নেই যেন। অবশ্য প্রতি সপ্তাহেই একই রুটিন। চৈতী খুব ধীর-স্থির, শান্ত, গোছানো গিন্নী গিন্নী হয়ে উঠেছে কয়েক বছরেই। ওকে দেখে আর আনন্দ ভাবে কোথায় গেল তার সেইসব ছেলেমানুষী পাগলামি, উচ্ছাস, চঞ্চলতা! কতই না বদলে গেছে মেয়েটা এই কয় বছরে!
সব কাজ সেরে দুপুরে যখন বাচ্চাদের নিয়ে শুতে এলো, গরমে ঘেমে নেয়ে মুখ লালচে হয়ে আছে। হঠাৎ করে আনন্দ এগিয়ে এলো। চৈতীর থুতনি ধরে আস্তে করে বলল, তোমাকে আজকে সুন্দর দেখাচ্ছে। চৈতী অবাক চোখে তাকাল আনন্দর চোখে। তারপর ওর চোখে ভর করল রাজ্যের লজ্জা। ঠোঁট কামড়ে হাসতে লাগল মুচকি মুচকি। আনন্দ হাসে, 'কিছু বললেই এমন লাল হয়ে যাও কেন? এখনো এত লজ্জা!'
-কই লাল হলাম! যাও সরো দেখি এখন। ওদের ঘুম পাড়াই। ঝটকা দিয়ে সরে গিয়ে আবার ঠিকই লুকিয়ে একবার আয়নায় দেখে নিল
নিজেকে। ধুর সারাদিন কাজ টাজ করে কেমন উদভ্রান্তের মতো অবস্থা। আনন্দ যে কিসে সুন্দর দেখল!
৩
একটু তোমায় নিলাম আমি
এক চিমটি মেঘে থামি
জলের ছিটেয় নিলেম পাগলামি
একটু তুমি বুকের ভিতর
বেপরোয়া শ্রাবণ ভাদর
ভাসাও ডোবাও তোমার-ই আমি।
মরে যাবো রে মরে যাবো,
কি অসহায় আমি, একবার ভাবো
পাঁচ বছর আগের সেই রাতে চৈতী নিজে যেমন অনুভব করেছিল তেমনি আনন্দও বুঝেছিল তারা দুজন দুজনের জন্য। চাইলেই তারা পারবে না দূরে সরে যেতে, বললেই আনন্দ পারবে না চৈতীকে অন্য কারো হতে দিতে। মরে যাবে, ঠিক মরে যাবে!
-চলো কফি খেতে যাই।
-এখন? সন্ধ্যা হয়ে গেছেতো!
-হোক না। চলো যাই।
-আচ্ছা চলো।
-বড় একটা টিপ দিয়ো কপালে, আর হাতে চুড়ি।
-আচ্ছা!
প্রথম দেখার দিনে যে কফিশপটায় বসেছিল দুজনে আজও সেখানেই বসে। জানালার কাচের বাইরে রাস্তায় ছুটে চলা গাড়ির হেডলাইট। এপাশে টেবিলে ওরা দুইজন মুখোমুখি। হাত ধরে বসে থাকে অনেকক্ষণ, পুরনো সব স্মৃতিচারণ করে, হাসে, কফি খায়, নিরবতায় অনুভব করে দুজনের হৃদস্পন্দন। যেন কয়েক সহস্র আলোকবর্ষ পার হয়ে ওরা মুখোমুখি হয়েছে দুজনে, যেন হাজার রাত পেরিয়ে গেছে চোখে চোখ রেখে।
ফেরার পথে হাত ধরে হাঁটে পাশাপাশি। বাচ্চার জন্য চকলেট কিনতে থেমে দুজনে দুটো আইসক্রিম নেয়। ফুটপাথের ওপর বসে আইসক্রিম খায়, গান গায় গলা ছেড়ে। এমন সময় হঠাৎ করেই ঝুম ঝুম বৃষ্টি নামে। রাস্তার সবাই দৌঁড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে থাকে, ওদেরও ফেরার তাড়া। ছুটে একটা খালি রিকশায় উঠে যায়। ঝুম ঝুম বৃষ্টিতে ফাঁকা রাস্তায় হুডতোলা পর্দা টানা রিকশায় দুজনে এগুতে থাকে বাড়ির দিকে। কাঁধের ওপর চৈতীর ছোট্ট টোকায় ফিরে তাকায় আনন্দ। দেখে ওর মুখে সেই পুরনো দীপ্তি ফিরে এসেছে। দুজনের মুখ কাছাকাছি এগিয়ে আসে, যতটা কাছে এলে নিঃশ্বাসের ঘ্রাণ পাওয়া যায়, যতটা কাছে এলে দুজনে বিলীন হওয়া যায়। একে ওপরের ঠোঁট থেকে প্রাণশক্তি শুঁষে নেয় ওরা, লুকিয়ে রাখে গোপন কৌটোয়। রিকশা এগিয়ে চলে। পরের সপ্তাহে আবার আসবে ওরা, তার আগে সাথে করে নিয়ে চলে ব্যস্ত আর কষ্টকর একটা সপ্তাহের জন্য সঞ্জিবনী শক্তি।
** গল্পে ব্যবহৃত গানের অংশগুলো চিরকুট ব্যান্ডের 'প্রথম প্রেমে মরে যাওয়ার গান' থেকে নেয়া।
একই থিমে নিয়ে এর আগেও লিখেছিলাম। আবার লিখলাম। হাসানের গল্পটা এখানে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৮