আমার দিনের শুরুটা হয় যুদ্ধ দিয়ে। শরীরের প্রতি কোষে যন্ত্রণা, চোখ মেলতে কষ্ট, হাত পা নাড়াতেও কষ্ট। তবুও, সমস্ত ইচ্ছাশক্তি একসাথে করে একসময় আমি বিছানায় উঠে বসি। এরপর পা মেঝেতে রাখতে হবে, বাথরুমে যেতে হবে, নাস্তা করতে হবে, তারপর ক্লাসে যেতে হবে, এর প্রতিটা কাজই আমার কাছে মনে হয় একের পর এক যুদ্ধ করার মত। ভাবতেই আমার প্রচন্ড ক্লান্তি আসে। ওহ, যদি আজই জীবনের শেয দিন হত! শুয়ে থেকে একটা পছন্দের কবিতা মনে করি:
In every terror I at morn awake
Upon the verge of bitter weeping
To see the day of disappointment break
To no one hope of mine -not one - it's promise keeping:-
--------------
Then, too, when night descends, how anxiously
Upon the couch of sleep I lay me
There also comes no rest to me,
But some wild dream is sent to fray me
--------------------
So by the burden of my days oppressed
Death is desired, life a thing unblest.
মনে হয় কবিতাটা যেন আমাকে মনে করেই লেখা!
কয়েকমাস আগেও সবকিছু অন্যরকম ছিল। আমি ছিলাম হাসিখুশি, প্রাণবন্ত, উচ্ছল। কবে থেকে যে এই অসীম ক্লান্তি আমাকে দিনরাত ঘিরে রাখতে লাগল তা আর মনে করতে পারিনা। অবশ্য আমি আজকাল অনেক কিছুই মনে রাখতে পারিনা। ক্লাসে স্যারের কথা শুনে মনে হয় অপরিচিত ভাষা শুনছি, তারপর কোন পড়াই আর মনে করতে পারিনা। আমি দেশের এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি, আগে খুব ভাল ছাত্রী ছিলাম কিন্তু এখন টেনেটুনে পাশ করি। আগে খুব খেতে পছন্দ করতাম কিন্তু এখন কোন খাবারেই স্বাদ পাই না। ফলে খেতে ভাল লাগেনা, ক্রমেই ওজন কমছে। সবসময় খুব ঘুম পায়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে আর ভাল লাগে না। ভাল লাগে না, কোন কিছুই ভাল লাগে না।
আমাদের বাড়ীতে খুব পড়ার চল আছে। বাবা, মা, ভাই আমি -আমরা সবাই খুব বই পড়ি, মানে আমার এই ভাল লাগেনার দিন শুরুর আগে আমি পড়তাম আরকি। সেই পড়ার অভ্যাস এখনো কিছুটা আছে তাই একদিন ট্যাব হাতে নিয়ে ইংরাজিতে "কিছু ভাল লাগে না " লিখে গুগলে সার্চ দিলাম। আমাকে অবাক কোরে দিয়ে একটা পেইজ এল - symptoms of depression. জানলাম আমার এই লক্ষণগুলো বলে দিচ্ছে আমার ডিপ্রেশন হয়েছে। কিন্তু কেন হল? গুগল বলছে, পারিপার্শ্বিকতার পরিবর্তন, আকস্মিক শারীরিক বা মানসিক আঘাত অথবা জেনেটিক কারণে ডিপ্রেশন হয়। আমার বেলায় প্রথম তিনটি কারণ ঘটেনি - তারমানে ডিপ্রেশনের উত্তরাধিকার আমার রক্তে খেলে বেড়াচেছ, আমার ডিপ্রেশন জেনেটিক কারণে হয়েছে। এই ধরণের ডিপ্রেশনকে বলে ক্লিনিকাল ডিপ্রেশন বা তীব্র ডিপ্রেশন । গুগল বলছে, ডিপ্রেশন হাল্কা বা তীব্র দুরকমই হতে পারে। হাল্কা ডিপ্রেশন কখনো শুধুমাত্র সাইকোথেরাপি দিয়েই সারিয়ে তোলা যায় কিন্ত তীব্র (severe/clinical) ডিপ্রেশন সারাতে প্রয়োজন ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসা, কখনো সাথে সাথে সাইকোথেরাপিও দরকার হয়। কারণ ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে ব্রেনের প্রয়োজনীয় কিছু কেমিকেলের পরিবর্তন হয়ে যায়, তাকে স্বাভাবিক মাত্রায় আনতে ঔষধ খেতেই হবে। আমার কাছের মানুষেরা মাঝে মাঝে আমাকে বলে এই ডিপ্রেশন নাকি আমার দুঃখবিলাস, আমি নাকি সত্যিকার দুঃখী মানুষ যেমন তীব্র শীত বা বরষায় ফুটপাতে থাকা মানুষ বা কোন অংগহীন মানুষের দুঃখের কথা ভাবলেই বুঝতে পারব আমি কতটা সৌভাগ্যবান - আর তখনি আমি ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে আসতে পারব! এদের আমি কিছুতেই বোঝাতে পারি না যে এটা একটা রোগ - নিজে নিজে এর থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব না। আমার যদি একটা টিউমার হত তাহলে যাদের আরো বড় টিউমার আছে তাদের কথা ভাবলেই কি আমার টিউমার সারিয়ে ফেলতে পারতাম!
আসলে আমার অবস্থা কোনভাবেই আমি কাউকে বুঝিয়ে উঠতে পারবনা। আমার বুকজুড়ে আছে অসীম শুন্যতা আর শরীরে প্রচন্ড ক্লান্তি। আমার মনে আশা, ভালবাসা, সুখ-দুখ, উদ্বেগ কিছুই নেই। আমি প্রতিদিন সকালে ভাবি আজকের দিনটা পার হবে তো? সব মানুষ স্বাভাবিক ভাবে দিন কাটায় অথচ আমাকে তাদের মত দেখাবার জন্য প্রচন্ড চেষ্টা করতে হয়। বন্ধুদের সাথে যখন হাসিমুখে আড্ডা দেই কেউ জানতে পারেনা আমার বুকে আছে কি অপরিসীম যন্ত্রণা ! প্রাণপণ চেষ্টা করি স্বাভাবিক থাকতে তবুও মাঝে মাঝে অন্যদের কথায় আমার তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়, সেটা কেউ বুঝতে পারেনা। একজন সারা শরীর এসিড দগ্ধ মানুষের গায়ে সামান্য খোঁচা লাগলেই যেমন খুব কষ্ট শুরু হয় কথার খোঁচায় আমার তার থেকে বেশী কষ্ট হয়। একটা উদাহরণ দেই, মায়ের যে সব কথা আমি সারাজীবন শুনে আসছি, কোন ভাবান্তর হয়নি এখন সেসব কথা শোনার চাইতে মরে যাওয়াও ভাল মনে হয়। যেমন হয়ত বললেন "খেতে পার না যখন এত খাবার নাও কেন" অথবা, "যেমন পড়াশোনা করেছ তেমনি রেজাল্ট হয়েছে" এসব শুনলে মনে হয় আমি যেন এক বোবা,অন্ধ প্রাণী যাকে খাঁচায় বন্দী করে খাঁচায় আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। মনের যন্ত্রণায় আমি অস্থির হয়ে মুক্তির পথ খুঁজি, মনে হয় জীবন শেষ করে দিলেই বুঝি এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব। যেন আর যন্ত্রণা না পেতে হয় তাই কারো কথায় কষ্ট পেলেই আমি তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেই। আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি, আজকাল আমার শরীরের যন্ত্রণাবোধ একেবারে কমে গেছে!
খুব ইচ্ছে করে কাউকে আমার অবস্থা বুঝিয়ে বলি কিন্তু ভয় হয় সে হয়ত না বুঝে এমন কিছু বলে বসবে যাতে আরো বেশি কষ্ট পাব। তার চাইতে দেখি কতদিন এভাবে থাকা যায়!
ছবি: ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:৫১