ছোটবেলায় আমার জীবন বাঁধা ছিল নানা নিষেধের বেড়াজালে। রোদের যাওয়া নিষেধ, নাক দিয়ে রক্ত পড়বে; দৌড়াদৌড়ি নিষেধ, হাঁপানি শুরু হবে; ঠাণ্ডা লাগানো নিষেধ, আইসক্রিম খাওয়া নিষেধ, অজস্র নিষেধ। আমি খুব অসুস্থ থাকতাম, মা বাবা সবসময় তাই উদ্বিগ্ন থাকতেন। কত ডাক্তারের কাছে যে নিয়ে যেতেন! প্রতিবার ডাক্তারের কাছে যাবার সময় আমার কান্না শুরু হত; কারণ ডাক্তার মানেই নতুন করে আরেকবার আমার রক্ত পরীক্ষা। আমি মায়ের কোলে বসে কাঁদছি, শুকনো মুখে আব্বা বলছেন, "একটু কম ব্যথা দেবেন" আর তার মধ্যেই আমার রোগা তর্জনীর উপর ঘ্যাচাৎ করে সুঁই ঢুকে রক্ত বের করল -এটা আমার ছোটবেলার নিয়মিত ঘটনা। শুনতাম আমার রক্তের ইসিনোফিল পরীক্ষা করা হচ্ছে। অনেক ওষুধ খেতাম কিন্তু আমি সুস্থ হই নি। ওষুধ গেলানো হত জোর করে; ট্যাবলেট গুঁড়া করে তার এক অংশ চামচের আগায় নিয়ে চামচটা চিনি দিয়ে ভরে দেয়া হত, কিন্তু তাতে ওষুধের তিক্ততা কিছুই কমত না। এংগলেট সিরাপ নামে আরেকটা ওষুধ গিলে প্রতিদিন কিছুক্ষণ রোদে বসতে হত। এটা ডিমের কুসুমের মত ঘন আর স্বাদে-গন্ধে পঁচা মাছের নাড়িভুঁড়ির মত। এটা খাবার আগে পরে খুব কাঁদতাম।
আমরা থাকতাম কলোনিতে, স্কুলের সময় ছাড়া দিনের বাকি সময়টা ছোটরা কলোনির ভেতর খেলে কাটাত। প্রায় সব বাড়ীতেই চার পাঁচটা ছেলেমেয়ে, এরা ঘরে না থাকলে মায়েদেরও কিছুটা বিশ্রাম হত। বিকালে রোদ কমে এলে আমিও বেরোতাম- গোলাপ টগর, গোল্লাছুট খেলতাম বা স্লাইড চড়তাম। একদিন আমার বন্ধুরা পিকনিক করল। সবাই সেজেগুঁজে একসাথে অনেক খেলল, তারপর বাসা থেকে আনা খাবার নিয়ে সবাই ভাগ করে খেল।সারাদিন রোদে থাকতে হবে বলে আমি এই পিকনিকে যেতে পারলাম না। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওদের দেখতে লাগলাম, আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল ওদের সাথে থাকতে না পারায়। বয়স তখন ছয় বা সাত।
কলোনিতে দু' টা বাসায় টেলিভিশন ছিল, একটা আমাদের তিনতালায়। আব্বা বাসায় না থাকলে ক্লাস ফোরে পড়া আমার বড়ভাই মাঝেমাঝে তার কয়েকজন বন্ধুর সাথে সে বাসায় টিভি দেখতে যেত। একদিন ভাইয়ের সাথে আমিও গেলাম। আমাদের টিভির সামনে ঠাণ্ডা মেঝেতে বসতে দেয়া হল, সোফায় বসেছিলেন একজন মেহমান আর বাড়ীর লোকেরা। তারা টিভি দেখছিলেন আর গ্লুকোজ বিস্কুট চায়ের সাথে খাচ্ছিলেন। জীবনে প্রথমবার টিভি দেখা, কিন্তু আমার চোখ পড়ে রইল বিস্কুটের প্লেটে। প্লেট যখন খালি হয়েগেল তখন ভাইকে বল্লাম বাসায় নিয়ে যেতে।
আব্বার কড়া নির্দেশ ছিল আমার শরীর খারাপ হয় এমন কিছু, যেমন আইসক্রিম যেন বাসায় না খাওয়া হয়। কিন্তু একদিন রাতে হঠাৎ ঘুম ভেংগে কাউকে দেখতে না পেয়ে বিছানা থেকে নেমে পাশের ঘরে গিয়ে দেখি সবাই "কুলফিবরফ" খাচ্ছে। (ষাটের দশকের শেষের সেসময় এটা সবচেয়ে লোভনীয় আইসক্রিম, রাতের বেলা ফেরিওয়ালারা নিয়ে আসত।) কয়েকজন আত্মীয় ছিলেন বাসায় আর আব্বা আম্মা কোথাও গিয়েছিলেন- এই সুযোগে হয়ত ভাইবোনরা কুলফিবরফের স্বাদ নিতে গেছিল! আমি আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলাম কুলফিবরফ খাবার জন্য; শেষে আমাকেও একটু খাওয়ানো হল। পরদিন ঘুম ভাঙল গলা ব্যথা নিয়ে; দুপুরের মধ্যেই এল প্রবল জ্বর! আইসক্রিম নিয়ে আমার আরেকটা স্মৃতি আছে। একদিন প্রবল কালবোশেখির ঝড় হচ্ছে, আমি জানালায় বসে দেখছি এক আইসক্রিমওয়ালা ঝড়ের মধ্যে তার আইসক্রিমের গাড়ি ঠেলে আমাদের পোর্চের দিকে আসার চেষ্টা করছে; হঠাৎ গাড়ি কাৎ হয়ে গিয়ে ঢাকনা খুলে অনেকগুলো আইসক্রিম পড়ে গেল। আইসক্রিমওয়ালা কোনমতে ঢাকনা এঁটে গাড়ি ফেলে দৌড়ে এসে পোর্চের নিচে দাঁড়াল; আইসক্রিমগুলা পড়েই রইল। আমি ছোটভাইকে ডাকলাম এ দৃশ্য দেখতে- আমাদের লুব্ধ চোখের সামনে আইসক্রিমগুলো গলে শেষ হয়ে গেল। আজো যতবারই আমি ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে কোন বিয়েতে যাই, ততবারই বাঁদিকের কলোনিতে আমাদের ফ্ল্যাটের দিকে তাকাই আর সেই আইসক্রিম গলার দৃশ্য দেখতে পাই! এই অসুখময় শৈশব জীবনে অনাবিল আনন্দের একটা উৎস ছিল আমার- ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরীর বই। ছোটদের জন্য খুব সুন্দর ছবিওয়ালা অনেক বই ছিল, সব নতুন। সপ্তায় একদিন আব্বা আমাদের ব্রিটিশ কাউন্সিল নিয়ে যেতেন; নতুন বইয়ের গন্ধ, বইয়ের সুন্দর ছবি আর গল্প আমার জন্য দুঃখকষ্টহীন এক কল্পলোকের দুয়ার খুলে দিত। মা বা বড়বোন আমাকে বই থেকে গল্প পড়ে শোনাতেন; খুব পছন্দ ছিল বারো রাজকন্যার গল্প, হিংসুটে দৈত্যর গল্প। অসুস্থ হলে শুয়ে শুয়ে আমি বইয়ের গল্প মনে করতাম, কল্পনায় দেখতাম রাজকন্যাদের মাটির নীচের বাগান অথবা হিংসুটে দৈত্যের ফুলবাগানের। ফুলবাগানের খুব শখ ছিল আমার; আর কিছুদিন পর সত্যি সত্যি একটা ফুলবাগান পেলাম। আমার আব্বা এক জেলা শহরে বদলী হলেন যেখানে আমাদের বাসার সামনের দিকে ছিল চমৎকার ফুলের বাগান আর পেছনে ফল আর সবজি বাগান। বুড়ো মালী মহাবীর তার ছেলে রতনকে নিয়ে সারাদিন বাগানে কাজ করতেন। আমার বয়স প্রায় আট- আমি আর আগের মত অত অসুস্থ হতাম না তাই সারাদিন যখনই ইচ্ছা মালীভাইয়ের সাথে ফুলবাগানে থাকতাম। এত বড় হয়ে তখনো আমি স্কুলে যাই নি; আমি স্কুলে গেছি অনেক দেরীতে, একেবারে ক্লাস ফোরে, সাড়ে আট বছর বয়সে। আব্বা বলতেন স্কুলে গেলে আমার কষ্ট হবে, তাই এই দেরী। স্কুলে না গেলেও বাসায় মা পড়াতেন, ক্লাস থ্রি পর্যন্ত ছিল মাত্র তিনটা বই- বাংলা, অংক আর ইংলিশ। তাই পড়াশোনাটা তখন মোটেই কষ্টের ছিল না। প্রচুর অবসর, টিভি নেই- তাই আমরা সারাদিন অনেকরকম বই পড়তাম,খেলতাম আর অনেক কবিতা মুখস্থ করতাম। রাতের বেলা মা বাবা, ভাইবোন সবাই বারান্দায়- কখনো মেঘ না থাকলে আকাশে কালপুরুষ, বশিষ্ঠ, সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখা, কখনো শুধুই গল্প। আমি সুস্থ হয়ে উঠছিলাম, তাই আমাদের সবার মনেই বেশ খুশি খুশি ভাব ছিল। কিন্তু এই খুশির দিন দীর্ঘস্থায়ী হল না। আব্বা মারা গেলেন। আমার বয়স তখন দশ বছরও পুরো হয় নি। আব্বা মারা যাওয়ায় সকলে কেন এত কান্নাকাটি করছে আমি বুঝতে পারছিলাম না। আব্বার উপর প্রচণ্ড অভিমান হল। আমি শুয়ে থাকলাম; শেষবার দেখার জন্য আমাকে সবাই ডাকতে এলেও আমি উঠলাম না। একদিন আব্বা বলেছিলেন কেয়ামতের ময়দানে সবার সাথে সবার দেখা হবে, আমি ঠিক করলাম কেয়ামতের ময়দানে আব্বাকে খুঁজে নিয়ে শক্ত করে হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকব!
কিছুদিন পর জানলাম যে সরকারী বাড়ি আমাদের ছেড়ে দিতে হবে, কিন্তু কোথায় যাব! অন্য একটি জেলাশহরে অবস্থিত পিত্রালয় ছাড়া নাবালক সন্তানদের নিয়ে থাকবার জন্য মায়ের আর কোন আশ্রয় ছিল না। সেখানে যাবার আয়োজন শুরু হল। এত বছরের সংসারের প্রায় সব কিছুই ছেড়ে যেতে হবে। দুটো মস্ত কাঠের বাক্সে মা তার প্রিয় ক্রকারি, শখের জিনিষপত্র আর আমাদের খেলনা ভরলেন। আমাদের আলমারি ভরা বই ভরা হল কয়েকটা কাল টিনের ট্রাংকে। কাঠমিস্ত্রি একবার কাঠ দিয়ে আমাকে একটা সুন্দর ছোট বাক্স বানিয়ে দিয়েছিলেন। বাক্সের গায়ে তালার ফুঁটো, সেটা খুলতে হত একটা লম্বা পিতলের চাবি দিয়ে। সেই বাক্সে নিলাম আমার কাপড়ের পুতুলগুলো আর মালীভাইয়ের বানানো চমৎকার একটা ফুলের তোড়া। মালীভাই এটা বানিয়ে দিয়েছিলেন নানারংয়ের কাগজের মত একরকম ফুল দিয়ে; বলেছিলেন "নানাবাড়িতে গিয়ে এই ফুল ফুলদানিতে সাজিয়ে রেখ, দেখবে তিন মাসেও ফুল শুকাবে না।" তারপর তিনমাস, ত্রিশমাস, ত্রিশবছর- আমার পুরো জীবনটাই কেটে গেল কিন্তু সেই ফুলসহ বাক্স তালাবদ্ধই রয়ে গেল, আমার শৈশবের সমস্ত আনন্দ সেই বাক্সে চিরকালের জন্য বন্দী হয়ে রইল।
নানাবাড়িতে আমরা আশ্রয় পেলাম কিন্তু নিজের বাড়ীর মতন কিছু না। সব বাক্স, ট্রাংক বন্ধই রইল; আমার, এমনকি ছোট ভাইবোনদের খেলনাও বাক্সেই থাকল। আমি একবার মাকে বললাম আমার কাঠের বাক্সটা বের করে দিতে কিন্তু মা বললেন ওটা রাখার জায়গা নেই। বইয়ের ট্রাঙ্কগুলো রাখা হল একটার উপর একটা করে, কোন বই বের করা হল না। আমি পড়ছিলাম জাহানারা ইমামের অনবদ্য অনুবাদে লরা মেরীর একটা বই- সেটা পড়ার জন্য আমার বুক ফেটে যেতে লাগল। অবশ্য এ বাসাতেও অনেক বই ছিল- মাসুদ রানা, কুয়াশা, দস্যু বনহুর, সোলেমানি খাবনামা, নীহারঞ্জন গুপ্ত আর এমন অনেক বই যা আমি জীবনেও পড়িনি। বাধ্য হয়ে সেসব বইই পড়তে লাগলাম। যাদবচন্দ্রের পাটিগণিত বলে একটা বই পেয়ে অংক করতে লাগলাম আর এটা দিয়ে শুরু হল আমার জীবনব্যাপী গণিতপ্রেম। আমরা সবাই স্কুলে ভর্তি হলাম। খুব তাড়াতাড়ি আমি শিখে গেলাম রোদ-বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে স্কুলে যাওয়া, অসুখ করলে একসাথে দুতিনটা ট্যাবলেট গিলে খেয়ে সুস্থ হওয়া কারণ ততদিনে বুঝে গেছিলাম নিজেকে নিজেই ভাল রাখতে হবে। পরিবর্তিত এই জীবনে আমাদের ছিল অনেক অভাব, কষ্ট, আশ্রিতের হীনমন্যতা আর অপমানবোধ। কিন্তু এ থেকে আলোয় আলোয় আমাদের মুক্তি নিয়ে এল বইয়ের জগৎ। আমরা ভাইবোনেরা অনেক বই পড়তে লাগলাম; কতরকম বই, কত মানসের পরিচয়, জানলাম আমরা কেউ ফেলনা নই, জগতের আনন্দযজ্ঞে আমাদেরও নিমন্ত্রণ রয়েছে। প্রথমে নানাবাড়িতে রাখা বই পড়া শুরু করলেও পরে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রচুর ভাল বই পাই। এরমধ্যে বাংলায় অনূদিত রাশিয়ান সমস্ত বই আর সেবা প্রকাশনীর প্রকাশিত কিছু বিদেশী গল্প ছিল অনবদ্য, অতুলনীয়; আজো মনে রয়ে গেছে।
আমাদের নিজেদের একটা সুন্দর বাড়ি হল যখন আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি তখন। নতুন বাড়িতে গিয়ে প্রথমেই খোলা হল আমাদের বইয়ের ট্রাংক - দেখা গেল ছয় বছর ধরে যে ট্রাংক সবচেয়ে নীচে ছিল তার অর্ধেক বই ড্যাম্প হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক বই রোদে শুকিয়ে নতুন করে বাইন্ডিং করা হল। বহুদিন পর আমার দেব সাহিত্য কুটিরের বই, লরা মেরীর বই পেলাম। এবার বড় কাঠের বাক্স খোলা হল- আমার, ছোট ভাইবোনের খেলনা একে একে বের হল। কিন্তু ততদিনে আমরা বড় হয়ে গেছি! আমার একটা খুব প্রিয় বিলেতি পুতুল বেরোল; নীল চোখ, গোলাপি জামা আর সাদা জুতো সব ঠিক থাকলেও দেখা গেল পুতুলের সারা গায়ে ছাতা পড়ে গেছে। আমার খুব মন খারাপ লাগছিল, এরমধ্যে এক মামা হো হো করে হেসে বললেন, "তোমার পুতুলের তো পক্স হয়েছে,ফেলে দাও, শিগগীর এটাকে ফেলে দাও।" আমি তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে বেসিনের কল আর চোখের জল একই সাথে ছেড়ে দিলাম- কলেজে পড়া মেয়ে সবার সামনে পুতুলের জন্য কি কাঁদতে পারে ! কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে দেখলাম আমার সেই কাঠের বাক্স! দেখে অনেকদিন পর মালীভাই, ফুলের তোড়া, বাগান সব মনে পড়ল। মা কাঁচের বাসনপত্র বের করতে করতে বললেন সব গুছিয়ে পরে চাবি দিয়ে আমার বাক্স খুলে দেবেন। কিন্তু বাক্সের চাবি পাওয়া গেল না, তাই তখন বাক্স খোলাও হল না। পরেও না। কয়েকবছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একবার বাড়ি গেছি, দেখি সেই বাক্স, তখনো তালাবন্ধ। তালা ভেংগে বাক্স খুলতে গিয়ে মনে হল, এরমধ্যে আমার শৈশব ভরা আছে, থাক এটা এভাবেই। তারপর আরো দুই দশক কেটে গেছে, জীবনের পথ অনেকটা পাড়ি দিয়ে ফেলেছি, বাক্সর কথা ভুলেই গেছি। একদিন মায়ের বাসায় গিয়ে দেখি
অনেক হাবিজাবি জিনিষের মাঝে সেই বাক্স- ফেলে দেবার আগে ভেতরে কি আছে দেখার জন্য বাক্স ভাংগার ব্যবস্থা হচ্ছে। আমি ভাংতে দিলাম না- বাক্সটা আমার বাসায় নিয়ে এলাম। এখন মাঝে মাঝে বন্ধ বাক্সটা দেখি, সেই ঝলমলে ফুলগুলো চোখে ভেসে ওঠে, আর মনে পড়ে আমার জীবনেও কিছু ঝলমলে দিন ছিল!