রাত দশটা হবে । পাঠ্য বইয়ের ভিতরে ঢুকিয়ে , রোমেনা আফাজের দস্যু বহুর পড়ছি । একটু আগে আব্বা ঘরে ফিরেছেন ।
আমার পড়ার রুমে এসে মিহি স্বরে বললেন , আব্বা একটু এদিকে আসেন ।
আমি আতঙ্কিত । আব্বার তুই তোকারি ছেড়ে আপনিতে নেমে যাওয়া অতি ভয়াবহ ব্যাপার । অতিত অভিজ্ঞতায় দেখেছি শাস্তির মাত্রা যত তীব্র হবে আব্বার সাম্ভোধোনিক আচার ব্যবহার আর ভোকাল কর্ডের আউট ফুট হবে তত অমায়িক ।
বুঝতে পারলাম তিন বিষয়ে ফেল করার বিষয়টি আব্বার নলেজে চলে এসেছে ।
এটা প্রভাত স্যারের কাজ ।
কিছু মানুষ আছে একজনের গোপন কথা আরেকজনের কাছে নিষ্ঠার সাথে চালাচালি করে । কথিত আছে এদের ''পেটে তিতা পাতাও হজম হয় না ।''
তিতা পাতা অনেক দূর ,আমার ধারণা প্রভাত স্যারের পেটে হজমীর ট্যাবলেটও হজম হয়না ।
ফেল বিষয়ে আজ স্কুলেও ধোলাই খেয়েছি ।
তিন বিষয়ে ফেল এটা যত গুরুতর ছিল , তার চেয়েও গুরুতর রূপে দেখা দিয়েছিল একটা ট্র্যান্সলেশন ।
গত পরীক্ষায় ''আমরা চা পান করি'' এর অনুবাদ লিখেছিলাম We drink tea. এটা নাকি শুদ্ধ হয়নি । শুদ্ধ We take tea.
পান করা ইংরেজি আজীবন শুনলাম ড্রিংক, এখন সেটা টেক হয় কেমনে ?
ট্র্যান্সলেশনটায় প্রভাত স্যার এমন ভাবে লাল কলমে ক্রস দিয়েছিলেন যে , কলমের খোঁচায় পরীক্ষার খাতার দুইটা পাতাই চিরে গেছিল ।
এবারে একটা পেসেজ ছিল , যার একটি বাক্য ''বৃষ্টি পড়ে'' ।
''বৃষ্টি পড়ে''র ট্র্যান্সলেট করেছিলাম ,''Bristi is reading." তেনার পছন্দ হয়নি ।
পছন্দ হয়নি ভাল কথা আগের মত কেটে দিতি , এবার নাহয় পাতা তিনটা যাইতো !
তা না তেনারা তদন্ত শুরু করে দিয়েছেন ।
বৃষ্টির ইংরেজি Rain না এসে তোর মাথায় person বৃষ্টি বেগম কেন এল ?
তুই নাকি বিকালে বৃষ্টিদের বাড়ির সামনে ঘুর ঘুর করিস ?
ইটের আধলা দিয়ে স্কুলের সারা দেয়ালে L+B কে লিখেছে ?
আরে বাবা করসতো পণ্ডিতি ,তোর এত গোয়েন্দাগিরির দরকার কি ?
গোয়েন্দাগিরির শখ হলে কেজিবি সিআই'এ যা !
সেটা না , তেনারা খেজুরের ডাণ্ডা নিয়া দৌড়াদৌড়ি করে । যত্ত সব----!
আব্বা আমাকে ডেকে সামনের রুমে চলে গেছেন । অতিতে আমার বড় ভাইয়েরা আব্বার ডাক উপেক্ষা করেছেন এমন নজীর নাই । আমিও উনাদের পদাংক অনুসরণ করে সামনের রুমে এসে দাঁড়ালাম ।
- স্কুলে যান নি গো আব্বা ?
- জী যাই ।
- উমেশ বাবুর অসুখ শুনলাম , আজ স্কুলে এসেছেন ?
কথার ঘূর্ণি শুরু হয়েছে , এখান থেকে শুরু হবে ঘূর্ণিঝড় । ঘূর্ণিঝড় কোন দিকে মোড় নিবে , এই রুমে দাদীর লাঠির উপস্থিতি দেখে অনুমান করা যায় ।
মনে মনে , ''আপনার খাজুরিয়া আলাপের গুল্লি মারি'' বলেই , দিলাম দৌড় ।
হাফাতে হাফাতে পূর্ব বাড়ির পুকুর পাড়ে এসে থিতু হলাম ।
কিছুক্ষন পর একটা শিয়াল এসে আমাকে রেকি করে গেল । একটু পরে তিনটা ।
কিছুদিন আগে আমাদের এলাকার একজন শিয়ালের সম্মিলিত আক্রমণের শিকার হয়েছিল ।
কিন্তু এরা আমাকে কিছু না বলে চলে গেল কেন বুঝে আসছেনা ।
পাশের জঙ্গলে তাদের কাঁই কুঁই শুনছি । সম্ভবত তারা জরুরি মিটিং কল করেছে ,আজকের এজেনডা - ''এই মিয়ারে ধরাশায়ী করতে কি রূপ শিয়াবল দরকার'' ( শিয়াবল = জনবলের শিয়ালিয় রূপ)।
এরকম ভাবনা মনে উদয় হওয়ায় আবার দৌড় ।
এবার উত্তর বাড়ির খালি গোয়াল ঘর ।
ঘন ঘন হাপাচ্ছি , সামনে দেখি আবারও একটা শেয়াল । আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে ।
ভাব খানা এমন , '' কাগা এইখানে ? আপনেরে পুরা গেরাম বিছড়াইতেছি ।''
শেয়ালটা স্বজাতিদের খবর দিতে গেলে হুলিয়া আসামীর মত আবার স্থান পরিবর্তন করলাম ।
এবার ছনখোলা বন । দিনেও যেখানে অন্ধকার । সচরাচর এখানে কেউ আসেনা দেখে পাড়ার কিছু দুষ্টলোক এখানে তাশ খেলে । এদের অনুপস্থিতিতে কেউ কেউ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ডাকে সাড়াও দেয় , তাই চার দিক থেকে মনুষ্য বিষ্ঠার তিব্র গন্ধ আসছে ।
তাশাড়ূরা এখানে বেশ আরামদায়ক একটা খড়ের বিছানা পেতে রেখেছে । বিছানায় বসলাম ।
রাত প্রায় আড়াইটা হবে , সম্ভবত মশাদের ডিনার টাইম । সবাই একযোগে হামলে পড়েছে । এত মশা দেখে আমার ধারণা তারা পাশের পাড়া থেকেও দাওয়াত দিয়ে মশা এনেছে ।
হয়তো মাইকিংও করেছে ,'' ভাই সব , ভাই সব ছনখোলা বনে এক বিশাল কাঙালি ভোজের আয়োজন করা হইয়াছে , ভাই সব--''
ঘুমে চোখ ঢুলু , মনে হয় ঘুমিয়েও পড়েছিলাম ।
কারা যেন সুরে সুরে কথা বলছে ।
''পালাবি কোথা মা কালী
আরতো তুই পালাতে পারলিনারে
আমি তোর গায়ের গন্ধ পাইয়াই তোরে
ছিইনা ফালাইছিরে খ্যাঙরা ! ''
এর পরই চীৎকার !! পাইছিরে ! পাইছি !!! খ্যাঙরারে পাইছিরে-------
চোখ মেলে যা দেখলাম ,এর জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না । সামনে দাঁড়ানো এক বিকট দর্শন কঙ্কাল ! চোখ থেকে সার্চ লাইটের মত আলো বেরুচ্ছে । অদুরে দেখি আরও একটা কঙ্কাল এদিকে আসছে , তার আবার একটা চোখ নাই ।
দুজন সামনে এসে আমাকে বলল , উঠ দোস্ত উঠ , এটা বিরাট অকল্যাণ , এভাবে কেউ পালিয়ে আসে ?
আমি বললাম , দোস্ত ? আপনারা কারা ? আপনারাতো মনে হয় ভূত ! আমি মানুষ , মানুষ ভূতের দোস্ত হয় কীভাবে ?
তুই মানুষ ? বলেই দুজন বিশ্রী ভাবে হেসে উঠলো , বলল এসব ঢং করিস না দোস্ত , আজ শ্যাওড়া গাছের পেত্নীর লগে তোর বিয়ে ।
আর তুই কিনা ''গায়ে গু'' অনুষ্ঠান থেকে পালিয়ে এলি ?
আতঙ্কিত আমি জানতে চাইলাম , ''গায়ে গু'' কি ?
একজন বলল , ফাজলামি করিস না , আচ্ছা যা , তুই যখন বলছিস তুই মানুষ তাহলে শোন , মানুষদের যেমন গায়ে হলুদ , আমাদের তেমনি ''গায়ে গু'' ।
এবার উঠ বলে এক চোখা খেঁকীয়ে উঠলো ।
উঠ কইলাম , নইলে গায়ে হাত দিমু , লাত্থিও দিবার পারি ।
একবার বৃষ্টিকে বিয়ে করবো বলেছিলাম । জবাবে সে বলেছিল ,তুই তো একটা ভুত ,তোকে কে বিয়ে করবে ?
বলেছিলাম , আমাকে তুই পেত্নী বিয়ে করবি ।
আমার চেহারা একটু খারাপ , তাই বলে ভূতেরা আমাকে একেবারে তাদের দোস্ত খ্যাঙরা ভেবে বসে আছে ?
এখন দেখছি সত্যি সত্যিই পেত্নীকে বিয়ে করতে হবে !
তারা রেগে যাচ্ছে , চোখ থেকে বেরুনো আলো তীব্র হয়ে আমার চোখের উপর পড়ছে ।
শেষ চেষ্টা হিসাবে কেঁদে উঠলাম , ভাই আমাকে মাফ করেন ভুত ভাই ও ভূত ভাই , আপনাদের পায়ে পড়ি আমি বিয়ে করবোনা ।
জলদি উঠ বলে আবার ধমক !
অগত্যা উঠে দাঁড়ালাম , তীব্র আলোয় চোখ জ্বালা করছে । আলোর উৎসর দিকে তাকিয়ে দেখি , সেটা একটা টর্চ , ধরে আছেন আব্বা ।
পাশে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে আমাদের কাজের ছেলে হামজা মিয়া ।
( পুনশ্চ ; গল্পের ''আমি'' , আর লিখক এক ব্যাক্তি নন ।)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০৯