নভেম্বর মাস শেষ হয়ে গেছে, ডিসেম্বর চলছে। আমি সুর্যের তেজ কমে যাওয়া রোদের মাঝে খোলা বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে আছি। নিস্তব্ধ নিরিবিলি সেই ঘুঘু ডাকা দুপুরে ঘরের সামনের পুকুরটায় হরেক রকম পাখির মধ্যান্হ কালীন স্নান পর্ব চলছে।
আমি চেয়ে চেয়ে দেখছি পাখিগুলো একটা করে ডুব দিয়ে আসছে তারপর পাড়ে বসে ঠোট দিয়ে ভেজা পালকগুলো চিরুনীর মত টেনে টেনে আচঁড়ে দিচ্ছে। আবার একটা ডুব আবার আঁচড়ানো। তারপর কিছুক্ষন পৌষের রোদে এ পাশ ও পাশ করে ডানা মেলে গা টা শুকিয়ে কোথায় যেন উড়ে যাওয়া।
এই গ্রামে এসে আমি অনেক রকম পাখি চিনেছি। দোয়েল, শ্যামা, টুনটুনি, বুলবুলি, বৌ কথা কও, কাক, চিল, ঘুঘু, হলদে পাখী কি নেই ! ছাতারে পাখিগুলো আসে দল বেধে ক্যাচ ক্যাচ করতে করতে, ওদের আমার ভারী মজা লাগে। সারাক্ষন মনে হয় ঝগড়া করছে, এমন কি গোসলের সময়ও ।
মাঝে মাঝে ঠান্ডা একটা দমকা বাতাস কোথা থেকে এসে চারপাশের গাছ থেকে শুকনো পাতা ঝরিয়ে দিয়ে যায়। কয়েকটা পাতা আবার ঘুরতে ঘুরতে পুকুরে এসে পরে।
আমার স্বামী মাঝে মাঝে ঘর থেকে বের হয়ে বলে, 'কি ব্যাপার আজও এই পাখীর স্নান পর্ব দেখছো'!
আমি শুধু বলি, 'হু খুব ভালোলাগে আমার'।
আমাদের শহুরে জীবনে কাক, চড়ুই, শালিক আর খাচায় পোষা ময়না, টিয়া ছাড়া কি দেখেছি বলতে পারবো না।
শীতের বেলা বিকেল হয়ে আসে খুব তাড়াতাড়ি। পুকুর থেকে ঠান্ডা বাতাস উঠে আসে।আমি ঘরে ফিরে যাই। আমার বাসার পেছনেই বিশাল এক বাঁশ ঝাঁড়। ঘর থেকে শোনা যায় সন্ধ্যায় হাজারো পাখির কলতান । অদ্ভুত এক ভালোলাগায় মন ভরে উঠে। আমি প্রতিদিন এই মুহুর্তটার জন্য অপেক্ষা করি। কখনো ক্লান্ত হইনা।
যেদিন প্রথম এসেছিলাম তখন ছিল অক্টোবর মাস, ওরা বলে মরা কার্তিক। কারন ধান কাটা শেষ। সে সময় কৃষকের কোনো কাজ থাকেনা ।ফসল শুন্য আদিগন্ত বিস্তৃত শুকনো মাঠ। রিকশাওয়ালাটা অনেক বেশী ভাড়ায় রাজী হয়েছিল আসতে। এখানে কোনো রাস্তা নেই। কোনো গাড়ি ঘোড়া চলেনা। পা দুটোই সবার ভরষা। সেই মাঠে মিষ্টি দেখতে ছাগলের বাচ্চাগুলো দৌড়াদৌড়ি করছিল। কি যে ভালো লাগছিলো বলার নয়।
আমার স্বামীর নিজস্ব পছন্দে সেখানে বদলী। আজীবন ঢাকায় থাকা মানুষ ইন্টারভিয়্যু দেয়ার সময় বলেছিল সেই সংস্থার সর্বোচ্চ প্রধানকে,
"আমি গ্রামে যেতে চাই, আমি তৃণমুল পর্যায় থেকে কাজ শিখতে চাই"।
আমার স্বামীর এই উক্তি পরবর্তীতে তিনি দীর্ঘদিন উদাহরণ হিসেবে অনেক স্টাফদের সামনে উল্লেখ করেছেন । কারণ কেউ গ্রামে যেতে চাইতো না। আর বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে আসা একটা ছেলে গভীর গ্রামে স্বইচ্ছায় যেতে চাইছে। যা তাকে ভীষন অবাক করেছিল।
এসে দেখলাম চারিদিকে ধু ধু মাঠের এক ধারে চারিদিকে তাঁরকাটার বেড়া দেয়া বেসরকারী সংস্থার অফিস কাম বাসা। মাঝখানে এই পুকুর আর দুদিকে পাচ ছয়টা করে রুম নিয়ে দুটো টিনের ঘর।
ঐ পাশে অফিস আর সাত জন স্টাফ থাকে আর আমরা দুজন এদিকে থাকি। ওনারা সবাই ছাব্বিশ থেকে তিরিশ বছরের যুবক। কেউ বিয়ে করেছে, কেউ করেনি। তবে যারা বিবাহিত তাদের বৌরাও কেউ এখানে থাকে না।
আমাদের এই কমপ্লেক্সের পুকুরটাই ছিল আমার আকর্ষনের কেন্দ্র বিন্দু। পুকুরের পানি দিয়েই রান্না বান্না, গোসল সব চলতো। বালতি ভরে পানি উঠানো হতো।
টিউবওয়েল অবশ্য ছিল একটা, কিন্ত সেটার পানিতে অসম্ভব আয়রন। দিনের মধ্যে কতবার যে আমি পুকুর ঘাটে এসে পা চুবিয়ে বসে থাকতাম তার ইয়াত্তা নেই। আটাগুলে টোপ বানিয়ে বড়শী দিয়ে মাছ ধরতাম আর সেই সাথে সাতার শেখার চেষ্টা।
হয়তো অফিসে কেউ নেই । গুটি পোকা দেখাশোনা করতো যে মেয়েটা নাম ছিল জোৎস্না। সে মাঝে মাঝে বলতো, 'আসেন ভাবী আপনাকে সাতার শিখিয়ে দেই' ।, কিন্ত ছোটোবেলা থেকেই কেন জানি পুকুরে নামলেই আমার হাল্কা পাতলা শরীরটা অসম্ভব ভারী হয়ে উঠতো আর নীচের দিকে টানতে থাকতো।কিছুতেই ভেসে থাকতে পারতামনা।এবার ও তার ব্যাতিক্রম হলোনা।
জ্যোৎস্না হাল ছেড়ে দেয় দুদিনে। ফলে আজও সাতার শেখা হয়নি আমার।
আস্তে আস্তে পুকুরের পানি কমে নীচে নেমে আসছে। পানি এখন ঘন মাঠার মত । এই পানিতে এখন আর কোনো কাজই হয়না।
সন্ধ্যা হতে না হতেই কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আসে চারিদিক । ঝি ঝি পোকা গুলো অবিরল ডাকতে থাকে। আর সকালের মত বিকাল হলেও আমার স্বামী সহ সবাই বিভিন্ন গ্রামের মানুষ নিয়ে গড়া যে বিভিন্ন সমিতি সেখানে চলে যেতো।
সন্ধ্যা হলেই হারিকেনের মৃদু আলোয় ঘরের কোনায় কোনায় অন্ধকার যেন ভারী হয়ে ওৎ পেতে থাকতো। পেছনের বাঁশঝাড়টা যেনো আরো নীচু হয়ে আসতো। শীতটাও যেনো জেঁকে বসতো। ভীষন ভয়ের সাথে সাথে একলা ঘরে দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকতো আমার।
আমি শাল গায়ে দরজায় তালা ঝুলিয়ে হারিকেন নিয়ে এক দৌড়ে পুকুরের ও পাশে চলে আসতাম। যেখানে বুড়ী শহুরীর মা বিশাল দুটো মাটির চুলা জ্বালিয়ে সবার জন্য রাতের খাবার রান্না করছে আর কিশোর দারোগা আলী যোগান দিচ্ছে। আমি গল্প করতাম ওদের সাথে পিড়ি পেতে হারিকেনের আলোয়, লাকড়ীর ধুয়োতে ঝাপসা হয়ে আসা কালি ঝুলি মাখা রান্না ঘরে বসে।
মাঝে মাঝে দারোগা আলী ভুতের গল্প করে, শহুরীর মাকে সাক্ষী মানে 'খালা কন তো এমন হইছিল না' ? সেও সায় দেয়। আমার হাত পা জমে আসে। কিন্ত ওরা বোঝে না।
গা ছম ছমে সেই ভুতুরে পরিবেশে আমি কোনো দিন থাকি নি । কি যে এক রোমান্চকর অভিজ্ঞতা ।সারা গ্রামে বিদ্যুত নেই, কলের পানি নেই। আশে পাশে গ্রামের কোনো চিন্হ নেই। অনেক দুরে মানুষের বসতি। আর আমরা সেই ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে তিনজন হারিকেন নিয়ে বসে আছি।
ছোটো এক কিশোরী আমার ঘর কন্নার কাজে সকাল থেকে সহায়তা করে। রাতের রান্না সেরে সে দুপুর খেয়ে দেয়ে চলে যায়। তার পর থেকে আমার অফুরন্ত অবসর। আমি ঘুরে ঘুরে বেড়াই সেই নির্জন দুপুরে শুকনো পাতার উপর মর্মর শব্দ তুলে। জানি না কেন জানি বন্য কোনো পাতার গন্ধ আমাকে দামী পারফিউমের চেয়েও বেশী আকৃস্ট করে।
আমার বাবা একবার এসে দেখে জীবনে কুটো ভেঙ্গে দুটো না করা মেয়ে তার মাটির চুলোয় পাঠখড়ি দিয়ে ভাত রান্না করছে। সেদিন চোখের পানি ফেলে বলেছিল, 'আমি কি এজন্য তোমায় লেখাপড়া শিখিয়েছিলাম! তুমি আজই আমার সাথে ঢাকায় চলো'।
আমি বলেছি 'না বাবা এটাতো আমার সংসার, তাছাড়া ওতো আমাকে রান্না করতে বলে না,আমার কাজের মেয়ে আছে। আমি নিজ থেকেই মাঝে মাঝে করি। আমার মজা লাগে, পট পট করে পাটকাঠিগুলো পুড়ছে'।
আমার রান্নাঘরটি ছনের চালে ছাওয়া, চারিদিকে বাশের বেড়া আর প্রতিদিন মাটি দিয়ে নিকানো মাটির মেঝে। ছনের চালের অর্ধেকটা জুড়ে বিছিয়ে আছে লকলকিয়ে ওঠা লাউ লতায় সবুজ পাতা তাতে সাদা ফুল। আঙ্গিনার কাচা মরিচ গাছটা সবুজ আর পেকে ওঠা লাল মরিচের ভারে নুয়ে আছে। সেই সাথে শখ করে লাগানো আমার দু একটা গাঁদা ফুলের গাছ যেন হলুদ হলুদ ঝোপ।
মনে আছে যেদিন আমার নতুন সংসারে প্রথম স্টোভ জ্বেলে দুধ জ্বাল দিতে বসেছি, সে দিন আমি আর আমার স্বামী দুদিক থেকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়েছিলাম কি ভাবে সেটা উথলে উঠছে ! এ যেন এক অভুতপুর্ব ঘটনা! এমনটি মনে হয় কখনো ঘটেনি কারো জীবনে!
আমার স্বামীর কলিগরা আমাদের দুজনকেই অসম্ভব পছন্দ করতো। কারণ আমাদের মধ্যে কোনো উন্নাসিকতা ছিলনা। আমার স্বামী সেখানকার ইনচার্জ ছিল। কিন্ত তার আচার আচরনে সেটা কখনই প্রকাশ পেতো না । আমরা সেই গ্রামীন জীবনের সাথে সম্পুর্ন মিশে গিয়েছিলাম। কখনো বলিনি, 'এটা পারবো না, ওটা করবো না, এমনটা জীবনেও দেখিনি'।, কিন্ত প্রকৃত পক্ষে আমরা গ্রামীন জীবনের সাথে সম্পূর্নই অপরিচিত ছিলাম।
ডিসেম্বরের শেষের দিকে গ্রামে একটা মেলা হয়েছিল। অফিস থেকে মাইল দেড়েক দুরে, আমরা দুজন সহ সব স্টাফরা ই হেটে হেটে গিয়েছিলাম। সেই গ্রামীন মেলার সেই আবেদন, সেই ভালোলাগার কথা আমি বলে বোঝাতে পারবো না।
সেই মেলায় আমি তাদের সাথে টিনের চোঙায় চোখ রেখে বায়োস্কোপ দেখেছি। উকি দিয়ে অনেক কিছুর সাথে দেখলাম ক্যালেন্ডারের পৃস্ঠা থেকে কেটে নেয়া একটা বিদেশী মেয়ের ছবি সুর্যমুখীর ক্ষেতে বসে আছে। বায়োস্কোপ ওয়ালা হাতল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ডুগডুগি বাজিয়ে গান গাইছে, 'কি চমৎকার দেখা গেলো... মাইয়ে মানুষ বইসে রইলো ....'।,আমরা হাসতে হাসতে শেষ।
ঝুরি ভাজা আর মুড়ুলী খেয়েছি। হাওয়াই মিঠাই খেয়ে জিভ লাল করেছি।কাগজের ঠোঙ্গা ভরে খৈ আর চিনির মঠ কিনে জমির আঁল ধরে রাতের বেলা বাশের বাঁশীতে ফু দিতে দিতে ঘরে ফেরার পালা। সেই জোৎস্না রাতে সেই কুয়াশার ভেতর হেটে হেটে আসা, গল্প আর হাসি, আমার স্বামীর গান গাওয়া। সে আমার সারা জীবনের স্মৃতি।
প্রতিদিন সবাই রাত সাতটা আটটায় মিটিং থেকে ফিরে আসলে দশটা পর্যন্ত চলতো আমাদের গল্প। কত হাসির গল্প, কত কৌতুক। মাঝে মাঝে বাজি ধরে মিস্টি খাওয়া।
দশটায় দারোগা আলী খাবার রেডী ঘোষনা করলে আমরা ফিরে আসতাম পুকুরের এপাশে আমাদের নির্জন ঘরে। এভাবেই কাটছে আমাদের দিন।
গতকাল হেড অফিস থেকে খবর এসেছে আমার স্বামী ঢাকায় বদলী হয়েছে। দশ দিন পর চলে যেতে হবে। প্রথম শুনে ভালোই লেগেছিল। কারন পুকুরের ঘোলাটে পানি এখন একদম নীচে। কোনো কাজ করা যায় না। পাখীরা ও কম আসে ।আয়রন ভরা টিউবওয়েলের পানিতে আমার চুল লাল শক্ত হয়ে যাচ্ছে।
যত সময় ঘনিয়ে আসছে ততই সবকিছু যেনো আমায় দু হাত দিয়ে টেনে ধরছে। গেটের পাশের দুটো শিরীষ গাছ, সেই পেপে গাছের বাগান, সেই পুকুর পাড়, সেই রাতের আড্ডা, সেই বুড়ী আর দারোগা আলীর সাথে পিড়ি পেতে ভুতের গল্প।
রাতে কামাল ভাই, শহীদ ভাইদের সাথে আড্ডায় কথার সুর ছিড়ে ছিড়ে যায়। একটু পরেই সবাই চুপ হয়ে যায়। আমার গলায় কষ্ট দলা পাকিয়ে আটকে আসে। ওনারা কেউ আমার আত্মীয় নন এমন কি আমার বাড়ীর কাছের ও না । কিন্ত এখন মনে হচ্ছে রক্তের মধ্যে কি যেনো এক অসম্ভব টান।
আজ চলে আসবো, সকাল দশটা বাজে। আমি গত রাত থেকে অবিরল কেঁদে যাচ্ছি। আমার স্বামীর ও অনেক মন খারাপ। কামাল ভাই দারোগা আলীকে পাঠিয়েছে শহর থেকে রিকশা ডেকে আনতে।
আমাদের ধরা গলায় ডাকলো 'ভাবী আসেন'।, দুটো প্লেটে মিষ্টি। কত বাজী ধরে মিষ্টি খাওয়া এর আগে। নিজেরা কাড়া কাড়ি করে খেতো ।আর আজ তারা লাল হয়ে আসা ছলছল চোখে অন্যদিকে তাকিয়ে আমাকে মিস্টির প্লেট এগিয়ে দিচ্ছে।
আমার চোখের পানি আর রসগোল্লার শিরা একাকার হয়ে গেলো। আমি প্লেট টা রেখে বারান্দায় দাড়ালাম। বৌ কথা কও পাখিটা ডেকে উঠলো পুকুর পাশের তুত গাছ থেকে।
রিকশা এসেছে, আমি কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে রিকশায় উঠলাম। খুব একটা আবেগী নয় সেই আমার স্বামীর চোখও ছল ছল করছে। রিকশাটা চলতে শুরু করলো। পেছনের পর্দাটা সরিয়ে ঝাপসা চোখে ফিরে তাকালাম। দেখি আমাদের বিদায় দিতে এসে গেটের কাছে জড়ো হওয়া সেই সাতজন পরিণত বয়স্ক যুবক শিরীষ গাছের নীচে দাড়িয়ে ঝর ঝর করে নিঃশ্বব্দে কেঁদে চলেছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:৩৬