ভাগ্নে সুজন যাবেনা কারণ সে বহুবার গেছে আর তার কাজও আছে। সুতরাং ঠিক হল তার দুজন বন্ধুকে নিয়েই যাব জুংফ্রাওশ বা টপ অফ ইউরোপ, আলপসের সবচাইতে উঁচু শৃঙ্গ। সকাল পাঁচটায় ভাগ্নেবৌ সিনথীয়া নাস্তা খাইয়ে দিল। হেঁটেই চলে গেলুম লুজান গাখ (Lausanne Gare) বা লুজান রেল স্টেশনে, কাছেই। অত সকালে সুইজারল্যান্ডে বাস চলেনা। যথারীতি ট্রেন সময়মতই এলো। আমরা সেই কার্তে জুখনী কেটে নিয়েছিলুম যাতে পুরো একদিনের ভ্রমনটা কভার করে। ঘন্টা তিনেক পর এক স্টেশনে নামলুম। সেখানে ট্রেন পাল্টে পাহাড়ে চড়ার বিশেষ ট্রেনে উঠলুম। ছবি দেখুন :
ট্রেনটা আকারে ছোট, গোটা তিনেক কম্পার্টমেন্ট, বিদ্যুতে চলে। এই ট্রেনটাতে চড়ার জন্য আলাদা টিকিট কাটতে হয়, ম্যালা দাম। আমাদের অবশ্য আর টিকিট কাটতে হয় নি। ট্রেনটার ইন্জীনের নীচে গিয়ারের দাঁত রয়েছে যা রেল লাইনের মাঝখানে অবস্হিত মাটির সঙ্গে যুক্ত গিয়ারের সাথে আটকে থেকে ট্রেনটাকে পিছলে যেতে না দেয়। কারণ ট্রেনটাকে কোন কোন জায়গাতে প্রায় ৩০ ডিগ্রী খাড়া উঠতে হয়, তার উপর বরফ তাকে প্রায়ই, সুতরায় পিছলে যেতে পারে যে কোন সময়। সেটা থেকে বাঁচার জন্যই মাটিতে আর ট্রেনে গিয়ার। ছবিতে খেয়াল করুন লাইনের গিয়ারগুলো।
অদ্ভুত তথ্য হচ্ছে এই ট্রেনলাইনটা বানানো হয় আজ থেকে একশ বছরেরও বেশি আগে ১৯১২ সালের দিকে! কল্পনা করুন তখনকার প্রকৌশল বিদ্যা ছিল একেবারে প্রাথমিক যুগের, ক্রেন ছিলনা, মাটি খোড়ার যন্ত্র বলতে হাতের কোদাল বেলচা হাতুড়ি।
আমরা প্রায় ঘন্টাখানেক খাড়া পাহাড়ের উপর চড়লুম, অবশ্যই ট্রেনে করে। অবশেষে পৌছলুম জুংফ্রাওশ নামক স্হানে যেটা সাগরপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩০০০ ফুট উঁচু!
ট্রেনটা থেমেছিল একটা গুহাতে সেখানে নেমেই পড়লুম ঠান্ডায়। প্রায় -৭ ডিগ্রী। গুহাটার ভেতরে অনেক দেখার জিনিস। সেই শত বর্ষ পুরোনো বেলচা কোদাল রাখা ছিল যা দিয়ে এই রেলপথ তখন বানানো হয়েছিল। ছিল তখনকার সেই শ্রমিকদের ছবি যারা এই অপুর্ব সুড়ঙ্গ বানিয়েছিল পরবর্তি প্রজন্মের মানুষের জন্য, আমাদের জন্য! ভেতরে লিফট আছে আছে চমৎকার রেস্তোরা আর তাতে রয়েছে চমৎকার সব খাবার।
জায়গায় জায়গায় বরফের রাস্তা, বরফ দিয়ে মুর্তি বানানো আছে। গুহা পেরিয়ে বাইরে বেরিয়েই দেখলুম খোলা আকাশ আর সাদা বরফ। অপুর্ব সেই দৃশ্য। সেখানে লোকেরা হাঁটছে স্কীইং করছে বা রোপওয়ে দিয়ে চড়ে অনেকদুর গিয়ে লাফিয়ে নামছে। এর কোনটাই করার বয়স বা শক্তি আমার নেই তাই শুধু দেখলুম আর উপভোগ করলুম। বরফের রাজ্যে দুনিয়া আনন্দময়, অবশ্য বঙ্গসন্তান আমরা তিনজনই।
যদিও টেম্পারেচার গেজ বলছে তাপমাত্রা মাইনাস ৬- ৭ ডিগ্রী কিন্তু বেশ কিছু পুরুষ মানুষ দিব্যি হাতা কাটা টি শার্ট পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! আমার অবশ্য বাসা থেকে আনা মোটা কোট গায়ে ছিল, বেশ আরামই লাগছিল।
স্কী করতে বা রোপওয়েতে চড়ে কয়েকশ গজ গিয়ে লাফ দিয়ে নামা প্রতিটাই টিকিট কাটতে হয়। প্রত্যকটা টিকিটের দাম ৪০ থেকে ৫০ ফ্রাংক!
এখানে পর্যটকরা সবাই সাধারণত খুব বড়লোক হয় একটা টিকিট পাঁচ হাজার ফ্রাংক হলেও এদের আসে যায় না! আমি অবশ্যই সে দলে পড়িনা। পেঁজা তুলোর মত বরফে কেডস পড়েই খানিকটা হাঁটাহাঁটি করলুম, বেশ মজা লাগল্ । কয়েক ঘন্টা সব দেখে টেখে এলুম সেই রেস্তোরাতে।
এখানে মানে এই রেস্তোরাতে সুইশ ফ্রাংক ছাড়াও ইয়েন ডলার পাউন্ড চলে। শত শত লোক খাচ্ছে কথা বলছে কিন্তু মেঝেটা ঝা তক তকে পরিষ্কার। ৫-৬ বছরের একটি জাপানী বাচ্চা চকলেট খাচ্ছিল, হঠাৎ তার হাত থেকে চকলেটের কাভার কাগজটা পড়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে তার মা'ই হবেন, মাটি থেকে কাগজটা কুড়িয়ে পাশেই ডাস্টবিনে রাখলেন। অন্যদিকে রেস্তোরা থেকে আরেকটি সাদা চামড়ার মেয়ে ছুটে আসছিল কাগজটা কুড়োবার জন্য। ভাল লাগল। আমাদের দেশের বাঙ্গালী কবে মানুষ হবে!
যাহোক আমরা খাবার দাবার খেয়ে আবার সেই ট্রেনে চড়েই সোজা নীচের স্টেশনে। ট্রেন কিন্তু একটা নয় অনবরত ট্রেন আসছে এক ঘন্টা পর পর। আপনার ট্রেন মিস করার কোন কারবার নেই!
সেখানে ট্রেন বদল করে লুজানের ট্রেন ধরে বাড়ি।
ক'দিন পর। প্ল্যান হলো যাবো পাশের দেশ ইতালী। রোমিও জুলিয়েটের শহর ভেরোনা বা খালের শহর ভেনিস, ঐতিহাসিক শহর পাদুয়া এসব দেখার ইচ্ছে।
টিকিট ফিকিট কেনা হল, যাবো আমি একাই। প্রথমে ইতালির শিল্প নগরী ভিসেনজা। আবার সেই সকালে একটা ব্যাগ কাধে করে লুজান স্টেশনে। সেখান থেকে পৃথিবীখ্যাত হাইস্পীড ট্রেনে করে ইতালী। টিভিজি ট্রেনটার ইন্জিনের গায়ে লেখা ছিল সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ৪৭৮ কিলোমিটার। আন্তর্জাতিক ট্রেন সুতরাং ওটা ঘন্টায় ঘন্টায় যায় না তবে দিনে তিন চার বার যায়। কিন্তু আপনি যেটার জন্য টিকিট কেটেছেন সেটাতেই যেতে হবে। এবারের টিকিটে আপনার সীট নম্বর আছে সময় দেয়া আছে। রিটার্ণ টিকিট।
হুড়োহুড়ি নেই, স্টেশনে শোরগোল নেই, অবশ্য কামড়াটাতে সীটের অর্ধেকই খালি দেখলুম। উঠে পড়লুম আমার কামড়াতে আর বসলুম আমার সীটে। পাশের চেয়ারটা খালিই থাকল সারা পথ্ । ভাল কথা গতি কিন্তু ঐ ৪৭৮ কিমি দেখিনি অনেক কম ছিল্ । পাসপোর্ট নিয়েছি, কারণ এক দেশ থেকে আরেক দেশ, সুইজারল্যান্ড থেকে ইতালী। একসময় সুইশ - ইতালী বর্ডার পড়ল কিন্তু কোন চেকার বা কাস্টমস ইমিগ্রেশন কিছুই চোখে পড়লনা্ একটা টানেল, ট্রেনটা টানেল পার হয়েই ইতালী। স্টেশনের নামের বানানগুলোর পরিবর্তন চোখে পড়ল্ এখন আর ফ্রেন্চ নেই ইতালীয়ান ভাষায় চলে গেছে।
বিখ্যাত শহর মিলানের স্টেশনে পৌছবার পর দেখি ট্রেনটা উল্টোদিতে যাচ্ছে। আমি ভাবলুম এখানে কি ট্রেন পাল্টাতে মিস করেছি নাকি কে জানে। সহযাত্রীটিকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলুম না ঘাবরাবার কিছু নেই। ঠিক পথেই যাচ্ছে ট্রেন। আমার গন্তব্যস্হল ভিসেন্জা, একটা শিল্পান্চল যেখানে আমার কনটাকট কাম গাইড ভাগ্নে আজাদ আর বিপ্লব থাকে। ওরাই আমার গাইড আর ইতালি বেড়াবার সব আয়োজনটা ওরাই সম্পন্ন করেছে। বেলা বেগারোটার দিকে পৌছলুম ভিসেন্জা। স্টেশনেই ভাগ্নেরা গাড়ী নিয়ে হাজির ছিল। না ওদের অপেক্ষা করতে হয় নি, ইউরোপে ট্রেন লেট হয়না! ওখানকার কর্মকর্তারা যথেস্ঠ নিস্ঠাবান।
পাদুয়া শহরের কিছু ছবি।
চলবে: