- ভাই জান,এই ভাই জান তাড়াতাড়ি উঠেন ।
সুনীলের পূর্ব পশ্চিম পড়ে রাতের একটায় শুয়েছি । সবে ঘুমটা ঝাঁকিয়ে বসেছে এমন সময় বিরক্তিকর ডাকাডাকিতে আমার ঘুমের বারোটা বেজে গেল ।
বিরক্ত হয়ে বললাম - কি হইছে ?
- হঠাৎ পেটে মোচড় দিয়ে উঠেছে ।
- হঠাৎ কেমনে হইল ? গতকালওতো আপনার এমনটি ঘটেছে ।
- গতকাল নয় পরশু ।
- ওই হইলো !
- ভাই ,ভাই , ভাই সময় নষ্ট কইরেন না --
অনিচ্ছা সত্ত্বেও পায়ে স্যান্ডেল ঢুকাতে ঢুকাতে বললাম - চল ! আইজকা তোরে খাইছি !
এ কথাটা অবশ্য মনে মনে বলেছি । হাজার হোক তালেবে এলেম মানুষ ।
আমাদের বাড়ীর দরজায় ছিল বিশাল এক কাছারি ঘর । এর দুপাশে দুই কামরা আর মাঝের বিরাট অংশ ফাঁকা , সামনে সিংহ দরজা ।
সবে ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছি , বিরাট বড় হয়ে গেছি , মনে এরকম একটা ভাব ।
নাটক ,পালা গান , যাত্রা দেখা জাতীয় পরিপূর্ণ স্বাধীনতা উপভোগ করতে ঘর ছেড়ে কাছারি ঘরের উত্তরের কামরায় আসন পেতেছি । এজন্য অবশ্য আম্মাকে - আমি যে বিরাট বিদ্যাসাগর , ঘরে আমার পড়া লিখার বিরাট সমস্যা ইত্যাদি বলে অনেক ভুজং ভাজং দিতে হয়েছে ।
দক্ষিনের অংশে থাকতেন একজন হুজুর আর মাষ্টার , দুজনেই জায়গীরদার (লজিং) ।
পেটের পিড়াটা হুজুরের সাথে বিরাট দোস্তিয়ালী করে বসে আছে । সেই সুত্রে ''ল্যাট্রিন''এর সাথে হুজুরের বন্ধুত্বটাও স্থায়ী রূপ নিয়েছে ।
''ল্যাট্রিন'' জিনিষটা বন্ধু হিসেবে তেমন সুবিধার না , তার কোন সময় জ্ঞ্যান নেই । রাত দুটা তিনটায়ও হুজুরকে ডেকে বসে । সাড়া না দিয়ে হুজুরের কোন উপায় থাকে না ।
হুজুরটা ছিল আবার ভীতুর একশেষ । দিনে দুপুরেও সে ভূতের ভয় পেত ।
পূর্বে মাস্টারকে সাথে নিয়ে তিনি বন্ধুর সাথে মোলাকাত করে আসতেন ।
একদিন ''কাচা ঘুম'' ভাঙানোয় ঘুমের ঘোরে মাষ্টার হুজুরের তলপেটে ক্যোঁৎ করে এক লাথি দিয়ে বসলেন । ব্যাস ! কম্ম সারা ।
রুমটা ধোয়া মোছা করতে হুজুরের ঘণ্টা দুই সময় লেগেছিল এই যা !
তবে ধোয়া মোছার কাজটা হুজুরের খুব একটা মনপুত হয়নি , তাছাড়া লাথির ব্যাথা সারাতে হুজুরকে সপ্তাহ খানেক ওষুধ খেতে হয়েছিল ।
তাই তিনি মাষ্টারকে ডেকে আর রিস্ক নিতে চান না ।
আমার রুমের দরজায় ধাক্কা ধাক্কি করে আমাকে ডেকে তুলেন । বিরক্ত হলেও আম্মার ভয়ে কিছু বলতে পারিনা ।
অগত্যা সামনে বদনা হাতে হুজুর , পেছনে আমি । গন্তব্য ছনখোলা বনের খোলা ল্যাট্রিন ।
আষাঢ় মাস ,চারদিকে পানিতে থৈ থৈ । ব্যাঙের ডাক ,পানিতে মাছের লাফ ঝাপ , নানা পতঙ্গের ডাক আর কবরের অন্ধকার মিলিয়ে এক ভয় ধরানো পরিবেশ । এর ভিতরে আবার সামনে দিয়ে চলে গেল তিনটি শেয়াল ।
হুজুরের মাশুকের কাছাকাছি এসে আমি বললাম , যান ; আমি এখানে আছি ।
হুজুর কি সব বিড়বিড় করে বুকে ফুঁ দেন আর আগে বাড়েন ।
তিনি জানেন আমি ভুত প্রেতে ভয় পাইনা ।
তাই আমার সাহসে বলিয়ান হয়ে হুজুর মনের সুখে কাম সারা করছেন , মাঝে মাঝে গলা খাঁকারি দিয়ে উনি যে এখনো কন্দ কাটার খপ্পরে পড়েন নি তা জানান দিচ্ছেন ।
আমিও প্রত্যুত্তর দিচ্ছিলাম ।
হুজুরের এরকমই এক গলা খাঁকারির প্রত্যুত্তরে আমিও গলা খাঁকারি দিয়ে অন্ধকারে কাছারি ঘরের উদ্দ্যেশ্যে দিলাম ভোঁ দৌড় ।
সোজা নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম ।
কিছুক্ষন পর হাঁপাতে হাঁপাতে হুজুর এসে আমার দরজায় ধাক্কা ধাক্কি শুরু করে দিলেন ।
কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় মহা বিরক্ত এরকম একটা ভাব নিয়ে আমি দরজা খুললাম ।
হুজুর পারলে কেঁদে দেয় এরকম হয়ে আমাকে বলল - ভাই জান এইটা আপনি কি কাম করলেন ? আমাকে ভূতের দুর্গম আস্তানায় একা ফেলে আপনি চলে এলেন ? আমি খালাম্মার কাছে বিচার দিমু । এর একটা বিহিত না হলে আমি আপনাদের বাড়ীতে থাকুম না , সকালেই আসসালামুয়ালাইকুম ।
সর্বনাশ ! ওলামা মাদ্রাসার মুহাদ্দিস সাহেবকে (আমার আম্মার ভাই) অনেক বলে কয়ে আমার আম্মা এই হুজুরকে জায়গীর এনেছেন ।
সে চলে গেলে আম্মা মনে কষ্ট পাবেন , আর চলে যাওয়ার পিছনে আমার হাত আছে এরকম প্রমান হলে আমারও রক্ষা নাই ।
বললাম - আপনি কি বলছেন আমি কিছুই বুঝতেছিনা । আবার বলেন ।
হুজুর আবার বললেন - আপনাকে নিয়া আমি ল্যাট্রিনে গেলাম , আর আপনি এই রাতের দুটায় আমাকে সেখানে একা ফেলে চলে এসেছেন ?
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম ! আমাকে নিয়ে আপনি ল্যাট্রিনে গিয়েছেন ? কখন ? এসব কি বলছেন আপনি ? আমিতো এর কিছুই জানিনা !!
হুজুর চোখ বড় বড় করে বললেন - কি বলেন ? ওটা আপনি ছিলেন না ?
- আরে না ! আমিতো আজ নয়টায়ই শুয়ে পড়েছি , এই এখন আপনার ডাকে আমার ঘুম ভাঙল ।
- লা হাওলা অলা কুউয়াতা ------ লা হাওলা অলা কুউয়াতা ------ হুজুর বিড়বিড় করে পড়তে লাগলেন ।
বললাম আপনি ভাল করে খেয়াল করেছেন তো ? ওটার ছায়া ছিল ? কথা কি নাঁকি নাঁকি বলছিল ? পা কি উলটা দিকে ? গায়ে কি মাছের গন্ধ ছিল ----- আমি বলেই যাচ্ছি ।
হুজুরের প্রতিক্রিয়া কি বুঝতে উনার দিকে তাকালাম । দেখি হুজুর ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করতে করতে ধপাশ করে মাটিতে পড়ে নাকে মুখে ফেনা ছেড়ে দিয়েছেন ।
পুনশ্চ ঃ এর পরে ''কসম'' আমি ভূত দেখেছি বলে ডাল পালা বিস্তৃত করে হুজুর এই কাহিনীটি বহুস্থানে বিবৃত করেছেন ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৪১