“It was as if God had decided to put to the test every capacity for surprise . . . to such an extreme that no-one knew for certain where the limits of reality lay. It was an intricate stew of truths and mirages that convulsed the ghost of José Arcadio Buendía with impatience and made him wander all through the house even in broad daylight.”
–Gabriel García Márquez, One Hundred Years of Solitude
জাদুবাস্তবতা এক ধরণের গোলমেলে রচনারীতি যা সবসময় দ্ব্যর্থক ও বিভ্রান্তিকর। জাদুবাস্তবতা সম্পর্কে ম্যাক্সিকান সাহিত্য সমালোচক লুই লীল ( Luis Leal ) যথার্থই বলেছেন, ” আপনি যদি ব্যাখ্যা করতে পারেন এটা কি , তাহলে তা জাদুবাস্তবতাই না।” কিন্তু বর্তমান বিশ্বসাহিত্যে জাদুবাস্তবতা জাজ্বল্যমান সত্য। ভীষণ জনপ্রিয়। তুমুল আলোচিত। প্রায়শঃই ভুল জিনিসকে জাদুবাস্তবতার লেবাস পরানো হচ্ছে। আমাদের দেশসহ অনেকেই ভুল করে দাবী করছেন জাদুবাস্তবতা অনেক আগে থেকেই চর্চা করা হচ্ছে।
জাদুবাস্তবতার শুরুর কথা
জাদুবাস্তবতা বা ম্যাজিক রিয়ালিজম কথাটি প্রথম উল্লেখ করেন ফ্রানৎস রোহ (১৮৯০-১৮৫৫)। এই জার্মান চিত্রকলা সমালোচক ১৯২৫ সালে তাঁর লেখা বই, ‘এক্সপ্রেসিওজমুসঃ মাগিশের রেয়ালিজমুসঃ প্রোবলেমে ডের নয়েস্টেন অয়রোপেইশেন মালেরাই’ (এক্সপ্রেশনিজমের পর ম্যাজিক রিয়ালিজমঃ নবীন ইউরোপীয় চিত্রকলার সমস্যাবলী)-তে এ কথার প্রথম সূত্রপাত করেন। চিত্রকলার বিবেচনায় রোহ জাদুবাস্তবতাকে বলেছেন, এটি-
১) পরিমিতিবোধ ও সুস্পষ্ট লক্ষ্যাভিমুখি; এর ভিশন আবেগহীন, ভাবালুতামুক্ত;
২) শিল্পী দৃষ্টি রাখবেন ছোটখাট গুরুত্বহীন বিষয়ের প্রতি; বিষয়গুলো অস্বস্তিকর হলেও তা নিঃসঙ্কোচে তুলে ধরবেন;
৩) এর কাঠামো হবে স্থির, ঘনবদ্ধ, কাঁচে ঘেরা জায়গার মতো; হতে পারে শ্বাসরুদ্ধকর, গতিময়তার বদলে স্থিতিশীলতাই বেশি কাম্য;
৪) চিত্র অঙ্কনপদ্ধতি হবে সম্পূর্ণ নতুন, আগের কোন ছবি আঁকার ধাঁচের বা হস্তশিল্পের ছাপ তাতে থাকবেনা;
৫) এতে থাকবে বস্তুজগতের সাথে এক নতুন আধ্যাত্মিক সম্পর্ক।
রোহর ধারণা অনুযায়ী জাদুবাস্তবতা পোস্ট-এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকলার সমার্থক। সে সব ছবিতে দৈনন্দিন জীবনের রহস্যজনক উপাদানের প্রাধান্য থাকায় ছবিগলোকে রোহ কুহকাচ্ছন্ন বলে বিবেচনা করেছেন এবং ছবির নব্য বস্তুনিষ্ঠতা হিসাবে একে বর্ণনা করেছেন। ম্যাগি এন বাউয়ার্সের মতে, ১৯৫৫ সালে সাহিত্যসমালোচক এনজেল ফোর্স ’আমেরিকান স্প্যানিশ উপন্যাসে জাদুবাস্তবতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে জাদুবাস্তবতার কথা সাহিত্যরীতি হিসাবে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করেছিলেন।
জাদুবাস্তবতা কি ?
উইকির মতে, জাদুবাস্তবতা এমন এক ধরণের সাহিত্যরীতি যাতে জাদুর উপকরণ অপরবাস্তব জগতের অপরিহার্য অংশ। যে রীতি চলচ্চিত্র এবং চিত্রকলায়ও ব্যবহৃত হয়। প্রফেসর ম্যাথু স্ট্রেচের মতে, “What happens when a highly detailed, realistic setting is invaded by something too strange to believe.” জাদুবাস্তবতার আরেক বিখ্যাত লেখক আলেহো কার্পেন্তিয়ার তাঁর বই ’ এল রেইনো দে এস্তে মুন্দো’র ভূমিকায় বলেছেন, জাদুবাস্তবতা পাঠকের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটা জিনিস গল্পে নিয়ে আসে। তার ফলে বাস্তব পৃথিবীর ঐশ্বর্য অবাস্তবের সামনে ধ্বসে পড়ে। মার্কেস বলেছেন, ’আমরা যে বাস্তবকে দেখি, তার পেছনে যে ধারণাটা আছে সেটাই জাদুবাস্তবতা।’ কলম্বিয়ার তরুণ ঔপন্যাসিক প্লিনিও আপুলেইয়া মেন্দোসাকে দেয়া এক সাাৎকারে মার্কেস বলেছিলেন, ’একশ’ বছরেরর নিঃসঙ্গতা বা অন্য যেকোন বইয়ের কথাই বলুন, আমার লেখার প্রতিটি লাইন খাঁটি বাস্তব থেকে উৎসারিত। আমি শুধু একটি আতসকাঁচ দিই যাতে পাঠক বাস্তবকে ভালোভাবে বুঝে নিতে পারেন। আপনাকে ছোট একটা উদাহরণ দিই। সরলা এরন্দিরা গল্পে আমি দেখাই উলিসেস কোন কাঁচ ছুঁলেই সেটা অনবরত রং বদলাতে থাকে। এটা তো আর সত্যি সত্যি ঘটে না। কিন্তু প্রেম সম্বন্ধে আগেই বহু কথা বলা হয়ে গেছে বলেই ছেলেটি যে প্রেমে পড়েছে সেটা বলার জন্য আমাকে নতুন একটা প্রকাশভঙ্গী উদ্ভাবন করতে হয়েছিলো। কাজেই আমি দেখাতে থাকি কাঁচের রং পাল্টে যাচ্ছে, আর তার মায়ের জবানীতে বলাই, ওসব জিনিস হয় কেবল প্রেমে পড়লেই... মেয়েটি কে, শুনি। অজস্ররবার বলা হয়ে গেছে প্রেম কেমন করে জীবনকে ওলটপালট করে দেয়। আমিও সে কথাই বলতে চাইছি। শুধু আমার বলার ধরণটা অন্যরকম।’ সহজভাবে বলা যায়, বাস্তব পার্থিব কাঠামোর সাথে ফ্যান্টাসির উপাদান মিলে তৈরি হয় জাদুবাস্তবতা। কিংবা এমন একটা ছবির কথা কল্পনা করুন যে ছবির চার ধার থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়ে ছবিটিকে অপার্থিব এক মহিমা দিচ্ছে যাকে মনে হয় অন্য কোন পৃথিবী থেকে আসা অলীক সৌন্দর্যের আধার। এটা এমন একটা জাদুময় অনুভূতি, যাতে মনে হবে যে কোন কিছুই ঘটা সম্ভব।
M.H. Abrams এর A Glossary of Literary Terms-এ বলা হয়েছে, ““The term magic realism, originally applied in the 1920s to a school of painters, is used to describe the prose fiction of Jorge Luis Borges in Argentina, as well as the work of writers such as Gabriel García Márquez in Colombia, Gunter Grass in Germany, and John Fowles in England. These writers interweave, in an ever-shifting pattern, a sharply etched realism in representing ordinary events and descriptive details together with fantastic and dreamlike elements, as well as with materials derived from myth and fairy tales. Robert Scholes has popularized metafiction as an overall term for the large and growing class of novels which depart drastically from the traditional categories either of realism or romance, and also the term fabulation for the current mode of free-wheeling narrative invention. These novels violate, in various ways, standard novelistic expectations by drastic -- and sometimes highly effective -- experiments with subject matter, form, style, temporal sequence, and fusions of the everyday, the fantastic, the mythical, and the nightmarish, in renderings that blur traditional distinctions between what is serious or trivial, horrible or ludicrous, tragic or comic.”
কোনটা জাদুবাস্তবতা নয়
জাদুবাস্তবতা আসলে এক ধরণের রচনারীতি যাতে অনেক বিষয়কে নতুন করে নতুন ভঙ্গিতে বর্ণনা করা হয়েছে। এ রীতিকে প্রায়ই মিলিয়ে ফেলা হয় অতিপ্রাকৃত, উদ্ভট, আজগুবি ঘটনার সাথে। রূপকথাকেও এর সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়। তাই খোলাসা করে বলা দরকার কি কি জিনিস জাদুবাস্তবতা নয়।
ফ্যান্টাসি
যে গল্পের পটভূমি, বর্ণনা সবকিছু আমাদের বাস্তব পৃথিবীর বাইরের কোন কল্পলোকের প্রেক্ষাপটে সেটাই ফ্যান্টাসি। যদি জাদু সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে গল্প বলা হয় সেটা জাদুবাস্তবতা নয়। লিন্ডসে মুরের মতে, জাদুবাস্তবতার সাথে ফ্যান্টাসির পার্থক্য হচ্ছে জাদুবাস্তবতা স্বাভাবিক ও আধুনিক পৃথিবীর মানুষ আর সমাজের বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনার প্রেক্ষাপটে স্থাপিত।
রূপকথা ও লোকসাহিত্য
রূপকথা আর লোকসাহিত্যও জাদুবাস্তবতা নয়। যদিও এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু উপাদান একই, লেখার ভঙ্গিতেও কিছু মিল আছে। আলবার্তো রাইওর মতে, জাদুবাস্তবতা যদিও রূপকথার একটি উপাদান তারপরও জাদুবাস্তবতার মধ্যে যেটা অসম্ভব সেটাকেও বাস্তব মনে হয়। সেটাকে ভিন্ন ভঙ্গিতে বলা হয়।
পুরান বা মিথলোজি
পুরান বা মিথোলোজি জাদুবাস্তবতা নয়। কোন কাহিনীতে গ্রীক বা রোমান মিথলোজির কোন দেবদেবীর কথা থাকলেও সেটা জাদুবাস্তবতা নয়। যদিও এককালে সেসব সেবদেবী বাস্তবসম্মত বলে তাঁদের প্রতি বিশ্বাসীদের কাছে বিবেচিত হতেন। এখন তা বাস্তব সম্মত বিবেচিত হয় না বলেই সেটা আর জাদুবাস্তবতা বলে গন্য হয় না। তবে বিশেষ কোন কিংবদন্তী জাদুবাস্তবতা বলে গন্য হতে পারে।
সায়েন্স ফিকশন
জাদুবাস্তবতা ভবিষ্যতবাদী নয়। জাদুবাস্তবতা মহাকাশ কিংবা এলিয়েন কোন গ্রহকে ঘিরে রচিত হয় না। কোন জাদুকে যদি বিজ্ঞানের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হয় তবে সেটা আর জাদুবাস্তবতা থাকেনা। সেটা হয়ে যায় সায়েন্স ফিকশন।
এছাড়া পরাবাস্তব, অতিপ্রাকৃত, আধিভৌতিক বা হরর গল্পও জাদুবাস্তবতা নয়।
জাদুবাস্তবতার উপাদান
আলবার্তো রাইও’র মতে জাদুবাস্তবতায় জাদু শব্দের আরেকটি অর্থ ’বিস্ময়কর’ যা বাস্তবতাকে বিশেষভাবে প্রতিপন্ন করে, সেটা বাস্তবতাকে বিকৃত বা প্রতিস্থাপন করে না। জাদু শব্দটি মানুষের কাছে বিস্ময়বোধক, তা ক্ষণিকের জন্য হলেও মানুষের মনে থাকা অবিশ্বাসের দোলাচলকে থামিয়ে দেয়। শ্যারন ব্লিসের মতে, জাদুবাস্তবতা শব্দের মধ্যে জড়িয়ে থাকা ’বাস্তবতা’ একটা বড়োরকমের ভূমিকা পালন করে। গল্পের প্রাথমিক প্লটটি বাস্তব পৃথিবীর বাস্তব কোন বিষয়বস্তুকে ঘিরে গড়ে উঠলেও এর ভেতর ফল্গুধারার মতো বয়ে চলে জাদু।
গল্পের মধ্যে জাদুবাস্তবতা সৃষ্টি হয় যেসব উপাদানকে ঘিরে সেগুলো হচ্ছে-
Setting বা পারিপার্শ্বিকতা
জাদুবাস্তবতায় গল্পের পটভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। জাদুবাস্তব গল্পের কাহিনী যেকোন বাস্তব জায়গার পটভূমিতে গড়ে উঠতে পারে। এ ধবরণের বেশির ভাগ গল্প লেখা হয়েছে গ্রামীণ বা ছোট শহরের পারিপার্শ্বিকতাকে অবলম্বন করে। বড়ো শহর বা নাগরিক পারিপার্শ্বিকতায় লেখা যেতে পারে জাদুবাস্তব গল্প।
গল্পের চরিত্র
দৈনন্দিন জীবন থেকে বেছে নেয়া সাধারণ গড়পরতা মানুষেরাই হবেন জাদুবাস্তব গল্পের চরিত্র। এমন মানুষজন যাদের সাথে পথেঘাটে চলার সময় বা মুদিদোকানে কেনাকাটার সময় দেখা হয়ে যায়। তাঁরা শুধুই মানুষ- আটপৌরে, সহজসরল। তাই বলে তাঁরা বৈশিষ্ট্যহীন মানুষ হবেন না। প্রত্যেকের মধ্যেই এক ধরণের স্বাতন্ত্র্য থাকবে।
অদ্ভুত বা চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য (Fantastical Elements)
বলাবাহুল্য, জাদুবাস্তব গল্পের অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে অদ্ভুত বা চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য। সেটা সময়, স্থান বা চরিত্রের মধ্যে মিশে থাকতে পারে। এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর একটি। এ বৈশিষ্ট্য ছাড়া গল্প হয়ে পড়বে নিছক বাস্তব ঘটনার বিবরণমাত্র। চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যের একটি উদাহরণ দেয়া যায়- এলিস হফম্যানের ’রাতেরপাখি’ বইতে আছে কয়েক প্রজন্ম আগের এক অভিশাপের কারণে একটি পরিবারের সব ছেলে শিশু দু’টি ডানাসহ জন্মাচ্ছে।
প্লট
জাদুবাস্তব কাহিনীর মূল বৈশিষ্ট্য হলো এতে দৈনন্দিন ঘটনাবলী এমনভাবে তুলে ধরতে হবে, যাতে অসাধারণসব ঘটনা ঘটতে থাকবে। সেটা আবার বড়ো বড়ো ঘটনার বর্ণনা নয়, যে সব ঘটনা জীবন বা ইতিহাসের বাঁক ফিরিয়ে দেয়। যেমন ’বিগফিস’ বইয়ের সাধারণ ফেরিওয়ালার জীবনের চেয়ে ঘটনাবলীকে বড়ো করে দেখানো হয়েছে। সব রকমের আজিব, পাগলামীভরা কান্ডকীর্তি ঘটছে, কিন্তু সেটাকে সাধারণ দৈনন্দিন কাজের সাথে মিলিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
সময়
গল্প বলার সময় হঠাৎ ’সময়’ থমকে দাঁড়াবে, আবার তা চলতে আরম্ভ করবে। জাদুবাস্তবতার গল্পে সময়কে জলের স্বভাবে পেয়ে বসে। সময় সেখানে সরলরেখা ধরে প্রবাহিত হয় না। একমুখীও নয়। এফ. স্কট ফিটজেরাল্ডের গল্পের চরিত্র বেনজামিন বাটনের জীবনে সময় উল্টো পথে চলেছে, সে বৃদ্ধ হিসাবে জন্ম নিয়ে শিশু হিসাবে মৃত্যুবরণ করেছে। ব্রুস হল্যান্ড রজার্সের ভাষায়, জাদুবাস্তবতার পৃথিবীতে সময় সর্বদা সামনে চলে না, বহু দূরের অতীতকাল প্রতি মুহূর্তে হাজির থাকে, ভবিষ্যৎ ইতোমধ্যেই অতিবাহিত হয়ে গেছে। গল্পের বর্ণনায় সময়ের ধারাক্রমকে সময়ের বাইরে স্থাপন করা হয়। আলবার্তো রাইও’র মতে জাদুবাস্তবতার গল্পে সময় প্রায়শঃই সবকিছু, কিন্তু ঘড়ি মূল্যহীন। ঘড়ির মিনিটের কাঁটার জায়গায় নিঃশ্বাস আর ঘন্টার কাঁটার জায়গায় হাই তোলার ছন্দকে বসিয়ে দেয়া হয়।
স্বর ও আবহ (Tone & Atmosphere)
আলবার্তো রাইও’র মতে জাদুবাস্তবতায় গল্প বলার স্বরভঙ্গিটাই সব। অসাধারণ ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয় অতিসাধারণ ভাষায়, কোন বিস্ময়সূচক যতিচিহ্ন ব্যবহার করা হয় না। বিষয়টা যখন বিশাল তখন তা বলা হয় নিচুস্বরে, ঘটনা যখন তুচ্ছ তখন তার বর্ণনা দেয়া হয় ফুলিয়ে ফাঁফিয়ে। এই সব মিলিয়ে বইয়ের বর্ণনার জন্য একটা স্বর ঠিক করে নেয়া হয়, সারা বইতে সে আবহটা বজায় থাকে।
সাহিত্যিক স্টাইল (Literary Style)
জাদুবাস্তবতার গল্প বিশেষ সাহিত্যিক স্টাইলে লেখা হয়। বর্ণনার জন্য অদ্ভুত সুন্দর ভাষা ব্যবহার করা হয় যার শৈলী ও শিল্পরূপ পাঠক মনে ইন্দ্রজাল বিস্তার করে। একটা সাদামাটা গল্পকে জাদুবাস্তব গল্পে এমনভাবে বলা হয় সেটা সত্যিকারের বিশেষ ধরণের গল্পে পরিণত হয়। এতে প্লটের চেয়ে ভাষা আর স্টাইলের ওপর বেশি জোর দেয়া হয়। মার্কেস যেমন গল্প বলার সময় তাঁর দাদীর গল্প বলার স্টাইল অনুসরণ করেছেন।
বাকসংযম (Authorial Reticence)
জেই আর্চার ডেভিসের মতে, ’গল্পের টেক্সটে বর্ণিত ঘটনাকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য কথক কোন ব্যাখ্যা যুক্ত করেন না। কথক এক্ষেত্রে নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব বজায় রাখেন। গল্প এগিয়ে চলে যুক্তির স্পষ্টতার পথ ধরে, যেন অন্যরকম কোন ঘটনাই ঘটেনি।’ কি ঘটতে চলেছে সেটা গল্পের চরিত্ররা বা কথক পাঠকের চেয়ে বেশি জানবেন না। ঘটনার সাথে সাথে বিষয়গুলো চরিত্রদের কাছে পর্যায়ক্রমে খোলাসা হবে। লেখকের বাকসংযম হলো সেটা, যখন লেখক গল্পের পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কিত তথ্য নিজের কাছে রেখে দিয়ে পাঠককে ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্টতার ভেতর রেখে দেন। ফলে গল্পের মধ্যে এক ধরণের চমকের সৃষ্টি হয়। লেখক চরিত্র আর পাঠকদেরকে আঁধারে রেখে গল্পের মধ্যে একটা সদাপ্রবহমান রহস্যময়তা রেখে দেন।
অভ্যন্তরীণ যুক্তিশৃঙ্খলা (Internal Logic)
জাদুবাস্তবতার গল্পে কখনো জাদুর কোন ব্যাখ্যা থাকেনা। তাই গল্পের চরিত্ররা যে দুনিয়ায় বাস করে সেখানে সদাঘটমান রহস্যময় কান্ডকারখানার মধ্যে একটা অভ্যন্তরীণ যুক্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হয় গল্পের সামগ্রিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য। স্বভাবতঃই জাদুর মধ্যে যুক্তির ঠাঁই নেই। তাই পুরো গল্পকে একটা মূল কাঠামোর আওতায় রাখার জন্য একটা যৌক্তিক শৃঙ্খলা রাখতে হয়, যাতে ঘটনাবলী পরষ্পরবিরোধী না হয়।
অন্যান্য উপাদান
জাদুবাস্তবতার গল্পে কাকতালীয় কোন ঘটনা থাকতে পারবে না। গল্পের সামগ্রিক সংহতির ভেতর কাকতালীয় কোন উপাদান খাপ খায়না। তাই সবকিছুকে একটা বৃহত্তর সমগ্রতায় গ্রথিত রাখতে হয়। সাধারণ একটা থিমকে মাথায় রেখে লিখতে হয়। জাদুবাস্তবতার গল্পে নিজস্ব একটা অর্থ কাঠামো তৈরি হয়ে যায়। ঘটনার পরম্পরার মাধ্যমে সেই অর্থকাঠামো সাযুয্য অর্জন করে। খোলামেলা বর্ণনা না দিয়ে অর্থের ভেতরে সূক্ষ্ম নিগূঢ় অর্থ চারিয়ে দেয়া হয়।
সমাপনী
জাদুবাস্তবতার কোন সুনির্দিষ্ট অর্থ বা ব্যাখ্যা নেই। এই অস্পষ্টতার কারণে জাদুবাস্তবতা নিয়ে পন্ডিতে পন্ডিতে কথার লড়াই লেগে যায়-কোনটায় জাদুবাস্তবতা আছে আর কোনটায় জাদুবাস্তবতা নেই। যে সব বইতে জাদুবাস্তবতা আছে বলে বেশিরভাগ পন্ডিত স্বীকার করেন সেগুলো হচ্ছে, নোবেলজয়ী লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ’শত বছরের নীরবতা’ ও ’কলেরার সময়কার ভালোবাসা’; মাইকেল বুলগাকভের ’ দি মাস্টার এন্ড মার্গারিটা’; ইসাবেলা আয়েন্দের ’ দি হাউজ অব দা স্পিরিটস’; নোবেলজয়ী লেখিকা টনি মরিসনের ’বিলাভড’; হারুকি মুরাকামি’র ’দি উইন্ড-আপ বার্ড ক্রনিক্যল’; সালমান রুশদির ’মিডনাইটস চিলড্রেন’ ইত্যাদি।
কেউ যদি বুঝতে চান তাঁর লেখাটিতে জাদুবাস্তবতা আছে কিনা, তার জন্য কয়েকটি প্রশ্নের জবাব খোঁজা যেতে পারে। যেমন- গল্পের ঘটনাবলী কি পৃথিবীর কোন বাস্তব স্থান ও সময়ে ঘটেছে ? গল্পটি সাধারণ জীবনযাপনকারী সাধারণ মানুষকে ঘিরে লেখা ? তাতে কি চমকপ্রদ উপাদানের/ঘটনার সমাহার ঘটেছে ? এসব উপাদানকে কি স্বাভাবিক জীবনযাপনের অংশ বলে মনে হয় ? চমকপ্রদ আর জাদুকরী ঘটনাবলী কি যুক্তি আর বিজ্ঞান দিয়ে অব্যাখ্যাত রাখা হয়েছে ? উপাদানগুলোকে কি সূক্ষ্ম নিগূঢ়তা দেয়া হয়েছে এবং সেগুলো উপস্থিতিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ? চমকপ্রদ উপাদানগুলো বাস্তব না অবাস্তব সে বিষয়ে পাঠকের মনে কি সন্দেহ জাগে ?
এই প্রশ্নগুলো উত্তর যদি ’হ্যাঁ’ হয় তাহলে আপনার লেখায় জাদুবাস্তবতার লক্ষণ আছে বলে ধরে নেয়া যায়। কিন্তু জাদুবাস্তবতাকে এটুকু দিয়েই চূড়ান্ত করাও বিপজ্জনক। কারণ কুহকাচ্ছন্ন ’জাদুবাস্তবতা’ স্বয়ং চিরবিতর্ক আর মতভেদের গন্ডিতেই গোড়া থেকে বসবাস করেন।
প্রবন্ধটি 'সাহিত্য আড্ডা'র ১১ মার্চের আড্ডায় পঠিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৬ রাত ৯:৩৩