বাংলা একাডেমি সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধানে প্রযুক্তি শব্দের তিনটি মানে দেয়া আছে- ১.প্রয়োগ। ২.প্রকৃষ্ট যুক্তি। ৩.শিল্প প্রভৃতিতে প্রয়োগ করবার কৌশল। এর ইংরেজিটা সবার জানা। আমরা প্রযুক্তির চেয়ে টেকনোলোজি বলতে ভালোবাসি। আমরা অভিধানের তৃতীয় মানেটাই নিই প্রথমে।
প্রযুক্তি বলতে আমাদের চোখে যন্ত্রপাতিই ভেসে ওঠে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সবখানে যে বিজ্ঞানের জয়জয়কার সেটা বিজ্ঞানকে প্রযুক্তির ছাঁচে ফেলার ফল। আজকাল তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের সবচেয়ে প্রিয় বিষয়।
তাহলে ভাষার সাথে প্রযুক্তির সম্পর্ক কোথায় ? ভাষার ক্ষেত্রে আমি অভিধানের প্রথম মানে তথা প্রয়োগকে বোঝাচ্ছি। আধুনিক সব ভাষার সবচেয়ে বড়ো গুণ হচ্ছে সবক্ষেত্রে তার প্রয়োগযোগ্যতা। যে ভাষা কবি,গীতিকার,বিজ্ঞানী,হিসাবরক্ষক,কৃষক,কামার,কুমার,জেলে অর্থাৎ সবমানুষের ভাবপ্রকাশ আর পেশাগত দরকার মেটাতে পারে সেটাই আধুনিক ভাষা। ভাষার এই কাজের দিকটির পাশাপাশি একটা আবেগের দিকও রয়েছে। মাতৃভাষাকে পৃথিবীর সব জাতিই আপন প্রাণের মতোই ভালোবাসে। কেউ কেউ প্রাণের চেয়েও বেশি। তাই যুগে যুগে বহু জাতির ভাষাপ্রেমিক সন্তানরা ভাষাকে বাঁচাবার জন্য লড়াই করেছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সবসময় দখলকৃত ভূখণ্ডে তার ভাষা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। কখনো সফল হয়েছে, কখনো ব্যর্থ হয়েছে। কখনো কখনো ভাষা দখলে সফল হলেও স্থানীয়দের ভাষা প্রেমের কারণে, লড়াই আর রক্তদানের ভেতর দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের চাপিয়ে দেয়া ভাষা হার মেনেছে।
রোমান সাম্রজ্যের সবখানে রোমানদের রাজভাষা ল্যাটিন চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো। গ্রীক, জার্মান, ফরাসি, স্পেন সব জাতিই শেষ পর্যন্ত আপন আপন ভাষাকে টিকিয়ে রেখেছে। রোমান সাম্রাজ্যের তুলনায় গ্রীকরা সাম্রাজ্য কিছুটা বেশি বাড়াতে পেরেছিলো। প্রকৃতপক্ষে প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় তথা বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ছিলো আরবরা। এশিয়া, আফ্রিকা হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো আরবদের সাম্রাজ্য। ফলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দেশের দাপ্তরিক ও ব্যবহারিক ভাষা আরবী। আবার আরবী থেকে মাতৃভাষায় ফিরে যাবার নজীরও আছে। পারস্য তথা ইরানে তিনশ' বছর আরবী ছিলো রাজভাষা। এরপর আবার প্রাচীন পারস্যের পাহলভী ভাষাই ফারসি হিসাবে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। সেলজুক রাজবংশের জালালুদ্দীন মালিক শাহ, লাহোরের কাদির খান আর গজনীর সুলতান মাহমুদের আনুকূল্যে ফারসি ইরান থেকে শুরু করে মুসলিম শাসনামলে ভারতবর্ষের রাজভাষায় পরিণত হয়েছিলো। তার ফল হিসাবে ফারসি ভাষা পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে ফেরদৌসী, শেখ সাদী, খৈয়াম, হাফিজ, রুমি, জামীর মতো মহাকবিদের। এটা মাতৃভাষার প্রতি চরম ভালোবাসার সুফল।
এখন যে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির স্বর্ণযুগে বিশ্বপল্লীতে বাস করছি। তারপও বিশ্বজুড়ে মাতৃভাষারপ্রতি ভালোবাসা আরো জোরালো হয়েছে। সবাই নিজ নিজ কাজে মাতৃভাষাই ব্যবহার করছে। এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য ব্যবসাবাণিজ্য, লেখাপড়া সব বিষয়ে বৈশ্বিক যোগাযোগের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা। সেই যোগাযোগের পথে মূল বাধা হলো ভাষা।
এই সমস্যার সমাধান হলো ভাষাপ্রযুক্তির ব্যবহার। পুরো জাতিকে মাতৃভাষার বদলে রাজভাষা (!?) শেখাবার চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। প্রায় সাত শ' বছরের চেষ্টায় ফারসি চাপিয়ে দিয়ে আমাদেরকে যেমন মাতৃভাষা ভোলানো যায়নি, তেমনি দুই শ' বছরের চেষ্টায় ইংরেজিও চাপানো যায়নি। কিন্তু বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা শেখার প্রচলনও গতি পাচ্ছে। বিষয়টা হচ্ছে পুরো দেশকে অন্য ভাষা শেখানোর বদলে যার যে ভাষা দরকার সে সেই ভাষা নিজ গরজেই শিখছে। আমাদের দেশ থেকে রাশিয়া, জার্মানি বা চীন-জাপানে পড়তে গেলে আগে সে দেশের ভাষা শিখতে হয়। কোন পেশাজীবী যদি চীন কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে চান তিনি সেই ভাষা শিখবেন।
এর একটা প্রাতিষ্ঠানিক প্রচলনও দরকার। বড়ো বড়ো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার জন্য নানা রকমের পেশাজীবী দরকার হয়। তারা তাদের অফিসে নানা বিভাগ খুলে সেখানে দক্ষ পেশাজীবীদের নিয়োগ দেন। জনসম্পদ বিভাগ, প্রশাসন বিভাগ, হিসাব বিভাগ, অর্থ বিভাগ, জনসংযোগ বিভাগ ইত্যাদি নামে বিভাগ থাকে। যে সব প্রতিষ্ঠান আমদানি বা রপ্তানি বাণিজ্যে অংশ নিতে চান তারা নতুন করে খুলবেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক যোগাযোগ বিভাগ। যে দেশে ব্যবসা করতে চান সেই দেশের ভাষা শিখবেন সেই বিভাগের কর্মীরা। এভাবেই ভাষা একটি প্রযুক্তি হয়ে উঠবে। ফলে মাতৃভাষার প্রতি আবেগ-ভালোবাসা যেমন অক্ষত থাকবে তেমনি আর্থিক উন্নতিতেও কোন সমস্য হবে না।
আকেটি বিকল্প হতে পারে নানা ভাষায় দক্ষ পেশাজীবীদের নিয়ে নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা। তারা বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভাষাগত সহায়তা দেবে ফি-র বিনিময়ে। ব্যক্তিও এই সেবা কিনবেন। এখনো এটা চলছে। ঢাকার নানা জায়গায় বিভিন্ন কাগজ অনুবাদ ও প্রত্যয়ন করা হচ্ছে।
এখন সময় এসেছে এভাবে ভাষা প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াবার।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ২:৪০