একটি কপি পেস্ট পোস্ট..
পয়লা আগস্ট। ১৯৭১।
নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার। মঞ্চে তুমুল জনপ্রিয় ব্রিটিশ ব্যান্ড বিটলসের জর্জ হ্যারিসন, সঙ্গে বব ডিলান, লিওন রাসেল, বিলি প্রেস্টন, রিঙ্গো স্টার, এরিক ক্ল্যাপটন। তাঁদের সঙ্গে ভারতীয় কিংবদন্তি সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও ওস্তাদ আলী আকবর খান। আর তাঁদের মুখোমুখি শ্রোতা-দর্শক। সবাই সমবেত যোদ্ধার ভূমিকায়। যুদ্ধ মানবতার পক্ষে, অমানবিকতার বিরুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধারা যখন অস্ত্র হাতে প্রত্যন্ত বাংলার রণক্ষেত্রে লড়াইরত, তখন ম্যাডিসন স্কয়ারেও যেন গিটার-ড্রামে বাজছে রণদামামা। স্বাধীন বাংলার জন্য কত ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে লড়ছে মানুষ!
চল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের সেই আয়োজনের। চার দশক আগে এই দিনে পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের যৌথ পৌরোহিত্যে আয়োজন করা হয়েছিল সেই বিখ্যাত কনসার্টের।
যুদ্ধে বিধ্বস্ত জনপদ, ঘরছাড়া-দেশছাড়া শরণার্থী আশ্রয় ও নিরাপত্তার খোঁজে বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা ভারতীয় রাজ্যগুলোর দিকে স্রোতের মতো ছুটতে থাকে মানুষ। সীমিত সম্পদের ভারতও প্রায় এক কোটি শরণার্থীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। সহায়-সম্বলহীন ঘরছাড়া এসব শরণার্থীর কথা বিবিসিসহ অন্যান্য গণমাধ্যম মারফত বিশ্ববাসী জানতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ভারতীয় বাঙালি সেতারবাদক রবিশঙ্কর হূদয় দিয়ে অনুভব করেন ছিন্নমূল সেই সব শরণার্থীর বিপন্নতা। এ রকম অমানবিক হূদয়বিদারক পরিস্থিতিতে বাঙালি হয়ে বাঙালির পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা থেকেই রবিশঙ্করের মাথায় আসে কনসার্টের কথা।
গত শতকের ষাটের দশকে তুমুল জনপ্রিয় ব্যান্ড বিটলসের ভাঙন ধরে ১৯৭০ সালেই। জর্জ হ্যারিসন তখন একক ক্যারিয়ার গড়তে ব্যস্ত। অন্যরাও সেদিকে ঝুঁকছেন। হ্যারিসন তখন লস অ্যাঞ্জেলেসে তাঁর নতুন অ্যালবাম রাগার কাজ করছেন। তখনই রবিশঙ্কর প্রস্তাব দিলেন বাংলাদেশিদের সাহায্য করার জন্য বড় ধরনের কোনো কনসার্ট করা যায় কি না। প্রাথমিকভাবে রবিশঙ্কর হাজার পঁচিশেক ডলারের একটা তহবিল দাঁড় করানোর ইচ্ছা থেকেই এই কনসার্ট আয়োজনের কথা বলেন। কিন্তু কোনো কিছু করলে বড় পরিসরেই করা উচিত—মত হ্যারিসনের। হ্যারিসন যোগ দিলেন এই কর্মকাণ্ডে। নিজের ব্যক্তিগত ম্যানেজার অ্যালেন ক্লাইনকে যাবতীয় সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনের ভার দিলেন। যোগাযোগ শুরু করলেন ভেঙে যাওয়া দলের সদস্যদের সঙ্গে। অনেকেই জড়ো হলেন মহতী এই উদ্যোগে। বিল প্রেস্টন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল রাজি হয়ে যান একবাক্যেই। রাজি করানো হয় বব ডিলান ও এরিক ক্ল্যাপটনকেও। জন লেননেরও যোগ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে তাঁর আসা হয়নি। ঠিক হলো পুরো জুলাই মাস সাংগঠনিক তৎ পরতা চলবে। এরপর আগস্টে হবে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’।
পয়লা আগস্ট দুপুরে শুরু হলো কনসার্ট। রাত অবধি চলে কনসার্ট।
প্রথম অংশে ছিল রবিশঙ্কর ও তাঁর দলের পরিবেশনা—সতেরো মিনিট স্থায়ী এই পরিবেশনার নামকরণ হয় ‘বাংলা ধুন’। এই পরিবেশনায় তাঁকে সংগত করেন তবলায় ওস্তাদ আল্লা রাখা ও তাম্বুরায় কমল চক্রবর্তী।
কনসার্টের আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিলেন স্বাভাবিকভাবেই বব ডিলান ও হ্যারিসন। জর্জ হ্যারিসন পরিবেশন করেন আটটি গান। একটি ছিল ডিলানের সঙ্গে দ্বৈত। বব ডিলান গাইলেন পাঁচটি। রিঙ্গো স্টার, বিলি প্রেস্টন ও লিওন রাসেল প্রত্যেকে গাইলেন একটি করে গান। গিটারে চমৎ কার ছন্দ তুললেন এরিক ক্ল্যাপটন।
শেষ পরিবেশনা ছিল কনসার্টের জন্য বিশেষভাবে লেখা বাংলাদেশ গানটি।
মাই ফ্রেন্ড কেইম টু মি, উইথ স্যাডনেস ইন হিজ আইজ
হি টোল্ড মি দ্যাট হি ওয়ান্টেড হেল্প
বিফোর হিজ কান্ট্রি ডাইজ...
...বাংলাদেশ...বাংলাদেশ... বাংলাদেশ...
(...বন্ধু আমার এল একদিন
চোখভরা তার ধু-ধু হাহাকার
বলল কেবল সহায়তা চাই
বাঁচাতে হবে দেশটাকে তার...
...বাংলাদেশ...বাংলাদেশ...
বাংলাদেশ)
(সাজ্জাদ শরিফ অনূদিত গানটির কয়েক পঙিক্ত)
বিশ্ববিখ্যাত এই শিল্পীদের সঙ্গে একাত্ম তখন চল্লিশ হাজারের বেশি শ্রোতা। বিপন্ন বাংলাদেশিদের জন্য তখন তাদের মনেও হাহাকার আর বেদনা। ...হাত নেড়ে, গলা মিলিয়ে তাঁরাও গাইছেন ‘...বাংলাদেশ...বাংলাদেশ...’ শূন্যে নড়তে থাকা হাতের ওপরে, মাথার ওপরে সীমানাহীন যে আকাশ, সেই আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে সেই সুর...সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছে দূরে বাংলার আকাশেও বুঝি...
মার্কিন সরকার যেখানে স্বাধীন বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জন্মের বিরোধী ছিল, সেখানেই এমন একটি আয়োজন আয়োজকদের বীরত্বের অসাধারণ নিদর্শন।
১৯৭১ সালেই কনসার্টের একটি সংকলন বের হয়। বাহাত্তরে মুক্তি পায় এর ওপর নির্মিত একটি চলচ্চিত্র। ১৯৭৩ সালে ওই অ্যালবামের জন্য গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড পুরস্কার লাভ যোগ করে আরেক ভিন্ন মাত্রা। এই কনসার্ট এবং অন্যভাবে প্রাপ্ত দুই লাখ ৪৩ হাজার ৪১৮.৫০ মার্কিন ডলার ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থীদের জন্য পাঠানো হয়। এভাবেই দেশ-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের লাখো সৈনিকের সঙ্গে যোগ হয় রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন এবং কনসার্ট ফর বাংলাদেশের আয়োজক মানুষদের নাম। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে জড়িয়ে যান তাঁরাও।
এম এম খালেকুজ্জামান
আজকের প্রথম আলো থেকে নেয়া।