মধ্যআয়ের দেশ হতে বাংলাদেশ এখনও কোনো সূচকেই উত্তীর্ণ হয়নি। মাথাপিছু জাতীয় আয়ের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে হলেও আরও এক বছর অপো করতে হবে। কারণ পরপর তিন বছর এ সূচক টেকসই হতে হবে। তবে গবেষকরা বলছেন, মধ্যআয়ের দেশ হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত বা আরও বেশি সময় অপো করতে হবে। এজন্য ২০১৮ সালের মধ্যে মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচক পুরোপুরি পূরণ করতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘আমাদেরকে মধ্যআয়ের দেশ হতে হলে শিল্পায়ন ও নগরায়ন বাড়াতে হবে। মাথাপিছু আয় বাড়াতে হলে তার বিকল্প নেই। এত কম জমি নিয়েও আমরা নগরায়নের দিকে যাচ্ছি টেকসই পরিবেশ বজায় রেখে। হংকং, সিঙ্গাপুর ছাড়া পৃথিবীতে এত কম জমি নিয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জনের নজির আর কোথাও নেই। এই প্রবৃদ্ধি অর্জনে যে তিনটি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সেগুলো হলো- ছোট উদ্যোক্তাদের অবদান, রেমিটেন্স ও পোশাক খাত। তবে মধ্যআয়ের দেশ হতে হলে এটাই একমাত্র নির্ণায়ক নয়। অন্যগুলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ।’
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ২০১২ সালের এক পর্যালোচনায় বলেছিল, মধ্যআয়ের দেশ হতে হলে মাথাপিছু জাতীয় আয় কমপে এক হাজার ১৯০ ডলার হতে হবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৭ দশমিক ৫ থেকে ৮ শতাংশ। এবং অন্যান্য ল্য অর্জন করা পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা রাখতে হবে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে বর্তমানে মাথাপিছু আয় বছরে ১ হাজার ৩১৪ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১৯০ ডলার। আর প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক মাথাপিছু আয়ের নতুন সীমা নির্ধারণ করলেও বাংলাদেশ মধ্যআয়ের দেশে উন্নীত হতে পারবে বলে মনে করেন গবেষণা সংস্থা পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান মনসুর।
মাথাপিছু আয়ের সাথে আরও দুটি নির্ণায়ক এেেত্র বিবেচনা করা হয়। একটি হলো হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স (মানবসম্পদ সূচক) এবং অন্যটি হলো ইকোনমিক ভালনারিবিলিটি ইনডেক্স (অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচক)।
মানবসম্পদ সূচকে বিবেচনা করা হয় জনসমষ্টির কত ভাগ পুষ্টিহীনতার শিকার, শিশুমৃত্যুর হার কত, মাধ্যমিক স্কুলে কতজন লেখাপড়ার সুযোগ পায় এবং বয়স্ক সারতার হার কত।
অর্থনৈতিক সূচকে যেসব দিক বিবেচনা করা হয়, তার মধ্যে আছে- মোট জনসংখ্যা, জনসমষ্টির বিচ্ছিন্নতা, রপ্তানিপণ্যের বহুমুখিতা আছে কি না, জাতীয় উৎপাদনে কৃষির অংশ কতটুকু, জনসংখ্যার কত অংশ নিচু অঞ্চলে বসবাস করে, রপ্তানিপণ্যের স্থিতিশীলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার জনসংখ্যার কত অংশ এবং কৃষি উৎপাদন কতটুকু স্থিতিশীল।
এসব কিছু বিবেচনা করে এবং তার সঙ্গে মাথাপিছু আয়ের ন্যূনতম ধাপটি মিলিয়ে তারপর দেখা হয় একটি দেশকে স্বল্পোন্নত বলা যায় কি যায় না। শুধু মাথাপিছু আয় দিয়েই বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে না। আবার একটি স্বল্পোন্নত দেশ সব সূচকে উত্তীর্ণ হলেই মধ্যম আয়ের দেশের সার্টিফিকেট পাবে না। পর পর তিন বছর এ সূচকগুলো টেকসই হতে হবে।
মধ্যআয়ের দেশ হলে বাংলাদেশের কী লাভ হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, ‘মানুষের আয় বাড়লে তার জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হয়। আর বিশ্বব্যাংকের তালিকায় মধ্যআয়ের দেশ হিসেবে পরিগণিত হওয়া মানে আন্তর্জাতিকভাবে এক ধরনের স্বীকৃতি। এ ছাড়া আগামীতে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যে চেষ্টা করছে, সেেেত্রও এক ধাপ এগোবে।’
জানা গেছে, মিয়ানমার এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর মাথাপিছু আয় অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচকে উত্তীর্ণ না হওয়ার কারণে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবেই রয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বিশ্বের দেশগুলোকে নানাভাবে ভাগ করে দিয়েছে। মোটাদাগে এগুলোকে বলা হয় স্বল্পোন্নত, নিম্নমধ্য আয়, উচ্চমধ্য আয় ও উচ্চ আয়ের দেশ। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের আওতাধীন সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি স্বল্পোন্নত দেশগুলোর একটি সংজ্ঞা দিয়ে থাকে। দেশগুলোকে এলডিসি (লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রি) নামে ডাকা হয়। বর্তমানে বিশ্বে ৪৯টি স্বল্পোন্নত দেশ আছে। এর মধ্যে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আছে ১৪টি, দণি এশিয়ায় বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল ও আফগানিস্তান। বাংলাদেশের পাশের দেশ মিয়ানমারও স্বল্পোন্নত দেশ। মালদ্বীপ কিছুদিন আগেও ছিল স্বল্পোন্নত দেশের কাবে। ২০১১ সালের পর তাদের উত্তরণ ঘটেছে মধ্যআয়ের দেশে।
বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা ও ঝুঁকি বাংলাদেশের মধ্যে প্রবল। কিছু কিছু সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে একটু সফল হলেও বেশ কিছু েেত্র এখনো প্রবল ঝুঁকির মধ্যে। বাংলাদেশের শিশু পুষ্টিহীনতার হার এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। নিম্নাঞ্চলের মানুষ যে প্রবল ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করে, তার প্রমাণ হিসেবে ‘সিডর’ ও ‘আইলা’কে বলা হয়। বাংলাদেশ এখনো ওই তি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। দেশের রপ্তানি এখনো তৈরি পোশাক খাতনির্ভর। আন্তর্জাতিক েেত্র কোনো অঘটন ঘটে গেলে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে বলেই সংশ্লিষ্টরা বলছেন। তাই তাদের মতে, রপ্তানিপণ্যের বহুমুখীকরণ খুবই জরুরি।
জানা গেছে, ১৯৭১ সালে যখন বিভাজনের শুরু, তখন বলা হয়েছিল, স্বল্পোন্নত দেশ হতে হলে জনসংখ্যা ৭৫ মিলিয়ন বা সাড়ে সাত কোটির কম হতে হবে। বাংলাদেশ এই হিসাবে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে পড়ে না। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের বিশেষ অনুরোধে তাকে স্বল্পোন্নত দেশের ‘মর্যাদা’ দেওয়া হয়।
নিয়ম হলো, একটি স্বল্পোন্নত দেশ সবগুলো সূচকে উত্তীর্ণ হলেই অবধারিতভাবে তার ‘গ্র্যাজুয়েশন’ হবে না। পরপর তিন বছর এটা দেখা হবে। যদি দেখা যায়, সব সূচকে উত্তীর্ণ হওয়ার অবস্থানটি টেকসই হয়েছে, তাহলে পরবর্তী পর্যালোচনা সভায় তার ‘গ্র্যাজুয়েশন’ নিশ্চিত করা হবে। তিন বছর পরপর এই পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে। ১৯৭১ সালের পর থেকে এযাবৎ মাত্র চারটি দেশ স্বল্পোন্নত দেশের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। এর মধ্যে আছে বতসোয়ানা, কেপ ভার্দে, মালদ্বীপ ও সামোয়া।
এ বিষয়ে ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘মধ্যআয়ের দেশের কাবে যাওয়ার পরও ঝুকি থেকেই যায়। কারণ এমন নজিরও আছে মধ্যআয়ের দেশের কাবে যাওয়ার পর পরবর্তী বছরগুলোতে খারাপ করায় আবার সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।’
বিশ্বব্যাংকের দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী মাথাপিছু আয় চার হাজার ১২৫ ডলার পর্যন্ত হলে ওই দেশকে নিুমধ্য আয়ের দেশ হিসেবে ধরা হয়। এসব দেশের মধ্যে আছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইরান ইত্যাদি। এ তালিকায় বাংলাদেশ তার অবস্থান করে নিতে চায়। পরবর্তী ধাপটি হলো উচ্চমধ্য আয়ের, যা অর্জন করতে হলে মাথাপিছু জাতীয় আয় চার হাজার ১২৬ থেকে ১২ হাজার ৭৪৫ ডলারের মধ্যে থাকতে হবে এবং ১২ হাজার ৭৪৬ বা এর ওপরে থাকলে উচ্চ আয়ের দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে।
গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বাংলাদেশ এ মুহূর্তে যে পর্যায়ে আছে, তাতে সবগুলো সূচকে উত্তীর্ণ হতে হলে কয়েক বছর অপো করতে হবে। ২০২১ সালকে পরবর্তী ল্য হিসেবে ধরা হলে ২০১৮ সালের মধ্যে মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচকের ল্যমাত্রা পূরণ করতে হবে। তাহলেই ২০২১ সালে আমরা মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হব। তবে ১৮ সালের মধ্যে না হওয়ার আশংকাই বেশি।’
সূত্র :
newsbdblog.com/opinion_analysis.php?id=25
এছাড়া
আমাদের অর্থনীতি
আমাদের সময় ডটকম