১ / ব্রহ্মদত্যি
ছোট বেলায় দেখেছি , জীন , ভুত , দেও ,পরীর খারাপ দৃষ্টি কাটান দিতে ''ভোগ'' দেয়া হতো ।
তিন রাস্তার সম্মিলিত স্থান বা তিন আইলের মিলিত স্থানে ''মুহাইঞ্জিন্না'' ( সূর্যাস্তের পর পর ) টাইমে , অশরীরী আত্মার সন্তুষ্টি কল্পে কিছু খাদ্য বস্তু রেখে দেয়া হতো । আমাদের ছনখোলা বনের ভিতর তিন আইলের মাঝে সারা গাঁয়ের মানুষ ''ভোগ'' দিয়ে যেতো ।
''ভোগ'' এর আইটেম গুলো খারাপ ছিল না । কয়েক টুকরা মাছ ভাজা , আতপ চাল আর গোটা চারেক সেদ্ধ ডিম ।
সকালে এসে যদি দেখা যেতো খাবার গুলো নাই , তাহলে ধরে নেয়া হতো অশরীরীর এসে ''ভোগ'' খেয়ে গেছে ।
এই ''অশরীরীর'' কম্মটা প্রায়শ আমি আর আমার ল্যাংটা কালের দোস্ত সেলিম কে করতে হতো ।
গ্রামের মানুষ খুশি , তাদের বাচ্চার উপর থেকে অশরীরীর বদ নজর কাটা যাচ্ছে । সাথে তারা আরও একটা বিষয়ে ধারণা পেলো ,
''এই ব্রহ্মদত্যির আতপ চাল আর টাকি মাছ ভাজায় রুচি নাই '' সুতরাং ঐ দু বস্তু বাদ দিয়ে ডিমের পরিমান বাড়ানো হলো ।
রমজান মাসে ইমাম সাহেবদের মত , এক অমাবস্যার রাতেতো শিডিউল দিতেই হিমশিম খাচ্ছিলাম ।
চার বাড়ী থেকে নাজরানা এসেছে । গোটা বিশেক ডিম ।
আটটা খেয়েই বমি করার জোগাড় । খোসা ছাড়ানো না হলে রেখে দিয়ে সকালের ব্রেকফাস্টটাও সারানো যেতো ।
কি করি ? কি করি ?
মাথায় উপায় একটা এসে গেলো । কমার্শিয়াল । উদ্রিত্ব পন্যের সফল বানিজ্যিকিকরন ।
জনটু , গবি , রিনটুকে অফার করা হোল , হালি আট আনা হিসাবে দাম দস্তুরও করা হল । তবে বাকিতে ।
হোক বাকি , আপাতত মাল টা গছাতে পারলেই আমরা বাঁচি ।
এই বাকিটা যে জনম বাকি হবে তখন বুঝতে পারিনি ।
২/ থানকুনি
শীতের শেষ । আমাদের উত্তরের পুকুরে মাছে কিলবিল করছে । বেশির ভাগ শিং মাছ । দুতিন দিন ধরে মাছ ধরা হচ্ছে ।
শিং মাছের ঘাই খেয়ে অনেকেরই নাকানি চোবানি অবস্থা ।
একটা কথা উল্যেখ করা দরকার । সেকালে মাছ ধরার কিছু আদব কেতা ছিল ।
তারই অংশ হিসাবে , পুকুরে অবস্থান কালিন শিং মাছের নাম ধরা নিষিদ্ধ ছিল । নাম নিলে তিনার ঘাই খাওয়ার সম্ভাবনা বহুগুন বৃদ্ধি পেত ।
তাই কেউ ঝুঁকি নিতে চাইতেন না । সকলে ডাকতেন ''মায়ু'' (মামা) ।
তার পরও কেউ মামার রোষানলে পড়লে , কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল - পুকুর থেকে উঠে একটু আড়ালে গিয়ে আক্রান্ত স্থানে ''পিশাব'' করে দেয়া । এতে বেশ আরাম পাওয়া যেতো । ( সম্ভবত গরম প্রস্রবনের কারনে এমনটি হতো )
এর একটা অসুবিধাও ছিল , মিনিটে মিনিটে মামার ক্রুদ্ধ আচরণ , সে তুলনায় ''দাওয়াইর'' স্টক ছিল সীমিত । সবাই ঝুঁকির মধ্যে থাকায় , কেউ কাউকে ও বস্তু ধার কর্জও দিতে চাইতেন না ।
এ অবস্থায় সেলিম এক ধন্বন্তরি প্রতিরোধ উপায় সন্ধান পেলো ।
আদুনি (থানকুনি) পাতা লুঙ্গীর হাঁইর (কোঁচড়ে) ভিতর ঢুকিয়ে রাখলে , শিং মাছের জারিজুরি ফেল । অনেক সন্ধান করে চরনারায়ন থেকে দুজন গিয়ে জিনিষটা সংগ্রহ করলাম ।
মাছ ধরা পর্বের শুরু হতে প্রায় আধা ঘনটা বাকি । আমি আর সেলিম জনপ্রতি প্রায় ১০০ গ্রাম করে থানকুনি পাতা হাঁইর (কোঁচড়ে) ভিতর গুজে বেশ ভাব নিয়ে ঘুরছি । ( সেলিম আমার চোখে ধুলি দিয়ে ভাগে একটু বেশি নিয়েছিল ,তার প্রায়শ্চিত্যও তাকে করতে হয়েছে )
ভাব নেয়ার বিষয়টা সেলিমের নানা ওয়ালী আহাম্মদ মিয়ার নজর এড়ালো না ।( ইনি সেলিমের মায়ের চাচা, আমার জেঠাতো ভাই) তিনি আমাদের দিকে কেমন যেন চিকন চোখে তাকালেন ।
তিনি ছুটে গেলেন আমার আম্মার কাছে ,'' চাচী আম্মা , আমনের হুতে বিড়ি খায় , তার হাঁইর ভিতর আবুল বিড়ির পুরা বান , আমি নিজে দেখেছি ।''
আমার আম্মা অতিশয় সরল মহিলা , বললেন , আমনে হেতারে চোবান্নো কিল্লায় ? ( চড় মারেন নাই কেন ?)
চড় মারা কর্মে ওয়ালী আহাম্মদ মিয়ার উৎসাহ অসীম । হাত যশও ঈর্ষনীয় । পূর্বে তিন জনের ''মুতে'' দেয়ার ইতিহাস আছে ।
এত দিন অভিভাবকদের বিনা অনুমতিতে চড় মারার চর্চা চালিয়েছেন । আজ অনুমতি পেয়ে উনার চোখ চকচক করছে ।
ভাব খানা এমন - আগে তিন জনরে মুতাইছি , আইজকা আর মুতানিতে পোষাইবো না , আজকের মিশন ''হাগু'' । ( অরুচিকর শব্দ চয়নের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি )
উনাকে বেশি খুঁজাখুঁজির ঝামেলায় জেতে হয়নি , একটু এগিয়েই তিনি আরেক মজুতদারের সন্ধান পেয়ে গেলেন ।
- '' সেলিমা , এদিকে আয় । বাব্বা ! তোর হাঁইতো দেখতেছি লিটইন্নার হাইর থেকেও বেশি ফুলা , ম্যাচ ও আছে মনে হয় । ( ইনি কাউকে ভালো নামে ডাকতেন না , আরও উল্যেখ্য যে , সেলিমের কোঁচড়ে মালের পরিমান ছিল ১৫০ গ্রামের মত)
উনি কি বললেন, সেলিম তা বুঝার চেষ্টা করছে , এমত সময়ে -
''ঠা'''''''''''শ '' ।
উঠানে পড়ে সেলিমের তিন চার গড়াগড়ি ।
কোথাকার লুঙ্গী কোথায় , আদুনিতো আরো দূর ।
না , কাঙ্ক্ষিত পারফরমেন্স উনি দেখাতে পারেন নি , তবে এই প্রথম কাউকে চড় মেরে আনন্দিত হওয়ার চেয়ে তাঁকে লজ্জিত হতে দেখলাম ।
কাহিনী এখানেই শেষ ।
উৎসুক পাঠক জানতে চাইবেন , মাছ ধরার কি হল ?
তাদের জ্ঞাতার্থে - মাছ ধরা যথারীতি চলেছে । সেলিমে খাইছে তিন ঘাই , আমি পাঁচ । এটা আমাদের জীবনের সর্বচ্ছো স্কোরও ।
বোনাস হিসেবে সেলিমের ঠ্যাং জড়িয়ে ধরেছিল ''ঢোরা'' সাপে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১৫ বিকাল ৫:৫২