
রোমের বিখ্যাত ট্রিভি ফাউন্টেন
ঢাকা থেকে রোম যাবো পথে এক রাত দুবাই থাকতে হবে ট্রানজিট, এমিরেটসের ফ্লাইট।আমার স্বামীর অফিসের হেডকোয়ার্টার রোমে। সে একটা ওয়ার্কশপে সাতদিন আগেই চলে গেছে ।
আমার সাথী তার এক কলিগ। চারটা বাজে দুবাই ল্যান্ড করলাম। বিশাল এক অত্যাধুনিক এয়ারপোর্ট। সম্পুর্ন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সমস্ত প্রকার আনুস্ঠানিকতা সেরে বাইরে আসলাম আমাদের নির্ধারিত হোটেলে যাবার বাস ধরার জন্য। কি প্রচন্ড গরম মনে হচ্ছে যেন আগুনের হল্কা বইছে চারিদিকে। সবাই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছি , আর একটার পর একটা বাস আসছে আর যাত্রী নিয়ে ছুটে চলেছে পীচ ঢালা ঝকঝকে রাস্তা ধরে নির্ধারিত হোটেলের দিকে।

শহরের মাঝে উটের সারি
দুবাই টাইম ৪টায় এক বিলাশ বহুল হোটেলে উঠলাম।আমার জন্য নির্ধারিত হলো বিশাল এক ডাবল বেড রুম। তারকা খচিত সেই হোটেলে আরাম আয়েশের কোনো ঘাটতি নেই।
৫টায় আমার যাত্রা সংগী আমাকে গোল্ড মার্কেটে যাবো কিনা জানার জন্য ইন্টারকম করলেন। গেলাম সেই বহুবার বহু মানুষের মুখে শোনা বিখ্যাত গোল্ড মার্কেটে।তবে আসার সময় দুবাই এয়ারপোর্টের ডিউটি ফ্রি গোল্ডের দোকানগুলোই বেশী ভালো লেগেছিল। দুবাই শহরের গোল্ড মার্কেটের দোকান মালিকরা সবাই ভারতীয় অথবা পাকিস্তানি। সেলসম্যান হিসেবে আছে অল্প কিছু বাংলাদেশী।অনেক ক্রেতা বিশেষ করে আফ্রিকান মেয়েদের দেখলাম প্রচুর গহনা কিনতে।
আমার সাথের সাথী শুধু বলছে, ভাবী কোন চিন্তা করবেন না পছন্দ হলে কিনেন, টাকা লাগলে আমার থেকে নিন। উনি জানতেন আমার কাছে কয়েকশো ডলার ছাড়া বেশীরভাগই ট্র্যাভেলারস চেক যা ওখানে ক্যাশ করা ঝামেলা। কিন্ত ধার কর্জ আমার একটুও ভালোলাগেনা তাই ১টা চেন আর ২টা চুড়ি কিনলাম যা আমার ডলারেই হয়ে গেল।
যখন হোটেল থেকে বের হয়েছিলাম মনে হয়েছিল আগুনে ঝাপ দিলাম,রাতে যখন ফিরলাম অনেকদুর হেটে হেটে উপসাগরের পাশ দিয়ে কি ভালো লাগছিল, সাগরের উপর দিয়ে ভেসে আসা ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ... কি মধুর যে লাগছিল।
এক পাকিস্তানী ক্যাব চালকের ক্যাবে করে ফিরলাম হোটেলে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার গল্প শুনতে শুনতে।তখন মনে হলো আমাদের শ্রমিক ভাইদের কথা যারা দালালদের প্রতারানায় ভিটে মাটি বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ টাকা ধার করে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছে পরিবারের সুখের আশায়। কিন্ত সুখ তাদের মরিচীকা হয়ে মরুভূমিতে বহু আগেই মিলিয়ে গেছে।তাদের একমাত্র ভবিষ্যৎ চিন্তা এখন মহাজনের দেনা শোধ।

মরুভুমিতে বিশ্রামরত উট আর বেদুইন
হোটেলে ডিনার ছিল।এয়ার লাইন্স থেকেই কুপন দেয়া। আমার ভীষন খিধে লেগেছিল কারন প্লেনের খাবার আমার ভালোলাগেনি। কিন্ত আমার সাথী বল্লো তার খিধে নেই তারপরও আমাকে সংগ দিতে হোটেলেরই খাবারের রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। কুপনে আমাদের জন্য চয়েস ছিল দুটি, এক ফিলিপিনো আরেক ইতালীয় রেস্তোরা । আমরা যেহেতু ইতালী যাচ্ছি তাই ফিলিপিনো খাবারটা পছন্দ করলাম । কিন্ত মশল্লা ছাড়া সেদ্ধ সেদ্ধ মাছ জাতীয় খাবারটাও আমার একটুও ভালোলাগে নি । কিন্ত আমার সাথী যার বিন্দুমাত্র ক্ষিধে ছিল না উনি নিজের খাবারটা তো খেলোই সাথে আমার রেখে দেয়া খাবারটাও খেয়ে ফেল্লো ! বল্লো খাবার নষ্ট করা ঠিক না। প্লেনেও উনি নাকি কোনো খাবার ফিরিয়ে দেয়নি!
খেতে খেতে আমি ভাবছিলাম আমার ছেলের কথা যাকে দেশে রেখে এসেছি, স্বামীর কথা যে আরেক দেশে আর আমি আরেক দেশে কি অদ্ভূত কান্ড! এমনটি আর আগে ঘটেনি কোনোদিন।
সকালে ফ্লাইট ৪ঘন্টা লাগলো রোমে পৌছাতে। দুবাই টু রোম বিশাল প্লেন সিট গুলোও একটু বড় সর। প্লেনে বাংগালী একটি দশ বারো জনের দলের সাথে পরিচয় হলো তারা কি একটা ট্রেনিং এ যাচ্ছে ইতালী।পরবর্তীতে তাদের দু তিনজনের সাথে আমার ভেনিসে দেখা হয়েছিল।
রোমের লিওনার্দো দ্যা ভিন্চি এয়ারপোর্টে নেমেই বের হয়ে দেখি আমার স্বামী দাড়িয়ে আছে। একটা মাচো টাইপ আইসক্রিম খেয়ে ট্রেনে করে টারমিনিতে (রোমের central train station.) আসলাম।
সেখান থেকে মেট্রো করে তিবুরতিনা বলে এক জায়গায় দুদিনের জন্য পুর্ব পরিচিত এক বাংগালীর বাসায়।এই জায়গাটা শহরের এক পাশে।
দুদিন পরে তিবুরতিনা থেকে রোমের সকল কিছুর কেন্দ্র বিন্দু ভিক্টরীয় ঈমানূয়েল মেট্রো স্টেশনের সাথে লাগানো এক ফ্ল্যাটে উঠলাম।সেটা ছিল আমার হাসবেন্ডের কলিগ লুচিয়ানো বার্টিনির।সে ভাড়া দিত তার দুটো রুম। নাহলে রোমের ঐ জায়গায় বিশ দিনের জন্য বাসা পাওয়া কল্পনারও অতীত আমাদের ফ্ল্যাট থেকে ৩মিনিটের হাটা দূরত্বে টারমিনি ,পাশেই ট্রাম আর বাসের রাস্তা ,বাসার নীচেই মেট্রো স্টেশন।

ভিক্টোরিও ইমানুয়েল মনুমেন্ট
চতুর দিকে রাস্তা চলে গেছে গোল বৃত্তাকার জায়গাটার মাঝখানে একটা পার্ক তার চারিদিকে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাজার বসে। কাচা থেকে পাকা সব জিনিসই মেলে, ধনে পাতা, কাচামরিচ পুই শাক থেকে মাছ মাংস কাপড় চোপড় হাড়ি পাতিল বাদ নেই কিছু।
কত বাংগালীরা যে সেখানে ইতালীয় মালিকের অধীনে কাজ করছে।ওরা বিকিকিনির ফাকে ফাকে আমার সাথে গল্প করতো। আমিও একটু মিশুক টাইপের। ওরা যখন জানলো আমি ২০দিনের জন্য শুধু বেড়াতেই গিয়েছি কেমন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল, সে তাকানো আমি কখনোই ভুলবোনা।কত কস্ট করে এসেছে লুকিয়ে লুকিয়ে কত পদ্ধতিতে সেই গল্প করতো ওরা।
আমাদের বাসার নীচেই ছিল ফোনের দোকান,আমরা সকাল বিকাল আমার ছেলেকে ফোন করতাম,ফোনের দোকানের মালিক বাংগালী ছেলেটা যখন জানলো আমার ছেলেকে দুবেলা ফোন করি তখন সে জানতে চাইলো কেন আমার ছেলেকে নিয়ে আসিনি? জানালাম ইতালীয়ান এম্বেসী আমার ছেলের ভিসা দেয়নি ভেবেছে আমরা আর আসবোনা।
আমরাও বোকামী করেছিলাম অফিস থেকে একটা নোট ভারবাল এম্বেসীতে জমা না দিয়ে। তাহলে আমার ছেলেকে নিয়ে যাওয়া কোনো ব্যাপারই ছিলনা।এর পরে আর এই ভুল হয়নি।
বাসার কাছেই এক ট্যুর কোম্পানীর অফিস ছিল তাদের সাথে প্রোগ্রাম সেট হলো। নেপলস, ফ্লোরেন্স,ভেনিস।

শান্ত লেকের পাশে বারক প্রাসাদ রোম
রোম সিটি আর টিভোলি ট্যুর যা ছিল সারা বেলার প্রোগ্রাম আমি একা একাই করলাম। বাসার সামনে থেকে পিক বাসার সামনেই সন্ধ্যা বেলায় ড্রপ।
আমার স্বামীর অফিস ছিল সে যায়নি তাছাড়া এগুলো সে আগেও বহুবার দেখেছে।
এরপর শনিবার আমরা নেপল্সের উদ্দেশ্য রওয়ানা হবো। দেখবো নেপলস্, পম্পেই আর সোরেন্টো।তার পর ফ্লোরেন্স তার পর ভেনিস।
বাকীটা পরে লিখি---
পরের পর্ব
ভিসুভিয়াস
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১০:৩৫