এতিমের সম্পত্তি বন্টন সংক্রান্ত মানব মস্তিষ্ক প্রসূত মুসলিম আইনে তাদেরকে অসহায় ও করুণার পাত্র বানিয়ে রাখার যে রীতি চালু আছে- আল-কোরআন কি তা কখনও সমর্থন করে?
বর্তমান মুসলিম আইন অনুসারে পিতা জীবিত অবস্থায় কোন ব্যক্তির মৃত্যু হলে এবং মৃত ব্যক্তির ভাই থাকলে সম্পত্তি বন্টনের সময় ( যখনই বন্টন করা হোক না কেন) মৃতের এতিম সন্তান ও উত্তরাধিকারীদের তার পৈত্রিক সম্পত্তির অংশ থেকে বঞ্চিত করা হয়। কিন্তু আল্লাহর যে হাবিব জন্মের আগেই পিতা-হারা এবং মাত্র ৬ বছর বয়সে মা-হারা হয়েছেন, সেই রাসূলের (সাঃ) কাছে অসহায় এই এতিমরা ছিল অতি আপনজন। সুতরাং তাঁর মত যারা এতিম, তাদের প্রতি কোনরূপ ভিত্তিহীন বিধান কি স্রষ্টার শাশ্বত কিতাবে থাকতে পারে? আল-কোরআনের বিধান অনুসারে এতিমদের প্রতি এরূপ অমানবিক আচরণ কতটা গ্রহণযোগ্য তা অবশ্যই খতিয়ে দেখার দাবি রাখে।
মৃত্যু জীবনের ইতি টানলেও মানুষের জন্মের সাথে সাথে বংশের যে ভিত রচিত হয় তা মৃত্যুর পরও অটুট থাকে। মৃত্যু বংশ সম্পর্ককে রহিত করতে পারেনা বলেই অনেক কাল পরেও কোন মৃত ব্যক্তির পরিচয় আমরা বংশ তালিকা থেকে বাদ দিতে পারিনা। পুত্র ও কন্যারা শুধু তাদের পিতার বংশধর নয়; পৌত্র, পৌত্রী, নাতি, নাতনী হিসেবে তারা তাদের দাদা/ নানারও বংশধর। সুতরাং পিতা জীবিত অবস্থায় কোন ব্যক্তি উত্তরাধিকারী রেখে মৃত্যুবরণ করলে এবং তার ভাই বর্তমান থাকার অজুহাতে মৃত ব্যক্তির ভাগের পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে তার এতিম বংশধরদের বঞ্চিত করার প্রশ্নই আসে না। তার অংশের পৈত্রিক সম্পত্তিও তার রেখে যাওয়া বা ত্যাগ করে যাওয়া সম্পত্তি হিসেবে গণ্য না হওয়ার কোন কারন থাকতে পারেনা। যখনই বন্টন করা হোক না কেন- অন্যান্য ভাই বোনদের সাথে মৃত ভাই/ বোনের সম্পত্তিও তার এতিম সন্তান ও উত্তরাধিকারীদের কাছে অর্পণ করা চাই। বিশেষ করে কোন ব্যক্তি বংশধর রেখে মৃত্যু বরণ করলে তার নিজের সম্পত্তির মত পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত তার অংশের সম্পত্তিও এতিম সন্তানদের মধ্যে বন্টন করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির পিতার মৃত্যুর পর বা যখনই সম্পদ বন্টন করা হোক না কেন, ঋণ (যদি থাকে) পরিশোধের ও ওয়াসিয়াতের অংশ প্রদানের পর সেই সময় যে পরিমাণ পৈত্রিক সম্পত্তি বর্তমান থাকবে তা থেকে সম পরিমাণ অংশ অন্যান্য জীবিত ভাইদের সাথে আনুপাতিক হারে মৃত ভাইয়ের নামেও বরাদ্দ রাখতে হবে এবং তা বিধি মোতাবেক উত্তরাধিকারীদের কাছে বন্টন করে দিতে হবে। কারন এতিমের সম্পত্তির দাবি ও হক কোন অবস্থাতেই বাতিল হয়ে যাবে না, বরং সর্বাবস্থায় তা রক্ষা করাই আল-কোরআনের নির্দেশ। পুত্র ও কন্যা সন্তান থাকা সত্বেও বংশীয় নিকট সম্পর্কের কারনে তাদের মৃত পিতার/ মাতার সম্পত্তি যেমন মৃত ব্যক্তির বাবা ও মা অর্থাৎ সন্তানদের দাদা ও দাদী/ নানা ও নানী পেতে পারেন। তেমনি যখনই সম্পত্তি বন্টন করা হোক না কেন, যদি মৃত ব্যক্তির বংশধর বা সন্তান থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির ভাই/ বোনেরা বর্তমান থাকা সত্বেও পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত মৃত ব্যক্তির অংশটি তার উত্তরাধিকারীরা নির্দিষ্ট অনুপাতে পাবার অধিকার রাখে। অর্থাৎ পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও তাদের সন্তানেরা সর্বাবস্থায় তাদের দাদা-দাদী/ নানা- নানীর সম্পত্তি থেকে তাদের বাবা/ মায়ের নামে বরাদ্দকৃত অংশটি পাবার অধিকার রাখে।
কিন্তু হায়! কোন অদৃশ্য মোহে এবং কবে থেকে এতিম সন্তান- সন্ততিদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার রেওয়াজ শুরু হয়েছে তা মহান স্রষ্টাই ভাল জানেন। অথচ আল্লাহর কিতাবে তো নেই, এমনকি কোন হাদিছেও এ ধরনের বৈষম্যমূলক নির্দেশ বা বিন্দুমাত্র ইংগিতও নেই। দুর্বল পেয়ে এতিমদেরকে যেন ঠকানোর চেষ্টা করা না হয় এবং উপযুক্ত সময়ে তাদের হাতে তাদের প্রাপ্য সম্পত্তির ন্যায্য হিস্যা অর্পণ করা হয় সে বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও অসহায় এতিম সন্তানদেরকে তাদের মৃত পিতার/ মাতার অংশ হিসেবে প্রাপ্য পৈত্রিক সম্পত্তির অর্থাৎ তাদের দাদার/ নানার সম্পত্তির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এতিমদেরকে করুণার প্রাত্র হিসেবে তাদের দাদার/ নানার সম্পত্তি থেকে ১/৩ অংশ পাবার আশায় আরও অনিশ্চিত ও দোদুল্যমান অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়ার বিধান চালু করা হয়েছে। যেখানে সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্বেও মা, বোন ও কন্যাদের প্রাপ্য অংশটুকু বুঝিয়ে দিতে গিয়ে কত রকমের বাহানার আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। সেখানে এরূপ অপশনাল অংশ থেকে দুর্বল এতিমরা যে পদে পদে বঞ্চিত হতেই পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানব মস্তিষ্ক প্রসূত এই বিধান কখনই আল-কোরআন ও হাদিছ সম্মত নয়। যে হাদিছের উপর ভর করে এরূপ সিদ্ধান্ত দেয়া হয় তার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন।
…………………………………….
Tafsir Ibn Kathir- Quran Tafsir-
It is recorded in the Sahihayn that Sa`d bin Abu Waqqas said, "O Allah's Messenger! I have some money and only a daughter inherits from me, should I will all my remaining property (to others)'' He said, "No.'' Sa`d said, "Then may I will half of it'' He said, "No.'' Sa`d said, "One-third'' He said, "Yes, one-third, yet even one-third is too much. It is better for you to leave your inheritors wealthy than to leave them poor, begging from others.'' Al-Bukhari mentioned in his Sahih that Ibn `Abbas said, "I recommend that people reduce the proportion of what they bequeath by will to a fourth (of the whole legacy) rather than a third, for Allah's Messenger said: (One-third, yet even one-third is too much.)''
………………………….............
এই হাদিছে স্পষ্ট বলা হয়েছে- "should I will all my remaining property (to others)" অর্থাৎ নিকট আত্মীয় নয় বরং অন্যদের জন্য ১/৩ অংশের কম পরিমাণ উইল করে দেবার বিষয়টি এসেছে। সাদ (রাঃ) যখন তার সমস্ত সম্পত্তি অন্যের নামে ওয়াছিয়ত করে দিতে চাইলেন তখন রাসূল (সাঃ) এরূপ করতে নিষেধ করেছিলেন। বরং সম্পত্তির ১/৩ অংশের চেয়েও কম পরিমাণ দেবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কারন সমস্ত সম্পত্তি দান করে দিলে মৃত ব্যাক্তির উত্তরাধিকারীরা বঞ্চিত হবে। আর এভাবে আপন আত্মীয়দের অভাবগ্রস্ত অবস্থায় ফেলে রাখাও সমীচিন নয়।
এবার আল-কোরআনে এ সম্পর্কে দয়াময় মহান স্রষ্টা কি নির্দেশ দিয়েছেন তা লক্ষ্য করি। মহান আল্লাহতায়ালা সম্পদ বন্টন সংক্রান্ত নির্দেশনা দেবার আগেই এতিমদের প্রাপ্য অংশ সংরক্ষণ ও প্রদান করার জন্য জোর তাগিদ দিয়েছেন। তাদেরকে সর্বপ্রকার সহায়তা করার পাশাপাশি ভরসা ও সান্তনা দেবার কথা বলা হয়েছে। অভিভাবক সম্পদশালী হলে এতিমরা উপযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের দেকভালের জন্য এতিমের সম্পত্তিতে হাত না দেয়াই উত্তম। কোন কারনে অভিভাবক অভাবে পড়লে খুবই সাবধানে ও সঙ্গত পরিমাণে এতিমের সম্পত্তি থেকে খরচ করতে পারেন। বুদ্ধি-বিবেচনা হবার পর অর্থাৎ উপযুক্ত হলে তারপর এতিমদের অংশ তাদের হাতে অর্পণ করতে হবে। এতিমদের মধ্যে যারা নিকট আত্মীয় তাদের ন্যায্য অধিকার তো আদায় করতেই হবে, সেই সাথে সম্পদ বন্টনের সময় অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন, অভাবগ্রস্ত ও অসহায় এতিমরা উপস্থিত থাকলে আপ্যায়ন করতে ও তাদের হাতে কিছু দিয়ে খুশি করতে বলা হয়েছে।
মহান আল্লাহতায়ালা এতিমদের সম্পদ নষ্ট বা আত্মসাৎকারীর প্রতি কঠিন শাস্তির হুমকি দিয়েছেন। এতিমদের সম্পত্তির ভাল অংশকে খারাপ দিয়ে বদলে দিতে নিষেধ করা হয়েছে। কোনরূপ ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে এতিমদের প্রাপ্য অংশের সম্পত্তি খেয়ে ফেলার পরিণাম যে ইহকালে ও পরকালে ভয়বহ হবে তা মহান আল্লাহতায়ালা আল- কোরআনে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন-
আল-কোরআন-
সূরা আন নিসা (মদীনায় অবতীর্ণ)
(০৪:০২) অর্থ- এতিমদেরকে তাদের সম্পদ বুঝিয়ে দাও। খারাপ মালামালের সাথে ভালো মালামালের অদল-বদল করো না। আর তাদের ধন-সম্পদ নিজেদের ধন-সম্পদের সাথে সংমিশ্রিত করে তা গ্রাস করো না। নিশ্চয় এটা বড়ই মন্দ কাজ।
(০৪:০৫) অর্থ- আর যে সম্পদকে আল্লাহ তোমাদের জীবন-যাত্রার অবলম্বন করেছেন, তা অর্বাচীনদের হাতে তুলে দিও না। বরং তা থেকে তাদেরকে খাওয়াও, পরাও এবং তাদেরকে সান্তনার বানী শোনাও।
(০৪:০৬) অর্থ- আর এতিমদের প্রতি বিশেষভাবে নজর রাখবে, যে পর্যন্ত না তারা বিয়ের বয়সে পৌঁছে। যদি তাদের মধ্যে বুদ্ধি-বিবেচনার উন্মেষ আঁচ করতে পার, তবে তাদের সম্পদ তাদের হাতে অর্পন করতে পার। এতিমের মাল প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করো না বা তারা বড় হয়ে যাবে মনে করে তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলো না। যারা স্বচ্ছল তারা অবশ্যই এতিমের মাল খরচ করা থেকে বিরত থাকবে। আর যে অভাবগ্রস্ত সে সঙ্গত পরিমাণ খেতে পারে। যখন তাদের হাতে তাদের সম্পদ প্রত্যার্পণ কর, তখন সাক্ষী রাখবে। অবশ্য আল্লাহই হিসাব নেয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট।
(০৪:০৮) অর্থ- সম্পতি বন্টনের সময় যখন আত্নীয়-স্বজন, এতিম ও অভাবগ্রস্ত মানুষ উপস্থিত হয়, তখন তা থেকে তাদের কিছু খাইয়ে দাও এবং তাদের সাথে কিছু সদালাপ করো।
(০৪:০৯) অর্থ- আর তাদের তেমনি ভয় করা উচিত, যদি তারা নিজেদের পেছনে অসহায় সন্তান-সন্ততি ছেড়ে গেলে তাদের জন্যে যেমন আশঙ্কা করত; সুতরাং তারা যেন আল্লাহকে ভয় করে এবং সংগত কথা বলে।
(০৪:১০) অর্থ- যারা এতিমদের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করেছে এবং সত্ত্বরই তারা অগ্নিতে প্রবেশ করবে।
মনে রাখতে হবে দুঃস্থ, নিঃস্ব এতিমদের নামে ব্যবসা করার কোন সুযোগ নেই। বরং তাদের তদারকি ও সকল ব্যায়ভার ইসলামি রাষ্ট্র বহন করবে।
অথচ দুঃখের বিষয় এই যে, কোন পরিবারে পিতা জীবিত অবস্থায় কয়েকজন ভাই ও বোনের মধ্য থেকে হঠাৎ কোন ভাই/বোন তার নাবলক সন্তান রেখে মৃত্যুবরণ করলে, সেই আপন ভাই/বোনের পৈতৃক সম্পত্তির অংশ থেকে এতিম সন্তানদের বঞ্চিত করা হয়। শরীয়তের দৃষ্টিতে মৃত্যুর সাথে সাথে আপন সন্তানের এতিম শিশুরা নাকি আপন দাদার/ নানার নিকটতম আত্মীয়দের পর্যায়ে থাকার যোগ্যতা হারায়!!! যে শিশুগুলো পিতাকে হারিয়ে অসহায় হয়ে যায়, ইসলামের নামে নিকট আত্মীয়তার খাতা থেকে সেই এতিমদের নাম মুছে ফেলে তাদেরকে করুণার প্রাত্র হিসেবে এক অনিশ্চিত কঠিন পরিবেশের মুখে ঠেলে দেয়া হয়। সত্যি, বিষয়টি ভাবতেও যেন বুক ফেটে যায়।
(০৪:১১) নং আয়াতের প্রথমাংশে ব্যবহৃত "আওলাদ"- (أَوْلاَدِ - genitive masculine plural noun ) শব্দটির অর্থ সন্তান-সন্ততি/ বংশধর। সম্পত্তি বন্টন সংক্রান্ত মৌলিক বিধান দেবার শুরুতেই এমন একটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যার মাধ্যমে বংশের সকল সদস্যকে সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। রক্ত সম্পর্ক ছিন্ন তো নয়ই, বরং সন্তান-সন্ততিদের মাঝে সুসম্পর্কের অবিচ্ছিন্ন ভিত রচনা করার জন্যই মূলত এরূপ শব্দ চয়ন করা হয়েছে। এটি মূলত পুরুষতুল্য বা পুংলিঙ্গবাচক ও বহুবচন অর্থাৎ এর মাধ্যমে বিশেষভাবে পুত্র সন্তানদের (পুত্র বা পৌত্র বা নাতি ইত্যাদি) বর্তমান থাকার বিষয়টি নির্দেশিত হয়। এই নির্দেশটি যদি শুধুমাত্র যার যার পুত্র সন্তানের জন্যই সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে এখানে "আবনা-উ" শব্দটি ব্যবহার করা হত। কিন্তু ক্ষুদ্র গন্ডি পেরিয়ে বংশের অধস্তন হিসেবে সকল পুত্র সন্তান-সন্ততিদের একীভুত করার লক্ষ্যেই এখানে "আওলাদ" শব্দটি সঠিক মাত্রা পেয়েছে। তবে পুত্র- সন্তানদের সাথে নারীতুল্য বা স্ত্রী-লিঙ্গবাচক কন্যা- সন্তান (কন্যা বা পৌত্রী বা নাতনী ইত্যাদি) বর্তমান থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু এককভাবে শুধুমাত্র কন্যা- সন্তানদের বর্তমান থাকার ক্ষেত্রে এই শব্দটি প্রযোজ্য নয়। এরপর আলাদাভাবে "নিসাআন (4:11:11) - nisāan- (only) women - accusative feminine plural indefinite noun - শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে নারীদের অংশ নির্ধারনের বিষয়েও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। সুতরাং "আওলাদ/ সন্তান-সন্ততি/ বংশধর" শব্দটি এখানে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর মাধ্যমে এই ইংগিতই দেয়া হয়েছে যে, মৃত্যু কখনই রক্তসম্পর্কীত নিকটাত্মীয়তার বন্ধনকে ছিন্ন করে দেয়না। সে কারনেই মৃত ব্যক্তির পুত্র ও কন্যারা শুধুমাত্র তাদের মৃত পিতার সম্পদের নয়, বরং এতিম পৌত্র, পৌত্রী, নাতি ও নাতনীরাও তাদের মৃত বাবা ও মায়ের সূত্রে দাদার/ নানার (কাছ খেকে বাবা/ মায়ের অংশ হিসেবে প্রাপ্ত পৈত্রিক) সম্পদের অংশ পাবার যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
আবার বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, এখানে সরাসরি "ইবনুন" (অর্থ ছেলে, পুত্র- একবচন) এবং "ইবনাতুন" (অর্থ মেয়ে, কন্যা- একবচন) শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়নি। বরং ব্যাপক অর্থ বোঝানোর জন্য "আওলাদ" শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং এর মাধ্যমে স্রষ্টা মহান আল্লাহতায়ালা এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, পূর্ণাঙ্গ পৌরুষের অধিকারী কিংবা পূর্ণাঙ্গ নারীত্বের অধিকারী না হওয়া সত্বেও তাঁরই সৃষ্ট পুরুষতুল্য অর্থাৎ পুরুষালী দেহাবয়ব ও আচরণের অধিকারী খোজা পুত্র-সন্তানেরা অন্যান্য স্বাভাবিক পুত্রদের মত এবং নারীতুল্য অর্থাৎ মেয়েলী দেহাবয়ব ও আচরণের অধিকারী খোজা কন্যা-সন্তানেরা অন্যান্য স্বাভাবিক কন্যাদের মত উত্তরাধিকারী হিসেবে নিছাব অনুসারে সম্পদের অংশ পাবেন। তেমনি মৃত্যুর পর তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তিও তাদের নিকটাত্মীয়রা পেয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে কোন ধরনের প্রতিবন্ধীত্ব যেন সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। তবে সম্পত্তি হস্তান্তরের সময় তাদের মাঝে স্বাভাবিক বুদ্ধি- বিবেচনার উন্মেষ ঘটেছে কিনা তা সরল দৃষ্টিকোন থেকে যাচাই করে নিতে হবে। কিন্তু কোনরূপ কুমতলব এঁটে ঠকানোর চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে ইহকালে ও পরকালে কঠিন আযাবের কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। একইভাবে শুধুমাত্র যৌন প্রতিবন্ধিত্বের কারনে খোজা সন্তানদের যেন ভিন্ন চোখে দেখা না হয়। সেজন্য সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে ভিন্ন পথ বাতলে না দিয়ে মহান আল্লাহতায়ালা এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেন তাদের ন্যায্য অধিকার প্রদান করা হয়। কিন্তু হায়! আমরা তার মহৎ শিক্ষাকে ভুলে ধর্মের নামে কতই না সংকীর্ণ মনের পরিচয় দিয়ে চলেছি।
এরপর "লিযযাকারি" (لِلذَّكَرِ - genitive masculine noun) ও "উল উংছাইয়াইনি" (الأُنثَيَيْنِ - genitive feminine dual noun) শব্দদুটি ব্যবহার করে পুরুষ সন্তান ও নারী সন্তানদের অংশের অনুপাত নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে এবং বোঝানো হয়েছে যে, ১ জন পুরুষ সন্তানের অংশ ২ জন নারী সন্তানের সমান। তেমনি এখানে "ওয়াহিদাতান"- (وَاحِدَةً - accusative feminine indefinite noun) শব্দটি ব্যবহার করে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, (পুত্র- সন্তানের অবর্তমানে) শুধুমাত্র একজন কন্যা- সন্তান থাকলে তার জন্য তার মৃত পিতা ও মাতার নিজস্ব অর্জিত ও পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির ১/২ অংশ এবং কন্যা- সন্তানের সংখ্যা ততোধিক হলে ২/৩ অংশ থেকে প্রত্যেকে সমান ভাগ পাবে। আর একইভাবে পৌত্র/ নাতির অবর্তমানে পৌত্রী/ নাতনীরাও একই অনুপাতে তাদের দাদা/ নানার কাছে থেকে মৃত পিতা/ মাতার নামে পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের উত্তরাধিকারী হবার অধিকার রাখে।
এই আয়াতে ব্যবহৃত "ওয়ালাদুন" ( وَلَدٌ - nominative masculine indefinite noun) শব্দটি মূলত পুরুষতুল্য বা পুংলিঙ্গবাচক এবং কর্তৃকারক । সুতরাং "ওয়ালাদুন" শব্দটি যখন পজেটিভ সেন্সে ব্যবহৃত হয় অর্থাৎ অন্ততঃ একজন সন্তান বর্তমান থাকার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, তখন সেই সন্তানটিকে নিশ্চয় ছেলে নয়ত মেয়ের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হতে হবে অর্থাৎ হয় সে পুরুষতুল্য নয়ত নারীতুল্য হবেই। তাই "ওয়ালাদুন" শব্দটি মূলত পুরুষতুল্য বা পুংলিঙ্গবাচক এবং একবচন হওয়ায় এর দ্বারা এই একমাত্র সন্তানটির উপস্থিতি বোঝানোর কারনে তার পুরুষতুল্য বৈশিষ্ট্যকেই নির্দেশ করে অর্থাৎ সেই সন্তানটি পুত্র-সন্তানের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হবে। আবার বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় যে, এই আয়াতের শেষ অংশে "আবাউকুম" অর্থ (ābāukum - your fathers) "তোমাদের পিতারা" এবং "আবনা-উকুম" অর্থ "তোমাদের ছেলেরা/ পুত্ররা" শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয়েছে । "আবা-উ" (آبَآؤُ - nominative masculine plural noun) এবং "আবনা-উ" ((أَبناؤُ - nominative masculine plural noun) শব্দ দুটির মাধ্যমে আমাদের পিতা ও পুত্র-সন্তানদের কথা সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এরপূর্বে ব্যবহৃত "ওয়ালাদুন" শব্দটি দ্বারা একজন সন্তান বর্তমান থাকার ক্ষেত্রে যে তাকে পুরুষ অর্থাৎ পুত্র-সন্তানই ধরতে হবে তা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে "ওয়ালাদুন" শব্দটি যখন নেগেটিভ সেন্সে ব্যবহৃত হয় অর্থাৎ একজন সন্তানও না থাকার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, তখন এর দ্বারা পুত্র ও কন্যা নেই অর্থাৎ কোন সন্তানই নেই নির্দেশ করে।
আল-কোরআনের (০৪:১১) নং আয়াতের নির্দেশ অনুসারে সহজেই বোঝা যায় যে, মৃত ব্যক্তির "ওয়ালাদুন" অর্থাৎ অন্ততঃ একজন পুত্র-সন্তান বর্তমান থাকলে মৃত ব্যক্তির পিতা ও মাতা প্রত্যেকে অথবা যিনি জীবিত থাকবেন তিনি মৃত ব্যাক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তির ১/৬ অংশ পাবেন। একইভাবে এতিম পৌত্র, পৌত্রী, নাতি ও নাতনীরা তাদের বাবা/ মার মৃত্যুর পরও বাবা/ মায়ের নিজস্ব সম্পত্তির মতই আনুপাতিক হারে তাদের দাদা ও নানার সম্পত্তির [পুত্রের ঘরের সন্তানেরা (পৌত্র ও পৌত্রীরা) তাদের বাবার এবং কন্যার ঘরের সন্তানেরা (নাতি ও নাতনীরা) তাদের মায়ের অংশ হিসেবে প্রাপ্ত পৈত্রিক সম্পদের] অংশিদার হবার অধিকার রাখে। কারন আল-কোরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যে মৃত ব্যাক্তির পিতা-মাতা ও পুত্র নেই (কালালাহ্) তার রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে তার ভাই/ বোন ওয়ারিশ হবেন। কিন্তু এমন কোন ইংগিত আল-কোরআনে নেই যার মাধ্যমে এই অন্যায় দাবি করা যায় যে, পিতা জীবিত থাকাকালীন কোন ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার "আওলাদ" বা বংশধর থাকা সত্বেও তিনি (সেই মৃত ব্যক্তি) পৈত্রিক সম্পত্তি পাবার তালিকা থেকে বাদ পরবেন এবং মৃত ব্যক্তির অপর কোন ভাই বর্তমান থাকার কারনে মৃত ব্যাক্তির "আওলাদ" অর্থাৎ এতিম সন্তান-সন্ততিরা তাদের মৃত পিতা/ মাতার অংশ হিসেবে প্রাপ্য পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন। সুতরাং সম্পত্তি যখনই বন্টন করা হোক না কেন মৃত হওয়া সত্বেও তার সন্তান-সন্ততিদের মাধ্যমে বংশধারা অব্যহত থাকায় সেই মৃত ব্যক্তির অছিলায় এতিম পৌত্র. পৌত্রী ও নাতি, নাতনীরা নির্দিষ্ট আনুপাতে অবশ্যই তাদের দাদা/ নানার কাছ থেকে প্রাপ্ত তাদের পৈত্রিক সম্পত্তির অংশিদার হবার অধিকার রাখেন এবং এটাই স্বাভাবিক।
তাহলে (০৪:১১) নং আয়াতের সঠিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায়-
..........................................
সূরা আন নিসা (মদীনায় অবতীর্ণ)
(০৪:১১) অর্থ- আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তান- সন্ততিদের/ বংশধরদের (পুত্র ও কন্যা সন্তান-সন্ততিদের) সম্পর্কে আদেশ করেনঃ একজন পুরুষের অংশ দু'জন নারীর অংশের সমান। অতঃপর যদি শুধু নারীই হয় দু' এর অধিক, তবে তাদের জন্যে ঐ মালের তিন ভাগের দুই ভাগ যা ত্যাগ করে মরে এবং যদি একজনই (নারী) হয়, তবে তার জন্যে অর্ধেক। মৃতের পিতা-মাতাদের মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্যে ত্যাজ্য সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ, যদি মৃতের ( وَلَدٌ) একজন পুত্রসন্তান থাকে। যদি ( وَلَدٌ) কোন সন্তানই ( পুত্র ও কন্যা) না থাকে এবং পিতা-মাতারাই ওয়ারিশ হয়, তবে মাতা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ। অতঃপর যদি মৃতের কয়েকজন ভাই-বোন "ইখওয়াতুন"- ikh'watun- brothers and sisters) থাকে, তবে তার মাতা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ ওছিয়্যতের পর, যা করে মরেছে কিংবা ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের পিতাদের ও পুত্রদের মধ্যে কে তোমাদের জন্যে অধিক উপকারী তোমরা জান না। এটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত অংশ নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, পরম কুশলী।
..........................................
"হে আল্লাহ! অজ্ঞতা হেতু অনিচ্ছাকৃত ভুল-ভ্রান্তির জন্য অবনত মস্তকে ক্ষমাভিক্ষা চাই"
...........................................
এখানে দেখুন- Zain Bhikha - Orphan Child
এখানে দেখুন- Heal the World - Zain Bhikha
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১২ রাত ৮:১৭