আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর একটা মেসেজ পেলামঃ "তুই তো ব্লগিং করিস। আর যতদূর জানতাম তুই ধর্ম কর্ম করিস। তোদের ব্লগে যা জঘন্য লেখালেখি দেখলাম, গা শিউরে ওঠার মতো লেখা! তার মধ্যে কিছু ব্লগারতো দেখি ইদানিং হেবি ফেমাস। আর তারা নির্লজ্জের মতো খুবই গর্ব বোধ করে সেসব সাহিত্যকর্ম নিয়ে! যেভাবে গালিগালাজ করে ধর্ম নিয়ে, বিশেষত ইসলাম কে নিয়ে, এটা কি ঠিক? কোন সভ্য মানসিকতায় কি পড়ে? এগুলোকেই কি তোরা সুস্থ লেখালেখি চর্চা বলিস? যে কোন ধর্মপ্রাণ মানুষের পক্ষেই তো এগুলো সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তা ব্লগার হবার পর তুইও কি নাস্তিক হয়ে গেলি নাকি আবার?"
ওকে কেবল “ধুর না” বলেই উত্তর শেষ করলাম।
কিন্তু ভেবে দেখলাম। ব্যাপারটা ভয়াবহ। ব্লগার বা ব্লগিং করি শুনলেই যে প্রশ্নটা মানুষ এখন প্রথমেই জিজ্ঞেস করে—আস্তিক না নাস্তিক?? আস্তিক বললে জিজ্ঞেস করে- ৭১ এর পক্ষে না বিপক্ষে??!! এ যেন ব্লগে দুই দল! একদল ব্লগে খলি ধর্মকে গালাগালি করে, আরেকটা ব্যাপার আস্তিক হলেই- ধর্মে বিশ্বাসী হলেই যেন যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন করা বোজায়!! ব্লগিং সম্পর্কে নন ব্লগার মানুষের এরকম ভয়াবহ মানসিকতা একটি বিপদ সংকেত! ব্লগিং প্ল্যাটফর্ম তো আমাদের মমনশৈলী উন্মেষ ঘটানোর জায়গা। প্রতীবাদ করার জায়গা, একতাবদ্ধ হয়ে কিছু বলা। সবাই তো পেপারে কলাম লিখতে পারে না, বই বের করতে পারে না। সেই মানুষ গুলোর জন্য এই ব্লগিং। এই ব্লগ থেকে জন্ম নিয়েছে কত বর্তমান বিখ্যাত মানুষজন। বছর বছর বের হচ্ছে ব্লগারদের বই। নতুন নতুন মেধা তৈরি হচ্ছে এই ব্লগিং চর্চা থেকেই।
কত মেধাবী মানুষজন লিখছেন এই প্লাটফর্মে। কত ভালো লেখা- সচেতনমূলক লেখা, মানবিক লেখা, সৃজনশীল লেখা, দেশ- সাহিত্য, আন্তর্জাতিক কত শত লেখা হচ্ছে এই ব্লগে। এই ব্লগের লেখাগুলো পড়েই নানা সময়ে নানা বিষয়ে সমাজের বিবেক জেগে উঠেছিল। সর্বশেষ শাহবাগের নব গণজাগরনকেই দেখুন না কেন। ব্লগাররাই পুরো দেশটাকে একটি জায়গায়, একটি দাবিতে নিয়ে এসেছে।
কিন্তু একই ভাবে দেখছি, এই ব্লগিং থেকেই রচিত হচ্ছে বা হয়েছিল কিছু উন্মাদতুল্য লেখালেখি!! যার ফলশ্রুতিতে ব্লগিং নিয়ে মানুষের একটা নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হওয়া!! সেই লেখাগুলোর জন্য, গুটি কয়েক উগ্রবাদী ব্লগারদের জন্য সুযোগ সন্ধানী মানুষ, সংবাদ পত্র পুরো ব্লগিং চর্চাটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে!!
সেটার সুযোগ কি আমরাই করে দিচ্ছি না? ভেবে দেখেছেন কি দেশের বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যেমন কিছু বললে আমরা কেন রাগে ফেটে যাই? কেন প্রতীবাদ করি?? কারণ আমরা দেশকে ভালোবাসি। লালন করি ৭১ এর চেতনা। ৪২ বছর ধরে এই দায় আমাদের মাথার উপর। কেন আজ সবাই চাচ্ছি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বন্ধ হোক? কারণ আমরা চাই, কেউই যেন ধর্মের মতো সেনসিটিভ একটা ব্যাপারকে পুঁজি করে কোন রকম রাজনীতি করতে না পারে। ধর্মের অপব্যবহার করতে না পারে। কেন কাদের মোল্লার রায় আমরা মেনে নিতে পারিনি? কারণ সেই রায় আমাদের একদম হৃদয়ে চপেটাঘাত করেছে। ভেবেছি যে কোন মূল্যেই দেশের বীর সন্তানদের যারা হত্যা করেছে, আমাদের বিশ্বাসে, ইতিহাসে যারা আঁচড় বসিয়েছিল, তাদের ক্ষমা নাই। আমাদের মনে হয়েছে, প্রান দিয়ে দেব-তবু ওইসব জানোয়ার দেশদ্রোহী মানুষদের সর্বোচ্চ সাজা আদায় করেই ছাড়ব।
সেই একই রকম অনুভূতি কাজ করে একজন ধর্মপ্রাণ মানুষের মনেও। কেও যখন দেখে তার ধর্মকে নিয়ে যা তা বলা হচ্ছে, অকথ্য ভাষায় গালি দেয়া হচ্ছে, রংচং মিশিয়ে নানান সব কাহিনী হচ্ছে; সেই মানুষগুলোরও কি তখন একই ভাবে মাথায় রক্ত চেপে যায় না? কয়জনই বা ইগনোর করতে পারে, কাবু রাখতে পারে নিজেকে। কেও কেও ক্রেজি হয়েতো হুমকি-ধামকি এমনকি রীতিমতো খুন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটাকে!! ন্যায়ের পক্ষে কাজ করে জীবন দেয়া আর শ্রেফ ধর্মকে নিয়ে আবোল তাবোল লিখে খুন হবার মধ্যে তফাত আছে! আপনার বাদ বাকী ভালো কাজ গুলো কেন চাপা পড়ে যাবে, সেই উন্মাদতুল্য লেখা গুলোর জন্য। সন্তান হিসেবে আপনি কেমন, বন্ধু-কলিগ বা প্রিয়জন হিসেবে আপনি কেমন সেটা কেন চাপা পড়ে যাবে আপনার মৃত্যুর পর বিতর্কিত লেখালেখির জন্য! সাংগঠনিক ভাবে সফল হওয়া মানেই নয় যে আপনি নৈতিক গুলাবলির ঊর্ধ্বে। দেশ কে ভালবাসেন, কিন্তু দেশীর ঐতিহ্য মানেন না, ধর্মীয় সম্প্রীতি মানেন না। এটা কেমন কথা?
ধরে নিই, নাস্তিকতা আলাদা একটা ধর্ম। কিন্তু কোন ধর্মেই কি আছে, আরেকটি ধর্মকে ছোট করা, প্রকাশ্যে গালি দেয়া? সব ধর্মের মূলমন্ত্রই হল বিশ্বাস, মেডিটেশন। কেও মানে কেও মানে না। এতে জোরাজুরি কেন থাকবে? আপনি মানেন না, কিন্তু তাই বলে যিনি মানেন, তাকে কেন অসম্মান করবেন। নাস্তিকতার মানে ছোট জ্ঞানে যেটা বুঝি, যে কোন ধর্মেই বিশ্বাস করেন না। কিন্তু প্রায়ই দেখা যাচ্ছে আমাদের নাস্তিকরা কেবল ইসলাম ধর্মকেই গালি দিতে পছন্দ করেন। এদেশের ৮০ ভাগ লোক মুসলিম। আর তার মধ্যে অধিকাংশ লোকই ধর্মে বিশ্বাসী, ধর্মে ভীতু সাধারণ মানুষ। এরকম বিশাল এক জনগোষ্ঠীর চেতনায় আঘাত দেয়া কোন চর্চার অংশ হতে পারে না।
ধর্মীয় গোঁড়ামি আর এই ধর্ম বিদ্বেষী লেখালেখি তো তবে দেখি একই হয়ে গেল। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আর ধর্মকে কটাক্ষ করার রাজনীতি দুটোই তো দেখি এক! একই হাতিয়ারঃ ধর্ম!! ধর্ম ব্যবসায়ীরা যেমন সাধারণ ধর্মপরায়ণ মানুষের সরলতার সুযোগ নেয়, ঠিক তেমনি উগ্র নাস্তিক সমাজও তো দেখি সেই একই সাধারণ ধর্মপরায়ণ মানুষের আবেগকে আঘাত করে!! ধর্মে বিশ্বাস করবেন, ধর্মীয় কাজ করবেন, কিন্তু আবার অনৈতিক কাজে অংশ নেবেন, নিজ দেশের বিরুদ্ধে যাবেন এটাতে যেমন সমালোচনা করি আমরা, ঠিক তেমনি দেশ সমাজ উদ্ধার করা আন্দোলন- কর্মে অংশগ্রহণ করবেন, কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে নিজে অনৈতিক কাজে অংশ নেবেন এটাও তো সমান সমালোচনা যোগ্য। দুটোই তো দেখি অভিন্ন- মুখোশধারী! উসশৃঙ্খলতা তো কোন শ্রেণীতেই কাম্য নয়।
আমি ধার্মিক এটা মানেই তো এই নয় যে, আমার দেশপ্রেম থাকবে না। ধর্ম আর দেশপ্রেমকে কেন আমরা দুইভাগে ভাগ করে ফেলছি! দুটোকে কেন প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলছি? দুটো সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা চেতনা একই ভাবে অবস্থান করতে পারে।
ঠিক তেমনি আমি একজন দেশপ্রেমিক, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি বাদ বাকী গুনাবলীর ঊর্ধ্বে উঠে গেছি। সব কিছু মিলিয়েই একজন মানুষ- ভালো মানুষের সংজ্ঞা কেবল দেশপ্রেমিক গুন দিয়ে বিচার করা যায় না। ব্যক্তিজীবন, সামাজিক জীবন, বিনয় বলে কিছুতো রয়েই যায়। দেশ তো হয় এক একটা পরিবার মিলে, সমাজ মিলে, গোত্র মিলে, যার যার বিশ্বাসের সংমিশ্রণ মিলেই জন্মে একটি দেশ। রাজনৈতিক, সামাজিক অন্যায় হলেই প্রতীবাদ করব, কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত জীবনে উসশৃঙ্খল থাকবো, এটা কেমন কথা? সমাজের অন্যায় নিয়ে কাজ করছি, অথচ নিজে লিখে আরেকটি অন্যায় কে উস্কে দিচ্ছি! উগ্র ধ্যানধারণা তা সেটা ধর্ম নিয়েই হোক আর ধর্ম বিদ্বেষীপনা নিয়েই হোক, দুটোই কোন সুফল বয়ে আনতে পারে না।
যে মেধা আপনারা ধর্মী বিদ্বেষী লেখালেখিতে কাজে লাগাচ্ছেন, সেই মেধাটি যদি সমাজের আরও আরও ইস্যুগুলোতে কাজে লাগাতেন, তবে শিওর এই সমাজ আরও অনেক খানি এগিয়ে যেত। আপনারা মেধাবী কোন সন্দেহ নেই, অনেক জানেন, অনেক পারেন, যুক্তি তর্কে আপনাদের হারায় সেই দৃষ্টটা কারো নেই, অথবা বলা ভালো সেই রুচি অনেকের নেই।
শুধু বলি, ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করতে সাহায্য করবেন না। যে যার ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে থাকুক। গালিগালাজ করে, ধর্মকে পুঁজি করে উস্কানিমূলক লেখালেখি তো একপ্রকার অস্থিরতাকেই প্রমোট করা। কয়জন কে বোঝানো যায়, বাক স্বাধীনতার কথা। বাক স্বাধীনতার মানেই কি যা ইচ্ছে বলা? ব্লগে, সংবাদ পত্রে, প্রচার মাধ্যমে আমরা যেমন যুদ্ধাপরাধিদের বাঁচাতে তাদের তাঁবেদার বাহিনীর বানোয়াট লেখা, খোঁড়া যুক্তি, অপপ্রচার ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি, প্রতিবাদ করি, সাজানো মিথ্যা মেনে নিই না। সেই একই ভাবে ধর্মকে নিয়েও বাড়াবাড়ি করা সাজে না।
সভ্য দেশের নাগরিক হিসেবে অপরাধ উস্কানি মূলক লেখা, কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা উচিত। মানুষে মানুষে ঘৃণা তৈরি করে এমন জীবন যাপন কেন গড়ব? আমার মৃত্যুর পর কেন আমার লাশ নিয়ে পক্ষ বিপক্ষ দল তৈরি হবে?? আমার ভালো কাজগুলো কেন চাপা পড়ে যাবে সামান্য কিছু লেখার জন্য!! কেনই বা একদল মানুষের মনে হবে, মরসে! উচিত হইসে!!?? খুন পর্যায়ে চলে যাবার মতো কেন হবে আমার সাহিত্য কর্ম!!
লেখালেখিতে গঠনমূলক সমালোচনা, যুক্তি তর্ক থাকবে, কিন্তু অকথ্য ভাষায় গালি কেন থাকবে! বাক স্বাধীনতার আবরণে বা রম্য রচনার নাম এসব লেখা সমাজ কে কেবল অস্থিরই করে। গুটিকয়েক মানুষই বোঝে আপনাদের এই রম্য! দেশ- সমাজের অনেক অনেক অসঙ্গতি আছে, সেগুলো নিয়ে এরকম রম্য লিখুন। জনমানুষের জন্য লিখুন। ধর্মীয় লেবাস পরে- তা সে যেই ধর্মেরই হোক না কেন, যারা যে কুকর্ম করেছিল বা করছে, সেই ব্যক্তি, সেই কুকর্ম নিয়ে লিখুন, প্রতীবাদ করুন। সে ধর্মকে নিয়ে নয়। এতেই মঙ্গল।