আমার বিদেশ ভ্রমন - ৪ - কুয়েত
..সে প্রায় ১৬-১৭ বছর আগেকার কথা। লেখি লেখি করেও আর লেখা হয়নি। তো আজ ভাবলাম - লেখা শুরু করি, দেখি কতদূর যাওয়া যায়...
কুয়েত কেন জীবনে কোনদিন বাংলাদেশের বাইরে কোথাও পা দেয়া হয়নি। তাই প্রথমবার দেশের বাইরে দেশ - ব্যাপারটা খুব অদ্ভূত লাগছিল। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আমি আর আমার ছোট ভাই বিল্ডিং-এর সামনে সিড়িতে বসে রাস্তার গাড়ী চলাচল করা দেখছিলাম। দুপুরের দিকে রোদে মনে হচ্ছিল গা পুড়ে যাবে, কিন্তু সন্ধার পর তাপমাত্রা দেখলাম অনেক কমে এসেছে।
বাসার পাশেই একটা রেস্তোরা। খুব জমকালো কিছু না, আমাদের স্টার কাবাব বা কস্তুরীর মতো। জীবনে প্রথম শর্মা খেলাম - মনে হয় যেন এখনও সেরকম মজার শর্মা আর খাইনি। সেখানে আপনি পাবেন চিকেন শর্মা আর দুম্বার (ভেড়া) শর্মা। ওরা দুম্বা অনেক পছন্দ করে, কিন্তু দুম্বা তে এত গন্ধ! এক কামড়ের পর আপনার ক্ষিদে গায়েব হয়ে যাবে!
শর্মার দাম রাখল ২৫০ পয়সা। ওখানে ১০০০ পয়সা = ১ টাকা। আমাদের যেমন ১০০ পয়সায় ১ টাকা হয়। ওখানের পয়সাকে বলে 'ফিলস'। টাকাকে বলে কে.ডি. (কুয়েতী দিনার)। তো ১০০০ ফিলস = ১ কেডি। আর ১ কেডি = ১৬৫ টাকা। এখন সেটা বেড়ে দাড়িয়েছে ১ কেডি = ২৭৫ টাকা। তাহলে বুঝতেই পারছেন কারো পকেটে কুয়েতী ৫০ টাকা থাকা মানে বাংলাদেশী প্রায় ১৪০০০ টাকা! সেইরকম পার্থক্য।
আমাকে একটা নতুন মানিব্যাগ দেয়া হলো, আর তাতে চকচকে ১০কেডি, সেটা দেখে আমার চোখও চকচকে - এই ১০ কেডি দিয়ে কি কি করতে পারতাম - ১০০০ টা পেপসি কিনতে পারব। অর্থাৎ ২ টা বিয়ের মানুষ খাওয়ানোর কোক-পেপসি-স্প্রাইট কিনতে পারব

ওখানে সবাই একটি বিশেষ রুটি খায় এটাকে বলে 'খুবজ'। নান রুটির মতো, কিন্তু এত নরম নয়। এই রুটি ২টার বেশি খাওয়া অসম্ভব, ৪টা রুটির প্যাকেট পাওয়া যেত, ২০০ ফিলসে। সাথে কিছুর ঝোল হলেই পেটপুরে খাওয়া শেষ।
আরো দেখলাম মিস্টি বলে কিছু নাই। আমরা যেমন রসে ভেজানো মিস্টি খাই - ওখানে সবাই শুকনো একটা মিস্টি খায়, যেটা আমার কাছে খুব একটা সুবিধার মনে হয়নি।
চকলেট/আইসক্রিম/জুস/পেপসি/কোক - এসবের দাম ছিল সবচেয়ে কম, তো আমাদের জন্য কুয়েত ছিল স্বর্গের মতো। সারাদিন খালি চকলেট পেপসি খেতাম, আর দোকানে যাবার প্রয়োজন কম ছিল, কারন ওখানে সবাই বাল্কে (পাইকারী স্টাইলে) জিনিস কিনে। আমি নিজেও বোকা হয় গেছিলাম প্রথম প্রথম! বাবা বললেন "জুসের প্যাকেট একটা নিয়ে নাও", আমি নিলাম, উনি বললবেন "না না, পুরোটাই" মানে পুরো কার্টন - ২৪টাই। পুরো মাসের জুস একদিনেই কেনা। চকলেটের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। আর আমি যেহেতু প্রথম গিয়েছিলাম, এসবের দিকেই আমার নজর ছিল বেশী।

খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে তারা যে দিলদরিয়া, সেটা তাদের কেএফসি, পিজ্জাহাট-এ গিয়ে বুঝতে পারলাম। কোক একবার কিনবেন এরপর ফ্রি। তাও মানুষের সুবিধার জন্য কোকের ফাউন্টেন (যেখান থেকে আপনার গ্লাসে কোক ভরবেন) কাউন্টার থেকে দূরে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ আপনি কোক খেতে চাইলে বারবার কাউন্টারে যেতে হবে না। ফাউন্টেনের বোতামে চাপ দিয়ে নিজে নিজের গ্লাস ভরে নেবেন।
মানুষজন সব আলখাল্লা পড়েই ঘুরাঘুরি করত। মহিলারা দেখলাম কিছু বোরখা পরিহিত, কিছু ছোট স্কার্ট পড়া। মানে দেশটিতে দুইরকম সংস্কৃতির পরিচয় চোখে পড়ে। আর মহিলারা সেইরকম মেকআপ দিয়ে রাখত, সেই তুলনায় পুরুষদের অনেকটাই মার্জিত মনে হতো।
একটা মজার ব্যাপার দেখলাম - সবার গাড়ী আছে! মানে সবার! একদিন এক গাড়ী এসে বাসার সামনে থামল (আমি বাসার সামনে সিড়িতে বসে অনেক সময় পার করতাম)। তো গাড়ি থেকে এক লোক বার হয়েই আমার সামনে হাত পাতল - তারমানে ভিক্ষা করতে গাড়ী চালিয়ে এসেছে। এ কেমন দেশরে বাবা - ভয়ানক অবস্থা! তাকে আমি ২৫০ ফিলস দিয়েছিলাম, আমার শর্মা খাওয়ার পয়সা। সে খুব খুশি হয়ে কিসব বলল (গালি দিল কিনা সেটা সেমূহুর্ত বা এইমূহুর্ত - কোন মূহুর্তেই বোঝা গেলনা) - তারপর অন্য বাসা গুলোতে বেল বাজিয়ে ভিক্ষা শুরু করল!
ওখানে আরো মজার একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম সেটা হলো পুরোনো জিনিস ফেলে দেয়া। আপনি হয়ত কাজ শেষে বাড়ী ফিরছেন, হঠাৎ দেখবেন রাস্তার পাশে পড়ে আছে, ২৫ইন্চি এক টিভি সেট অথবা বিশাল বড় এক সোফা। কাছে গিয়ে পরীক্ষা করলেই দেখবেন সেগুলো বলতে গেলে নতুনই। আমরা যখন চলে আসি, আমরাও তখন কালো লেদারের একটি সোফা, ড্রেসিং টেবল, খাট রেখে আসি - যার প্রয়োজন সে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। আবার সেখানে "ফ্রাই-ডে মার্কেট" বলে একটা বাজার বসে। আপনি এই রকম সেকেন্ড হ্যান্ড বিভিন্ন জিনিস সেখানে পাবেন। বিশাল বড় এলাকা নিয়ে এই ফ্রাই-ডে মার্কেট বসত, দিন দুনিয়ার যা আছে সব পাবেন, তবে সেকেন্ড হ্যান্ড অথবা একটু অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের।
কুয়েতে যাবার আগে থেকেই জানতাম, ওখানে বাংলাদেশীরা খুব একটা ভালো নেই। ওখানে যেয়ে কিছু কিছু চোখেও পড়ল। একদিন খুব ভোরে ঘুম ভেংগে যাওয়ায় বারান্দায় দাড়িয়ে আছি, ভোর হবে হবে, এরপরও ভীষন গরম, সূর্য তখনও ওঠেনি। হঠাৎ দেখি একজন মানুষ রাস্তা দিয়ে আপন মনে হেটে আসছে, গায়ে খুব উজ্জল হলুদ/কমলা ইউনিফর্ম পড়া। তার হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ। উনি মাটির দিকে তাকিয়ে হাটছিলেন আর রাস্তা থেকে কাগজ, পেপসি ক্যান -এসব উঠিয়ে উঠিয়ে ব্যাগে ভরছিলেন। তার চেহারা স্পষ্টভাবে দেখিনি, তবে আমাদের দেশী হবার সম্ভাবনাই বেশি। শরীর ও গায়ের রং তো আমার মতোই ছিল। এতদূর দেশে এসে সকাল হতে না হতেই তাকে রাস্তায় নেমে যেতে হচ্ছে, ঘন্টার পর ঘন্টা এই গরমে সে হেটে বেড়াবে, আর ময়লা কুড়াবে, যাতে আমরা পরিস্কার রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে পারি। অথচ আমরা ময়লা ঠিক জায়গায় ফেললেই কিন্তু ঐ মানুষটার কষ্ট ৭০% কমে যাবে - কিন্তু না, আমরা আয়েশী মানুষ! আয়েশ করে এখানে-সেখানে ময়লা ফেলব, পরিস্কার করার জন্য তো এরা আছেই, ওর কষ্ট কমানোর জন্য আমরা আয়েশ করা ছাড়ব কেন???
হয়তো আয়েশ করলেই, সমাজে সম্মান বাড়ে!
(চলবে)
ছবি:গুগল
******************************************
আমার বিদেশ ভ্রমন - ১ - পূর্বকথা
আমার বিদেশ ভ্রমন - ২ - আকাশে উড়াউড়ি
আমার বিদেশ ভ্রমন - ৩ - উড্ডয়ন ও অবতরন
আমার বিদেশ ভ্রমন - ৪ - কুয়েত
******************************************
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৩:৫১