বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার আলোকে জানা গেছে যে, অবাধ যৌনাচার ছাড়াও প্রবাহিত রক্তের মাধ্যমেও হেপাটাইটিস-বি ও সি, এইডস্ ও আরও অনেক জানা অজানা প্রাণঘাতি রোগ সংক্রমিত হয় এবং মহামারির আকার ধারণ করতে পারে। আর এ কারণেই সর্বজ্ঞ মহান আল্লাহতায়ালা (০২ : ১৭৩) ও (৬:১৪৫) নং আয়াতে যৌন অপরাধের পাশাপাশি প্রবাহিত রক্ত অর্থাৎ শিরা ও ধমনীর টাটকা রক্ত (কাঁচা বা রান্না করে) খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। আর যা খাওয়া হারাম তা শরীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করানোও হারাম হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ কিছু খেলে তা পাকস্থলিতে গিয়ে পরিপাক হয়। অতঃপর এর সারাংশ রক্তের মাধ্যমে শরীরের সর্বত্র ছড়িয়ে পরে। কিন্তু যখন কোন কিছু মাংসে বা ধমনীতে বা শিরায় প্রবেশ করানো হয় তখন তা সরাসরি রক্তের মাধ্যমে মুখে খাওয়ার তুলনায় দ্রুত ও সহজেই শরীরের সর্বত্র পরিচালিত হয়। এভাবে রক্তের মাধ্যমে জানা ও অজানা বিভিন্ন রোগের জীবাণু একজনের দেহ থেকে অন্যের দেহে প্রবেশ করতে পারে। রক্ত হারাম হওয়ার এই বৈজ্ঞানিক কারণটি অনেক গবেষণার পর আজ আমরা জানতে পেরেছি। রক্ত সংস্পর্শের ব্যপারে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য এখন চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডিস্পোসিবল্-সিরিঞ্জ ব্যবহৃত হচ্ছে। একজনের ব্যবহৃত ছুঁচ (Needle) যেন অন্যের দেহের সংস্পর্শে না আসে সেজন্য সেমিনার, ব্যানার, পোষ্টার ও লেখালেখির মাধ্যমে জনগনকে সচেতন করে তোলা হচ্ছে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জীবন নাশের হুমকি থাকলে কোন হারাম সেই সংকটময় সময়ের জন্য সাময়িকভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। আর এই বিষয়টি আমরা (০২:১৭৩) ও (০৬:১৪৫) নং এবং নীচের আয়াতগুলো থেকে বুঝে নিতে পারি।
আল-কোরআন-
সূরা আন নাহল-আয়াত নং- ১১৫ ও ১১৯
(১৬ : ১১৫) অর্থ- তিনি তো তোমাদের উপর হারাম করেছেন মৃত, প্রবাহিত রক্ত ও শূকরের গোশত এবং এমন জানোয়ার যার ওপর (যবাই করার সময়) আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নাম নেয়া হয়েছে, কিন্তু যদি কাউকে বাধ্য করা হয়, সে যদি সীমালংঘনকারী না হয়, তাহলে আল্লাহতায়ালা ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
(১৬ : ১১৯) অর্থ- অতঃপর যারা অজ্ঞতাবশত কোন গুনাহের কাজ করলো, অতঃপর (অন্যায় বুঝতে পেরে) তওবা করে নিল এবং নিজেদেরকে সংশোধনও করে নিল, তোমার মালিক অবশ্যই এরপর তাদের জন্য ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
সূরা আল বাক্বারা-আয়াত নং- ১১৯
(০২ : ২১৯) অর্থ- (হে নবী), এরা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে; তুমি বলে দাও, "এ দু’ট জিনিসের মধ্যে বড় ধরনের পাপ (ক্ষতি) এবং মানুষের জন্য সামান্য কিছু উপকারও রয়েছে; কিন্তু এগুলোর পাপ (ক্ষতি) উপকার অপেক্ষা অনেক বেশী।" তারা তোমাকে (এও) জিজ্ঞাসা করে (আল্লাহর পথে) তারা কি খরচ করবে? বল, 'যা উদ্বৃত্ত।' এভাবে আল্লাহ্ তাঁর সকল নিদর্শন (আয়াত সমূহ স্পষ্টরূপে) তোমাদের জন্য বর্ণনা করেন যাতে তোমরা চিন্তা কর,
সূরা মায়েদাহ- আয়াত নং-(৯০ ও ৯১)
(০৫ : ৯০) অর্থ- হে বিশ্বাসিগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃন্যবস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর, যাতে করে তোমরা সফলকাম হতে পার।
(০৫ : ৯১) অর্থ- শয়তান তো মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্র“তা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায়, এবং তোমাদের আল্ল¬াহর স্মরণে ও নামাজে বাধা দিতে চায়। অতএব তোমরা কি নিবৃত হবে না ?
মানবজাতির কতটুকু ভাল বা মন্দ কিসে নিহিত আছে তা স্রষ্টা মহান আল্লাহতায়ালা ভালভাবেই জানেন। তাই তিনি সকল মন্দ থেকে বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে বার বার সাবধান করে দিয়েছেন। বর্তমানে মাদকাসক্তি একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে, যা সমাজ তথা গোটা জাতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সর্বনাশা নেশার কবলে পড়ে যে অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে এবং সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আল্লাহর আইন গুটিকয়েক মানুষের জন্য নয়। সমগ্র মানব জাতির স্বভাব, চরিত্র অনুসারে ও তাদের কল্যাণের জন্যই আল্লাহতায়ালা বিধি বিধান প্রেরণ করেন। স্রষ্টা সর্বজ্ঞ মহান আল্লাহ্ এই মাদক এর সামান্য কিছু উপকারের বিষয়টি ভালভাবেই অবগত আছেন। আর তাই তো তিনি অব্যক্ত না রেখে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বেই আল-কোরআনের সূরা আল বাকারা -এর (০২:১১৯) নং আয়াতে প্রথমত মদ এর সামান্য কিছু উপকারের বিষয়টি প্রকাশ করেছেন এবং সাথে সাথে যেহেতু এর (শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও সামাজিক) ক্ষতির মাত্রাই অধিক, তাই মদ্যপান হারাম করে দিয়েছেন।
মাদকাসক্ত অবস্থায় এবং নেশার চাহিদা মেটাতে গিয়ে একজন মানুষ বিবেকশুন্য হয়ে যায়। তখন সে অতি সহজেই চুরি, ডাকাতি, খুন, ছিনতাই, জেনা ও ব্যভিচার সহ নানা রকম অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়। ফলে একদিকে যেমন সমাজের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে, তেমনি লাগামহীন অবৈধ সম্পর্ক এবং একই সিরিঞ্জের মাধ্যমে একই সময়ে অনেকে মাদক গ্রহণের ফলে 'এইডস্' সহ নানা রকম সংক্রামক রোগের প্রকপ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তাই সূরা মায়েদাহ এর (০৫ : ৯০) নং আয়াতে এগুলোকে ঘৃন্যবস্তু ও শয়তানের কাজ বলা হয়েছে। মাদক ও জুয়ার নেশার মন্দ স্বভাব থেকে দূরে থাকার সাথে সাথে এর ভয়ংকর প্রভাব থেকে মানবজাতিকে রক্ষার জন্য সর্বজ্ঞ আল্লাহতায়ালা ঐশীবাণী প্রেরণের মাধ্যমে বারবার সাবধান করে দিয়েছেন।
বর্তমানে উন্নত বিশ্বের মানুষ বলতে আমরা যাদেরকে বুঝি সেই বুদ্ধিমান অথচ অবিবেচক ও অহংকারী মানুষগুলো আল্লাহ্ প্রদত্ত সত্য-জ্ঞানকে অবজ্ঞা করার কারণে মরণব্যাধি 'এইডস্' এর কবলে পড়ে দিশেহারা প্রায়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যে এই রোগটি মহামারির আকার ধারণ করে একটি দেশ বা জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে সে সম্পর্কে চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ আশংকা প্রকাশ করেছেন। এর হাত থেকে মুক্তি পাবার লক্ষ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিরন্তর গবেষণা চলছে। অতি সম্প্রতি এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, খাৎনা করা পুরুষদের যৌনবাহিত 'এইচ আই ভি' ভাইরাসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কম।
দৈনিক ইনকিলাব-১০ এপ্রিল-২০০০ইং-১২পৃষ্ঠা-
(গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী বাল্টিমোরের জনস হপকিনস্ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ থমাস কুইন, গষেকদের 'এইডস্' সংক্রান্ত এক সম্মেলনে বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে খাৎনাকারী কোন পুরুষের 'এইচআইভি' সংক্রমণ ঘটেনি।)
মূলত এখানে যারা মহান আল্লাহর ঐশী বিধান অর্থাৎ ইসলামী অনুশাসন মেনে চলেন তাদের কথাই বুঝানো হয়েছে। পরিপূর্ণ ইসলামী জীবন ব্যবস্থা 'এইডস্' প্রতিরোধে ও জানা অজানা অনেক জটিল রোগ সংক্রমনের হাত থেকে রক্ষার জন্য যে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে তা আজ সর্বজনস্বীকৃত ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
আল-কোরআন-
সূরা বাকারা-আয়াত নং-১৭৩
(০২ : ১৭৩) অর্থ- তিনি তোমাদের জন্য হারাম করেছেন মৃত জীব, প্রবাহিত রক্ত ও শূকর এবং যেসব জীব-জন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে উৎসর্গ করা হয়। কিন্তু যদি কেউ নিরুপায় হয়ে পড়ে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে সীমালংঘনকারী না হয়, তাহলে তার কোন অপরাধ হবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহতায়ালা ক্ষমাশীল ও অত্যন্ত দয়াবান।
সূরা মায়েদাহ- আয়াত নং- ৯৩
(০৫ : ৯৩) অর্থ- যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও সৎকাজ করেছে (এই নিষেধাজ্ঞা জারির ) পূর্বে তারা যা কিছু খেয়েছে তার জন্য তাদের কোন পাপ নেই। যদি তারা (ভবিষ্যতেও) সাবধান থাকে ও (আল্লাহর উপর) ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, অতৎপর সতর্ক থাকে, (এভাবে যতক্ষণ পর্যন্ত ) তারা ঈমান আনবে ও ভাল কাজ করবে, পুনরায় আল্লাহতায়ালাকে ভয় এবং ভাল কাজ করতে থাকবে ( আল্লাহতায়ালা অবশ্যই তাদের ক্ষমা করে দেবেন, কেননা ); সৎকর্মশীল মানুষদেরকে আল্লাহ্তায়ালা ভালবাসেন।
সূরা আনয়াম- আয়াত নং-১৪৫
(০৬ : ১৪৫) অর্থ- তুমি বলে দাও, 'আমার কাছে যে ওহী পাঠানো হয়েছে তার মধ্যে তো এমন কোন হারাম জিনিস আমি পাচ্ছি না যা একজন ভোজনকারী মানুষ (সচরাচর) খেয়ে থাকে; কিন্তু মৃত বা প্রবাহিত রক্ত অথবা শূকরের মাংস (হলো হারাম) - কেননা এসব অপবিত্র - অথবা যা অবৈধ আল্লাহ ছাড়া অন্যের নাম নেওয়ার কারণে।' তবে কেউ যদি অবাধ্য না হয়ে এবং সীমালংঘন না কোরে তা গ্রহণে বাধ্য হয়, তাহলে তোমার প্রতিপালক অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
সূরা আন নিসা-আয়াত নং-২৮
(০৪ : ২৮) অর্থ- আল্লাহ্ তোমাদের বোঝা হালকা করতে চান। কেননা মানুষকে তো দুর্বলভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।
মহান আল্লাহতায়ালা মানুষকে দুর্বলভাবে সৃষ্টি করেছেন। তাই গুরুতরভাবে অসুস্থ ও দুর্বল কোন রোগীর জীবন রক্ষার্থে যদি কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেই রোগীর শরীরে রক্ত সরবরাহ অর্থাৎ ব্লাড-ট্রান্সফিউশন করা অত্যন্ত জরুরী বলে পরামর্শ দেন, তবে তা সেই সংকটের সময়ে বৈধ হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই চেনা-জানা, সুস্থ-সবল ও পরিচ্ছন্ন ব্যক্তির নিকট থেকে যথাসম্ভব পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ করতে হবে। ঠিক তেমনি কোন বিশ্বাসী যদি জীবন বাঁচানোর জন্য নিরুপায় হয়ে অথবা না জেনে-শুনে অর্থাৎ অজ্ঞতাবশত কোন হারাম খাদ্য খেতে বাধ্য হয় বা খেয়ে ফেলে, কিন্তু তার অভ্যাসে পরিণত না করে এবং পরবর্তীতে তওবা করে তা বর্জন করে ও সৎ পথে চলে, তাহলে {(০৫ : ৯৩), (০২:১৭৩), (০৬:১৪৫), (১৬:১১৫) ও (১৬:১১৯) নং আয়াতে} মহান আল্লাহতায়ালা তাদেরকে ক্ষমা করে দেবার কথা ব্যক্ত করেছেন।
সূরা মায়েদাহ- আয়াত নং- ৯২
(০৫ : ৯২) অর্থ- এবং আল্লাহর অনুসরণ কর, ও রসূলের অনুসরণ কর এবং সতর্ক হও, যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে জেনে রাখ যে, স্পষ্ট প্রচারই আমার রসূলের কর্তব্য।
মহান স্রষ্টার সাবধান বাণী যারা বিশ্বাস করে ও মেনে চলে এবং রাসূলুল্লাহ্ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে যারা সঠিকভাবে অনুসরণ করে তারা নিরাপদ থাকে। আর যারা অবজ্ঞা করে তারাই চরমভাবে ভোগে ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরম করুণাময় মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের পাপ মার্যনা করার জন্য সব সময়ই তাঁর ক্ষমার দ্বার উন্মুক্ত করে রেখেছেন। তাই আসুন আর দেরি নয়, এতদিন অজ্ঞতার আঁধারে থেকে মন্দ যা করেছি তার জন্য অনুতপ্ত হই এবং খাঁটি অন্তরে তওবা করে তা চিরতরে বর্জন করি। সেইসাথে প্রকৃত ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমে ইহকালীন ও পরকালীন শান্তি ও মুক্তির পথকে সুগম করে তুলি। .
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১২ দুপুর ১:৫৮