এক লোক দোকানে গিয়ে নাপিতকে বলছে , আচ্ছা তুই ছাগলের দাঁড়ি কামাতে পারিস ?
নাপিত বলল , আসেন চেষ্টা করে দেখি।
চেষ্টা করতে দোষ নাই ,তাই একটা রম্যের অপচেষ্টা ।
ছোট বেলায় সম্ভবত সুকুমার রায়ের এক ছড়া পড়েছিলাম , ‘’মেজাজ ছিল তিরিক্ষি তার , মাথায় ছিল চুলের বাহার।‘’ সাথে এই চুলের বাহার ওয়ালা লোকটির খড়ের গাঁদার মত বিশাল চুল সমেত মাথার একটা ছবি । জিনিষটা ছিল দেখার মত । বেটার চুলের ভিতর পাখিরা বাসা বেঁধে ছানাপোনা নিয়ে দিব্যি বসে আছে ।
এরকম এক লোক গেল চুল কাটাতে । নাপিত তাকে চেয়ারে বসিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চুলে বিলি কাটছে ,চুল কাটার নাম নাই । লোকটা অধৈর্য হয়ে খেঁকিয়ে উঠলো , আধা ঘনটা ধরে চুল নিয়ে টানাটানি করছিস বিষয় কি ? চুল কাটবি কখন ?
নাপিতও খ্যাপা – রাখেন আপনার চুল কাটা ! চুলের ভিতরে কাঁচি হারাই ফেলছি , খুইজ্জা পাইতাছিনা ।
কাঁচি হারালে কাঁচি পাওয়া যায় , আমার নানা বাড়ীতে যে নাপিত আসতো সে হারাতে বসেছিল এমন বস্তু যা হারালে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না ।
প্রতি শুক্রবার ছিল নানা বাড়িতে ‘ক্ষেরি’ দিবস । হরেন্দ্র নাপিত এসে সবার চুল দাঁড়ি কেটে দিয়ে যেতো । টাকা পয়সা দিতে হতনা । ধানের মৌসুমে এসে ধান নিয়ে যেতো ।
চুল কাটার বিষয়ে আমার বৈরাগ্য ছিল , কাটাতে চাইতাম না । যতটা ছিল বৈরাগ্য তার চেয়ে বেশি ছিল ভীতি । চুল কাটা শেষ হলে ফিনিশিং টাচ দেয়া হত ক্ষুর দিয়ে । এ জিনিষ আমার ঘাড়ে ছোঁয়ানোর সাথে সাথে আমার ভীষণ কাতুকুতু পেতো । একবার ঘাড়ের উপর ৯ যায়গায় ক্ষুরের পোঁচ লেগেছিল ।
এক শুক্রবার আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে হরেন্দ্রর দুই হাঁটুর মাঝে সোপর্দ করা হল । আমি নাকি বেশি নড়া চড়া করি তাই হাঁটু থেরাপি । বৃদ্ধ হলে কি হবে বেটার হাঁটু যেন শিল কাঠে তৈরি । দুদিক থেকে চেপে ধরেছে ,মাথা ঝিম ঝিম করছে, চোখে অন্ধকার দেখছি ।
আধা ঘণ্টা শেষে ফিনিশিং টাচ ! এই বার সে আমার ঘাড়ের উপর পা তুলে দিয়ে ঝাঁতি মেরে ধরেছে ।
সেকালে তসরের সুতা দিয়ে এক প্রকার জালির থলে বানানো হত । সেখানে টাকা ,খুচরা পয়সা রাখা হত । পয়সা খুচরা হলেও তখন তার ভ্যালু ছিল । ৫ পয়সায় একটা আস্ত বারো মিঠাই পাওয়া যেতো । এই থলিকে আমরা বলতাম ‘খইলতা’ । টাকা থাক বা না থাক খইলতা একটা সকলের কোমরের তাগির সাথে ঝুলে থাকতো । বয়স্করা কাপড়ের তৈরি খইলতা ব্যবহার করতো , একে ‘দোলবান’ও বলা হত ।
একটা চল তখনো ছিল এখনো আছে , চুল কাটা শেষ হলে নাপিত দুই হাতের তালু এক করে আঙ্গুলে আঙ্গুল লাগিয়ে ঠাশ ঠাশ করে মাথায় বাড়ি মারতো এতে বেশ আরামই লাগে ।
আমারও তখন ঠাশ ঠাশ কর্ম চলছে । এমন সময় ধুতির ফাঁক দিয়ে আমার আবচা নজর পড়লো বেটার ‘খইলতা’র উপর । ঠাশ ঠাশ এর সাথে তাল মিলিয়ে ওটাও বেশ দোল খাচ্ছে । মাল পানি ভালই আছে বলে মনে হল । মনে একটা দুষ্ট বুদ্ধি এল , এতক্ষন ব্যাটা হাঁটু দিয়ে ,কাঁধে পা তুলে আমার জান পেহচান করে ফেলেছে । এখন টান দিয়ে বেটার ‘খইলতা’ নিয়ে পালিয়ে যাবো ।
যেই ভাবা সেই কাজ , ‘খইলতা’ ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে দিলাম দৌড় ! ভাগ্য খারাপ ! শক্ত রশি দিয়ে ওটা বেঁধে রেখেছে, ছিঁড়তে পারিনি । পিছনে ফিরে দেখি ব্যাটা রাম রাম , ভগবান ভগবান বলে গড়া গড়ি দিচ্ছে আর চিৎকার করছে । সবাই দৌড়ে এল বিষয় কি ? বিষয় কি ?
হরেন্দ্র আর্ত চিৎকারের ফাঁকে ফাঁকে জানালো – ‘’চবুরার হোলায় আঁর ‘অন্তরকোষ’ টানি ছিঁড়ি ফালাইতো লাগছে গো --- ।‘’
বয়সে বড় মামাতো ভাই বলল - করছস কি ?
আমি বললাম , কি করছি ? আমি বেটার ‘দোলবান’ ধরে টান দিছি , ‘দোলবান’রে বুঝি ‘অন্তরকোষ’ কয় ?
মামাতো ভাই বলল – ‘বলদ ! তুই বেটার ‘অণ্ডকোষ’ ধরি টান দিছত!’’
আমার বুঝে আসছিল না ও বস্তু তার নিজের স্থান ছেড়ে বিঘত খানেক নিচে এসে ঝুলছিল কেন?
ঘটনা এখানেই শেষ হলে ভাল হত ।
আমার আম্মা ছিলেন কট্টর রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে । সেকালে হিন্দু ,মুসলমান একে অন্যকে অস্পৃশ্য মনে করতো ।
আম্মা ছিলেন আরো এক কাঠি সরেস, হিন্দুদের ধরা ছোঁয়া কিনা এই ভয়ে তিনি জীবনে বাজারের মিঠাই মণ্ডা খান নি । আমার মেঝ ভাই একবার উনার দুস্তিয়ালা গৌরাঙ্গকে আমাদের ঘরে খাইয়েছিলেন , আম্মা ঘরে ছিলেন না । পরে কোন প্লেটে খেয়েছে ভাবীরা এটা সনাক্ত করতে না পারায় উনি সব প্লেট ফেলে দিয়েছিলেন ।
সেই মায়ের পুত্র হয়ে আমি কিনা হরেন্দ্রর ‘ইয়ে’ ধরে বসে আছি । আমার আম্মা পারলে প্লেটের মত আমাকেও ফেলে দেয় অবস্থা । মাটিতে ঘষে ঘষে হাত ধুইয়ে আমার হাত ক্ষয় করে ফেলার জোগাড় । এর পরে ছাই , সব শেষে সোডার সাবান । মামী মামাতো বোনরা যেভাবে ছ্যা ছ্যা করছে , খেতে গিয়ে দেখি হাতের উপর আমার নিজেরই ঘেন্না লাগছে । চামচ দিয়ে কাজ সারালাম ।
আঘাত পেলাম সমবয়সী মামাতো বোনটির কথায় , সে ফরমান জারী করলো – সাবধান ! তোর ডান হাত যেন আমার গায়ে না লাগে ।‘
জামাই বউ খেলায় আমরা নিয়মিত দম্পতী , এমতাবস্থায় শুধু বাম হাতে পোষাবে ? যাক কি আর করা !
এমন সময় রিনা আরেক ফরমান পেশ করলো , আজ থেকে জামাই খলিল , তুই চাকর ! ফুট ফরমাশ খাটবি , বাজার করবি ।
পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই , ৬/৭ বছরের এই আমি তখনো মনে হয় পুরুষ হয়ে উঠিনি ; অন্য দিকে ফিরে চোখের জল মুছলাম ।
হরেন্দ্রর ''দোলবানের'' অভিশাপে ফুট ফরমাশ খাটা , বাজার করার চাকরীটা এখন আমার স্থায়ী , এমনই স্থায়ী যে এর কোন এল পি আর নাই , রিটায়ার নাই ।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৫:৪৭