মাস দুয়েক আগে আমি আমার ফেইসবুকে “পার্ট অফ লাইফ!” শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটাতে অনেকে মন্তব্য করেছেন এবং “লাইক” দিয়েছেন। তাতে বুঝলাম, জীবনের এ ধরনের অভিজ্ঞতাগুলোর হয়তো একটা সার্বজনীন আবেদন আছে। লেখাটা ছিল আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে আমার বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমীতে (বিএমএ) জেন্টেলম্যান ক্যাডেট (জিসি) হিসেবে প্রশিক্ষণ চলাকালীন একটা ঘটনা নিয়ে।
বিএমএ লাইফে আমরা সাধারণতঃ কোন ছোটখাট অপরাধের জন্য যখন "এক্সট্রা ড্রিল" (ইডি) পেতাম, তখন সেটা কী অপরাধে পেতাম তা আগে থেকেই জানতাম। একদিন হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই ইডি তালিকায় নিজের নাম দেখে বিস্মিত হ'লাম। যথারীতি প্রস্তুত হয়ে ইডিতে হাজির হয়ে দেখি, ইডি পরিচালনা করবেন ১ নং প্লাটুনের এনসিও প্রশিক্ষক হাবিলদার আলী আকবর জোয়ারদার, ই বেঙ্গল (বর্তমানে মরহুম, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে বেহেস্ত নসীব করুন!)। আমি ছিলাম ২ নং প্লাটুনের। বিএমএতে তখন এটা একটা প্রতিযোগিতার মত শুরু হয়ে গিয়েছিল যে এক প্লাটুনের ওস্তাদরা সুযোগ পেলেই অন্য প্লাটুনের জিসিদের টোকাই করতেন। তাতে তাদের নিজেদের প্লাটুনের শ্রেষ্ঠ প্লাটুন বিবেচিত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যেত। আমি তাঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে কী অপরাধে ইডি দেওয়া হয়েছে? উনি পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবই বের করে আমাকে দেখালেন। দেখলাম, তাতে লেখা আছে- "GC 139-ED For LOV"। GC 139 আমারই জিসি নম্বর ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না LOV বলতে কি উনি লাভ টাভ জাতীয় কোন কিছু বুঝাচ্ছেন নাকি? তখন তো আমাদের ব্যক্তিগত চিঠিপত্রগুলো সেন্সর করা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা করলেও তো করবেন এ্যাডজুট্যান্ট স্যার, কোন এনসিও তো নয় নিশ্চয়। তাই তাঁকে আবার LOV এর অর্থ জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, "ভিহিক্যালে (Vehicle এ) উইঠ্যা এত হাসেন ক্যান?" ইডি পাইছেন "লাফিং অন ভিহিকাল" এর জন্য।
বুঝলাম, মিলিটারী যানবাহনে উঠে হাসাহাসি করা একটা অপরাধ, আর সে অপরাধের নামই তাহলে "লাফিং অন ভিহিকাল" বা LOV!
মনে পড়লো, একদিন বহিরাঙ্গণ প্রশিক্ষণ থেকে ফেরার সময় আমি বসেছিলাম একটা খোলা ৩ টন লরীর একেবারে শেষে, টেইল বোর্ড ঘেঁষে। আমাদের ট্রাকটার ঠিক পেছনেই আসছিলো ১ নং প্লাটুনের ট্রাক, যেটার ফ্রন্ট সীটে বসা ছিলেন ওস্তাদ (হাবিলদার) আলী আকবর জোয়ারদার। তাঁর সাথে আমার কয়েকবার চোখাচোখিও হয়েছিলো। ফেরার সময় সতীর্থ ফিরদাউস আহমেদ (আর্মি দলের এবং পরে জাতীয় হকি দলেরও, নামকরা গোল কীপার ছিলো একসময়ে) আমার পাশে বসেই দারুণ একটা জোক বলেছিলো। আমি হাসিতে ফেটে পড়েছিলাম, আর ওস্তাদ আলী আকবর জোয়ারদার পেছনের ট্রাকের ফ্রন্ট সীটে বসে সেটাই লক্ষ্য করেছিলেন। আর যাই কোথা! সাথে সাথে তিনি সেটা তার নোটবুকে টুকে নিয়েছিলেন।
একটা নির্দোষ, নির্মল প্রাণখোলা হাসির জন্য এরকম একটা মূল্য আর কোথাও দিতে হয় কিনা জানিনা, কিন্তু তখন ওগুলোই ছিলো আমাদের পার্ট অফ লাইফ!
ঢাকা
১৪ অগাস্ট ২০১৫
১. ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৮:২২ ০