আমার কথা -২২ পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুনঃ আমার কথা -২২
আমার শিক্ষকেরাঃ
জনাব আব্দুল্লাহ আল আমিন
জনাব আব্দুল্লাহ আল আমিন আমাদের বাংলার শিক্ষক ছিলেন, তবে ইংরেজীতেও তাঁর বেশ ভালো দখল ছিলো। একইসাথে তিনি নজরুল হাউসের হাউস মাস্টারও ছিলেন। প্রতিদিন সিরিয়াসলী পড়াতেন না, কিন্তু যেদিন তাঁর পড়ানোর মুড আসতো, সেদিন তিনি পিন পতন নিস্তব্ধতার মাঝে গড়গড় করে লেকচার দিয়ে যেতেন। আমরা হয়ে থাকতাম তাঁর বিমুগ্ধ শ্রোতা। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল, গোলাম মোস্তফা, জসিম উদ্দিন প্রমুখ কবিদের লেখা থেকে তিনি প্রচুর রেফারেন্স টানতেন। তবে তিনি এক্সট্রা ড্রিল (ইডি) দেবার ব্যাপারেও মুক্তহস্ত ছিলেন, এজন্য আমার কিছু সতীর্থ তাঁকে খুব একটা পছন্দ করতোনা। তবে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ না করলেও তাঁর ক্লাসগুলোর প্রতি তাদের সীমাহীন আগ্রহ ছিলো। বাংলা পরীক্ষায় রচনাগুলোকে তিনি এমনভাবে নির্বাচন করতেন যেন মুখস্থ বিদ্যায় বেশী কাজ না হয়। যেমন, আমরা যখন নবম শ্রেণীতে পড়ি, তিনি রচনার বিষয় দিয়েছিলেন “গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ”। এই রবীন্দ্র সঙ্গীতটা তখনো পর্যন্ত আমার অজানা ছিলো। তখন তো আর গান শোনার ব্যবস্থাদি এত সুলভ ছিলোনা। আমাদের সম্বল ছিলো দুই বা তিন ব্যান্ডের একটা রেডিও বা টেপ রেকর্ডার। কারো কারো বাসায় অবশ্য একটা বড় ফিতেওয়ালা ঢাউস সাইজের ক্যাসেট প্লেয়ারও ছিলো। গানটি অপরিচিত হলেও একটা মোটামুটি সাইজের রচনা নিজ ভাষায় দাঁড় করাতে পেরেছিলাম। সপ্তম/অষ্টম শ্রেণীতে থাকতে স্যার মোটামুটি কমন রচনাই দিতেন, কিন্তু নবম শ্রেণীতে ওঠার পর থেকে শুরু হয় তার চোরাগোপ্তা হামলা। কি রচনা, কি গদ্য পদ্য, তাঁর প্রশ্নগুলো এমন থাকতো যে উত্তরগুলো নিজ থেকে বানিয়ে লিখতেই হতো। মাঝে মাঝে তিনি অফটপিক অনেক কিছু নিয়ে রসালো আলোচনা করতেন, যা স্বভাবতঃই ঐ বয়সে আমাদের আনন্দের খোরাক ছিলো। আমার মনে আছে, দেশের চিত্রনায়িকাদের সম্বন্ধে একবার তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “সকালের মাখন বিকেলে খাওয়া যায় না”। বলাবাহুল্য, তাঁর এই মন্তব্যটা আমাদেরকে সে সময় ব্যাপক আনন্দ দিয়েছিলো।
স্বাধীনতার পরে কলেজে গিয়ে দেখি, আল আমিন স্যার হুইল চেয়ার নির্ভর, তিনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। একবার আমাদের কলেজে মির্জাপুরের এমপি জনাব ফারুক এসেছিলেন কোন একটা ব্যাপারে। তিনি খুব সুন্দর, কাব্যিক ভাষায় বাংলাতে একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেকথা মনে আছে। একাডেমিক ব্লকের সামনের গোলচক্করটাতে দাঁড়িয়ে তিনি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ আল আমিন স্যার হুইল চেয়ারে বসে খুব উত্তেজিত হয়ে কিছু একটা নিয়ে দাবী দাওয়া তুলেছিলেন। যতদূর মনে পড়ে, খুব সম্ভবতঃ তাঁর আহত হবার ব্যাপারটিকে তিনি glorify করতে চাচ্ছিলেন। জনাব ফারুক তাঁকে একটা কিছু তাৎক্ষণিক আশ্বাস দিলে তিনি শান্ত হন। পরে শুনেছি তাঁর মুক্তিযুদ্ধে আহত হবার ব্যাপারটা নিয়ে কিছু কানাঘুসা ছিলো। তিনি ভাইস প্রিন্সিপাল পর্যন্ত হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর শেষ জীবনটা তেমন সুখকর যাচ্ছেনা বলে জেনেছি।
জনাব হায়দার আলী
হায়দার আলী স্যার আমাদের ইসলামিয়াত পড়াতেন। তিনি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছিলেন। পোশাক পরিচ্ছদে অত্যন্ত পরিপাটি থাকতেন। চেইন স্মোকার ছিলেন। তবে তাঁর আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ছিল অনর্গল চোস্ত ইংরেজীতে বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতা। তিনি একজন ক্রিকেট পাগল ব্যক্তি ছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তানের উঠতি অলরাউন্ডার আসিফ ইকবালের ভক্ত ছিলেন। ক্রিকেট সম্বন্ধে তাঁর আলোচনা শুনে শুনে আমার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিলো যে নিশ্চয়ই তিনি একজন ভালো খেলোয়ারও হবেন। কিন্তু একদিন ক্যাডেটস বনাম টীচা্র্স এর এক খেলাতে তাঁর খেলা দেখে আমি নিদারুণ হতাশ হয়েছিলাম। সেদিন দেখেছিলাম, তিনি আমারই মত আনাড়ি বই কিছু নন। সোমবারের (সপ্তারম্ভ) এসেম্বলীতে ক্বোরান তিলাওয়াতের পর তাঁর ব্যাখ্যাগুলো শুনতে খুব ভালো লাগতো। খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে তিনি বক্তৃতা করতেন। তিনি খুব একটা ইডি দিতেন না, তবে ক্লাসে তাঁর একটা হুঙ্কারই সবার পিলে চমকে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। তাঁর কন্ঠের পীচ খুব উচ্চ থাকতো। আমরা তাঁর ধমককে যমের মত ভয় পেতাম। ইসলামিয়াতে তিনি যেসব বিষয় পড়াতেন, সাধারণতঃ সেসব পাঠ্যপুস্তকে সাজানো অবস্থায় লেখা পেতাম না। এজন্য তিনি আমাদেরকে নিজের লেখা নোট দিতেন। সেগুলো পড়তে আমাদের দাঁত ভেঙ্গে যেতো। অবশ্য সেই সুবাদে আমাদের অনেকের ইংরেজী শব্দভান্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিলো। মনে পড়ে আয়াতুল কুরসির উপরে তিনি একটা নোট দিয়েছিলেন, যা মুখস্থ করা ছাড়া আমাদের কোন উপায় ছিলনা। ক্বোরানের অর্থ ও ব্যাখ্যা পড়াতে গিয়ে তিনি প্রধাণতঃ Mohammed Marmaduke Pickthall এর The Meaning Of The Glorious Quran এবং আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলীর অনুবাদ ও ব্যাখ্যা পড়াতেন। স্বাধীনতার পর কলেজে ফিরে গিয়ে আমরা আর তাঁকে পাইনি।
জনাব নূরুল ইসলাম
নূরুল ইসলাম স্যার আমাদের রসায়ন শিক্ষক ছিলেন। রসহীন এ বিষয়টাকে আমাদের কাছে আকর্ষক করে তুলতে তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা ছিলো। তিনি খুবই আন্তরিক একজন শিক্ষক ছিলেন। কর্ণেল আনসারীর আমলে তিনি অনেকটা চুপচাপ থাকতেন। কিন্তু উইং কমান্ডার কীয়ানি এসে তাঁকে কলেজের নানা কর্মকান্ডের একেবারে পুরোভাগে নিয়ে আসেন। তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি ছিলো। ক্যাডেটদেরকে তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতেন। অনেকের ব্যক্তিগত সুবিধা অসুবিধা সম্বন্ধে তিনি ওয়াকিফহাল থাকতেন। বিপদে আপদে তিনি নিরীহ ক্যাডেটদের পাশে এসে দাঁড়াতেন। হাউস মাস্টারের পাশাপাশি তিনি মেস ইন-চার্জ এর দায়িত্বও পালন করতেন। তিনি ক্লাসে ভালো প্রস্তুতি নিয়ে আসতেন এবং যতক্ষণ না শেষ ছাত্রটিও তাঁর পড়া বুঝতে পারতো, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি পড়ানোতে ক্ষান্ত দিতেন না। একদিনে পড়া বুঝাতে না পারলে পরের দিনে তিনি অসমাপ্ত পাঠ পরিক্রমা থেকে পড়ানো শুরু করতেন। তাঁর প্রতিটি আচরণ স্নেহসুলভ ছিলো। স্যারের বাড়ী ছিলো তৎকালীন ময়মনসিংহ (বর্তমানে নেত্রকোনা) জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল দূর্গাপুর উপজেলায়। মনে পড়ে, তাঁর বাড়ী যেতে কংস নদী পার হতে হতো। অনেকদিন পরে যখন আমি ময়মনসিংহ সেনানিবাসে চাকুরীরত ছিলাম, তিনি একদিন আমার বাসায় এসেছিলেন। তখন তিনি আমার সাথে বন্ধুর মত আচরণ করেছিলেন। স্যার এখনও মনে হয় ধানমন্ডি এলাকায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত একটি ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলের কর্ণধার হিসেবে কর্মরত আছেন।
চলবে...
ঢাকা
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:২১