১ /
খেতে বসেছি । প্রথমেই গিন্নি ডালের বাটি দিয়ে গেলেন !
ডাল কেমন জানি বিবর্ণ দেখাচ্ছে । চামুচ দিয়ে একটু মুখে দিয়ে ওয়াক করে উঠলাম ।
- চ্যা চ্যা চ্যা ! কি ডাল রেঁধেছ , এর চেয়ে মহসিন হলের ডালওতো আরো ভাল ছিল !
দৌড়ে এলেন গিন্নী ।
- ডাল কোথায় দেখলে ? এগুলো স্যুপ !
- স্যুপ ? ও ইয়ে ! তাইলে আমার ক্ষিদা নাই ।
- এতক্ষণ ক্ষিদা ক্ষিদা বলে বাসা মাথায় তুলছো , এখন বলছো ক্ষিদা নাই ? একটু খেয়ে দেখ , দারুণ হয়েছে । ছিদ্দিকার রেসিপি ।
- কোন ছিদ্দিক্কা ? ছিদ্দিক ভাই ?
- আরে নাহ ! ছিদ্দিকা আফা । ও তুমি চিনবেনা ।
২ /
একটু পিছনে যাই ---
সকালে বসে বসে খবরের কাগজ পড়ছি । গিন্নি তার বান্ধবীর সাথে ম্যারাথন আলাপ জুড়ে দিয়েছেন । এক পর্যায়ে কার জানি মৃত্যু সংবাদ চালাচালি হচ্ছে । কান খাড়া করলাম !
- আহারে ! চুমকির হাজব্যান্ড টা মারা গেল , কি যে খারাপ লাগছেরে ---
চুমকি আমার খালাতো শালী । অনার্স ফাইনালের সময় আমাদের বাসায় ছিল । মাস ছয়েক আগে বিয়ে হয়েছে । বরটা পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী , অমায়িক ভদ্রলোক । এমন তরতাজা মানুষটা মারা গেল আর আমি জানলাম না ! ভীষণ রাগে গিন্নীদের পরবর্তী আলাপ আমার আর কানে ঢুকেনি । আলাপ চারিতা শেষ হলে গিন্নীকে ডাকলাম ।
- চুমকির বর কবে মারা গেছে ?
- গত কাল ।
- এরকম একটা সংবাদ তুমি আমাকে দিলেনা ?
- তোমাকে দিয়ে কি হবে ? তুমি এসব বুঝ নাকি ?
- দেখ কাজে কর্মে বিজি থাকি তাই হয়তো শ্বশুর কুলের আত্মীয় স্বজনের খোঁজ খবর তেমন রাখতে পারিনা । কিন্তু চুমকিতো আমাদের পরিবারের সদস্যের মত ! তার বরের মরার সংবাদ আমি পাবো না , এটা কেমন কথা ?
গিন্নী খিল খিল করে হেসে উঠলেন , আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে ।
- আরে পাগল এই চুমকি সেই চুমকি নয় ! এ চুমকি ''বুঝে সে সব বুঝে'' সিরিয়ালের চুমকি ! ( হাসির বাকি অংশ--)
ছোট্ট বেলায় বাবা নিয়মিত ইত্তেফাক পত্রিকা পড়তেন । সেখানে টারজান নামে এক কার্টুন সিরিয়াল দেখতাম ।
ওই টারজান দেখি ইত্তেফাকে এখনো চলছে ।
ভারতীয় চ্যানেল গুলিতেও এ জাতীয় কিছু সিরিয়াল চলে । আগা, মাথা লতা, পাতা ছড়িয়ে সিরিয়ালের এমন অবস্থা হয়েছে , কিভাবে এর সমাপ্তি টানা যায় তা এর নির্মাতারা জানে না । তাই চালিয়েই যাচ্ছে ! যেন ব্রেকহীন রেলগাড়ী ।
অনেকটা ''চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া , চলতে আছে জনম ভরে '' টাইফ !
গিন্নী এরকম সব সিরিয়ালের ডাইহার্ট ফ্যান । সেরকম কোন সিরিয়ালের কে মারা গেছে , এটাও তাদের আলোচনার অংশ ! আর আমি কিনা তাকে বাস্তব জীবনের সাথে গুলিয়ে ফেলছি !
ইদারনিং দেখি তিনি চ্যানেল বাদ দিয়ে বই পাঠে মনোযোগ দিয়েছে । এত দিনে সুমতি হয়েছে , সিরিয়ালের চেয়ে বই পড়া লক্ষ গুণ ভাল ! আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি ।
নানা পুষ্টির প্রলোভন আর অনুরোধ উপরোধে মাড় জাতীয় ও তরল গলা দিয়ে নামাতে বাধ্য হলাম ।
মানুষ অনুরোধে ঢেঁকী গিলে , পিতা পুত্র কন্যা গিললাম 'রাইচমিল' । স্যুপ !
ফলাফল নোস্পা , ওমিডন , ওমিপ্রাজল , ফ্লাজিল আরও কি কি মিলিয়ে জন প্রতি ৩১৬ টাকার ঐষধ !
৩ /
আরেক দিন টেবিলে কাউডাং সদৃশ্য এক বস্তু । জিজ্ঞাসিলাম এগুলা কি ?
জানালেন কচুপাতার পাতুরি ; ইন্ডিয়ান রেসিপি ।
ইন্ডিয়ান এক মুভি দেখেছিলাম , 'বিধিলিপি' না কি যেন নাম। সেখানে ইলিশের মাথা দিয়ে কচু শাক রান্না করে, বউ ; শশুর শাশুড়িকে না দিয়ে তা একা খাওয়ার পাঁয়তারা করছে । এই নিয়ে বিরাট গৃহ যুদ্ধ , যেন ওটা কচু শাক না হয়ে অমৃত ছিল ।
আর আমাদের বাড়ীতে ইলিশের মাথাটা কাঁটার ভয়ে কেউ খায় না । ওটা সচরাচর কুকুর বেড়ালের পেটে যায় । এই নিয়ে গিন্নী অনেক হাসাহাসি করেছিলেন ।
সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে কিছু কথা বললাম ।
আরো বললাম , তুমি ভাল করেই জান ,কচু শাকে ''ঝগড়াটে মহিলাদের স্বামীর গলা ধরে'' , সেই সুত্রে আমারও ।
গিন্নি কটমট করে আমার দিকে তাকালেন - ''ঝগড়াটে মহিলাদের স্বামীর''? দেখ এখন আমার ঝগড়া করার মুড় নাই । গলা ধরবেনা , সোডিয়াম কার্বনেট দিয়েছি । ও বইতে লিখেছে কচু ,লতি, কচুশাকে সোডিয়াম কার্বনেট দিলে গলা ধরেনা ।
এতক্ষণে বই পড়ার মাজেজা আমার কাছে পরিস্কার হল । ওটা ছিল অধ্যাপিকা সিদ্দিকা কবিরের 'উপমহাদেশের হাজার রান্না' বা এ জাতীয় কোন রেসিপির বই । যাকে সিরিয়াল দেখার চেয়ে হাজারগুণ ভাল বলে ভ্রম করেছি ।
পাতুরি না চচ্চড়ি পুত্রের দিকে এক চামুচ এগুতেই পুত্র বিদ্রোহ করে বসলো -
- দেখ ! এসব গোবর খাবর যদি আমার প্লেটে দাও , প্লেট শুদ্ধ উড়াল মেরে ফেলে দেব ।
মেয়ে লেইজারে বাসায় এসেছে , বলল ওইসব আমাকে দিতে চাইলে না খেয়ে চলে যাবো ।
মা হলে আমিও বিদ্রোহ করতাম ।
গৃহশান্তি ভঙ্গের আশংকায় এক চামুচ মুখে দিলাম ।
সাথে সাথে মুখ দিয়ে স্বগতোক্তির মত রবি বাবুর একটা গান বেরিয়ে এল - ''আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান--'' ।
আমার ধারণা ঠাকুর সাহেব মৃণালিনী দেবীর রান্না করা কচু শাক খেয়ে এই গান লিখেছিলেন ।
গিন্নি বললেন - বিড়বিড় করে কি বলছো ? খেতে কেমন লাগছে ?
বললাম - গোবরের মত ।
গিন্নি ঝামটা দিয়ে উঠলেন - ওসব খাওয়ারও অভিজ্ঞতা আছে দেখছি !
৪ /
খেয়ে উঠলাম । পেটের অবস্থা সুবিধার মনে হচ্ছেনা ।
গায়ে শার্ট জড়াচ্ছি দেখে গিন্নি জানতে চাইলেন , কোথায় যাই ।
বললাম -সৈয়দ বাড়ীর মোস্তফা আলীর কথার ঠিক নাই ।
- সে এখনো তোমার টাকা দেয়নি ?
- সে মোস্তফা নয় , লিখক মোস্তফা । লিখতে শিখে মোস্তফা আলী থেকে হয়ে গেছেন মুজতবা আলী ।
- তিনি তোমার কি করলেন ?
- তিনি বলেছিলেন 'বই পড়ে কেউ দেউলিয়া হয়না। ''
তোমার বই পড়ার কারণে আমি ঐষধ কিনতে কিনতে দেউলিয়া হতে বসেছি!
এখন ডিসপেনসারিতে যাচ্ছি ।
৫ /
বেশ কিছু দিন থেকে গিন্নি একটা ওভেন কিনে দিতে বলছেন । আজ কিনে দিলাম ।
তবে শর্ত প্রযোজ্যঃ - আমাকে স্যাম্পল প্রোডাক্ট খেতে বাধ্য করা যাবেনা ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:৫০