মৃত্যু একটি অনিবার্য ঘটনা। তারপরও সৃজনশীল ব্যক্তিদের মৃত্যু একটু বেশি দুঃখজনক বৈকি। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে গোটা জাতি কষ্ট পেয়েছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। আমিও কিঞ্ছিৎ পেয়েছি। যদিও জীবনের অনিবার্য কোন ঘটনা নিয়ে আমার মধ্যে হাহাকার নেই। হাহাকার করে লাভও নেই।
কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো হুমায়ূন আহমেদের ছাড়াও অনেক সৃজনশীল কবি সাহিত্যেকের মৃত্যুতে জাতি এতোটা কষ্ট পায়নি। কষ্ট বা স্মৃতি বিলাসের প্রচারণাও পায় নি। অনেককে দেখছি, হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে অতিরিক্ত আবেগ প্রকাশ করে তাকে নানা বিশেষণে ভূষিত করছেন। কিন্তু তাঁর চেযে অনেক বেশি সৃজনশীল লেখকদের সে সৌভাগ্য জোটে নি। জীবননান্দকে চিনতে আমাদের অনেকদিন লেগেছে। কারন আমাদের বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত শিক্ষিতদের (তথাকথিত) রুচির স্তর একটা পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থেকেছে।
হুমায়ূন আহমেদের গল্প উপস্থাপনের ঢং আকর্ষণীয়। খুব সহজেই পড়ে ফেলা যায়। তাঁকে একটা বিশেষণেই ভূষিত করা যায়, সেটা হলো তিনি জনপ্রিয় লেখক। তবে তাঁর কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, এইসব দিনরাত্রি নাটকগুলো নিঃসন্দেহে অসাধারণ। যদিও পরে তিনি শুধুই চকোলেট নাটক বানিয়েছেন।
উপন্যাসের ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদ বিগত কয়েক বছর ধরে একই চরিত্রের জাবর কেটে গেছেন। কোনো এক চরিত্রের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে একই জিনিসের জাবর কেটেছেন ব্যবসার জন্য। মজাদার চকোলেটের মতো পাবলিক তা খেয়েছেও বেশ। খাওয়ার পরই আবার ভুলে গেছে। কিন্তু তঁার জনপ্রিয়তা আকাশ ছুয়েছে। তবে জনপ্রিয়তাই সাহিত্যিকের বিচারের একমাত্র মাপাকাঠি নয়। আমাদের মমতাজ যত মানুষের কাছে পরিচিত। কয়েকটি দেশ মিলিয়েও গজল শিল্পী মেহেদী হাসান ততটা জনপ্রিয় নন।
তবে সৃজনশীল কোনো লেখকই একই জিনিসের জাবর কাটতে পারেন না। এই কাজটা সাহিত্যের ক্ষেত্রে অসততা। সাহিত্যের উদ্দেশ্য হলো প্রতিনিয়ত সৃষ্টি। একই সৃষ্টির পুনরাবৃত্তি নয়।
কৈশরে আমি হুমায়ূন আহমেদের অনেক উপন্যাস পড়েছি। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে মনে রাখার মতো কিছুই পাই নাই। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, পেন্সিলে আঁকা পরী এ জাতীয় কিছু উপন্যাস ভাল লেগেছিল। তাই নাম মনে আছে। তবে তীব্রভাবে মনে কোনো দাগ কাটে নি। দাগ কাটার জন্য তিনি কিছু লেখেন ও না। যা হুমায়ূন আহমেদ নিজেই বলে গেছেন।
হুমায়ুন তাঁর একই ধরনের গল্পের জাবর না কাটলেও সাহিত্যের কোনো ক্ষতি হতো না। তবে ব্যবসার ক্ষতি হতো। হিমু নিয়ে তিনি প্রথম যে গ্রন্থ রচনা করেছেন তারপর তিনি ওটা নিয়ে আর না লিখলেও পারতেন। যদিও অনেকের ধারণা, হিমু চরিত্রটা শীর্ষেন্দুর কাগজের বৌ উপন্যাস থেকে নেওয়া। শীর্ষেন্দু কাগজের বউ দ্বিতীয়টি লেখেননি। যাইহোক মূল কথা হলো, একই জিনিস অনেক বেশি প্রসব করলেই সাহিত্যে তঁার অবদান বিরাট হয়ে দাড়ায় না।
বিভূতি, মানিক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ ছফা ...... এরা ব্যবসার জন্য কখনোই একই জিনিসের জাবর কাটেন নি। তাদেরকে মূল্য দেওয়া শিখতে হবে।
'কিংবদন্তী' বিশেষণ আমরা এই মুহুর্তে কাউকেই দিতে পারি না। আজ থেকে ২০০ বা ৩০০ বছর যেসব সাহিত্যিকদের রচনা বেঁচে থাকবে শুধুমাত্র তারাই কিংবদন্তী। আমরা যেহেতু জানি না ওই সময়ে কাদের সাহিত্য বেঁচে থাকবে, সেহেতু আমরা অতিরিক্ত আবেগের বশবর্তী হয়ে কাউকেই এখনই কিংবদন্তী বিশেষণে ভূষিত করতে পারি না। আর ভূষিত করলেও সেটা স্থায়ী কোনো উপাধি হবে না। জীবিত থাকলে এসব উপাধি দেখলে হুমায়ূন আহমেদ নিজেও লজ্জিত হতেন।
হুমায়ূন আহমেদ নিজেই বলে গেছেন তিনি পাঠক হিসেবেও উচ্চমানের নন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'চিলেকোঠার সেপাই' তাঁর ভালো লাগেনি। কিন্তু হুমায়ূনের ভক্তরা এটাকে বিনয় হিসেবে দেখে তাঁকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যান মূর্খতাবশত।
হুমায়ূন আহমেদের রচনাগুলো ভালো ব্যবসা করলেও ব্যবসায়ীক মানসিকতার লোক তিনি ছিলেন না। কারন তিনি তাঁর কামানো মালের (অর্থ) বৃহৎ অংশ বিলাসিতার পাশাপাশি তিনি সমাজসেবামূলক কাজে ব্যয় করেছেন। আমার লেখার যে অংশগুলো সমালোচনা বলে মনে হচ্ছে, তা মোটেই সমালোচনা নয়। অনেক গাধা লোকজন বোঝার অভাবের কারনে তারা সমালোচনা ভাবছেন। আমি সমালোচনা করছি না, কারন আমি যা বলেছি হুমায়ূন আহমেদ নিজেই এসব কথা স্বীকার করে গেছেন। হুমায়ূন আহমেদ নির্দ্বিধায় বলেছেন, তিনি নগদ চান। এসব নিয়ে তাঁর মধ্যে কোনো ভণ্ডামি ছিল না।
তিনি উচ্চমার্গীয় সাহিত্য রচনার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাঁর কিছু লেখায় মধ্যবিত্তের সমস্যা উঠে এসেছে। সমস্যা গুলোর মধ্যেও তিনি মজা করে গেছেন সমানে। সমাজের পরিবর্তন বা মঙ্গল নিয়ে ভাবিত হওয়ার প্রয়োজন মনে করেন নি তিনি। পাঠকদেরকেও ভাবান নি, রেখেছেন মজার জগতে। কলুষিত ও বৈষম্যের সমাজকে মেনে নিয়ে তিনি মজা খুঁজেছেন। কারন সমাজকে মেনে নিলে ভাল থাকার পথ পরিস্কার হয়। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতসহ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই তাঁর সম্পর্ক বিরুপ হয় নি কোনোদিনই। ভাল থেকেছেন তিনি।
হুমায়ূন নিজের যৌক্তিক মূল্যায়ন নিজেই করে গেছেন। অবাঞ্ছিত আবেগ সব সময়ই ক্ষতিকর। আমার অতি প্রিয় লেখককেও আমি কিংবদন্তী বিশেষণে ভূষিত করি না। অতিরিক্ত আবেগের অনেক সমস্যা রয়েছে। আবেগের মাত্রা বেশি হলে মানুষ মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীকে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তুলনা করে বসেন। সেটা মোটেই কাম্য নয়।
আহমদ ছফা তাঁর প্রথম উপন্যাস 'নন্দিত নরকের' পান্ডুলিপি পড়ে মুগ্ধ হন এবং তা প্রকাশের উদ্যেগ নেন। পরবর্তীতে তিনিই হুমায়ূন আহমেদকে বর্ননা করেন 'নষ্ট প্রতিভা' বলে। আর একটা বিষয় হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের জাবর কাটা সাহিত্যগুলো কিশোর-কিশোরীদের সাহিত্যপাঠে উদ্বুদ্ধ করে। এটা ভালো দিক। তবে শিশু সাহিত্য হিসেবে আরও অনেক ভালো রচনা রয়েছে। সেগুলো বাদ দিয়ে শিশু কিশোরেরা হুমায়ূনীয় সাহিত্যে বন্দী হয়ে পড়ছে। এটা খারাপ একটা দিক।
কৈশর পার হওয়ার পরও হুমায়ূন আহমেদে বন্দী হয়ে পড়া মোটেই কাম্য নয়। হুমায়ূন আহমেদ যা দিয়েছেন তার মূল্যও জীবদ্দশাতেই তিনি পেয়েছেন। তা অর্থ হোক আর সম্মানই হোক। তবে এই বঙ্গদেশে অনেক গুণী সাহিত্যিক জীবদ্দশাতে কিছুই পান নি আমাদের অজ্ঞতার কারনে। কারন আমরা মূল্য দিতে পারি নি। বা মূল্য দেওয়ার মতো উচ্চ পর্যায়ে উঠি নি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে কলকাতায় যতটা মূল্য দেওয়া হয় আমরা সেটাও দিতে পারি নি। কলকাতার খ্যাতিমান এক লেখিকা (নামটা মনে আসছে না) বলেছিলেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের নখের সমান যোগ্যতাও যদি তাঁর থাকতো, তাহলেও তিনি নিজেকে লেখক হিসেবে দাবি করতেন।
আমার কৈশর কেটেছে হুমায়ূন আহমেদ পড়ে। তার উপন্যাস দিয়েই একাডেমকি জগতের বাইরে আমার প্রবেশ। এবং এটা ভেবেও আমি খুশী যে, আমি তাঁর গন্ডী থেকে বের হতে পেরেছি। কিশোর-কিশোরীদেরকে হুমায়ূন আহমেদের লেখা আকৃষ্ট করে। চকোলেট খুব সহজেই মজা করে চেটেপুটে খাওয়া যায়। ওই বয়সে খাবারের পুষ্টিমান কেমন তা যাচাই করার বুদ্ধি থাকে না। যাচাই করার প্রয়োজনও নেই। প্রয়োজন হলো খাওয়া শেখা।
আমি কোনো বাড়িতে বেড়াতে গেলে সময় কাটানোর জন্য বই বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদকেই বেছে নেই। কারন আমি জানি অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর বই শেষ করা সম্ভব। অথবা শেষ করতে না পারলেও কোনো আফসোসের ব্যাপার নেই। আগে যেমন প্রথম আলোর আলপিন পড়তাম।
অসাধারণ কোনো খাবার খেতে হয় তাড়িয়ে তাড়িয়ে। তাতে সময় বেশি লাগে। এবং খাবারটা শেষ করতে না পারলে বিরাট অতৃপ্তি থেকে যায়।
আজ তরুণদের হুমায়ূন আহমেদ বা কিশোরদের জন্য রচিত অ্ন্যান্য রচনা দিয়ে সাহিত্যপাঠ শুরু হোক। কিন্তু তারা যেন চকোলেট সাহিত্যে বন্দী হয়ে না পড়েন সেটাই কাম্য। ধীরে ধীরে তারা উচ্চমার্গীয় সাহিত্য রস আস্বাদনের যোগ্যতা অর্জন করবে সেটাই প্রত্যাশা।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: মধ্যবিত্তের তথাকথিত ভদ্দরনোকি আমার মধ্যে নাই। আমি বকাবাজি করতে পছন্দ করি। কাজেই আমার এখানে কেউ মন্তব্য করতে চাইলে তাকে ভেবে চিন্তে মন্তব্য করার আহবান জানাই। ফালতু মন্তব্য করে আমাকে কটুশব্দ ও বাক্য ব্যবহার করতে বাধ্য করবেন না।
আর হুমায়নী গন্ডী থেকে যারা বের হতে পারেন নি, এবং যারা আবেগে গদগদ হয়ে আছেন, তাদেরকেও মন্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহবান জানাই।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:০২