সব ধর্মেই বলা হয়ে থাকে সৃষ্টিকর্তা সর্ব শক্তিমান। তিনি কি কোনো জীব?
না, তিনি কোনো জীব নন।
তিনি কি মানুষ?
জীবই যদি না হয়, তাহলে মানুষ তো নয়ই।
তিনি কোনো জীব নয়, মানুষ নয়। তাহলে আমরা ‘তাকে’ ‘তিনি’ বলে সম্বোধন করি কেন? আর সৃষ্টিকর্তা শব্দটাও যর্থার্থ নয়। কর্তা হলো কোনো ব্যক্তি যিনি কর্তৃত্ব করেন। তার মানে, যে ব্যক্তি সৃষ্টির ওপর কর্তৃত্ব করে থাকেন তিনি সৃষ্টিকর্তা।
সৃষ্টিকর্তার পরিবর্তে আমরা বলতে পারি সর্ব শক্তিমান কোনো ‘জিনিস’ বা ‘কিছু’।
এবং এখানেই আমাদের থেমে যেতে হবে। ওই ‘জিনিস’ সম্পর্কে আর কিছুই বলা যাবে না। কারণ সর্ব শক্তিমান কেনো ‘জিনিস’ বা ‘কিছু’ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা থাকতে পারে না। মানুষ সর্ব শক্তিমান নয়। আর ওখানেই না থেমে যদি ওই 'জিনিস' সম্পর্কে আর কিছু বলা হয়, সেটা মানবিক পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়ে যায়।
মজার ব্যাপার হলো প্রতিষ্ঠিত কোনো ধর্মই ওখানে থেমে যায়নি। সর্ব শক্তিমান ‘জিনিস’ বা ‘কিছুকে’ প্রতিটা ধর্মই মানবিক পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করেছে। জিনিসটার সব কর্মকাণ্ডই মানুষের মতো। সর্ব শক্তিমান ওই জিনিসের মানবিক সব ধরনের অনুভূতি রয়েছে। যেমন উপাসনা করলে তিনি সন্তুষ্ট হন। সন্তুষ্ট হওয়াটা মানবিক অনুভূতি। যার অতুষ্টি আছে তার মধ্যেই সন্তুষ্টির অনুভূতি রয়েছে। মানুষের অতুষ্টি রয়েছে। কারণ মানুষসহ সব জীবকেই সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়।
সর্ব শক্তিমান ওই জিনিসটার মধ্যেও তাহলে কি অতুষ্টি রয়েছে?
আবার সর্ব শক্তিমান ওই 'জিনিস'টাকে বলা হয় দয়ালু। দয়ালু অনুভূতি কি মানবিক গুণ নয়? ইসলামে ওই জিনিসটার ৯৯টি গুণের কথা বলা হয়েছে। ওই গুণগুলোর প্রতিটিই মানবিক গুণ। মূল কথা হলো, ওই জিনিস সম্পর্কে মানুষ যে বর্ণনাই দিক না কেন, তা মানবিক পরিপ্রেক্ষিতেই হতে বাধ্য।
জিনিসটা সমগ্র মহাবিশ্ব পরিচালনাও করেন মানুষের মতো। প্রধানমন্ত্রীর যেমন দেশ পরিচালনার জন্য মন্ত্রী এমপি ও আমলা লাগে। তেমনি সর্বশক্তিমান ওই জিনিসেরও মহাবিশ্ব পরিচালনা করতে আমলা (ফেরেশতা, দেবদেবী) লাগে। ওই 'জিনিস'টা প্রতিটা সেক্টরে আমলা রেখে দিয়েছে। মেঘবৃষ্টির জন্য মিকাইল। পাপ পূন্য লেখার জন্য কীরামান কাতিবিন। হিন্দু ধর্মে যেমন, বিদ্যার দেবী স্বরস্বতী।
সর্ব শক্তিমান জিনিসের আবার আমলা লাগবে কেন বাপু? সর্ব শক্তিমান কোনো জিনিসের তো এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য আমলা লাগার কথা নয়। আর আমলা যদি লাগেই, তাহলে জিনিসটা সর্ব শক্তিমান হয় কিভাবে? সব প্রতিষ্ঠিত ধর্মের ভাষ্য অনুযায়ী, সর্বশক্তিমান 'জিনিস'টা চলে আমলাতান্ত্রিক সিস্টেমে। আর এভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, সবগুলো প্রতিষ্ঠিত ধর্মই 'জিনিস'টাকে পরিপূর্ণ মানুষ বানিয়েছে। এবং মানুষটার ব্যক্তিত্ব, রুচি আধুনিক সভ্য মানুষের মতো উন্নতও নয়। মানুষটা ছোটোলোক।
ছোটলোক কেন?
একটা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। গল্পটা আমি একজনের কাছ থেকে শুনেছি। সত্যতা কতটুকু জানি না। গল্পটা হলো, আহমদ শরীফ একবার তাঁর এক পরিচিত আস্তিক বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছিলেন। হঠাৎ এক প্রসঙ্গে আহমদ শরীফ তাঁর ওই বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, বিভিন্ন সময়ে তোমরা যে এতো ‘আল্লাহু’ ‘আল্লাহু’ উচ্চারণ করো, মানে যিকর করো, এতে কি আল্লার রাগ হয় না? বন্ধুটি তখন প্রশ্ন করলো, কেন? আল্লাহর রাগ হবে কেন? তখন আহমদ শরীফ বললেন, ‘আমার সামনে কেউ যদি ১০ বার ‘আহমদ শরীফ’ ‘আহমদ শরীফ’ বলতে থাকে, আমি তাকে থাপ্পড় দিয়ে ফেলে দিতাম। এতোবার ডাকাডাকির কি আছে?
আশা করি গল্পটার মধ্য বিষয়টা বেশ খানিকটা ন্যাংটা (খোলসা) হয়েছে। তথাপি বিষয়টাকে আমি আরও একটু ন্যাংটা করতে চাই। ধরা যাক, কোনো অপরিচিত ব্যক্তি আমার কাছে কিছুই চায়নি। তবু আমি তাকে মজার কোনো জিনিস দিলাম। এবং আমি মনে মনে চাইলাম ওই ব্যক্তি সারা জীবন আমার নাম নিক এবং আমার স্তুতি করে যাক। আমি কি তাহলে ছোটলোক মানসিকতার লোক নই? যে মানুষটাকে আমি জিনিসটা দিয়েছিলাম, সে যদি জানতে পারে আমার মানসিকতা এ ধরনের তবে ওই মানুষটার ন্যূনতম ব্যক্তিত্ব থাকলে বলবে, তোর এই বালের জিনিস কি আমি চেয়েছিলাম? নে ধর, ফিরিয়ে দিলাম।
আমরা কি সর্ব শক্তিমান ওই জিনিসের কাছে বলেছি বা চেয়েছি আমাকে জীবন দিয়ে দুনিয়াতে পাঠাতে? অনেক ধর্ম বলতে পারে যে, হ্যা আমরা চেয়েছি, তাই পঠিয়েছে। সেক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হলো, চাইলেও তো আমাদের মনে নেই। আর কারোরই যদি মনেই না থাকে তাহলে ওই চাওয়ার কি কোনো দাম আছে? মানলাম, এমন জিনিস আসলেই আছে, যা আমাদের সৃষ্টি করেছে। তো কি হয়েছে? তার এতো পূজা অর্চনা বা উপাসনা পাওয়ার এতো খায়েশ কেন? এ তো ছোটলোক মানসিকতারই ইঙ্গিত বহন করে। আমরাও সর্ব শক্তিমান জিনিসটাকে বলতে পারি, তোর কাছে এই জীবন কি আমরা চেয়েছি? তুই যদি দিয়েই থাকিস তো ভালো মনে দে। এতো পূজা অর্চনা পাওয়ার খায়েশ তোর কেন? হাগামোতা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে তোর বন্দনা করতে গেলে জীবনটাই তো বরবাদ হয়ে যাবে। বাস্তবতা হচ্ছে, বেশিরভাগ ধার্মিকেরা আসলে ওইভাবে বন্দনার নির্দেশ পালনও করে না। আবার বন্দনা–প্রশংসা হচ্ছে মনের ব্যাপার। লোভ আর ভয় থেকে যে বন্দনা সে বন্দনার কোনো দামই নেই। কেউ পাওয়ার আশায় বা ভয়ে প্রশংসা করলে প্রশংসিত ব্যক্তির যদি ব্যক্তিত্ববোধ থাকে তবে ওই প্রশংসা গ্রহণ করবে না।
সৃষ্টিকারী ওই জিনিসের সঙ্গে মানুষের সব সম্পর্কই চাওয়াপাওয়া আর ভয়-ভীতির সম্পর্ক। আমার এই পোস্টটি যারা পাঠ করছেন, তাদের অনেকেই ভয়ে কয়েক বার নাউজুবিল্লাহ পাঠ করছেন। যাইহোক, ধর্মে বলা হয়, একবার অমুক দোয়া–মন্ত্র পাঠ করলে বা অমুক কাজ করলে এতগুণ সওয়াব–পূণ্য। বা অমুক কাজ করলে এতো হাজার বছর নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। এসব কি আবোলতাবোল কথা গো বাপু?
আবার ধর্মগ্রন্থগুলোতে স্বর্গ–নরকের বর্ণনাও খুবই হাস্যকর। সোনা–রুপা জহরতের আধিক্য, হুরপরীসহ সব ভোগবিলাসই জৈবিক স্থূল–হাস্যকর। সেখানে মননশীলতার কোনো সুখ নেই। একজন কবি কবিতা লিখে যে সুখ পান, তার সঙ্গে জৈবিক সুখের কোনো তূলনা চলে না। অর্থাৎ আদিম জৈবিক মানুষেরাই এসব স্থূল স্বর্গ–নরকের স্রষ্টা। তাদের রুচি আধুনিক মানুষের মতো ছিল না। আবার তাদের সুখের সরঞ্জামেরও কোনো সার্বজনীনতা নেই। যেমন আরবে গরম আবহাওয়া এবং সেখানে পানির অভাব রয়েছে। তাই তাদের বানানো স্বর্গে পানির ব্যপক আধিক্য লক্ষ করা যায়। সেখানে বয়ে যাবে সুশীতল ঝরণাধারা ও তিন প্রকারের নদী। শীতের দেশের লোকজন সুশীতল পানিতে সুখী হবে কেন?
সর্ব শক্তিমান জিনিসকে ছোটলোক এবং স্থূল রুচির মানবিক ব্যক্তিত্ব দিয়েছে মূলত তৎকালীন স্থূল মানুষেরাই। আধুনিক যুগেও পশ্চাতপদ থাকা মানুষেরা সেটাকে বয়ে বেড়াচ্ছে। সর্ব শক্তিমান জিনিসকে ছোট করে দেখেছেন এবং দেখছে আস্তিকেরাই। যুগ যুগ ধরে বহু অশান্তি, বহু যুদ্ধের মূলে রয়েছে ধর্ম। সেটা ইতিহাস বলে। নাস্তিকেরা আর যাই হোক সর্ব শক্তিমান জিনিসটাকে অন্তত ছোটোলোক মানুষ বানায়নি।
‘মা’ উপন্যাসে ম্যক্সিম গোর্কি একটা কথা লিখেছিলেন, সৃষ্টিকর্তাকে নতুন করে সৃষ্টি করতে হবে যে সৃষ্টিকর্তা হবে মানুষের বন্ধু।
আমার মামার এক নাস্তিক বন্ধু ছিলেন, নাম তাঁর সেলিম। একদিন মামার বাড়িতে খেতে বসেছি, এমন সময় তিনি হাজির হলেন। তিনিও খেতে বসে গেলেন। যথারীতি ধর্ম প্রসঙ্গ আসলো। তিনি ধর্ম সম্পর্কে কিছু কটু বাক্য বর্ষণ করলেন। এমন সময় আমার ধার্মিক মামী হায় হায় করা শুরু করলেন। মামির নাম আসমানী।
এক পর্যায়ে সেলিম মামা বললেন, শোন আসমানী, যদি বেহেশতো-দোযথ থেকেই থাকে, তাহলে বলতো তুই আগে বেহেশতে যাবি নাকি আমি যাব? মামি চুপ।
সেলিম মামা বললেন, হাশরের ময়দানে আল্লাহ তোকে বলবে, আসমানী বেগম.., জন্মের পর থেকে তোর পরিবার-সমাজ তোকে বলেছে, ‘আমি আছি। আমি দয়ালু। তাই তুই আমাকে সেভাবেই মেনেছিস।’ কিন্তু তোর পরিবার এবং সমাজ যদি বলতো আমি শয়তান। তাহলে তুই তো আমাকে শয়তানই ভাবতিস!! তোর তো নিজের কোনো আক্কেলবুদ্ধিই তৈরি হয়নি। তুই তো আমাকে বিচার করার ক্ষমতাই অর্জন করিস নাই ।
কিন্তু এই সেলিম ছেলেটি পড়াশোনা করেছে। জ্ঞানার্জন করেছে। নিজের বিবেককে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছে। এক পর্যায়ে ওর মনে হয়েছে, আমি নেই। তাতে কি বাল হইছে? এতে–তো আর মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়নি। সেলিম ছেলেটি আর যাইহোক কারও ক্ষতিতো করে নাই। আর গাধা আস্তিকের চেয়ে বিবেকবান নাস্তিক আমার কাছে শ্রেষ্ঠ। কাজ্যেই সেলিম তুমি যাও, বেহেশতে গিয়ে ফূর্তিফার্তা শুরু করো। এদিকে দেখি, আসমানীর মতো মাদি ছাগলদের কি ব্যবস্থা করা যায়!!
সর্ব শক্তিমানের ক্ষেত্রে ‘জিনিস’ বা ‘কিছু’ শব্দটাও আসলে প্রযোজ্য নয়। কারণ ‘জিনিস বা ‘কিছু’ বললে তাঁর আকার-আকৃতি ও অবস্থান বোঝায়। কিন্তু সৃষ্টিকারী ওই জিনিসের তো আকার-আকৃতি নেই। তাহলে কি বলা যায়? স্রষ্টা?
না, স্রষ্টা বললেও সক্রিয় কোনো ব্যক্তিত্বের আভাস পাওয়া যায়। তাহলে? সর্বশক্তিমান থেকে আমরা ওই জিনিসটাকে শুধু ‘শক্তি’ বলতে পারি। শক্তির কোনো আকার-আকৃতি নেই। এবং শক্তির নিত্যতা বিধি অনুযায়ীও শক্তি সর্ব শক্তিমান। যার কোনো ধ্বংস নেই। যার কোনো স্রষ্টা নেই। বস্তু শক্তিতে এবং শক্তি বস্তুতে পরিণত হয়। আমাদের মধ্যেও এই শক্তি রয়েছে। শক্তি তার নিয়ম অনুযায়ী চলছে। এর কোনো মানবিক ব্যক্তিত্ব নেই। শক্তিকে পূজা করার কিছু নেই। বিজ্ঞান মূলত শক্তির চরিত্র জানার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এটাই প্রগতি। যার সূত্রপাত ইউরোপে। গির্জার শাসনকে লাত্থি মেরেই এসেছে এই প্রগতি। প্রগতির মধ্যে বাস করে এবং প্রগতির সব সুবিধা নিয়ে পশ্চাদপদ থাকাটা মোটেই কাম্য নয়। বিকৃত লোভ আর ভয় দিয়ে মানুষ কোনোদিনই নৈতিক হয়নি।
অবশ্য মানুষই যেহেতু সৃষ্টিকর্তার স্রষ্টা কাজেই মানুষ তাকে মানবিকভাবে সৃষ্টি করবে সেটা অবশ্য স্বাভাবিক।
ধর্ম অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তার মানবিক অনুভূতি ও সত্ত্বা রয়েছে, কিন্তু দুনিয়ার কোনো অমানবিক পরিস্থিতিতে তার কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। অনেক শিশু পাপ করার আগে দুনিয়াতেই জন্মে খোঁড়া, অন্ধ ও বিকলাঙ্গ হয়ে। নারী–শিশুসহ বাড়িঘর বোমা মেরে তুলা তুলা বানিয়ে ফেলছে ইসরায়েল। ধর্মের নামে সংঘর্ষে বিপুল মানুষ নিহত হয়। কোথায় থাকে তখন ঈশ্বরের মানবিক অনুভূতি ?
চলবে.....।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : পোস্টটিতে সুনির্দিষ্ট কোনো ধর্ম নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। আলোচনা করা হয়েছে ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত সৃষ্টিকর্তার মানবিক সত্ত্বা নিয়ে। কাজেই যেচে এসে ব্যক্তিগত আক্রমণ কাম্য নয়।
প্রসঙ্গত, গত রমজানে আমি বাঙালি মুসলিমদের ভণ্ডামি নিয়ে আমি একটি গদ্য রচনা করেছি। যারা পড়েননি তাদেরকে পড়ার আহবান জানাই।
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:১৩