২৬৮ কারাংগাহাপি রোডের বাসাটাতে যদি কখনো আসে কেউ বুঝতেই পারবেনা এটা নিউজিল্যান্ডের কোন বাসা। মনে হবে ঢাকায় কোন মেসে বসে আছি। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল অগ্রযাত্রা, এখানেই পরিচয় হয় মেহেদি ভাইয়ের সাথে। ভাইয়া আমাকে সময়মত এমন একটা উপকার করেছিল যেটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে, যাই হোক কে'রোডে বেকার অবস্থায় যখন সিভি বিলাচ্ছি তখন একদিন শুনলাম শহর থেকে দূরে ফার্মিং এর কাজ আছে। ঐ ইন্ডিয়ানকে ফোন দিয়ে ভোর বেলায় রওনা হয়ে গেলাম কাজ করতে সারাদিন কামলা দিয়েছিলম, পেয়েছিলাম ৯২$। জীবনের প্রথম ইনকাম অনেক এক্সাইটেড ছিলাম, কিন্তু আল্লাহ আমাকে সেদিন বুঝিয়েছিলেন যারা দেশে এই কাজ গুলো করে তারা কতটা কষ্ট করতে হয়।
এরই মধ্যে বাসায় ঝামেলা শুরু হয়ে গেল বাসার মালিক অবৈধ লোকদের ঝাটানোর উদ্দেশ্যে নোটিশ দিলেন। হায় আল্লাহ পনের দিনের মধ্যে বাসা পাবো কই? কয়েকজন ভাইকে ধরেছিলাম লাভ হয়নি। নিউজিল্যান্ড এ আমার এক পাতানো মামা ছিল। সে আমার পরে আসলেও তাকে আমি মামা বলে ডাকতে শুরু করলাম শুধুমাত্র বয়সের কারনে। সেই মামা এক ইন্ডিয়ানের বাসায় থাকত, কোনমতে তার বাসায় থাকার ব্যবস্থা করা হলো। সপ্তাহে ৯০$ ভাড়া দিয়ে থাকতে শুরু করলাম ৭২নেলসন স্ট্রিট এ। মামা ভাগিনা এক সাথে কান্না করতাম। আমি করতাম ১০০$ এর জব আর উনি করত ১৩০$ এ।
এরই মধ্যে একটা ভালো জবের জন্য এদিক সেদিক দৌড় ঝাপ দিচ্ছিলাম। এরই মধ্যে এক ইন্ডিয়ানের সাথে পরিচয় হয় তাকে জবের জন্য প্যারা দিতে লাগলাম। কিছুদিনের মধ্যে একটা সু-খবরো পেলাম। একটা জব পেলাম তাও যে খুব ভালো তা কিন্তু নয়, তিনদিন ৩৬ ঘন্টা কাজ করতাম। তবে তারা একটু ভদ্র ভাবে সরকারকে ট্যাক্স ফাকি দিত। আমি কাজ করতাম ৩৬ ঘন্টা কিন্তু তারা আমাকে মিনিমাম ওয়েজ দিয়ে মাত্র ১৪ ঘন্টার পেমেন্ট দিত। তার মানে আমি ৩৬ ঘন্টা কাজ করলেও ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট জানতো আমি ১৪ ঘন্টা কাজ করছি। নিউজিল্যান্ডে এভাবেই ইন্ডিয়ান বাঙালি আর পাকিরা ছাত্রদের মাথায় কাঠাল ভেঙে খায়; তাও আবার আইনের মধ্যে থেকেই। সরাসরি কেউ অভিযোগ করবেনা কারন তাতে নিজেই ফেসে যাবে।
এরমধ্যে আরো একবার বাসা চেঞ্জ করলাম। ২মাসে বাসাটার জন্য মায়া লেগে গিয়েছিল কিন্তু কি আর করা নিয়তি আমাদের কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায় সেটা আমরা কেউই বলতে পারিনা।
২১০ টাকার জব; বাসা ভাড়া, গ্রোসারি আর বাস ভাড়া দিয়ে হাতে ৫০-৬০ ডলারও হাতে রাখা দায়। ভাবতে লাগলাম কিভাবে হবে? ৫০০০ ডলার টিউশন ফী কোথায় পাবো সেই টেনশনে মাথার চুল সব দিনদিন ঝরতে শুরু করলো। মেহেদি ভাইয়ের সাথে থাকতা ৮৩ এনযেক এভেনিউতে, তার সাথে অনেক কথা শেয়ার করতাম। সারাদিন কাজ করতাম রাত ১০টায় বাসায় ফিরে কাউন্টডাউনে যেতাম খাবার কিনতে; খাবার কিনে বাসায় এসে মেহেদি ভাইয়ের সাথে টুংটাং করে রান্না করতাম আর গল্প গুজব করতাম। রান্নাবান্না শেষ করে খাওয়া দাওয়া করে রাত ২টার দিকে ঘুমোতে গেলেও টেনশনে ঘুম আসতোনা; আবার সকালে উঠেই নতুন দিনের দৌড়াদৌড়ি শুরু।
এরমধ্যে একটা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হলো; যে হোস্টেলে থাকতাম সেখানে মাউরিরা(মাউরিদের নিয়ে একটা পোস্ট থাকবে) থাকত। এদের দেখলেই ভুতের মত লাগত আমার। সারা শরীরে মুখে ভয়ংকর রকমের সব ট্যাটু আর শালারা যে কতদিন পরপর গোসল করে আল্লাই জানে। তারউপর সবগুলা ড্রাংক থাকতো; আর তাই এদের আমার প্রচন্ড ভয় লাগতো। বুঝতে পারছিলাম এখানে বেশিদিন থাকা সম্ভব না। কিন্তু বাধ্য হয়েই সেখানে থাকছিলাম শুধু বিশটা ডলার বাচাতে।
চলবে.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।.।
সকল পর্বের লিংক একসাথেঃ
নিউজিল্যান্ডে এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১)
নিউজিল্যান্ডে এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:১৬