ক্ষীর সাগর মন্থনের সময় মন্দার পর্বতের উপর দন্ডায়মান দেবরাজ বিষ্ণু, সুবার্নভুমি এয়ারপোর্ট, থাইল্যান্ড
অমর কথাটির অর্থই হলো যার মরণ নেই অর্থাৎ মৃত্যুহীন জীবন। অমরত্ব শব্দটা শুনলেই আমরা সবাই নড়েচড়ে বসি, উৎসুক হয়ে উঠি। এটা সেই বিখ্যাত গায়ক মাইকেল জ্যাকসন থেকে শুরু করে আমাদের মতন আমজনতা পর্যন্ত।?
এই নশ্বর জীবন জরাজীর্নহীন অনন্ত যৌবন, অক্ষয় আর অমর হোক তা কে না চায় ? এক্ষেত্রে মানুষই হোক আর স্বর্গের দেবতাই হোক। কিন্ত আমরা তো জানি আমাদের প্রত্যেককে মৃত্যুর স্বাদ অবশ্যই গ্রহন করতে হবে । কিন্ত এক্ষেত্রে দেবতাদের ব্যাপার স্যাপার ভিন্ন। তারা অমর -অক্ষয় । কি করে তা হলো তা জানার জন্য আসুন ব্যাসদেব রচিত মহাভারত নিয়ে বসি।
সংক্ষিপ্ত আকারে লেখা ঘটনা, সুবার্নভুমি এয়ারপোর্ট
এই বিশ্ব ব্রম্মান্ড যখন দেবতা আর অসুরদের বাস ছিল সেই সময় একদিন দেবরাজ ইন্দ্র হাতীতে চড়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছিলেন। এ সময় তার সামনে পড়লো অত্যন্ত কোপন স্বভাব বলে খ্যাত মুনী দুর্বাশা। দুর্বাশা ইন্দ্রকে দেখে তাকে সৌভাগ্যময় একটি মালা উপহার দিল। দুর্বাশা সত্যি সত্যি দুর্মুখ রগচটা কি না তা পরীক্ষার জন্য ইন্দ্র মালাটি হাতির শুড়ে পরিয়ে দিল। তার ইশারায় হাতী মালাটি মাটিতে ছুড়ে মারলো। এ ঘটনায় মুনি দুর্বাশা অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলেন এবং অভিশাপ দিলেন যাতে সকল দেবতারা সবরকম ভাবে শক্তিহীন, ভাগ্যহীন এবং দুর্বল পড়েন।
মহাভারতে বর্নিত সেই ক্ষীর সাগর
এই ঘটনার পরপরই রাজা বালির নেতৃত্বে অসুররা শক্তিহীন দুর্বল হয়ে পড়া দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গ্যরাজ্যের অধিপতি হয়ে বসলো। পরাজিত দেবতারা যে যেখানে পারলো আশ্রয় নিল। এর মধ্যে অনেকেই সাগরের নীচে পাতালপুরীতেও আশ্রয় গ্রহন করলো। এদের মধ্যে অমৃতের কলসী নিয়ে স্বর্গের দেবরাজ ধন্বন্তরীও আছে। অবশেষে নিরুপায় দেবতারা এ অবস্থা থেকে উদ্ধারলাভের জন্য ভগবান বিষ্ণুর আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। অনেক চিন্তা ভাবনা করে বিষ্ণু তাদের সমুদ্র মন্থন করে অমৃত নিয়ে আসার বুদ্ধি দিলেন।
ক্ষীর সাগর মন্থনে ব্যাস্ত অসুরের দল
কিন্ত ক্ষীর সাগর মন্থন করা ছিল এক বিশাল দক্ষযজ্ঞ ব্যপারস্যপার যা একা দেবতাদের পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়।ভগবান বিষ্ণু তখন দেবতাদের বুদ্ধি দিলেন অমৃতের ভাগ দেবার লোভ দেখিয়ে অসুরদেরও এই কাজে টেনে আনা হোক।অসুরদের অমৃতের ভাগ দেয়া হবে শুনে দেবতারা চঞ্চল হয়ে উঠলো। তখন বিষ্ণু তাদের এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে অসুরদের সাহায্য নেয়া হলেও তারা যাতে অমৃতের ভাগ না পায় সেই ব্যবস্থা তিনি করবেন।
অসুররা সমুদ্র মন্থনে
অমৃতের লোভে অসুররা রাজী হলো ক্ষীর সাগর মন্থনে দেবতাদের সাহায্য করতে। এখন এই বিশাল সাগর মন্থনের জন্য দন্ড হিসেবে কি ব্যবহার করা যায় দেবতারা তা ভেবেই পাচ্ছিলনা। তখন বিষ্ণু বুদ্ধি দিলেন বিশাল পর্বত মন্দারকে একাজে লাগানোর। কিন্ত সেই এগার হাজার যোজন উচু,তেমনি তার বেড় সেই পর্বতকে কি করে এনে সাগরের মাঝখানে স্থাপন করা যায়! দেবতা আর অসুররা মিলে সেটা উপড়ে আনার জন্য টানাটানি করে কাহিল হয়ে পড়লো।
অবস্থা দেখে ভগবান বিষ্ণু শিবের কন্ঠে সর্বদা হারের মত জড়িয়ে থাকা সর্পরাজ বাসুকিকে এব্যাপারে সাহায্য করতে অনুরোধ করলো। সর্পরাজ বাসুকী গিয়ে সেই বিশাল মন্দার পর্বতকে একটানে উপড়ে এনে ক্ষীর সাগরের মাঝে বসিয়ে দিল। এখন এত বড় দড়ি কই পাবে! দেবরাজের পুনরায় বাসুকীকে অনুরোধ করলো যেন সে নিজে পর্বতকে বেষ্টন করে মন্থনের দড়ি হিসেবে।
তাড়াতাড়ি কুর্মরাজ এগিয়ে পিঠ পেতে দিল বিশাল সেই মন্দার পর্বতকে ধারন করার জন্য
এদিকে সেই বিশাল মন্দার পর্বত ক্ষীর সাগরে স্থাপন করার কিছুক্ষন পরে তার নিজের ভারেই ডুবে যেতে শুরু করলো। তা দেখে ভগবান বিষ্ণু নিজে কচ্ছপের আকার ধারন করে মতান্তরে বিষ্ণুর অনুরোধে কচ্ছপরাজ কূর্ম তার পিঠের উপর মন্দার পর্বতকে আশ্রয় দিলো।
অসুররা দাবী করলো লেজ যেহেতু নিকৃষ্ট স্থান তাই তারা সর্পরাজ বাসুকির মুখের দিকটা ধরবে। বিষ্ণুর বুদ্ধিতে দেবতারা লেজ ধরতে রাজী হলো, কারন সমুদ্র মন্থনের ফলে বাসুকীর মুখ দিয়ে ধোঁয়ার আকারে যখন বিষ বের হয়ে আসবে তা অসুরদের উপর গিয়ে পরবে এবং পরবর্তীতে তাই ঘটেছিল।
মতান্তরে বাসুকীর মুখ নিঃশ্রিত হলাহল অসুরদের উপর গিয়ে পরে
বাসুকিকে দড়ির মত দুদিক ধরে টানাটানি করতে করতে অসুর আর দেবতারা শুরু করলো ক্ষীর সাগর মন্থন। এর ফলে সাগরের তল থেকে একে একে উঠে আসতে লাগলো অনেক কিছু। এর মধ্যে একটা ছিল হলাহল নামে ভয়ংকর এক প্রকার বিষ। ।কারো কারো মতে সেই বিষ ছিল বাসুকির মুখ নিসৃত। প্রচন্ড বিষাক্ত এই বিষ দেখে দেবতা এবং অসুরা উভয় দলই আতংকিত হয়ে পড়লো। এই বিষ সাগরে ছড়িয়ে পড়লে পানি দুষিত হয়ে সব প্রানী মারা যাবে। এই আশংকায় বিষ্ণুর অনুরোধে শিব ঠাকুর সেই বিষ এক চুমুকে গিলে ফেলতে গেলে শিবের স্ত্রী পার্বতী তার গলা চেপে ধরলো। ফলে সেই বিষ আর শিব ঠাকুরের গলা অতিক্রম করে পেটে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়নি। সেই হলাহল বিষের নীলে নীল হয়ে যাওয়া কন্ঠের জন্য শিবের আরেক নাম নীলকন্ঠ।
নাগরাজ বাসুকীর লেজ ধরে আছেন দেবতারা
এই মন্থনের ফলে একে একে ক্ষীর সাগর থেকে ভেসে উঠতে লাগলো ইচ্ছাপূরণকারী তরু কল্পবৃক্ষ সহ বিভিন্ন ঔষধি লতা গুল্ম এবং বিভিন্ন প্রকারের দামী দামী রত্ন। এই রত্নের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে দামী রত্ন কৌস্তভ যা বিষ্ণু নিজের জন্য গ্রহন করলেন এবং বাকিগুলো মান অনুযায়ী দেবতা এবং অসুরদের মধ্যে ভাগ করে দিল।
এরপর যথাক্রমে মন্থনের ফলে ক্ষীর সাগর থেকে উঠে আসলো দেবীগনঃ
লক্ষীঃ ঐশ্বর্য্য এবং ভাগ্যের দেবী লক্ষীকে বিষ্ণু নিজেই গ্রহন করলেন তার সাথী হিসেবে।
অপ্সরাঃ এদের মাঝে ছিল ভুবনমোহীনি রূপসী পরবর্তীকালে বিখ্যাত মুনি বিশ্বামিত্রের ধ্যানভঙ্গকারী মেনকা, উর্বশী, তিলোত্তমা, রম্ভা ইত্যাদি। তাদের দেবতারা সঙ্গী হিসেবে বেছে নিলেন স্বর্গের নর্তকী হিসেবে।
বারুনীঃ তিনি হলেন সুরার দেবী, ঢুলু ঢুলু চোখ আলুথালু বেশে বারুনী উঠে এসে বিষ্ণুর নির্দেশে অনিচ্ছাসত্বেও অসুরদের বেছে নিলেন সঙ্গী হিসেবে।
উঠে আসলো অতিলৌকিক শক্তি/ক্ষমতা সম্পন্ন তিন প্রকার প্রানী, যেমনঃ-
কামধেনুঃ বাছুর ছাড়াই দুধ দানে সক্ষম এই অত্যাশ্চার্য গরু ভগবান বিষ্ণু গ্রহন করে মুনিদের দান করলেন। যাতে তারা এর থেকে উৎপাদিত ঘি ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদিত বিভিন্ন যাগযজ্ঞে ব্যাবহার করতে পারে।
ঐরাবতঃ এ নামের হাতীটি ছাড়াও আরো কিছু হাতী উঠলো যা দেবরাজ ইন্দ্র গ্রহন করলেন।
উচ্চৈঃশ্রবাঃ এই সাত মাথাযুক্ত ঘোড়াটি অসুরদের দেয়া হলো।
ক্ষীর সাগর মন্থনে সুর আর অসুরের দল
আসলো চির অম্লান ফুল পারিজাত,যা দেবতারা ইন্দ্রলোকে নিয়ে গেল। পাতাল থেকে চাঁদ উঠে স্থান পেল শিবের জটায়। আসলো সুর্য্য, শংখ আরো অনেক কিছু ।
অবশেষে যার জন্য এত কান্ড সেই অমৃত নিয়ে এবার উঠে আসলো স্বর্গের কবিরাজ ধন্বন্তরী। দেবতারা যখন তাদের ভাগ বাটোয়ারায় পাওয়া জিনিসপত্র নিয়ে মহাব্যাস্ত সেই সুযোগে অসুররা সুধার কলসীটা কবিরাজ ধন্বন্তরীর কাছ থেকে নিয়ে নিল।এবার দেবতাদের টনক নড়লো। একি! যার জন্য এত কিছু সেই অমৃতের কলসী দেখি অসুরদের হাতে । এরপর সেই অমৃতের অধিকার নিয়ে উভয়পক্ষের মাঝে শুরু হলো তুমুল কলহ। সেই ঝগড়া দেখে শিবঠাকুর এসে উভয়পক্ষকে শান্ত হতে নির্দেশ দিলেন। এরই ফাকে নারায়ন অপরূপ এক নারী মুর্তি ধারন করে সেখানে এসে হাজির ।তার সেই অপুর্ব মোহীনি রূপে সবাই যখন বাকরূদ্ধ হয়ে তাকে দেখতে ব্যাস্ত, সেই সুযোগে দেবতা বিষ্ণুর বাহন বিশাল পাখি রূপী দেবতা গরুড় এসে অসুরদের কাছ থেকে অমৃতের কলসী নিয়ে উড়ান দিল।
ক্ষীর সাগর মন্থন
কিন্ত মেয়ে রূপী নারায়ন গরুড়ের কাছ থেকে অনায়াসেই কলসীটা নিয়ে নিল এবং অমৃত পানের জন্য সবাইকে সার বেধে বসতে অনুরোধ করলো। পুর্বপরিকল্পনা মাফিক প্রথমেই দেবতাদের দিয়ে শুরু হলো অমৃত পান। অসুররা দেখলো যে ভাবে অমৃত বিলি করা হচ্ছে তাতে শেষ পর্যন্ত তাদের ভাগে আর কিছুই থাকবে না।
এটা দেখে এক অসুর লুকিয়ে দেবতাদের সারিতে ঢুকে অমৃত পান করতে শুরু করলো যা সুর্য্য আর চন্দ্র এর নজরে পড়ে যায়।
তারা এই ঘটনা দেবতা নারায়নের নজরে আনলে তিনি সাথে সাথে তার সুদর্শন চক্র নামক অস্ত্র দিয়ে তার গলা কেটে ফেলে।কিন্ত অমৃত পানের ফলে সেই অসু্রও এখন অক্ষয়, অমর হয়ে গেল আর গ্রহ হয়ে আকাশে আশ্রয় লাভ করলো। এই গ্রহের মাথার নাম হলো রাহু আর দেহের নাম কেতু। চন্দ্র আর সুর্য্যের উপর আজীবন এক তীব্র আক্রোশ সৃষ্টি হলো অসুর রাহুর। আর তার ফলেই যখনই সুযোগ পায় তখনই তাদের গিলে খেয়ে ফেলতে চেষ্টা করে সে। কিন্ত গলা কাটা থাকায় অল্প কিছুক্ষন পরই তারা গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে। এটাই হিন্দু ধর্ম মতে চন্দ্র এবং সুর্য্য গ্রহনের কারন।
ক্ষীর সাগর মন্থনে দেবতার দল
দেবতা আর অসুরদের মাঝে দীর্ঘ এই বিবাদের পরিসমাপ্তি ঘটে তখনই যখন অমৃত পান করে অমর হয়ে ওঠা দেবতাদের হাতে অসুরদের পরাজয় ঘটলো। এবার পরাজিত হয়ে অসুররা পাতালে আশ্রয় গ্রহন করে আর দেবতারা হয়ে উঠে স্বর্গরাজ্য এর একচ্ছত্র অধিপতি। সেই তখন থেকেই অক্ষয়, অজর, অমর দেবতারা স্বর্গের অপ্সরা উর্বশী মেনকাদের নৃত্য উপভোগ করে সুখে জীবন যাপন করতে থাকলো।
এই ঘটনাটি নিয়ে অনেক রকম মতভেদ আছে। আমি মহাভারতকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি।
ছবিঃ আমার ক্যামেরায় তোলা, ব্যাংককের সুবার্নভুমি এয়ারপোর্টে স্থাপিত ভাস্কর্য্য ।
তথ্য সুত্র নেট:
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০১৭ সকাল ১০:৪৬