খুব সম্ভবতঃ ১৯৭৯-৮০ সালের দিকে বিটিভিতে একটা নাটক দেখেছিলাম, যার শিরোনাম ছিল “শান্তা তখনো ঘুমিয়ে”। আমি নাটক খুব একটা দেখতাম না, তবে কখনো এটা সেটা দেখতে দেখতে যদি কোন নাটকের শুরুটা ভাল লাগতো, তবে শেষ পর্যন্ত দেখতাম। ঐ নাটকটার ঘটনা এখন কিছুই আমার মনে নেই, তবে শিরোনামটা তখনই মনে গেঁথে ছিল, আজও তাই আছে। নাটকটিতে আমার এক বন্ধুর ছোট বোন অভিনয় করেছিল, সেজন্যই দেখার আগ্রহটা একটু বেশী ছিল। আজ যখন আমি আরেক শান্তার গল্প লিখতে বসেছি, তখন কেন জানি ঐ শিরোনামটাই মনে ভেসে উঠলো। তাই আমার গল্পের শিরোনামটাও একই রাখলাম।
বড় বড় চোখে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকা আরিফকে শান্তার প্রথম দেখাতেই খুব ভাল লেগেছিল। চোখ দুটো থেকে যেন ঠিকরে বেরোচ্ছিল এক অদ্ভূত রকমের বিশ্বস্ততা। ওর সাড়া মুখাবয়ব জুড়েও ছিল একটা শিশুসুলভ সরলতার ছাপ। সেটাই শান্তাকে সবচেয়ে বেশী আকর্ষণ করেছিল। এ ছাড়া শান্তার মত একজন সুন্দরী মেধাবী মেয়ের আরিফের মত একটা গড়পড়তা ছেলের প্রেমে পড়ার কোন কারণ ছিলনা। শান্তা পড়তো ইংরেজীতে অনার্স, আরিফ পড়তো হিসাব বিজ্ঞানে, একই বর্ষে। অনার্স, মাস্টার্স শেষ করার পর থেকেই শান্তার পরিবার থেকে ক্রমাগত চাপ আসছিল তাকে বিয়ে দেয়ার। শান্তা একে একে সেসব চাপ একাই সামলিয়েছিল। শান্তাদের পরিবার বেশ অবস্থাপন্ন ছিল, পক্ষান্তরে আরিফ বনেদী ঘরের ছেলে হলেও তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা তার প্রকৌশলী দাদার আমল পর্যন্ত ছিল। সে কালের একজন প্রকৌশলীর ছেলে মেয়ে হিসেবে আরিফের বাবা-চাচা-ফুফুদের মধ্যে বেশীরভাগই কোনমতে টেনেটুনে মেট্রিক বা ইন্টারমিডিয়েটের ঊর্ধে উঠতে পারেনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরোনো তো বহুত দূরের কথা। এজন্য অবশ্য আরিফের আত্মীয়স্বজন আরিফের সংসারকর্মে উদাসীন দাদীকেই দায়ী করে। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরতে পারেন নি। শুধু ভাল ভাল খানাপিনা ও আত্মীয় অনাত্মীয়ের জন্য ঘন ঘন আপ্যায়নের আয়োজনে তিনি এবং তার সন্তানেরা ধন সম্পত্তির অপচয় করেছিলেন। তাই বলা যায়, আরিফের রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স সম্পন্ন করাটা পূর্বসূরীদের তুলনায় কম কৃ্তিত্বপূর্ণ ছিল না এবং তা বংশের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অর্জন ছিল। আরিফ যখন উচ্চ বিদ্যালয়ে, তখন থেকেই তার বাবা কিছু বদ অভ্যাসের কারণে যা কিছু ব্যবসাপাতি করতেন, সবকিছুতে লস খেয়ে ভবঘুরে বনে যান। তাদের পৈত্রিক সহায় সম্পত্তি যা কিছু ছিল, সবকিছু শেষ করে তিনি মাঝে মাঝে এদিকে ওদিকে উধাও হয়ে যেতেন। ফেলে যাওয়া সংসার কিভাবে চলবে, এ নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। মাঝে মাঝে কিছু ফটকাবাজী ব্যবসা কিংবা ব্যবসায়ীদের দালালী করে কিংবা সাময়িকভাবে ম্যানেজারী করে হাতে যদি কিছু আসতো, তবে তা দিয়ে বাজার থেকে ভাল ভাল সওদা করে তিনি পরিবারের মাঝে আবির্ভূত হতেন। তাকে দেখে তার অভাগী স্ত্রী আর অবোধ সন্তানদের মাঝে তখন আনন্দের বন্যা বয়ে যেত।
সেই কিশোর বয়স থেকেই আরিফ ব্যথিত মনে দেখেছে তার মা একাই কতটা আত্মত্যাগ করে তার সংসারটাকে স্বামীর হেলাফেলা সত্তেও চালিয়ে নিয়েছেন। ওদের দু’ভাই বোনের মুখে অন্ন যুগিয়েছেন, স্কুল কলেজে ভর্তি করিয়েছেন, পড়াশুনার খরচ কিছুটা হলেও যুগিয়েছেন। বাকীটা আরিফ টিউশনী করে যোগার করেছে। সেই আরিফকে যখন শান্তা বিয়ের কথা বললো, তখন ওর মাথায় বাজ ভেংগে পড়লো। আরিফ ওকে এড়িয়ে যেতে শুরু করলো, কেননা সাংসারিক দৈন্য দশা এতটাই করুণ ছিল, যা বিয়ে প্রত্যাশী প্রেমিকাকে বলার মত নয়। যাহোক, শান্তা তার সিদ্ধান্তে অনড় ছিল এবং সে সবকিছু মানিয়ে নিয়ে সংসার করবে বলে আরিফকে কথা দিল। এভাবেই ধীরে ধীরে আরিফের মনেও সাহস সঞ্চয় হতে থাকলো। একদিন কিছুটা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে ওদের শুভ পরিণয়ও সুসম্পন্ন হয়ে গেল।
বিয়ের পর পরই বেশীরভাগ দম্পতিদেরই যা হয়, ওদেরও তাই হলো, অর্থাৎ ওরা হাওয়ায় উড়তে লাগলো। মধুর দাম্পত্য জীবন আনন্দের সাথে উভয়ে উপভোগ করতে থাকলো। কিন্তু বাস্তবতাও ধীরে ধীরে ওদের এ আনন্দের মাঝখানে স্থান করে নিতে শুরু করলো। আরিফদের টিনের ঘরে ওর মা বাবা আর বোনের সাথেই ওদের যৌথ সংসার শুরু হয়। এম এ পাশ শান্তা প্রথম প্রথম ঘরকন্যার কাজগুলো বেশ মন দিয়েই করতে থাকলো, কিন্তু অচিরেই ওর এসব কাজ করতে আর ভাল লাগতো না। চুপে চুপে ও আরিফের সম্মতিক্রমেই চাকুরী খোঁজা শুরু করলো। বিয়ের ঠিক আগে আগে আরিফ একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে হিসাব রক্ষকের কাজ পেয়েছিল। সেখান থেকে ও যা বেতন পেত, তা দিয়ে শান্তার জন্য, ওর নিজ মা ও বোনের জন্য মাঝে মাঝে সামান্য কিছু উপহার কিনে আনতো, সংসার খরচও শেয়ার করতো। অল্প দিনের ভেতরেই শহরের একটা বিখ্যাত ইংরেজী মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেনে বেশ ভাল বেতনে শান্তার একটা চাকুরী হয়ে গেল। আরিফের মাও ওদের মধ্যেকার টানাপোড়েনটা টের পাচ্ছিলেন, তাই তিনিও চাচ্ছিলেন, শান্তার কোন রকম একটা চাকুরী হয়ে গেলে তিনি ওদেরকে আশে পাশেই একটা আলাদা বাসা নিয়ে নিজস্ব সংসার শুরু করতে বলবেন। তিনি তাই বললেন, ওরাও সানন্দে তাই করলো।
বছর খানেকের মধ্যেই ওদের মাঝে এল ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান। মাতৃত্বজনিত ছুটি শেষ হবার পরে শান্তাকে কাজে যোগ দিতে হলো। রানাবান্না, ছোট বাচ্চার দেখাশোনা, ঘরের অন্যান্য কাজ সামলানো, ইত্যাদিতে শান্তার হিমশিম খাওয়া দেখে আরিফ নিজেই এগিয়ে এসে সাহায্যের হাত বাড়ালো। মাকে মাঝে মাঝে সাহায্য করতে গিয়ে আরিফ কিছুটা রান্নাবান্নার কাজ শিখে ফেলেছিল। আর ও বরাবরই নিজের কাপড় চোপড় নিজেই ধৌত করতো। তাই সে শান্তাকে অভয় দিয়ে বললো, টুকটাক রান্নাবান্না এবং ধৌতকর্ম সে নিজেই করবে, ঘর ধোয়া মোছার কাজ করতেও তার আপত্তি নেই। এভাবেই দুজনে মিলে মিশে ওরা সংসার করতে থাকলো। যখন দুজনকেই বাইরে থাকতে হয়, তখন মেয়েটাকে আরিফ হয় ওর মায়ের কাছে রেখে আসতো, নয়তো ওর মাকে নিয়ে এসে ঘরে রাখতো। কিন্তু এভাবে আর কয়দিন চলে! এসব ডোমেস্টিক কাজ করতে ওর আর বেশীদিন ভাল লাগলোনা। গৃহস্থলীর কাজে মনোনিবেশ করতে গিয়ে ও অফিসের কাজে অনেকটা অমনযোগী হয়ে পড়তে লাগলো। শান্তা যেহেতু ওর চেয়ে অনেক বেশী বেতন পায়, সেহেতু ও চাচ্ছিলো যে শান্তাই যেন ওর চাকুরীটা ভালভাবে মন দিয়ে করে, আর ও কোনরকমে জোড়াতালি দিয়ে ওরটা চালিয়ে নিচ্ছিলো। এদিকে স্কুলে শান্তার সুনাম খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগলো- একজন সফল শিক্ষক হিসেবে এবং স্কুলের অন্যান্য কাজে একজন যোগ্য সহকারী হিসেবে। শান্তা টের পেতে শুরু করলো যে ওর প্রতি অনেকের অকারণ সুদৃষ্টি রয়েছে। সুনাম ছড়িয়ে পড়ায় প্রাইভেট পড়ার জন্য শান্তার দুয়ারে ছাত্রছাত্রীদের ভিড় ক্রমাগত বাড়তে থাকলো, শান্তারও ব্যক্তিগত সঞ্চয় দিনে দিনে স্ফীত হতে থাকলো।
শান্তার উন্নতি নিয়ে আরিফের মনে কোন ঈর্ষাবোধ ছিল না। বরং সে সর্বতোভাবে তাকে সাহায্য সহযোগিতা করতো। কিন্তু সমাজে এবং কর্মক্ষেত্রে ও মাঝে মাঝেই শুনতে শুরু করলো যে শান্তা ওর তুলনায় অযোগ্য একটি পাত্রকে বিয়ে করেছে। শান্তার স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেও আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যেত। সেখানে সে নিজেও দেখতে পেত শান্তার জনপ্রিয়তা। ধীরে ধীরে ওর মধ্যে একটা হীনমন্যতাবোধ শেকড় ছড়াতে শুরু করলো। মাঝে মাঝে আরিফকে অফিসের কাজে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে হতো। প্রায়ই ওর একজন জ্যেষ্ঠ্য সহকর্মীও সাথে যেতেন। ওনার কিছুটা নেশার দোষ ছিল। আরিফের হীনমন্যতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি আরিফকে নিজের দলে ভেড়াতে শুরু করলেন। নেশার জগতে আরিফের হাতেখড়ি হলো। দিন যত যেতে থাকলো, সংসারের প্রতি, স্ত্রী ও কন্যার প্রতি আরিফ ধীরে ধীরে ততই মনযোগ হারাতে থাকলো। নেশার পরিমাণ দিনে দিনে বাড়তে থাকলো। ব্যাপারটা চারিদিকে জানাজানি হতে শুরু করলো। এক সময়ে আরিফের বাবা তার এক উকিল বন্ধুর সাথে পরামর্শ করে আরিফকে মাদকাসক্ত শোধনাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সিদ্ধান্তটা তিনি একাই নিয়েছিলেন, আরিফের মায়ের সাথে ব্যাপারটা খুলে আলাপ না করেই। একদিন রাত দশটার সময় যখন ওর বাবা একটা মাইক্রোবাসে করে আরিফকে ঘর থেকে তুলে শোধনাগারে নিয়ে যাচ্ছিলেন, আরিফ তখন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিল যে সে ভাল হয়ে যাবে, জীবনে আর কখনো সে ওসব স্পর্শ করবেনা। কিন্তু সঙ্গে আসা নিরাময় সেন্টারের লোক ওর মাকে বুঝাচ্ছিল যে সব মাদকাসক্তরাই ওরকম বলে থাকে। আরিফ অনিচ্ছা সত্তেও গাড়ীতে উঠতে উঠতে উচ্চঃস্বরে চিৎকার করতে করতে বলে যাচ্ছিল, ওর স্ত্রী ও কন্যারা যেন কখনও ওকে দেখতে সেন্টারে না যায়। নদীভাঙনের সময় যেমন তীর ভেঙে ভেঙে মাটির বড় বড় ঢেলা নদীর বুকে আছড়ে পড়ে, আরিফের মারও তখন মনে হচ্ছিল যে তার বুকের পাঁজরগুলো যেন ভেঙে ভেঙে তার হৃদয়টাতে আছড়ে পড়ছে। ভীত বিহ্বল হয়ে তিনি শুধু তাকিয়েই থাকলেন চলে যাওয়া মাইক্রোবাসের পেছনের লাল বাতিদুটোর দিকে, গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুফোঁটা মোছার কথা তার খেয়ালেই ছিলনা।
এর পরের পর্ব পড়ুন এখানেঃ শান্তা তখনো ঘুমিয়ে—২
ঢাকা
২১ ফেব্রুয়ারী ২০১৮
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:৫৫