খুব ভোরে দোলন এলো। ওকে দেখে চমকে উঠলাম আমি! এক রাতের মাঝে বুড়িয়ে গেছে যেন। উস্কোখুস্কো চুল, লাল চোখ আর উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। আমার এত কষ্ট হচ্ছিলো। তবুও ভেতরের উদ্বেগ চেপে রেখে জানতে চাইলাম কি হয়েছে। ও বললো আমার সাথে জরুরী কথা আছে তার। ও বাইরে অপেক্ষা করছে আমি যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রেডি হয়ে আসি।
আমি খুব তড়িঘড়ি রেডি হয়ে নিলাম। নায়লাকে বললাম ফিরতে দেরী হতে পারে। এটাও বললাম দোলনের সাথে যাচ্ছি। কি যেন জরুরী কথা আছে ওর। গত কাল পর্যন্ত আমার আর দোলনের এই সম্পর্ক নিয়ে নায়লা খুব আনন্দে ছিলো কিন্তু গত রাতে যখন ওকে সব খুলে বলি বুঝতে পারি নায়লার মনটা খারাপ হয়ে গেছে। কিছুটা অপমানবোধ বা ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়ে গেছে যে আমার থেকে ওর মাঝেও তা কাল ওর চেহারা দেখে আমাকে আর কারও বলে দিতে হয়নি। তাই আজ সকালে যখন আমি বের হচ্ছিলাম। নায়লা ব্যাপারটা পছন্দ করছে না সে বেশ বুঝতে পারলাম। অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইলো সে আমার দিকে এরপর গম্ভীর মুখে বললো, তোর উচিৎ দোলনের মুখও আর ইহজীবনে না দেখা। আমি ভীষন অবাক হলাম! হতভম্বের মত তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।
এরপর আমরা সেদিন চলে গেলাম বহুদূর। রাঙ্গামাটির পথ ছাড়িয়ে দূর দুরান্তে। দোলন আমাকে অবিশ্রাম বলে চলেছিলো। এ কখনই সম্ভব হবে না মানে কারো পক্ষে কোনোদিনই কোনো কিছুর বিনিময়েই আমাদের এ সম্পর্কের বাঁধন ছেড়া সম্ভব না। কাল রাতে ওর বৌদিকে সেও সাফ জানিয়ে দিয়েছে তারা জোরাজুরি করলে তাকেই তাদেরকে হারাতে হবে। এতে বেশ কাজ হয়েছে বলেই তার মনে হয়েছে। বৌদি কিছুটা ভয়ও পেয়েছে। পুত্রতুল্য এ দেবরটিকে তিনি যে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসেন। কত অন্যায় আবদার পূরন করেছেন তিনি তার জীবনে সকলের অগোচরেও তা দোলনের চাইতে বেশি আর কে জানে!
সেদিনের রাঙ্গামটির পথের ধুলোয় কতটা পথ ধরে যে চলে গিয়েছিলো আমাদের পদচিহ্ন তা জানা হয়নি। এ দিকে লোকালয় কমে আসছিলো। দু একটা বিছিন্ন মাটির ঘর, কলাগাছ, খড়ের গাঁদা বা ঘাসবিঁচালী খাওয়া গরু সবই আজও রঙ্গিন তৈলচিত্রের মত বাঁধাই করে আটকানো আছে আমার হৃদয়ের ক্যানভাসে। সেই লালচে মাটির পথ দেখে হঠাৎ আমার মনে হয়েছিলো রবিঠাকুরও একদিন হয়তো এই পথেই হেঁটে যেতে যেতে লিখেছিলেন ঐ গান-
গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গামাটির পথ আমার মন ভুলায় রে -
ও যে আমায় ঘরের বাহির করে, পায়ে পায়ে পায়ে ধরে
মরি হায় হায় রে -
ও যে কেড়ে আমায় নিয়ে যায় রে-
যায়রে কোন চুলায় রে -
আমার মন ভুলায় রে!!
আমার আর ঘরে ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। এই ঘরের বাহিরটাই যেন বড় আপন তখন। হাতের মুঠোয় হাত। দু'জনের পাশাপাশি হেঁটে চলা। এই পথ এই গানের মতন যে চুলোতেই নিয়ে যাক না কেনো কোনো আপত্তি ছিলো না আমার । দোলন আমার আশ্রয়। যেই আশ্রয় হারতে দেয় না। যে আশ্রয় হঠাৎ আসা ঝড় ঝাপটায় আগলে রাখে বুকের মাঝে। কোনোভাবেই ঠেলে ফেলে না পথের মাঝে ধুলো কুটোয়।
পথের ধারে সরু নদীর ঘাটে বাঁধা নৌকাতে করে আমরা সেদিন সারা দুপুর ভেসে চললাম। ক্লান্ত শ্রান্ত সেই আমরা নৌকার গলুই এ গা বিছিয়ে দিয়েছিলাম। মাথার উপরে ঝকঝকে আকাশ আর আমাদের মন তখন ঘর ছাড়া মেঘেরও সঙ্গী। সেই ভর দুপুরেও নদীর উপর ভেসে চলা ঝিরঝিরে বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছিলো। একটি অপূর্ব সুন্দর নীল মাছরাঙ্গা পাখি পানিতে ছোঁ মেরে গিয়ে বসলো নদী তীর ঘেষা বাঁশঝাড়ের নূয়ে পড়া একটি বাঁশের উপরে। চারিদিকে নিস্তব্ধ নীরবতা। শুধু বৈঠা টানার সাথে সাথে জলের কলল কলল শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। পৃথিবী এত সুন্দর কেনো? মাঝে মাঝেই পৃথিবীকে ক্লেদশূন্য অপার্থীব লাগে। মনে হয় বেঁচে থাকি এই খানে হাজার বছর।
নৌকার মাঝি আমাদের এক অদ্ভুত জিনিস খেতে দিলো। সবুজ রং গোল মতন এক ফলের উপরে ছোট ছোট গোলাকার ডিজাইন। সেই ঢাকনি খুলে বের হয়ে আসে সাদা সাদা বীজের এক অদ্ভুত স্বাদের বস্তু। মাঝি বললো এসব নাকি পদ্মের চাঁক। পদ্ম মানে আসল পদ্ম ফুলের তলে নাকি এই পদ্মের চাঁক তৈরী হয় আর এ খাবারটি বিশেষ সুস্বাদু। তবে এসব চাঁক তুলে আনাটাও দুরহ বটে। কারণ প্রায়শই নাকি পদ্মের সাথে জড়িয়ে থাকে বিষধর সাপ।
পৃথিবীতে সব সুন্দরই কি রহস্যময়? সব সুন্দরের সাথেই কি জড়িয়ে থাকে এক একটি বিষধর সর্প? কত যে প্রশ্ন জাগে আমার মনে! তবুও হাতের মাঝে হা্ত। আশ্বাস দেয়, ভয় নাই, ভয় নাই। আমার মন মুক্তি চায়, সকল বাঁধা বিপত্তি, অভিযোগ পেরিয়ে একটি নির্মল দিনের বিশুদ্ধ বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস টেনে নেবার মুক্তি। নিষ্কন্টক পথে নগ্ন পায়ে নিশ্চিন্তে হেঁটে চলার মুক্তি। আমার এই ভীরু প্রান অভয় চায়। সামনে আঁধার সরে যাওয়া স্বপ্নমাখা দিন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। দোলনের চোখে তাকিয়ে আমি সেই সোনালী দিনের স্বপ্নে ডুবে যাই। বার বার এই দূর্বল মন ঠায় চায় দোলনের কাছে কোন প্রতিশ্রুতিতে জানা নেই আমার। তবুও আমি নিশ্চিন্ত প্রছন্নতায় জেনে বুঝে ডুবে যাই দোলনের মাঝেই।
তখন তরুন ছিলো অরুন আলো
পথটি ছিলো কুসুমতীর্ণ
বসন্ত যে রঙ্গিন বেশে ধরায় সেদিন অবতীর্ণ-
বৌদির বেঁধে দেওয়া নিষেধের বেড়াজাল ছিড়ে খুড়ে আমরা যেন মুক্ত আকাশে উড়ে চললাম এরপরে ডানা মেলে। ততদিনে আমি এতটুকু বুঝেছি যে দোলনকে ছাড়া আমার যেমনই চলবে না, দোলনেরও চলবে না আমাকে ছাড়া। কাজেই এই পৃথিবীর আর কারো বাঁধা নিষেধ বা রক্তচক্ষু বা অগ্নিবাণ যাই আসুক আমাদেরকে থামানো যাবেনা আর। রোধ করা যাবেনা আমাদের চলার পথ। আমার ভেতর বাহির অন্তর জুড়ে তখন শুধু দোলন আর দোলন।
প্রায়ই আমরা ঐ রাঙ্গামাটির পথ ধরে হেঁটে যেতাম বহুদূরে। এক বিকেলে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠের ঠিক মধ্যিখানে পেয়েছিলাম এক জাগ্রত মনসা মন্দির। জাগ্রত বলছি কারণ সেই মন্দিরের গায়ে অপঠনযোগ্য হরফে কিছু লেখনী ছিলো যার মর্মদ্ধার করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তবে বিশাল হরিৎ প্রান্তরের মাঝে সেই ছোট্ট এক রতি মন্দিরের ঘরে একটি অপরূপা শ্যামা মূর্তীর মাথায় উপরে জড়ানো ছিলো বিশাল ফনা তোলা এক ধাতব সাপ। তার সামনে সাটাঙ্গে উবু হয়ে পড়েছিলেন একজন বৃদ্ধ মহিলা। আমরা যখন মন্দিরের দুয়ারে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি ভ্রুক্ষেপ করেননি। যখন উঠলেন এবং ফিরে তাকিয়ে দেখলেন আমাদেরকে তখন বেশ চমকে উঠলেন। জানতে চাইলেন কোথা থেকে এসেছি আমরা এই অবেলায়। আমি অবাক হয়ে দেখলাম উনি ঐ একটি কথাই জিজ্ঞাসা করে সৌম্য শান্ত দৃষ্টিতে ফিরে তাকালেন মনসা দেবীর মুর্তীর দিকে এবং পরম মমতায় উনার চকচকে পেতলের ঘটি হতে দুধ ঢেলে দিতে লাগলেন মনসা দেবীর সামনে রাখা পাথরের বাটিতে।
উনি ফিরে যাবার সময় আমাদেরকে সাবধান করে দিলেন। আমরা যেন মা মনসাকে কোনোভাবেই বিরক্ত করে না তুলি। উনি বড় জাগ্রত দেবী। দয়াবতী কিন্তু রাগ অনির্বান। রেগে গেলে আর জান নিয়ে ফেরা হবে না আমাদের। উনার কথায় কি ছিলো জানিনা কিন্তু আমার গা ছমছম করতে লাগলো। উনি আমাদেরকে রেখে চলে গেলেন। আমি বললাম, দোলন চলো ফিরে যাই। কাজ নেই এখানে থেকে। দোলন হঠাৎ এক অদ্ভুত কান্ড করলো। মনসা দেবীর মূর্তীর সামনে ছোট্ট পাত্রে রাখা সিঁদুর তুলে নিয়ে আমার সিঁথিতে লাগিয়ে দিলো। তারপর হো হো করে হাসতে লাগলো। বললো, শাস্ত্র মতে তুমি কিন্তু আজ থেকে আমার সহধর্মিনী হয়ে গেলে। আর কখনও কাউকেই তুমি জীবনসঙ্গী করতে পারবে না, এই আমি ছাড়া। আমি ওর কথা শুনে অবাক হয়েছিলাম কিন্তু তারপরই হাসতে লাগলাম ওর ছেলেমানুষী দেখে।
এরপর দিনই বাংলাদেশ থেকে জরুরী ট্রাঙ্ককল এলো। আমার জরুরী তলব পড়লো দেশে ফিরে যাবার। মা মরণাপন্ন অবস্থা শঙ্কটে আছে। ফোনটা করেছিলেন আমার নতুন বাবা। উনি বেশি কিছু বললেন না । ফোন কেটে দিলেন। যদিও মায়ের উপর আমার অভিমানের কোনো শেষ সীমা ছিলোনা কিন্তু এই সংবাদে আমি এতটাই অস্থির হয়ে উঠলাম যে দোলন আমার ছুটির ব্যাবস্থা থেকে শুরু করে টিকেট ও অন্যান্য সকল ব্যাবস্থা দেড়দিনের মাথায় করে ফেললো।
বাংলাদেশে ফিরে আসার ঠিক আগের সন্ধ্যায় আমি আর দোলন পাশাপাশি বসে ছিলাম। তখন সন্ধ্যা নামছিলো। ধুধু প্রান্তরের বুকে আমরা দু'জন। আমার মন ভীষন খারাপ ছিলো এমনিতেই। কিন্তু হঠাৎ আমার ভেতরে হু হু করে উঠলো। আমার মনে হলো আমি আর কোনোদিন দোলনকে দেখতে পাবোনা। আমার বুকের ভেতরে কে যেন বলে গেলো আমি দোলনকে হারাতে যাচ্ছি। দোলনের সাথে এই বুঝি আমার শেষ দেখা।
আমি আকুল হয়ে কাঁদছিলাম। দোলনের বুক ভেসে যাচ্ছিলো আমার চোখের জলে। দোলন আমাকে সান্তনা দিয়েই যাচ্ছিলো। বলছিলো, দূর পাগলী এসব কি ভাবো? আমাদের দুজনকে আলাদা করার সাধ্যি স্বয়ং বিধাতারও নেই । উনি আমাদেরকে গড়েছেনই একে অন্যের জন্য। তবুও দোলনের কথায় আমার মন সাঁয় দিচ্ছিলো না। আমার মনে হচ্ছিলো আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। আমার সামনে অনিশ্চিৎ ভবিষ্যৎ। আমি প্রানপনে দোলনকে আঁকড়ে ধরে ছিলাম। রাত গাঢ় না হওয়া পর্যন্ত।
আজ এত টুকুই থাক। এরপরের ঘটনাগুলো লিখতে গেলে একটু সময় নিয়ে বসতে হবে। তার চেয়ে বরং একটি কবিতা লেখার চেষ্টা করি। মন কিছুটা ডাইভার্ট হবে-
I'll remember forever
The tears I found in your eyes
The last day, the last kiss,
I’ll remember forever.
The night will glow in my dark
My head was on your neck
The things you said-
You never leave me
And won't let this end"
I flash back to the days,
That flew away on bird’s wings
I can remember your promise
you can do for me anything.
Keep the memories in your heart
the good times we had,
And I hope you look back
And think I am still by your side….
একি খেলা আপন সনে- ১০
একি খেলা আপন সনে- ৯
একি খেলা আপন সনে- ৮
একি খেলা আপন সনে- ৭
একি খেলা আপন সনে- ৬
একি খেলা আপন সনে - ৫
একি খেলা আপন সনে- ৪
একি খেলা আপন সনে - ৩
একি খেলা আপন সনে- ২
একি খেলা আপন সনে - ১