চন্দ্রালোকিত তুষারাবৃত গহন রাত। প্রচণ্ড গতিতে ধাবমান বলগা হরিণের রথটি হঠাৎই থেমে পড়ে বাড়ির চালে। চিমনির ভেতর দিয়ে অসম্ভব ক্ষীপ্রতায় ঘরে প্রবেশ করে বৃদ্ধ লোকটি—ছোটখাট স্থূলকায় দেহ, শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখে শিশুর মতো অনাবিল উচ্ছলতা। রক্তিম লোমশ আলখেল্লা পড়নে তার, শুভ্র আস্তিন ও ঝুল তাতে, মোজাসদৃশ টুপি ঝুলছে মাথার পেছনে, কোমরে প্রশস্ত কটিবন্ধ।
নিঃসন্দেহে দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে আমার! তথাপি নিছক কৌতূহলেই ডাকি তাকে, ছিন্ন হয় এ বিভ্রম যদি, "এই যে, শুনুন।"
"আমি সান্তা, সান্তা ক্লজ," আমাকে আরও বিস্মিত করে পেছন ফিরতে ফিরতে স্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠে বুড়ো। হাসিতে উদ্ভাসিত মুখ তার, চমকায়নি একটুও। "বড়দিনের উপহার নিয়ে এসেছি তোমার পুত্র-কন্যাদের জন্য। আরও একশ কোটি শিশুর বাড়িতে যেতে হবে আমাকে, আজ রাতের মধ্যেই।"
"আপনি আসলে আমার দৃষ্টিবিভ্রমের ফল," হাত নেড়ে তাকে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করি আমি।
"না," দৃঢ়ভাবে বলে সে, নিজের অস্তিত্বের ব্যাপারে আশ্বস্ত করার ঐকান্তিক প্রয়াস যেন। "সুস্পষ্ট দৃষ্টি তোমার, সম্ভবতঃ চিন্তাভাবনাও।"
"সেক্ষেত্রে আপনার পুরো ব্যাপারটিই অবৈজ্ঞানিক, স্রেফ ধাপ্পাবাজি। হয়তো আপনি তস্কর এক।" উষ্ণ হয়ে বলি আমি।
"কেন বলছ এ কথা!" চেহারা বিষণ্ণ হয় তার।
"পাটিগণিতের সহজ হিসেবে," তাচ্ছিল্যভরে বলি আমি। "সমগ্র পৃথিবীতে বাস করে প্রায় ৭১০ কোটি মানুষ। এদের মধ্যে আনুমানিক ২৭% শিশু হলে, শিশুর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯২ কোটি। আপনি যদি কেবল বড়দিন উদযাপনকারী এবং শান্ত শিশুদের চকলেট ও খেলনা উপহার দেন এবং দুষ্ট শিশুদের কয়লা প্রদানে বিরত থাকেন, তবুও...।"
"সকল শিশুকেই উপহার দেই আমি, দুষ্ট-মিষ্ট সবাইকে সমান ভাবে," অদ্ভুত শান্ত স্বর এবার বুড়োর।
"সেক্ষেত্রে আপনার বিষয়টি, ব্যাকরণবিধিতে বাহুল্য হলেও, বলতেই হচ্ছে, অধিকতর অসম্ভব। কারণ প্রতি দুটি পরিবারে সাত জন করে শিশু থাকলে, আপনাকে মোট ৫৫ কোটি বাড়ি পরিদর্শন করতে হবে, এক রাতের মাত্র ১০ ঘন্টায়, যেহেতু সুবোধ শিশুরা ঘুমোতে যায় রাত ৮টার দিকে, জেগে উঠে তারা সকাল ৬টায়।"
"শিশুদের জন্য উপহার ভ্রমণ আমি শুরু করি দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের টোঙ্গা দ্বীপ থেকে, সমগ্র পৃথিবী প্রদক্ষিণ শেষে সমাপ্ত করি তা সামোয়াতে। কখনও অভিযান আমার শুরু হয় বেরিং প্রণালির চুকচে প্রান্ত থেকে, সমাপ্ত হয় অন্যপ্রান্তে, আলাস্কায়।"
"এত করেও আপনি সময় পাবেন বড় জোর ৩৪ ঘন্টার মতো," বুড়োর ভূগোল জ্ঞান খানিকটে চমকে দিলেও চেহারা নির্বিকার আমার।
"সান্তার আস্তিনের ভাঁজে এখনও লুকিয়ে আছে চমক কতক, রয়েছে কৌশল কতিপয়; সেগুলোকে অবজ্ঞা করো না, হে। তোমার কাছে যখন সময় বয়ে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা, আমার কাছে তা আঁখির পলকমাত্র, সেকেণ্ডেরও কিয়দংশ।" সহাস্যে ঘোষণা করে বুড়ো।
দৃষ্টিবিভ্রমের সঙ্গেসঙ্গে পাগলা বুড়ো বোধহয় এবার চিন্তারও বিভ্রাট ঘটিয়ে ছাড়বে আমার, ভাবলাম আমি।
"বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার বুঝতে পারছি। গল্প শোন তাহলে।
সে অনেক অনেক কাল আগের কথা—বৈবস্বত মনুর প্রথম মহাযুগের সত্যযুগের মধ্যাহ্ন তখন। পৃথিবীতে ছিল সসগরা সদ্বীপা সাম্রাজ্য এক, আনর্ত নাম তার, রাজধানী তার কুশস্থলি। তথায় সম্রাট ছিলেন পুণ্যাত্মা রৈবত; তার ছিল একটিমাত্র কন্যা—রেবতী, বহু গুণে গুণান্বিতা, অনিন্দ্য অসামান্য রূপসী এক।
কন্যার বয়সকালে উদ্বিগ্ন হলেন মার্তণ্ডপ্রতাপ সম্রাট, মর্ত্যলোকে তো নেই সুযোগ্য পাত্র তার। অনেক চিন্তাভাবনা করে অবশেষে একদিন সরাসরি ব্রহ্মলোকেই গমন করলেন রৈবত, কন্যার হাত ধরে, উপদেশ কামনা করবেন স্বয়ং ব্রহ্মার, কে হতে পারে উপযুক্ত বর আত্মজার।
দেব যজ্ঞ বেদ গিরি সিন্ধু তটিনী-বেষ্টিত ব্রহ্মা তখন ব্যস্ত ছিলেন গন্ধর্বদের সঙ্গীতসূধায়। সঙ্গীত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন রৈবত, তারপর গভীর শ্রদ্ধায় উপস্থাপন করেন প্রার্থনা।
'হা হা হা,' প্রচণ্ড হাসিতে ফেটে পড়েন ব্রহ্মা। 'হে সম্রাট, মর্ত্যলোকে এরই মধ্যে অতিক্রান্ত হয়ে গেছে বৈবস্বত মনুর সপ্তবিংশতি মহাযুগ। গত হয়েছে তোমার যুগের রাজপুত্রগণ, গত হয়েছে পুত্র প্রপৌত্র তাদের, এমনকি তস্য তস্য পুত্রগণ, শতসহস্র বর্ষ পূর্বে।'
বিষম খেলেন পিতা-পুত্রী, এ কীরূপে সম্ভব! ব্রহ্মলোকে দুয়েকটি সঙ্গীতই তো মাত্র শ্রবণ করেছে তারা।
'দ্বাপর যুগের শেষে পৃথিবীতে এখন আগমন ঘটেছে বসুদেব কৃষ্ণের। পুনর্বার গমন কর পৃথিবীতে তোমরা, কৃষ্ণভ্রাতা বলরামই হবে তোমার কন্যার সুযোগ্য পাণিগ্রহীতা।' আশ্বস্ত করেন ব্রহ্মা।
"সুতরাং বুঝতেই পারছ, মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কালের গতিও বিভিন্ন," রহস্যময় হাসিতে এবার বলে সান্তা। "তোমাকে আমি আরও বর্ণনা করতে পারি হোনি হাম-আগেলের ঘটনা, এক ঘুমে যার কেটে গিয়েছিল সত্তর বছর, অথবা গুহাবাসিদের কথা, যাদের সঙ্গে ছিল একটি কুকুর, কিংবা উরাশিমা তারোর উপাখ্যান, সমুদ্রগর্ভের এক নগরীর কিয়ৎ দিবসে কেটে গিয়েছিল যার তিনশত বছর। আসলে বড়দিনের পূর্ব রজনীতে ৫৫ কোটি বাড়ি পরিদর্শন করা মোটেও কষ্টসাধ্য নয় আমার জন্য।"
"আপনি যদি দার্শনিকতা বাদ দিয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করতেন সময় কীভাবে আপনার জন্য ধীরে চলে, কৃতার্থ হতাম," বুড়োকে অবৈজ্ঞানিক কূপমণ্ডূক বলে অবজ্ঞা করার লোভ সংবরণ করতে খানিকটা কষ্টই হয় আমার, তবে কণ্ঠে ঢেলে দেই শ্লেষ। "আপনার জানা উচিত, দর্শনের মৃত্যু ঘটেছে।"
"মৃত্যুবরণ করেছে দর্শন!" অবাক হলো যেন বুড়ো। "কবে কখন, কে বলল এ কথা?"
"স্টিফেন হকিং বলেছেন।"
"হা হা হা, তাই বলো," প্রচণ্ড হাসির তোড়ে কেঁপে উঠল বুড়োর শরীর। "দর্শনের আলোচনায় করুণ ব্যর্থতা এবং স্ববিরোধিতার এক নাম হকিং। এমনকি তাঁর তথাকথিত বিজ্ঞান সব বিজ্ঞানও নয়। বিজ্ঞান লেখক হিসেবে অসাধারণ সফল তিনি, এক্ষেত্রে একেবারে প্রথম সারিতেই রাখব তাঁকে, যদিও বিজ্ঞানী হিসেবে, নির্মোহভাবে অকাট্য অবদানের ভিত্তিতে বললে, তাঁর প্রকৃত অবস্থান প্রথম সারির অনেক অনেক পেছনে। তবে এ আমাদের আলোচ্য বিষয় নয় এখন। আমার বক্তব্য হচ্ছে, একজন পদার্থবিদ বলবেন, 'দর্শন মৃত', আর একজন দার্শনিক বলবেন, 'তরুণ প্রজন্মের পদার্থবিদগণ, এই যে ফাইনম্যান শোয়িঙারগণ, হতে পারে তারা মেধাবী অনেক, হতে পারে অধিকতর বুদ্ধিদীপ্ত তারা পূর্বসূরীদের চেয়ে, বোর আইনস্টাইন শ্রোয়েডিঙার বোল্টজম্যান ম্যাক-প্রমুখের চেয়ে। কিন্তু এরা হচ্ছে অসভ্য পশু, এদের নেই কোনো দার্শনিক গভীরতা...'—বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের এরূপ দ্বন্দ্বসংঘাত মানবজীবনের সুবিশাল প্রেরণার অর্থহীন দায়িত্বহীন অপচয়মাত্র।
যা হোক, ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে। আধুনিক বিজ্ঞানের আপেক্ষিকতার যুগে সময়কে ধীর কিংবা রাবারের ফিতার মতো প্রসারিত করে ফেলা কোনো ব্যাপারই নয়। কৌশলটি হলো, প্রচণ্ড বেগে ভ্রমণ করি আমি, আলোর কাছাকাছি বেগে, আর তাতে তোমাদের তুলনায় সময় ধীর হয়ে যায় আমার জন্য। যত বেশি বেগ, সময় তত ধীর। এই যে তোমার সঙ্গে কিছু অতিরিক্ত সময় ব্যয় করেও উদ্বিগ্ন হচ্ছি না, তার কারণ এখান থেকে প্রস্থানের পর গতিবেগ আগের তুলনায় খানিকটা বাড়িয়ে নিব আমি। বাস্তবিকই বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা আমার।"
"স্পষ্ট করুন বক্তব্য আপনার। ফাঁকিবাজ শিক্ষার্থীগণের মতো আচরণ করবেন না, যারা গণিত কিংবা বিজ্ঞানের কোনো একটি বিষয় সুষ্ঠুভাবে প্রমাণ করতে না পেরে পরীক্ষার খাতায় লিখে আসে—অনুরূপভাবে প্রমাণিত হয় যে..., ইত্যকার বাক্য।"
"তোমার এরূপ 'অনুরূপ' প্রমাণের আশ্রয় মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনও নিয়েছিলেন ক্ষেত্রবিশেষে, এবং মানুষমাত্রেই ভুল হতে পারে যেহেতু, এতদসংক্রান্ত বিশেষণটি ভাগাভাগি করতে আপত্তি নেই আমার," আমার দিকে চোখ মটকে বলে বুড়ো। "তবে এতে প্রমাণিত হয় না যে ভুল থেকে উত্তরণ ঘটে না মানুষের, কিংবা আমার যুক্তি ও বক্তব্য আমি নিজেই স্পষ্ট উপলব্ধি বা ব্যাখ্যা করতে পারি না।"
"আচ্ছা, বলতে থাকুন তাহলে, কেবলমাত্র বিজ্ঞানের নিরিখে।"
"সারা দুনিয়ার প্রায় সকল মহাবিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার ক্লাসে সময় প্রসারণের অকাট্য যুক্তি হিসেবে পড়ানো হয়, এমন একটি সুবিখ্যাত মানসপরীক্ষা ও সংশ্লিষ্ট চিত্রণের সাহায্যেই বিশদ ব্যাখ্যা করছি। নোবেল জয়ী অনেক বিজ্ঞানীও যে যুক্তি প্রদান কিংবা গ্রহণ করেছেন।"
বিজ্ঞানীদের কথায় সতর্কতা অথচ গভীর ঔৎসুক্য, সমীহে ভরে উঠে আমার মন।
"মনে কর, আমার গতিশীল বলগা হরিণের যানে বসে সময় মাপছি আমি, সান্তা, তুমি মাপছ তোমার ঘরের বৈঠকখানায় স্থির বসে। এরকম যান কল্পনা করতে তোমার কষ্ট হলে, ধরে নাও একটি ট্রেনের কামরায় মাপছি আমি। প্লাটফর্মে স্থির দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছ তুমি, আমার মতো সময় মাপার চেষ্টা করছ তুমিও।"
"মৃগদল অপেক্ষা রেলগাড়িই উত্তম।" বুড়োকে মৃদু খোঁচা দেই।
"এখন প্রথম চিন্তা, সময় মাপতে কী ধরণের ঘড়ি ব্যবহার করব আমরা? আসলে যেকোনো ধরণের ঘড়িই ব্যবহার করতে পারি, আগেকার দিনের চাবি দেয়া ঘড়ি, বর্তমানের ডিজিটাল ঘড়ি, এমনকি মোবাইল ফোনও। কারণ আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব অনুসারে, পদার্থবিদ্যার যে নিয়ম অনুসারে ঘড়িগুলো কাজ করে, সে নিয়মগুলো আমার জন্য যেরূপ, তোমার জন্যও সেরূপ। কাজেই কোন ঘড়ি আমরা ব্যবহার করছি, সেটি গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়।
তবে, হ্যাঁ, ব্যবহারিক দিক থেকে একটি সমস্যা আছে: যেকোনো বস্তুর যান্ত্রিক ত্রুটি থাকতে পারে, তা আবার বিভিন্ন বস্তুতে বিভিন্ন মাত্রায় থাকতে পারে, কাজেই খুব সূক্ষ্ম ঘড়ি না হলে দুজনের পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয় করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
সুতরাং এমন একটি ঘড়ি আমরা কল্পনা করি যা সহজ ও যৌক্তিক এবং যাতে যান্ত্রিক কোনো ত্রুটির অবকাশ নেই। এটি হচ্ছে আলোক ঘড়ি, যাতে আছে দুটি আয়না—একটি ট্রেনের মেঝেতে, অন্যটি ট্রেনের ছাদে, আর আছে একটি আলোক রশ্মি। রশ্মিটি নিচের আয়না থেকে প্রতিফলিত হয়ে সোজা উপরের আয়নায় আপতিত হচ্ছে, সেখান থেকে প্রতিফলিত হয়ে আবার নিচের আয়নায় আপতিত হচ্ছে। তুমি কি আমার সঙ্গে আছ?"
"হ্যাঁ, আয়না থেকে আয়নায় ক্রমাগত একই আলোর আপতন–প্রতিফলন চলছে। এমনকি ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীগণও বিষয়টি জানে, তাদের বিজ্ঞান গ্রন্থে আলোর ঘটনায় তার ব্যাখ্যা রয়েছে।" কিছুটা উষ্মাভরে বলি আমি।
"রাগ করো না। আমার ব্যাপারে যেহেতু কোনো খটকা রাখতে চাই না তোমার মনে, কাজেই আলোচনায় ভাষার ব্যবহার যথাসম্ভব সরল রাখতে চাই আমি, যাতে সহজে হৃদয়ঙ্গম হয় ব্যাপারটি। কারণ আমার সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ঘটনাবলীর বর্ণনা যখন দুর্বোধ্য পারিভাষিক শব্দ ও জটিল গাণিতিক বৈজ্ঞানিক হিসেবনিকেশের আড়ালে চলে যায়, তখন প্রকৃত বিষয়ের অনুধাবন বিভ্রান্ত হতে পারে।
"তা অবশ্য মন্দ বলেননি," স্বীকার করতেই হয়, বুড়োর কথায় যুক্তি আছে বটে।
"আলোর গতি যেহেতু ধ্রুব, প্রতি সেকেন্ডে ঠিক ২৯৯,৭৯২,৪৫৮ মিটার, এবং আয়না দুটোর দূরত্বও যেহেতু নির্দিষ্ট, কাজেই এক আয়না থেকে আরেক আয়নায় যেতে প্রতিবার আলোর, সহজ করে বললে, আলোর একটি ফোটন কণিকার, একই সময় লাগবে। যেমন, আয়না দুটোর দূরত্ব ৫ মিটার হলে, প্রতিবার ফোটনের সময় লাগবে ৫/(২৯৯,৭৯২,৪৫৮) বা ১.৬৭×১০^-৮ সেকেন্ড (প্রায়), অর্থাৎ ১৬.৭ ন্যানো সেকেন্ড (প্রায়)।
আমাদের পরীক্ষাটিতে সময়কে বিতর্কের উর্ধ্বে রাখতে এবং 'প্রায়' জাতীয় শব্দকে পরিহার করতে, সেকেন্ড কিংবা ন্যানোসেকেন্ড এককে সময় মাপব না আমরা। বরং এক আয়না থেকে আরেক আয়নায় যেতে ফোটনের যে সময় লাগে তার নাম দেই আমরা আলো ঘড়ির এক টিক। পুরনো দিনের পিতামহ ঘড়ি নামের দোলন ঘড়িগুলো এভাবে টিক টিক পদ্ধতিতেই কাজ করত। ঘড়িগুলো দুবার টিক করলে আমরা বলতাম এক সেকেন্ড সময় অতিবাহিত হয়েছে। কাজেই সে ঘড়ি অনুযায়ী, কোন মানুষের ভাত খেতে ৫ মিনিট লাগে বলা যে কথা, ..."
"তার ভাত খেতে সময় লাগে পিতামহ ঘড়ির ৬০০ টিক, একই কথা," মৃদু হাস্যে দ্রুত জবাব দেই আমি। "অর্থাৎ, সময় বুঝাতে একক হিসেবে সেকেন্ড, মিনিট এসব শব্দ ব্যবহার করতেই হবে আমাদের, এমন নয় বিষয়টি।"
"যথার্থ," শিশুসুলভ হাসিতে সায় দেয় সান্তা।
"এখন আমার আলো ঘড়িতে ১ টিকের সময়কে t প্রতীক দ্বারা প্রকাশ করা হলে,
t = এক টিকে আলো কর্তৃক অতিক্রান্ত দূরত্ব/আলোর বেগ
⇒t = h/c ... ... ... (1),
তাই না?"
"হ্যাঁ," একমত পোষণ করি আমি।
"কিন্তু প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আমার আলো ঘড়িতে ফোটনের ক্রমাগত আপতন-প্রতিফলনের গতিপথটিকে তুমি কেমন দেখবে? যেহেতু তোমার সাপেক্ষে ট্রেনের গতিবেগ ডানদিকে v, তুমি দেখবে সান্তা, আয়না, ফোটন সবই v বেগে ডানদিকে সরে যাচ্ছে। আলোর ফোটনটা যখন নিচের আয়না থেকে যাত্রা শুরু করে কিছুক্ষণ পর উপরের আয়নায় প্রথম টিক দিল, সে সময়টুকুতে আয়না দুটো তাদের আদি অবস্থান থেকে কিছু দূরত্ব ডানে সরে গেছে (তোমার সাপেক্ষে)। সরে যাওয়া এ দূরত্বটুকু, মনে কর, l। সুতরাং তুমি দেখবে ফোটনটি খাড়া উপরে না গিয়ে কোনাকুনি পথে উপরের আয়নায় টিক দিচ্ছে (যদিও আমি দেখব, ফোটনটি খাড়া উপরেই টিক দিচ্ছে)।"
এখন তোমার কাছে ১ টিকের সময় t′ হলে,
t′ = দূরত্ব/বেগ
⇒t′ = d/c ... ... ... (2)
লক্ষ্য করবে, আমার দৃষ্টিতে ফোটনটি ১ টিকে h দূরত্ব পাড়ি দিয়েছে, কিন্তু তোমার দৃষ্টিতে উক্ত ফোটন ঐ ১ টিকে d দূরত্ব পাড়ি দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের দ্বিতীয় সূত্রানুযায়ী, আমাদের দুজনের কাছেই আলোর গতি একই হতে হবে, যা আমাদের সূত্রে c দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে।
এখন পিথাগোরাসের সূত্রমতে,
d^2 = l^2 + h^2 ... ... ... (3)
l হচ্ছে তোমার দৃষ্টিতে ফোটনের এক টিক সময়কালে (অর্থাৎ তোমার t′ সময়ে) ট্রেন ও ট্রেনের ভেতরের যাবতীয় জিনিস v বেগে যতটুকু ডানে সরে গিয়েছিল। সুতরাং আমরা লিখতে পারি,
l = vt′ ... ... ... (4)
আর (2) নং সমীকরণ থেকে পাই,
d = ct′
এবার (3) নং সমীকরণকে বিস্তৃত করে পাই,
এবার সান্তা বলল, একই ঘটনায় আমার পরিমাপকৃত সময় ছিল,
⇒t = h/c
সুতরাং তোমার পরিমাপকৃত সময়,
যেখানে γ=1/√(1-v^2/c^2)। γকে বিজ্ঞানীগণ বলেন লরেন্টজ ফ্যাক্টর।
v যত বাড়তে থাকবে, γ-এর মানও তত বড় হতে থাকবে। ফলশ্রুতিতে যে ঘটনা তোমার ক্ষেত্রে ঘটবে হয়তো এক বছরে, আমার ক্ষেত্রে তা ঘটতে পারে ১ মাস বা ১ দিন কিংবা এমনকি ১ মিনিটেও। বিশ্বাস না হলে গাণিতিক হিসেবটি পরীক্ষা করে দেখতে পার, v-এর বেশ বড় মান নিয়ে।"
"এ কী হলো!" বিস্ময়ে বলে উঠি আমি। "একই সঙ্গে পুরো ঘটনা ঘটতে দেখলাম দুজনে, একই ঘটনার সময় পারিমাপ করলাম আমরা, কিন্তু দুজনের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন সময় লাগল! এ কি সত্যি, নাকি গাণিতিক কোনো ধাঁধাঁ, কোন বিভ্রম?"
"মূল ধারার পদার্থবিদগণ তো বলে থাকেন এ সত্য, কাল পরম কোনো বিষয় নয়। তারা এ-ও বলেন, একই সময়ে জন্মগ্রহণকারী দুজন যমজ বোনের একজন যদি পৃথিবীতে থাকে, আর অন্যজন যদি প্রচণ্ড বেগে মহাশূন্য ভ্রমণে বের হয়, এবং মহাশূন্যচারী বোনটি যদি তার ৫ কিংবা ১০ বছর পর পৃথিবীতে ফিরে আসে, সে দেখবে পৃথিবীর বোনটি থুত্থুরে বুড়ি হয়ে গেছে!"
বিস্ময়ের ঘোর পুরোপুরি কাটে না আমার।
"তবে গল্প আমাদের শেষ হয়নি এখনও," রহস্যময় ভঙ্গিতে সান্তা বলল। "কিন্তু উঠতে হচ্ছে এখন। বাকি উপহার বিতরণ শেষে ফিরে আসব শীঘ্রই, চলবে আমাদের বিজ্ঞান ও বিভ্রমের কথোপকথন।"
------------
প্রথম পর্ব