somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নতুন বই পরিচিতিঃ বসন্তদিন

৩১ শে আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৪:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




বই পরিচিতিঃ
বই এর নামঃ বসন্তদিন
বই এর ধরণঃ পত্রালাপে গল্প
লেখকের নামঃ বরুণা ও প্রতিফলন
প্রকাশকের নামঃ তারিকুল ইসলাম
এক্সেপশন পাবলিকেশন্স,
ডন প্লাজা, ১০ম তলা
৯, বঙ্গবন্ধু এভিন্যু, ঢাকা-১০০০
প্রচ্ছদঃ শায়মা হক
উৎসর্গঃ “বসন্তপ্রেমী মানুষগুলোকে”
প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭
মূল্য: ১৭৫.০০ টাকা


অন্তর্জালের সুবাদে পৃথিবী আজ মানুষের শুধু হাতের মুঠোতেই নয়, বলা যায় আঙুলের ডগায় চলে এসেছে। আঙুল দিয়ে কী বোর্ডের বাটন টিপে পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে দু’জন বা ততোধিক মানব মানবী একে অপরকে দেখতে পারে, একে অপরের সাথে কথা বলতে পারে, মনের আবেগ অনুভূতি বিনিময় করতে পারে। ঠিক এমনিভাবেই অন্তর্জালে বিচরণের সময় একদিন বরুণা ও প্রতিফলন নামের দু’জন মানব মানবী একে অপরের গৃহকোণে প্রবেশ করে কথোপকথন শুরু করে। ক্রমান্বয়ে তারা একে অপরের মনের কোণেও পরস্পরের জন্য একটা ভালবাসার আসন তৈরী করে নেয়। শুরু হয় তাদের ভালবাসার পথে হাঁটা- কখনো একসাথে, কখনো পৃথক পৃথক ভাবনায়। প্রাথমিক জানা-পরিচয় থেকে শুরু করে তারা কিছুটা দেখাদেখি, কিছুটা মাখামাখি করে এগিয়ে চলে। তাদের এই আবেগঘন আলাপচারিতার সূত্র ধরে শুরু হয় প্রেমের পত্রালাপ, সে পত্রালাপে উঠে আসে তাদের আকুলি বিকুলি করা মনের যত কথা। কখনো তা শুধুই প্রেমালাপ, কখনো তাদের আটোপৌরে জীবনের দৈনন্দিন কথকতা, আবার কখনো দুটো প্রেম প্রত্যাশী হৃদয়ের অনিবার্য বিয়োগাত্মক পরিণতির কথা ভেবে অন্তহীন আহাজারি ও হা হুতাশ। দুটো বসন্তানুরাগী প্রেমাকুল হৃদয়ের টুকরো টুকরো এসব কথামালার সংকলন নিয়েই রচিত হয়েছে “বসন্তদিন”, যা পাঠকালে গ্রীষ্মের দাবদাহ কিংবা ঘনঘোর বর্ষার মাঝেও পাঠকের মন কল্পনায় এঁকে নিতে পারে এক প্রেমের রঙধনু।

ছদ্মনামে দ্বৈত লেখকের প্রকাশনা এই “বসন্তদিন”। লেখকদ্বয় বলেছেন ‘বসন্তদিন’ “না গল্প, না উপন্যাস। এটা পত্রালাপ। চিঠির ভাষায় কথামালার আলোকচ্ছটা”। যারা সামহোয়্যার ইনব্লগের নিয়মিত পাঠক, তারা হয়তো এসব পত্রালাপের সাথে আগেও কিছুটা পরিচিত হয়ে থাকবেন। দুটো প্রেমিক হৃদয়ের ইচ্ছে আকাঙ্খার, চাওয়া পাওয়ার আনন্দ এবং না পাওয়ার হাহাকার, ইত্যাকার অনুভূতির সন্নিবেশ ঘটেছে এসব পত্রালাপে। সুখের বিষয়, এগুলো কোন টীন এজ ক্রাশ এর মত ব্যাপার স্যাপার ছিলনা, পত্রালাপগুলোতে ছিল দুটো পরিণত প্রেমিক হৃদয়ের প্রেম বিষয়ক অনুভূতি, ভাবনা ও দর্শনের প্রতিফলন। কাকতালীয়ভাবে, এই গল্পের প্রেমিক প্রবরটির ছদ্মনামও ‘প্রতিফলন’।

আন্তর্জালিক কথোপকথনে নিজের নাম ধাম, পরিচয় ইত্যাদি গোপন রাখা কিংবা ছদ্মনাম ব্যবহার করাটা নতুন কোন ব্যাপার নয়। বরুণাও তাই করেছিল, যা সে প্রথমেই অকপটে স্বীকার করেছে এভাবেঃ “মিথ্যে নাম, মিথ্যে পরিচয়, সে আমি অবলীলায় বলতাম”। তবে পাঠকেরা অনেকেই ভীষণ মজা পাবেন এ কথাটা জেনে যে বরুণা একবার প্রতিফলনকে তার টেলিফোন নম্বর হিসেবে গুলশান থানার টেলিফোন নম্বরটি দিয়েছিল। অবশ্য সেটা দিয়ে সে যে কিছুটা দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতায় ভুগেছিল, বই এ তারও আভাস পাওয়া যায়। প্রতিফলন এতে কিছুটা দুষ্টুমি আন্দাজ করতে পারলেও নির্দ্বিধায় সে সেই নাম্বারে ফোন করেছিল, আর সেই কলটা রিসিভ করেছিলেন গুলশান থানার ডিউটি অফিসার স্বয়ং!

বুঝাই যায়, কথা বলার তর্কাতর্কিতে প্রতিফলনের চেয়ে বরুণাই বেশীরভাগ সময়ে জয়ী হতো। তাই প্রায় শুরুতেই প্রতিফলনের প্রশ্নঃ “তুমি কি এখনো কোন কথা মাটিতে পড়তে দাও?” তাদের মধ্যে যতই ঝগড়া ঝাটি হোক না কেন, তাদের মন মানসিকতায়, আচার আচরণে মিল ছিল প্রচুর, যেন একে অপরের পরিপূরক। বরুণার ভাষায়- “তুমি যেন আমার ঠিক একটা ‘পুরুষ’ সংস্করণ”। উভয়ের কথোপকথন ছিল বুদ্ধিদীপ্ত, শাণিত, এবং প্রায় সময়েই, যুক্তিযুক্ত। তবে তাদের পত্রালাপেই বুঝা যায়, বরুণা প্রেমময়ী তো ছিলই, সেই সাথে ছিল ভীষণ জেদীও। আর জেদীদের ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, কোন বিষয়ে যুক্তিতর্কে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জানলে তখন আর যুক্তির তোয়াক্কা করেনা, বরুণার মধ্যেও সে প্রবণতা ছিল। তবে দেশের শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত ও সংস্কৃতির জ্ঞানে ওরা উভয়েই আলোকিত ছিল। তাই তাদের যুক্তি তর্ক, আলাপন, রুটিন কথোপকথন, পত্রালাপ, বার্তা বিনিময়, সবকিছুই হতো পরিশীলিত ভাষায়, কখনো গানে গানে, কখনো কখনো কবিতার চরণে চরণে। এ ব্যাপারে তারা অকাতরে এবং অনায়াসে রবীন্দ্রাশ্রয়ী ছিল, কারণ রবীন্দ্র রচনাবলীর অলিগলি তাদের উভয়ের বেশ চেনা ছিল। নজরুলের প্রেমের গানগুলোও তাদের মুখস্থ ছিল। তাই টেক্কা দিয়ে একে অপরের সাথে কথোপকথনে রবীন্দ্র-নজরুলের প্রেমের কথা, গানের কথা উদ্ধৃত করতো। কথায় আছে, মানুষ প্রেমে পড়লে দার্শনিক হয়ে যায়। ওরাও মাঝে মাঝে নিজেদের ভাবাবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে কিছু দার্শনিক উক্তি ব্যক্ত করতো। যেমনঃ

প্রতিফলনঃ এই দেখা না দেখার অনুভূতিটাই বেঁচে থাকা। এই জার্নিটুকুই জীবন। জীবন থেকে পালানোর প্রয়োজন নেই। পালানো যায় না (পৃষ্ঠা-১৭)।
ভালবাসা জিনিসটা এমন যে নিজেকে খালি প্রকাশ করতে চায়, ঘোষিত হতে চায় পৃথিবীর কাছে (পৃষ্ঠা-৪৪)।
ততদিন পর্যন্ত আমরা দুজন আমাদের একান্ত পৃথিবীতে ভালবাসার স্বপ্নকাজল মেখেই থাকবো সবার সাথে (শেষ কথা)।

বরুণাঃ “হার মেনেছি মিটেছে ভয়, তোমার জয় তো আমারই জয়” (পৃষ্ঠা-২৩)।
ভালবাসার মানুষের সবকিছুই ডিফারেন্ট। একদম আলাদা অন্যদের থেকে (পৃষ্ঠা-২৯)।
আমার গন্ডীবদ্ধ পৃথিবী থেকে, বিদ্রোহের কোন সুযোগ নেই (পৃষ্ঠা-৩৩)।
ভালবাসাটা লুকিয়ে রাখতে হয় কখনো সখনো... কিন্তু ভালবাসার দ্যুতি কি সত্যি লুকানো সম্ভব? ফাঁক ফোকর গলে ঠিকই সে বের হবার চেষ্টা চালায় (পৃষ্ঠা-৪৬)।
ভালবাসা আছে বলেই আজও চাঁদ-সূর্য ওঠে, ফুল ফোটে, পাখিরা গান গায় (পৃষ্ঠা-১০৪)।

এই বইটা পড়ার সময় রবীন্দ্রনাথের একটি গানের কিছু কথা আমার মনে বারে বারে উঁকি দিয়ে গেছে। গানটি বহুল শ্রুত নয়, তাই গানের কথাগুলো এখানে উদ্ধৃত করলামঃ

আমরা দুজনা স্বর্গ-খেলনা গড়িব না ধরণীতে
মুগ্ধ ললিত অশ্রুগলিত গীতে॥
পঞ্চশরের বেদনা মাধুরী দিয়ে
বাসর রাত্রি রচিব না মোরা প্রিয়ে--
ভাগ্যের পায়ে দুর্বল প্রাণে ভিক্ষা না যেন যাচি।
কিছু নাই ভয়, জানি নিশ্চয় তুমি আছ আমি আছি।

উড়াব ঊর্ধ্বে প্রেমের নিশান দুর্গম পথমাঝে
দুর্দম বেগে দুঃসহতম কাজে।
রুক্ষ দিনের দুঃখ পাই তো পাব--
চাই না শান্তি, সান্ত্বনা নাহি চাব।
পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি,
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ আমি আছি।

দুজনের চোখে দেখেছি জগৎ, দোঁহারে দেখেছি দোঁহে--
মরু পথতাপ দুজনে নিয়েছি সহে।
ছুটি নি মোহন মরীচিকা-পিছে -পিছে,
ভুলাই নি মন সত্যেরে করি মিছে--
এই গৌরবে চলিব এ ভবে যত দিন দোঁহে বাঁচি।
এ বাণী, প্রেয়সী, হোক মহীয়সী "তুমি আছ আমি আছি"॥


আমরা দুজনা স্বর্গ-খেলনা গড়িব না ধরণীতে


যাহোক, পুনরায় ফিরে আসছি বইএর পেছন-প্রচ্ছদে প্রদত্ত লেখকদ্বয়ের কথায়ঃ ‘বসন্তদিন’ “না গল্প, না উপন্যাস। এটা পত্রালাপ। চিঠির ভাষায় কথামালার আলোকচ্ছটা”। যারা গল্প বা উপন্যাস ভালবাসেন, এ বইটা না গল্প, না উপন্যাস হলেও, তারাও এ বইটি পড়ে আনন্দ পাবেন বলে আমার বিশ্বাস, কারণ এতে গল্প এবং উপন্যাস উভয়েরই উপাদান রয়েছে, প্রকৃত এবং উপযুক্ত কলেবরে তা প্রকাশিত না হলেও।

সবাইকে ঈদুল আযহার অগ্রিম শুভেচ্ছা! সবাই ভাল থাকুন, প্রিয়জনদের নিয়ে। ঈদ মুবারক!!!

ঢাকা
২৬ আগস্ট ২০১৭
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১০:০৬
৩৭৫ বার পঠিত
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ভিসা বন্ধ করায় ভারতকে ধন্যবাদ।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩



ভারত ইদানীং ভিসা দিচ্ছেনা; তারা ভিসা না দিয়ে আমাদেরকে শিক্ষা দিতে চায়! তাদের করদ রাজ্য হাতছাড় হওয়া খুবই নাখোশ, এতোই নাখোশ যে মোদী মিডিয়া দিনরাত বয়ান দিচ্ছে এই দেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতের চিকিৎসা বয়কট এবং

লিখেছেন পবন সরকার, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৫৬


ভারতের এক হাসপাতাল ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশের কোন রুগিকে তারা চিকিৎসা দিবে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যে হাসপাতাল থেকে এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে সেই হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার জন্য বাংলাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল দেশ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:১৩






চামচা পুঁজিবাদ থেকে দেশ চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মিলে চোরতন্ত্র করেছে।

সোমবার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখ হাসিনাকে ভারত ফেরত পাঠাবে তবে............

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪২


শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে বিচারের জন্য ভারতের কাছে ফেরত চাইতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশকে প্রতিহিংসামূলক বিচারপদ্ধতি বাদ দিতে হবে। বিচারে শেখ হাসিনা যাতে ন্যায় বিচার পান বাংলাদেশকে আগে তা নিশ্চয়তা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারত সোনার ডিম পাড়া হাঁস হারিয়েছে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৫২



শেখ হাসিনা ভারতে বসে ষড়যন্ত্র-অপপ্রচার করছেন। ভারত চাচ্ছে বাংলাদেশে একটি অশান্তি হোক। কারণ ভারত একটি মসনদ হারিয়েছে। সোনার ডিম পাড়া হাঁস হারিয়েছে।

আওয়ামী লীগ প্রতিদিন একটি সোনার ডিম পেড়ে নরেন্দ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×