*********************************************
কানাডা দিলাম পাড়ি -ছবিব্লগ - ১
কানাডা দিলাম পাড়ি -ছবিব্লগ - ২
*********************************************
ইস্তানবুল থেকে টরন্টো যেতে প্রায় ১১ ঘন্টার মতো লাগবে। ঢাকা থেকে ইস্তানবুল আসার যাত্রাটা খুব বেশি আরামদায়ক হয়নি। এর জন্য টার্কিশ এয়ারলাইন্সের ছোট-খাট প্লেন, তাদের ভাবলেশহীন কেবিন ক্রু এবং তাদের ঠান্ডা/শক্ত অখাদ্য কেই 'ধন্যবাদ' দিতে হয়।
তবে ইস্তানবুল থেকে টরন্টোর প্লেনটি আগের প্লেনটির চেয়ে বিশাল বড়। যাত্রা শুরু হবার কিছুক্ষন পরই কেবিন ক্রুরা যাত্রীদের "টার্কিশ ডিলাইট" পরিবেশন করলেন - যেহেতু টার্কিশ ডিলাইট দেয়া মাত্র আমি সেটাকে সেকেন্ডে সাবাড় করে ফেলেছি, তাই সেটার ছবিটা দিতে পারলাম না। ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত এই ছবিটা দিয়ে তাই কাজ চালালাম:
খুবই মজার এক বস্তুু, ভেতরে পেস্তাবাদাম ও জেলী, বাইরে চিনির পাউডারের মিশ্রন - ভাবলাম আরেকটা চাই, কিন্তু ভদ্রতার কারনে চাইলাম না

প্লেনের নিচে একটা ক্যামেরা লাগানো থাকে, যেটার সাহায্যে যাত্রীরা ঠিক তাদের পায়ের নিচের দৃশ্যটাই দেখতে পারবেন।
একটু পরই ভূখন্ড ফেলে আবার মেডিটেরিয়ান সাগরের উপর দিয়ে যাত্রা। নীলাভ এক সাগর যেটার বর্ননা দেয়া যাবে না, ক্যামেরাতেও আসলো না ঠিক মত।
কি বিস্তৃত এই মহাসাগর, যতদূর চোখ যায়, কিছু নেই শুধু পানি আর পানি। ভাবলেই অবাক লাগে, কি করে এটার উপর দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা উড়ে যাই।
এক ঘন্টার মতো হয়েছে, তারপর দেখলাম এয়ার হোস্টেস এসে একটা কেয়ার প্যাকেজ দিয়ে গেলেন। তার সাথে আরো দেয়া হলো খাবারের মেনু: চিকেন, বিফ, ভেজিটেরিয়ান, ডেজার্ট, সালাড - সবই ছিল। সাথে বেভারেজ মেনুও দেয়া হলো: তাতে কোক, পেপসি, জুসের সাথে সাথে ওয়াইন, জিন, ভদকা, রাম, বিয়ারও আছে - সবই ফ্রি!

আর ছবিতে যে টিনের পেন্সিলের বক্স দেখা যাচ্ছে, সেটা হলো কেয়ার প্যাক। এটার ভেতরে পেলাম - লিপ বাম (ঠোট শুকিয়ে গেলে), পায়ের মোজা (নরম তুলোর মতো), ঘুমানোর জন্য স্লীপ মাস্ক, ফ্রেশ টাওয়াল/টিস্যু (ভেজা যাতে মুখ মোছা যায়)।
অনেক বড় জার্নি তারপরও খুব একটা খারাপ লাগছিল না। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি সূর্য তখন মাথার উপর, প্লেন উঠে গিয়েছে মেঘের উপরে। সূর্যের আলো মেঘে প্রতিফলিত হচ্ছে - বেশিক্ষন তাকালে চোখে ধা ধা লেগে যায়।
এভাবেই সময় কাটে, আর আমি বসে বসে আমার ভবিষ্যৎের কথা ভাবি। কিছু কিছু যাত্রী নিজের সিট থেকে উঠে গিয়ে হাটাহাটি করছেন, এদিক ওদিক কথা বলছেন। আমি সেটা করতে চাচ্ছি না, কারন আমার পাশে বসে আছে এক দম্পতি, দুজনকে ডিংগিয়ে যাওয়াটা বড়ই ঝামেলার কাজ।
একটু পর দুপুরের খাবার দেয়া হলো। যা ভেবেছিলাম আগের থেকে অনেক ভালো। লান্চে পেলাম, চিকেন সাশলিক এর সাথে পালং শাক (শাকটাকে আবার মাখন দিয়ে ভাজা হয়েছে, মন্দ না), সাথে ইয়া বড় দুই ক্যপসিকাম (ঝাল নেই মরিচ) ও গরম ভাত। আরো আছে গ্রীক দই (পানসে মজা নাই), স্যামন মাছ, ভ্যানিলা কাস্টার্ড, পানি। আরো দিয়েছে বিশাল বড় এক বানরুটি ও জেলি, পনির। আমি ভাবছি এত কিছু কে খাবে! উত্তর 'আমি'।
খাওয়া শেষ করে বুঝলাম আমি ভীষন ক্লান্ত। হয়ত তখন অপেক্ষাকৃত ভালো সিটে বসেছি দেখে অথবা ভাল খাবার খেয়েছি বলেই কিনা চোখ বুজে যাচ্ছিল। মাথার উপর তাকিয়ে দেখি পিংক রংয়ের একটা আলো জ্বলছে। আলোটা ধীরে ধীরে বেগুনি হয়ে গেল, তারপর আবার পিংক। যখন আমাদের লাউন্জে পিংক হয়, তখন আমাদের সামনের লাউন্জে বেগুনি হয়ে যায়, এসব দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমের রাজ্যে ডুব দিলাম!
হঠাৎ শব্দে ঘুম ভেংগে গেল। দেখি এয়ার হোস্টেস আমাদের পাশের যাত্রীদের জুস দিচ্ছেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১২টার মতন বাজে, কিন্তু এটা কি দুপুর ১২টা, নাকি রাত ১২টা? কোথায় ১২টা বাজছে বাংলাদেশে নাকি ইস্তানবুলে, নাকি টরন্টোতে? সময়ের কোন হিসাব আর নেই, যেন একটা চক্রে পড়ে আমি ক্রমাগত ঘুরছি আর ঘুরছি। ঘোর লাগার মতন!
জুসটুস খেয়ে একটু ফ্রেশ লাগল। মনেও পড়ল আমি প্রায় ২৪ ঘন্টার উপর না ঘুমিয়ে আছি। কারন যেদিন ভোরে রওনা দিলাম তার আগের রাতেও ঘুমাইনি। তার উপর আবার এখন ১৫ ঘন্টার উপর প্লেন যাত্রা - এখন এসে সেটার মজা টের পাচ্ছিলাম।
একটু পর আবার দেখি খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। বুঝলাম না ব্যাটারা এত খাওয়া দেয় কেন। মানে এত তাড়াতাড়ি তো কারোই ক্ষিদে লাগার কথা না। ২/৩ ঘন্টা পর পরই খাওয়াচ্ছে।
এবার খাবার হিসেবে দেয়া হলো টমাটো পাস্তা সাথে বেগুন ফ্রাই। আমি তো ভাবলাম, একি প্লেনে উঠে বেগুন খাব?! কিন্তু নাহ বেগুনটা খুবই মজার ছিল, ছোট ছোট বেগুন টুকরো ঘিয়ে ভাজা। আরো দেয়া হলো, চিংড়ির সালাদ (সাদামাটা), ক্যারামেল পায়েস (চিনিকে পুড়িয়ে পায়েসের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে, মজার জিনিস), বিস্কুট, পানি, জুস।
জানালার বাইরে সেই মেঘের রাজ্যে পৃথিবী চাদরময়.....
মেঘের উপরে লান্চ করার মজাই আলাদা!

একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন, জানালার কাচে বরফকণা জমে আছে।
এরই মাঝে পাশের দম্পতির সাথে টুকটাক কথা হলো। তাদের বয়স ৪৫-৫০ এর মতো হবে। আলবেনিয়া থেকে আসছেন, দুজনেই কানাডিয়ান নাগরিকত্ব পেয়ে গেছেন। কানাডায় আছেন প্রায় ১৮ বছর। ভদ্রলোক বললেন "আমাদের ২৪ বছরের একটি ছেলে আছে। এখন আমাদের দুজনের থেকে বেশি কামায়", ভদ্রমহিলা সাথে সাথে বলে উঠলেন "নাহ আমাদের চেয়ে বেশী কামায় না, ও ফাজলামী করছে"। তারপর দেখলাম এই আলবেনিয়ান দম্পতি নিজেদের ভাষায় ছেলের ও তাদের আয়-উপার্জন নিয়ে হিসেব-নিকেশ শুরু করলেন। বুঝলাম তারা আসলেই অনেক সুখী।
প্লেন ল্যান্ড করার আগে একসময় আমাকে বললেন "দেখ তোমাকে একটা উপদেশ দেই - এখানে এসেই একটা কলেজ/ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে পড়, একটা কোর্স করে ফেল। এটা তোমাকে পরে অনেক কাজে দিবে"। হুমম।
এরপর বসে বসে ১০ মিনিট ম্যান অফ স্টিল দেখি তো আবার ১০ মিনিট ষ্পাইডারম্যান, কিছুক্ষন হ্যাংওভারও দেখলাম। আবার খবরও দেখলাম। সবচেয়ে বেশি দেখেছি এই চ্যানেল টি। এর মাধ্যমে আপনি বুঝতে পারবেন, আপনি ঠিক ঐ মূহুর্তে কোন দেশের কোন এলাকার উপর দিয়ে যাচ্ছেন। এটাও বুঝবেন কতদূর যেতে হবে, কতক্ষন লাগবে আপনার গন্তব্যে পৌছতে।
কিউবেক-এর উপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। এটা কানাডার ফ্রেন্চ স্পিকিং একটি প্রভিন্স। অর্থাৎ এখানে থাকলে আপনার ফ্রেন্চ জানাটা অপরিহার্য।
মনিটরের নিচের রিমোট কন্ট্রোলার টি খুলে ফেলা যায়। ওটা আপনি রিমোট হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন, আবার গেম খেলার জন্য কন্ট্রোলার হিসেবেও চালাবেন।
টরন্টো থেকে কয়েক ঘন্টা দূরে থাকতেই আকাশ অন্ধকার হয়ে এলো। বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব, কয়েক ফোটাও মনে হয় দেখলাম জানালার পড়তে।
একেবারে মেঘের মাঝে ঢুকে গেছে প্লেন, বুঝতে পারছিলাম ধীরে ধীরে নিচে নামছি।
আর একটু পরই টরন্টোর মাটি দেখতে পেলাম। ছোট ছোট রাস্তা, বাড়ীঘর সবই দেখা যাচ্ছিল। উপর থেকে দেখে যা বোঝা যাচ্ছিল তাতে মনে হচ্ছিল দেশটাই মনে হয় সবুজে ঢাকা। আর মাইলের পর মাইল খালি পড়ে আছে।
মূল টরন্টোর একাংশ। রেসিডেন্শিয়াল (থাকার জন্য) এরিয়া। পুতুল ঘরের মতো সাজানো।
হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলছে গাড়ীর বহর
পাইলট মাইকে জানালেন আমরা টরন্টো পিয়ারসন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতে যাচ্ছি।
প্লেন ল্যান্ড করার পর ধীরে ধীরে সবাই নামলাম, কোন সমস্যা ছাড়াই। আমি আবার শুরু করলাম সেই 'দে ছুট' প্রক্রিয়া। এটার সুফল পেয়েছি পরে, ইমিগ্রেশন লাইনে আমার সামনে ছিল মাত্র ২ জন। যারা নামার পরই একটু বিরতি নিয়েছেন (বাথরুম, খাওয়া) তারাও এসেছেন, কিন্তু তাদের সামনে রয়েছে ২০-২৫ জনের বিশাল এক লম্বা লাইন। এতবড় জার্নি করে এসে আবার লাইনে দাড়ানোটা এক বিরক্তিকর ব্যাপার। তাই আমি বলব, ওসব বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি ইমিগ্রেশন শেষ করে ফেলুন। তারপর ঘুরাঘুরি।
পুরো এয়ারপোর্ট ইন্টারনেট WiFi এর আওতায়। শুধু আপনার ফোনের WiFi অন করুন, তারপর গুগল ব্রাউজ করুন। দেখবেন, গুগল না এসে অন্য একটি সাইট আসবে, তাতে আপনাকে বলা হবে "অমুক ব্যাংকের সৌজন্যে আপনার ফোন এখন ফ্রি ইন্টারনেট সেবা গ্রহন করবে, আপনি কি সেটা মেনে নিচ্ছেন?" Yes চাপুন, তারপরই ফ্রি ইন্টারনেট পাবেন।
হাটতে হাটতে গোছানো এয়ারপোর্টের একাংশ দেখতে পেলাম। একজায়গার দেখলাম সারি সারি আইপ্যাড, প্রিন্টার সাজানো আছে। এই রকম সব মিলিয়ে ১০০ টার বেশি আইপ্যাড সাজানো, কিন্তু সেই রকম ব্যবহার কেউ করছেনা। কারন সবার নিজের কাছেই আইপ্যাড/আইফোন আছে।
এই সাইন অনুসরন করে হাটতে থাকুন...
...একসময় এসে এই গেটের সামনে দাড়াবেন
"Welcome To Canada"
এরপর ইমিগ্রেশন পার হলাম। বলতে গেলে সবচেয়ে কম সময় লেগেছে কানাডার ইমিগ্রেশনে। একজন মহিলা অফিসার আমার কাগজ দেখলেন, আমার ইমিগ্রেশন নম্বরটা কম্পিউটারের ইনপুট করতেই সব ফাইনাল। তারপর আমাকে অভিন্দন জানিয়ে বললেন "Congratulations, you are now officially a permanent resident of Canada, your card will arrive in 6-8 weeks."। তারপর আমাকে একটা রুমে গিয়ে আমার SIN নম্বর করতে বললেন, এই SIN নম্বর অনেকটা আমাদের ন্যাশনাল আইডি নম্বরের মতো, তবে আমাদেরটার মতো এতো ফেলনা নয়। এটি হবে আপনার একান্ত ব্যাক্তিগত নম্বর এবং কানাডাতে সব জায়গায় এটার প্রয়োজন পড়বে।
SIN নম্বর পাবার ৫ মিনিটের মাঝেই পেয়ে গেলাম, আবারও আগে এসেছি বলে, এরপর আমাকে কিছু নতুন অভিবাসীদের জন্য লেখা কিছু বই, ডায়রী দেয়া হলো। এসব ডায়রীতে সব ফোন নম্বর, ঠিকানা, পড়াশোনা, চাকুরীর সম্পর্কে কোথায় খোজ নিতে হবে - সব লেখা আছে।
এরপর ব্যাগেজ ক্লেইম থেকে নিজের লাগেজ দুটো খুজে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম এয়ারপোর্ট থেকে। একটা ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিলাম গন্তব্যে। আমি যাচ্ছি টরন্টো থেকে ৪৫ মিনিট দুরের এক শহরে। আপাতত ওখানেই আমার আবাস।
পৌছতে রাত ৮টার বেশী বেজে গেল। কিন্তু আকাশে তখনও আলো। মনে হয় সন্ধা হবে হবে, অথচ ঘড়ির কাটা ৯ ছুই ছুই। সারা শহর যেন ঘুমিয়ে পড়েছে, এখানে ৭ টার পরই সব কিছু থেমে যায়।
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় এসে বসলাম। ধীরে ধীরে মনটা খারাপ হতে লাগল। এই তো, কালই সবার কাছে ছিলাম, আর আজ হাজার হাজার মাইল দূরে, দুনিয়ার ঠিক অপর প্রান্তে। বাবা মা, ভাই সবাই কে অনেক মিস করছিলাম। কিন্তু সবাইকে ফেলে আসা শুধু মাত্র একটা নিয়ন্ত্রিত জীবনের জন্য। কে জানে ভাগ্যে কি লেখা আছে।
শুধু জানি আমার ডাক এসেছে, আমি হাজির হয়েছি, এর বেশি কিছু বোঝার ক্ষমতা তো আমার নেই।
(শেষ)
ছবি: নিজ (টার্কিশ ডিলাইট, ইন্টারনেট)