এক কানা কয় আর এক কানারে, চল এবার ভব পারে ।
নিজে কানা পথ চেনে না পরকে ডাকে বারং বার।
এসব দেখি কানার হাট বাজার
লালন শাহের এই বিখ্যাত আধ্যাতিক গানের কানার হাট বাজারের মতই আমাদের দেশ জুড়েও রয়েছে অসংখ্য হাট বাজার। আজ বাজার নয় শধু হাটের কথাই হোক। তা সেটা লালমনির হাট থেকে টেকের হাটই হোক,অথবা গাবতলী পশুর হাট থেকে যশোরের গঁদখালী ফুলের হাটই হোক। গদখালীর এই ফুলের হাটে নাকি লক্ষ লক্ষ টাকার ফুল কেনা বেচাই হয়। এরই সাথে রয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের বিখ্যাত এক হাট যার নাম পিৎজা হাট। এর শাখা রয়েছে আমাদের দেশেও, যেখানে উচ্চবিত্ত রসনা বিলাসীদের পিৎজার স্বাদ নিত্য আনাগোনা, এছাড়া আরো আছে ছবির হাট, শিশুদের নিয়ে চাঁদের হাট, রূপসীদের জন্য রূপের হাট এমনতর অসংখ্য হাট।
গঁদখালী ফুলের হাট
অভিধানিক ভাষায় হাট হলো সেই স্হান যেখানে প্রকাশ্যে পন্যের কেনা বেচা চলে। তবে সেটা বাজারের মত প্রতিদিন বসে না। সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিন একটি নির্দিষ্ট স্থান শুধু বরাদ্দ থাকে হাটের জন্য। সেই দিনে হাটুরেরা সব দুরদুরান্ত থেকে আসে তাদের পন্য নিয়ে আর বিক্রি করে ফিরে যায় দিন শেষে তাদের নিজস্ব আলয়ে।
হাটের পথে যাত্রীরা।
এ সব কথা থাক। চলুন আজ আপনাদের নিয়ে যাই এক নতুন হাটে।এই হাটের নাম বর্ডার হাট। নামটা কি আপনাদের পরিচিত লাগছে ? হয়তো অনেকে শুনেছেন,আবার অনেকের কাছে একেবারেই আনকোরা। আমারও কিছুটা ধোঁয়াশা ছিল এই নতুন হাট নিয়ে।
যেখানে সীমান্ত আমার
এই সীমান্ত হাটের জায়গা হলো আমাদের প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত আর আমাদের দেশের সীমান্তের মাঝে যাকে বলে নো ম্যান্স ল্যন্ড এ। স্থানটি সংরক্ষিত বলে ভোটার আইডি কার্ড বা ডিসির অনুমতি লাগে ব্যাবসায়ী ছাড়া সাধারন জনগনের হাটে প্রবেশ করতে ।
শুনেছিলাম এই হাট শুরু হয় প্রতি মঙ্গলবার দুপুর দুটো থেকে। কিন্ত ডিসির অফিস জানালো এই অভিনব হাট সকাল নটা থেকেই শুরু হয়। প্রথম দিকে কড়াকড়ি থাকলেও একটু বেলা গড়ালে সবার জন্যই খুলে দেয়া হয় এর দরজা। আর কথা নয় তাড়াতাড়ি রওনা হোলাম সীমান্ত হাটের উদ্দ্যেশে।
ঘাটের নাম হালুয়ারঘাট।
বাস স্ট্যান্ড থেকে নদীর এপারে হালুয়ার ঘাট অটো ভাড়া ১২০ টাকা। মাথাপিছু ৫ টাকা দিয়ে নৌকার ফেরি পেরিয়ে অপর পারে আসলাম। ঐ পারে এক ব্যাক্তির নির্দেশনায় সব অটোর চলাচল। সীমান্ত হাটে আসা যাওয়া এবং অপেক্ষা সব কিছুর জন্য ৬০০ টাকায় রিজার্ভ, এবং এই টাকা আপনি হাট থেকে ফিরে এসে ইজারাদারের হাতে দেবেন। অটোতে ৪০ মিনিটের মত লাগে গন্তব্যে পৌছাতে। আসার সময় সেই অটো আলাকে খুজে পাইনি। যেহেতু সিন্ডিকেট সুতরাং যে কোন অটো আমাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য। এই প্রথম বারের মত সিন্ডিকেট সিস্টেম ভালো লাগলো ।
রাস্তার দু পাশে কেটে রাখা সোনালী ধান
সুন্দর এক গ্রামীন পরিবেশের ভেতর দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি সেই আমাদের জন্য নতুন এক বিষয় সীমান্ত হাটের দিকে।
দূর থেকে মনে হলো আলুর ক্ষেত
অটোতে আমরা
দক্ষ চালকের সাথে ঢালাই করা রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি সীমান্ত হাটের দিকে।
রেস্ট্রিকটেড থাকায় এখানে পোষ্ট করা সব ছবির দিন তারিখ ও ব্যাক্তি বিশেষের ছবি মুছে দিলাম।
এখন দেখুন আমার চোখে দুদেশের সীমান্তে বসা বর্ডার হাট
বর্ডার হাট
প্রচুর লোক সমাগমে জায়গাটি তখনই গম গম করছে। সবাই সেই হাটে ঢুকতে চাইছে। কিন্ত একটি ছোট্ট সেতুর উপর দাঁড়ানো আমাদের সীমান্ত প্রহরী ভাইয়েরা আড়াআড়ি বাশ দিয়ে পথ আটকে রেখেছে।ওটাই আমাদের দেশের সীমানা। অনেকে মাটিতে বসে আছে গেট খোলার অপেক্ষায়।
খৈয়ামের কবিতার ভাষায় সবাই বলছে 'দুয়ার খোল দুয়ার খোল ভাই, সময় যে আর নাই'
বিফল মনরথে এদিক ঘুরতে লাগলাম। এক বার চেষ্টা করে বাশ প্যাঁর হোলাম। কিন্ত হাটের ভেতর প্রবেশের দরজা তখনো বন্ধ। বাইরে থেকে কিছু ছবি তুললাম
সবাই হাটের দরজার সামনে কিন্ত গেট বন্ধ
বিফল হয়ে ফিরে আসলাম। পথের মাঝে লোক জন ঘুর ঘুর করছে
আমরাও এখানে ঘোরাঘুরি করছি
খানিক পর রাস্তার ধারের এক অস্থায়ী রেস্তোরায় বসে চা আর ছোলা ভুনা খেলাম ।
হাটের মতই অস্থায়ী রেস্তোরা
এখান থেকে বের হয়ে অন্যপাশে চলে আসলাম । এখান থেকে কিছুটা দূরে সীমান্ত হাটকে দেখছিলাম । বুঝতে চেষ্টা করছিলাম কি বেচা কেনা হচ্ছে এখানে।
দূর থেকে সীমান্ত হাট
হাটের ছবি
তীক্ষ চোখে দেখা
কাঁটা তারের ভেতর হাটের ছবি
ওপারের সীমান্ত রক্ষীদের ট্রাক
ছোট্ট পানির ছড়ার এপার আমাদের দেশের ভেতর থেকে তোলা
দূর থেকে হাটের ভেতর।
আস্তে আস্তে ছোট ছড়াটি ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে গেলাম কাটাতারের কাছে।
দূর থেকেই মনে হচ্ছে আমাদের দেশের বিখ্যাত চিপসের বস্তা।
অপর পারের ক্রেতা বিক্রেতার মাঝে আলাপ।
আমাকে ছবি তুলতে দেখে নিষেধ করছে ছেলেটি
অবশেষে ঠিক ঠিক দুপুর দুটোয় আমরা সেই সীমান্ত হাটে প্রবেশ করতে সক্ষম হোলাম। ভারতীয় বিক্রেতারা তাদের দেশীয় পন্য নিয়ে এসেছিল। তবে সেগুলো তেমন মান সম্পন্ন কোন জিনিস ছিল না। পরিমানেও কম তারপরও আমাদের দেশের ক্রেতাদের ঝাপিয়ে পড়া দেখে চমকে গেলাম। বেশিরভাগই ছিল কাচা সুপারী, এবং কমলা লেবু, সামান্য প্রসাধনী এবং কিছু শাল ও কম্বল।আমাদের বিক্রেতারা নিয়েছিল জ্যুস, চিপস , গরম কাপড় এবং মেলামাইন ও ঘর সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় নিত্য পন্য।
কাঁচা সুপারী আর কমলা নিয়ে দাঁড়ানো সীমান্তে ঐ পারের এক বিক্রেতা
এই ছবিটা তোলার পর কি মনে করে আমি গেটের কাছে গিয়ে আমাদের এক সীমান্ত প্রহরী অফিসারকে বললাম "ভাই আমি গেটের উপরে লেখা বর্ডার হাট কথাটি ভালো করে তুলতে চাই"। সেতো আমাকে ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। বল্লো 'আপনি কি করে এখানে ক্যামেরা নিয়ে এসেছেন ? আপনাকে কিছু বলে নি '!
কে কি বলবে হাজারও জনতার ধাক্কাধাক্কিতে কে কাকে চেক করে !
আমি বললাম "নাতো"! আমিও ততোধিক হতভম্ব হোলাম।
এরপর আর হাটের ভেতর ছবি তোলা হয়নি।সেই অফিসারের নির্দেশে ক্যামেরা ব্যাগে ঢুকিয়ে বিরস বদনে হাটে ঘুরলাম আধ ঘন্টার মত। তারপর ফিরে আসলাম সেই ভয়ংকর জানজট ঠেলে।
ছুটে আসা হাটুরেরা
তখনো মানুষ পাগলের মত সেই হাটের দিকে ছুটছে। তবে ওপার থেকে আসা বিক্রেতারা ছাড়া সে দেশের সাধারন ক্রেতা বলতে ছিলই না। নতুন এক ধরণের হাটে ঘোরার স্মৃতি হিসেবে কিনে আনলাম গোটা চারেক কমলা আর এলাচ।
রবি ঠাকুরও লিখেছেন কবিতায়
কোন হাটে তুই বিকোতে চাস ওরে আমার গান ?
কোনখানে তোর স্থান
মনে হয় গানেরও হাট আছে
ফুলের হাটের ছবিটি শুধু নেট থেকে নেয়া .....বাকি সব ছবি আমার তোলা ।