প্রবাসীদের নিয়ে আরেক প্রস্থ
বাংলাদেশী প্রবাসীদের সম্পর্কে কারো কারো বিরূপ মনোভাব চোখে পড়লো। দু'একজন বললেন, তোমরা তো আমাদের দেশ থেকে অনেক রেমিটেন্স নিয়ে যাচ্ছ। এর জবাবে বললাম, আমাদের ছেলেদের কঠোর পরিশ্রমে তোমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। আমাদের ছেলেরা বরং অনেক কম বেতনে তোমাদের অর্থনীতির জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে। তখন চুপ মেরে গেছে।
তবে বাংলাদেশী কর্মী নেয়ার ব্যাপারে সুসংবাদ চোখে পড়লো না। বলা যায় বরং দু:সংবাদ। আমরা থাকা অবস্থায় মন্ত্রীসভার বৈঠকে বাংলাদেশী অবৈধ কর্মীদের বৈধকরণ ও আরো কর্মী নেবার বিষয়টি উঠেছিলো। কিন্তু মন্ত্রিসভা একমত হতে পারেনি। ফলে সিদ্ধান্ত ছাড়াই বিষয়টি ঝুলে গেছে।
খোঁজ খবর করে যেটুকু জানা গেছে অনেকগুলো বিষয় মিলে আমাদের শ্রমবাজারকে বিপদে ফেলেছে। একটা কারণ আমাদের কর্মীদের কারণে তাদের কিছু সামাজিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমাদের ছেলেদের সুন্দর চেহারা আর ব্যবহারে মালয়ী মেয়েরা পটে যায়। এই সুযোগে অনেকে বিয়ে করে কয়েকটি সন্তানসহ মেয়েটিকে ফেলে দেশে চলে এসেছে। আর কোন যোগাযোগ করেনি। অনেকে বিবাহিত হওয়া সত্বেও নিজেকে অবিবাহিত পরিচয় দিয়ে বিয়ে করেছে। সন্তানসহ মেয়েটিকে ফেলে চলে এসেছে। এই সব কারণে সরকারী পর্যায়ে অনেক ক্রোধ জমেছে। অনেক অবৈধ কর্মীকে সরকারের মন্ত্রী পর্যায়ের অনুরোধে বৈধ করা হয়েছে। শর্ত দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ সরকার আর যাতে কোন অবৈধ প্রবেশ না ঘটে সেটা নিশ্চিত করবে। এর পেছন দিয়ে হাজার হাজার অবৈধ কর্মী প্রবেশ করেছে। ফলে এটা নিয়ে মালয়ী সরকার ক্ষুব্ধ হয়েছে। ওআইসি'র মহাসচিব পদ নিয়ে মালয়েশিয়ার অনুরোধ উপেক্ষা করে বাংলাদেশ প্রার্থী দেওয়া নিয়েও মালয়েশিয়া কর্মী নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আরেকটা কারণ আছে যেটা মধ্যপ্রাচ্যেও আমাদের শ্রমবাজারকে ব্যাহত করছে সেটা হলো বাংলাদেশ সম্পর্কে অপপ্রচার। অন্য যে সব দেশ কর্মী পাঠাতে চায় তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে অপপ্রচার বা অতিরঞ্জিত প্রচার করে বাংলাদেশের শ্রমবাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
কর্মীদের আরেক বিপদ হলো এজেন্টরা। নানাভাবে কর্মীদের ঠকায়। হয়তো বেতন ৩ হাজার রিঙ্গিত। মালিকের সাথে এজেন্টের মৌখিক চুক্তি হয় কর্মীকে দেড় হাজার রিঙ্গিত দিয়ে বাকী বেতন এজেন্ট আর মালিক ভাগাভাগি করে নেয়। মালিকরা এই অবৈধ আয়ে উৎসাহী হয় বিশেষত: চীনা মালিকরা। ওখানকার ব্যবসাবাণিজ্যে চীনাদের প্রভাব অনেক বেশী। এই সব প্রতারিত কর্মীদের অসহায় দীর্ঘশ্বাসে ক্রমাগত ভারী হচ্ছে মালয়েশিয়ার বাতাস।
একজন আলমগীর
মালয়েশিয়ায় অনেক বাংলাদেশী স্থায়ী হয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করে বেশ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তাদের কেউ কেউ ২০/৩০ বছর ধরে সেখানে আছে। অনেকে মালয়ী মেয়ে বিয়ে করে সেখানে থেকে গেছে। আমি একজনকে জানি এবার রমজান উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে ৫ টন মুড়ি নিয়ে গেছে ওখানে বিক্রির জন্য। নানা ক্ষেত্রে অনেকে ভালো ব্যবসা করছেন। আমার সহকর্মীর মাধ্যমে আলমগীর নামে একজনের সাথে পরিচয় হলো। এক বিকেলে আলমগীরের সাথে তার গাড়ীতে ঘুরে বেড়ালাম। ত্রিশ বছর আগে ওখানে গেছেন কুমিল্লার এই ভদ্র লোক। শুরুতে অনেক সংগ্রাম করেছেন। দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে থেকেছেন। এখন তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক। অনেক ব্যবসা আছে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মাদাগাস্কার আর বাংলাদেশে। স্ত্রী মালয়ী। ৫ ছেলে ১ মেয়ে তাদের। ডুপ্লেক্স বাড়ী কিনেছেন কুয়ালা লামপুরের সব চেয়ে অভিজাত এলাকা ভ্যালেন্সিয়াতে। একটি ১৮ হোলের পূর্ণাঙ্গ গলফ কোর্সের ভেতর পাহাড়ের ঢালে অনেকগুলো বাড়ীর একটি তার। বাড়ীর ভেতরের বৈভব দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। তার গাড়ীর সংখ্যাই ১২টি। আমাদের হোটেল থেকে নিয়ে গেছেন মার্সিডিজ গাড়ীতে। ফিরিয়ে দিয়ে গেছেন বিএমডাব্লিউতে করে। এছাড়া আছে প্রাডো, টয়োটা ফরচুনার, হোন্ডা সিআরভি জীপ, আলফার্ড মাইক্রো আর বাকীগুলো মালয়েশীয় গাড়ী। একজন ড্রাইভার নিয়েছেন বাংলাদেশ থেকে। তাকে ডিউটি শেষে বাড়ী যাবার জন্য একটা গাড়ী দিয়ে রেখেছেন। নিজে ড্রাইভ করেন। তার স্ত্রী পুত্ররাও নিজ গাড়ী ড্রাইভ করেন। এবার নিজ এলাকা থেকে হাজার দেড়েক ছেলেকে মালয়েশিয়া নেবার কাজ শুরু করেছেন। এই একজন আলমগীর আমাদের দেশের জন্য সংগ্রামী বিজয়ীর সুনাম বয়ে এনেছেন। এখানেই আমাদের আশার ক্ষীণ আলোর রেখা দেখতে পাই।
সমাপনী
আমাদের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে উপসচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা। ইন্জিনিয়ার আসরি ছিলেন। আর ছিলেন বড়ো বড়ো বিজনেস হাউজের কর্তারা। উইসমা পুত্রার সেই কর্মকর্তার প্রতি সবার সেকি সমীহ !
প্রধান অতিথি
সমাপনী ছবি
সাবই পরষ্পরের কাছে বিদায় নিলাম। ঠিকানা বদল করলাম। আবার কোথাও দেখা হবে এই ক্ষীণ আশা মনে নিয়ে বেরিয়ে এলাম।
সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা
পিএসডিসির প্রেসিডেন্ট ইন্জিনিয়ার আসরি সালোমা বিস্ত্রো রেস্তোরায় আমাদের সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করলেন। সাথে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ঐতিহ্যবাহী মালয়ী পোষাকে শিল্পীরা প্রথমে মালয়ী, এরপর চীনা, এরপর ভারতীয় এবং বোর্নিও আইল্যান্ডের আদিবাসীদের পরিবেশনার ব্যবস্থা করলেন। শুরুতে আর শেষে সবাই মিলে ওয়ান মালয়েশিয়ার স্মারক হিসাবে যৌথ আয়োজনও করলেন।
নাচের চমক
মঞ্চে নেয়া হলো অতিথিদেরকেও
শিল্পী অতিথি যৌথ নাচ
তারপর গ্রুপ ছবি-স্লোগান--ওয়ান মালয়েশিয়া
এরপর এতিহ্যবাহী মালয়ী রান্নার বিচিত্র সমাহারে ভূরিভোজ।
ফিরে আসা
এরপর দেশে ফেরার পালা। আমাদেরকে এয়ারপোর্টে নিয়ে এলেন ট্যাভেল এজেন্টের কর্মকর্তা। ঢোকার মুখেই সেল্ফ চেক-ইন এর ডিজিটাল আয়োজন। নিজেই চেক-ইন করে সিট পছন্দ করলাম। বেরিয়ে এলো বোর্ডিং পাস। কাউন্টারে গিয়ে লাগেজ জমা দিলাম। তিনবার সিকিউরিটি চেক আর একবার ট্রেন ভ্রমন শেষে উঠলাম মালয়েশিয়ান এয়ারের এ ৩৮০ এয়ার বাসে। উড়লো স্থানীয় সময় রাত ১০টায়। আক্ষরিক অর্থেই মেঘের কোলে ভেসে ভেসে এলাম। বাংলাদেশে ল্যান্ড করলাম রাত সোয়া বারোটায়। ঘরে ফিরে মনে হলো- হোম, সুইট হোম !
সমাপনী
এই দুই সপ্তাহে মালয়েশিয়ার সাফল্যের যে মূল কারণ গুলো বুঝলাম সেটা হলো নেতৃত্বের প্রতি, রাষ্ট্র কাঠামোর প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য। বিনা বাক্য ব্যয়ে কঠোর নিষ্ঠায় দায়িত্ব পালন। নিজ নিজ সংস্কৃতির প্রতি মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা। শ্রমের ভেতর দিয়ে ভাগ্য বদল। তাই বলে সবাই সাধু বনে গেছে তা নয়। সরকারী বেসরকারী অনেক পর্যায়ে টাকা বানাবার ব্যাপার আছে। মালয়েশীয় পুলিশেরও পুলিশসুলভ গুণাবলীও কিছু যে নেই তা নয়। মাহাথির নিজে প্রশ্নাতীত সততায় ঈমানদার থাকলেও টাকা বানাবার সব ধান্ধা বন্ধ করতে পারেননি। তবে একটা সীমা রেখা টেনেছেন- টাকা বানাও তবে দেশের স্বার্থ নষ্ট করে বানাবে না। তাদের অল্পস্বল্প খারাপ লোকেরা মাহাথিরের এই আদেশটা অন্তত মেনে চলেন। ফলে তাদের জন্য মালয়েশিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
পাশাপাশি মালয়েশিয়ার দেশ হিসাবে যে মানসিকতা সেটা হলো দক্ষতা দিয়ে বিশ্বসেরা হও নানা ক্ষেত্রে। কিন্তু আঞ্জলিক মোড়ল হবার কোন কু-খায়েস মালয়েশিয়া বা আর কোন আসিয়ান দেশের নেই। এখানেই নিহিত আসিয়ানের অকল্পনীয় অর্থনৈতিক সাফল্যের মূল সূত্র।
মালয়েশিয়া থেকে বা যাতায়াত করে আমাদের দেশের লোকজন দেখি আমাদের মৌলিক স্বভাব ছাড়তে পারেননি। সুযোগ পেলেই মালয়েশিয়ার বদনাম করছেন। দূতাবাস কর্মকর্তা বা প্রবাসী কর্মী সবার এক রা। কোথায় মালয়েশিয়ার দোষ, কোথায় মালয়েশিয়ান এয়ারের দোষ কোথায় মাহাথিরের দোষ এই নিয়ে বিস্তর গবেষণা।
মালয়েশিয়া বা মাহাথির নির্দোষ সেটা আমিও বলিনি। মূল কথা হলো মালয়েশিয়ার লোকদের কাছে দোষত্রুটি মুখ্য নয়। আমাদের কাছে দোষই মুখ্য। ভাগ্যিস মাহাথির আমাদের দেশে জন্মাননি। জন্মেছেন মালয়েশিয়ায়। সেজন্য তাঁর নেতৃত্বে মালয়ীদের প্রশ্নাতীত আনুগত্য, নিষ্ঠা আর শ্রমের যোগ ফলেই মালয়েশিয়া বো'লে !
এই দীর্ঘ সিরিজে অসীম ধৈর্যে যারা আমার সাথে ছিলেন তাদের সবাইকে কৃতজ্ঞতা আর সালাম জানাই। সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
(শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১০ দুপুর ২:০৭