শান্তা তখনো ঘুমিয়ে—১ পড়ুন এখানেঃ শান্তা তখনো ঘুমিয়ে—১
পরেরদিন সকালে নিরাময় সেন্টারের (এর পর থেকে শুধু ‘সেন্টার’ নামে ডাকা হবে) পরিচালিকা এবং কাউন্সেলর, উভয়েই আরিফের সাথে কথা বললেন। ওর সাথে কথা বলার পর তারা জানালেন, শান্তার সাথেও তাদের কথা বলতে হবে। এদিকে সেন্টারে শান্তা কিংবা ওদের মেয়েকে আনার ব্যাপারে আরিফ তার বাবা মাকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু পরিচালিকার পীড়াপীড়িতে আরিফের বাবা মা সে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শান্তাকে সেখানে উপস্থিত হতে বললেন। চলতে থাকলো শান্তির অন্বেষণে উভয়ের যৌথ কাউন্সেলিং। কিন্তু কে তখন জানতো, এই যৌথ কাউন্সেলিং এর উর্বর পলিতে রোপিত হচ্ছিল আরো বড় বড় অনেক অশান্তির বীজ!
সেন্টারের কাউন্সেলর সাহেব ছিলেন শান্তা-আরিফের চেয়ে বয়সে বিশ পঁচিশ বছরের মত বড়। আরিফ তাকে মামা বলে সম্বোধন করতো। তিনি তাদের জীবন কাহিনী শুনতে শুনতে নিজেই নিজের অগোচরে আরেকটা নতুন কাহিনীর জন্ম দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বিবাহিত ছিলেন, একজন ধনী মহিলাকে বিয়ে করে তিনি সুখেই সংসার করছিলেন। তাদের এক ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েও ছিল। তার পরেও তিনি শান্তাকে কাউন্সেলিং করতে করতে তার প্রতি দুর্বলতা অনুভব করতে শুরু করলেন। প্রথম প্রথম তিনি উভয়কে এক সাথে সেন্টারেই কাউন্সেলিং করতেন। তার কিছুদিন পর থেকে শান্তা বাসায় ফিরে যাবার পরেও তিনি তাকে টেলিফোনে কাউন্সেলিং করতেন। আরিফ প্রায় তিন মাস সেন্টারে কাটিয়ে যখন বাসায় ফিরলো, তখনো তিনি উভয়ের উপস্থিতিতে ওদের বাসায় আসতেন বিনামূল্যে কাউন্সেলিং অব্যাহত রাখার ঘোষিত অভিপ্রায়ে, যদিও অঘোষিত অভিপ্রায় ছিল অন্যরকম। এতে আরিফ প্রথম প্রথম তেমন আপত্তি করতো না। কিন্তু বাসায় ফেরার কিছুদিন পর থেকে আরিফ তার প্রতি শান্তার একটা প্রকাশ্য ঔদাসীন্য অনুভব করতে শুরু করলো। এমনকি শান্তার বাবার বাড়ী থেকে আনা কাজের বুয়াটাও কথায় কথায় আরিফকে উপদেশ দেয়া শুরু করলো। আরিফ মনে মনে খুব বিরক্তবোধ করলেও তা চেপে যাচ্ছিল। বিরক্তির মাত্রাটা বেড়ে যেত যখন কাউন্সেলর সাহেব বাসায় এলেই শান্তা তার কাছে আরিফের বিরুদ্ধে নানান খুটিনাটি বিষয়ে অভিযোগ উল্থাপন করতো। বিরক্তি চেপে রাখতে রাখতে আরিফের মেজাজটা বিগড়ে যেতে শুরু করলো। সামান্য বিষয়েও সে জোরে কথা বলা শুরু করলো। আর এটাই কাউন্সেলর সাহেবের কাছে শান্তার প্রধান অভিযোগে পরিণত হল। অপরদিকে কাউন্সেলর সাহেব খুব নীচু, নরম গলায় কথা বলতেন। তিনি নরম গলায়ই আরিফকে তার গরম গলা কিছুটা ঠান্ডা করার পরামর্শ দিতে থাকলেন।
প্রথম প্রথম পরামর্শ দিতে থাকলেও পরের দিকে কাউন্সেলর সাহেব নিজেও আরিফের বিরুদ্ধে নানা রকমের অভিযোগ উল্থাপন করতে শুরু করলেন। আরিফ অনুভব করতে শুরু করলো, তার বাসগৃহে দুটো পক্ষের সহাবস্থান। এক পক্ষে সে একাকী, অন্য পক্ষে শান্তা, কাউন্সেলর আর তাদের কাজের বুয়া। মাঝে মাঝে ওদের বড় মেয়েটা তৃতীয় পক্ষ হিসেবে নিরপেক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতো। তুচ্ছ তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে বড় বড় শোরগোল সৃষ্টি হতে শুরু করলো। আরিফ যতই ভেতরে ভেতরে নিঃসঙ্গ বোধ করতো, ততই সে তার স্ত্রী কন্যাকে জাপটে ধরে আঁকড়ে থাকতে চাইতো। কিন্তু মাঝখানে একটা অদৃশ্য দেয়াল ইতোমধ্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তাই জাপটে ধরার প্রতিটি প্রচেষ্টায় আরিফের কোমল হৃদয় কাঠিন্যের আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হতে থাকলো। অসহায় আরিফ তার শক্তিহীনতাকে গলার জোর দিয়ে অতিক্রম করতে চাইতো, কিন্তু এটাই শান্তার হাতে একটা মোক্ষম অস্ত্র তুলে দিয়েছিল, যার আঘাতে আরিফ কালক্রমে ধরাশায়ী হয়েছিল।
এ ধরনের কাহিনী যেভাবে গড়ায়, সেভাবেই গড়ালো। যতই গড়াতে থাকলো, গড়ানোর গতি ততই তীব্রতা পেতে থাকলো। অবশেষে একদিন আরিফের স্থায়ী ঠিকানায় একটা রেজিস্টার্ড চিঠি এলো। সেসময় বাসায় আরিফের মা ছাড়া আর কেউ ছিল না। মায়ের মন বলে কথা, চিঠির কথা শুনেই তার বুকটা ধক করে উঠলো। তিনি চিঠিটা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। তবে এভাবে তো আর ভবিতব্যকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। ভবিতব্য অবশেষে নানা পথ ঘাট পেরিয়ে একদিন প্রলয় হয়ে তাদের গৃহে প্রবেশ করলো। শান্তার তালাকনামা কার্যকর হয়ে গেল। কাউন্সেলর মামা একদিন একটা অটো ডেকে নিয়ে এসে আরিফের সামনে দিয়েই শান্তা আর তার দুই বাচ্চাকে নিয়ে চলে গেলেন, আরিফ প্রতিবাদহীন তাকিয়ে থাকলো ওদের চলে যাওয়ার পথের দিকে। তার চোখে তখন জল আসেনি, চেপে রাখা অনল শিখায় বুকটা দগ্ধ হচ্ছিল, তারই ছাইঢাকা কালো মেঘে চোখদুটো শুধু ঝাপসা হয়েছিল। চোখে জল আসে আরো অনেক পরে। রাতের বেলা আরিফ তার বাবা মায়ের মাঝখানে এসে শুয়ে পড়লো। দু’হাতে দু’জনের গলা জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো, “আমি এখন তোমাদের সেই ছোট্ট বেলার আরিফ। আমাকে একটু আদর করো!”
সুখের কথা, এর পর থেকে আরিফ আর নেশামুখো হয়নি। সে তার বড় মেয়েটাকে বড় ভালবাসে। ওকে দেখা ছাড়া সে বাঁচতে পারবেনা, একথা ভেবে সে শান্তার সাথে সকল শর্ত মেনে নিয়ে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। তার মেয়েকে একদিন বিয়ে দিতে হবে। বিয়ে দিতে হলে বাবার কথা উঠবে। আরিফ চায় না, ওর বিয়ের সময় ওর বাবার প্রসঙ্গটা কোনভাবেই ওকে বিব্রত করুক। শান্তার সাথে আরিফের এখনো কেবল একটিমাত্র বিষয়েই কথা হয়ে থাকে, মেয়েকে প্রতি সপ্তাহান্তে নিজের কাছে নিয়ে আসার ব্যাপারে। আরিফ শান্তাকে এখনো তুমি করে ডাকলেও শান্তা ওকে ‘আপনি’ সম্ভাষণ করে। মেয়েকে আরিফ কতটা ভালবাসে তা শান্তাও জানে। তাই মেয়েকে বাবার কাছে পাঠানোর ব্যাপারে সে বিন্দুমাত্র আপত্তি করেনা। মেয়েটাও মুখিয়ে থাকে সপ্তাহান্তে দাদীর বাড়ীতে বেড়াতে আসার জন্য। সেখানে তার শৈশব কেটেছে, এখন সে চপলা কিশোরী। শৈশবের অনেক বন্ধুও এখনো সেখানে আছে। আরিফ সময় পেলেই ডায়েরী খুলে তার মনের কথা লিখে রাখে। খুবই বিশ্বস্ততার সাথে নির্ভুল, নিরপেক্ষভাবে ঘটনা প্রবাহের কথা লিখে রাখে। ওর আশা, একদিন ওর মেয়ে ওর ডায়েরী পড়ে ওকে যদি কিছু ভুল বুঝেও থাকে, তা শুধরে নেবে। যদিও সে জানে, ওর মা শান্তা তখনো ঘুমিয়েই থাকবে, হয়তো জেগে জেগেই ঘুমোবে......
(কাহিনী সমাপ্ত)
ঢাকা
২৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৮
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।